রাজদীপ ভট্টাচার্য


 


একটি ভ্রমণকাব্য

আপার টুরুকে লেখা কুয়াশাগুচ্ছ






সুন্দরের কাছে এলে মৃত্যুর কথা মনে পড়ে। হারিয়ে ফেলার ভয় উঁকি মারে চুপিচুপি। গতকাল দুপুরে আপার টুরুকে এসেছি। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিঙের বাসে কার্শিয়ং, টুং, মার্গারেটস্ হোপ পেরিয়ে দিলারামে নামা। সেখান থেকে লোকাল গাড়ি বুক করে আট নয় কিলোমিটার ভিতরে মহালধিরাম টপের সামান্য আগে এই ছোট্ট বসতি। পথে ঘন গভীর শতাব্দী প্রাচীন পাইনবন। তার গায়ে জমে আছে অন্ধকার, অচেনা অর্কিড। আমাদের ড্রাইভার ভাইটি বলছিল এইসব পাইনগাছ মেঘ ডেকে আনে। সারাবছর একটা অদ্ভুত ভিজে ভাব আটকে থাকে। পুঞ্জ পুঞ্জ কুয়াশা। হোম স্টে'র ঠিক বিপরীতে একটা বৌদ্ধ গুম্ফা। মাঝে মাঝে সেখান থেকে ভেসে আসছে আধফোটা ঘন্টাধ্বনি। পাশের রাস্তা দিয়ে একটি দুটি গাড়ি যাওয়ার শব্দ। আর সারাক্ষণ নির্জনতা চিরে আমাদের হোম স্টে'র কাচের জানলা বেয়ে দূরের মেঘলা পাহাড়ের মাঝে বিস্তৃত পাইন, চাপ, মায়া, গোগুন, কাউলো, পিপলি এমন কত নাম না-জানা গাছের জঙ্গল থেকে হাজারো পাখির ডাক। অবিরাম ধ্বনি প্রবাহ। 





রাত ন'টায় ডিনার সেরে শুয়ে পড়েছিলাম। ভোর সাড়ে চারটেয় ঘুম ভেঙে গেল। উঠে বাইরে বেরুতেই দেখি আধো অন্ধকার আধো আলোয় আকাশ আড়মোড়া ভাঙছে। ঠান্ডা আছে তবে পীড়াদায়ক নয়। চেয়ার পেতে বসলাম ঘরের সামনে ব্যালকনিতে। চোখের সামনে রাতের অবশেষ মুছে স্পষ্ট হয়ে উঠল আঁকাবাঁকা দিগন্তরেখা। সেখানে নীল শৈলশিরা। গলা অবধি ডুবে আছে চাপ চাপ মেঘে। বিস্তৃত সমুদ্র তরঙ্গরাশির মাঝে যেমন জেগে থাকে দ্বীপমালা। যেন আত্মমগ্ন শহুরে মানুষজনকে ভেদ করে এক উত্তুঙ্গ মহীরুহ। চারপাশে থকথকে অহং, উপেক্ষা আর উদাসীনতার স্তূপকে অগ্রাহ্য করে ব্যতিক্রমী দু'একজন মানুষ। এমন পর্বতচূড়ার দিকে তাকালে রবীন্দ্রনাথের কথা মনে হয়। মনে পড়ে বিভূতিভূষণ। ঝলমলে আলো ছড়িয়ে পড়ে ক্রমশ সবুজ গালিচার উপর। 





দুপুরে খাওয়ার পরে পায়ে পায়ে পৌঁছে গেলাম রাস্তার উল্টো দিকে গুম্ফার উঠোনে। ঘন গাছপালার মধ্যে দিয়ে শতখানেক সিঁড়ি ভেঙে তবে সমতল জমি। চারপাশে অজস্র ফুল ফুটে আছে। সানাই-এর মতো বড় গোলাপি রঙা ধুতরো ফুল। সাদা তোড়ার মতো শতবেলি। সোনালি বাঁশের গাছ। আর গুম্ফার গায়ে রঙিন তিব্বতি নক্সা। দুটি স্থানীয় বাচ্ছা ধর্মচক্র ঘোরাতে ঘোরাতে খেলা করছিল। টুংটাং ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছিল তাদের অমল হাসির সাথে সাথে। গুম্ফার চূড়া থেকে চারদিকে উড়ছে রঙিন লুংটার সারি। দোতলার বারান্দা থেকে চমৎকার দেখাচ্ছিল এই গাঢ় সবুজ বন্ধুরতা। ধীরে ধীরে বিকেল ঘন হয়ে এল। আর নিস্তব্ধতা। 


নির্জনতার কাছে এলেই নিসর্গের কথা শোনা যায়। শহর নির্জন হতে পারে না, তাই সেখানে প্রকৃতি মূক হয়ে থাকে। সেখানে আমরাই বড় বেশি কথা বলে ফেলি। প্রতিদিনের হুল্লোড়ে ঢেকে দিতে চাই অসুখ ও বেদনা। জীবনের অকপট নাটককে ভুলে থাকতে মেলোড্রামার কাজল পরে বসি সাজানো ড্রইংরুমে। সুপ্রভাত বার্তা, স্টিকার লাগানো হাসিমুখ আর তীক্ষ্ণ রিংটোনে ভরা থাকে গোটাদিন।





টুরুকে এসে রাত ন'টায় ডিনার সেরে শুয়ে পড়া বেশ মানিয়ে নিয়েছি। বিছানায় শুয়ে জানলার শার্সি পেরিয়ে দূর পাহাড়ের জোনাকি আলোয় চোখ যায়। ভেসে আসে অবিরাম পাখি আর পতঙ্গের ডাক। নাম না জানা নিশাচর জানোয়ার। আজ দুপুরে খাওয়ার টেবিলে বসে হঠাৎ চোখ গেল ত্রিশ হাত দূরে ঘন গাছপালার দিকে। বাদামী রঙের জীবটি একমনে ঘাস লতাপাতা খেয়ে চলেছে। মাথায় বেশ বড় শিং। দার্জিলিং হিমালয়ে হোম স্টে'র জানলা বেয়ে এমন হরিণ দৃশ্য আগে দেখিনি। আসলে এখানে প্রকৃতি এখনও অনেকটাই আদিম। এখানে এখনও গাছপালার বুকে প্রাণ আছে। হোম স্টে'র প্যসম দিদি বললেন, হরিণ আর বুনো শুয়োরের বড় উৎপাত। ক্ষেতিবাড়ি করা বেশ মুশকিল। চারপাশে ঘিরে রেখে তবে চাষবাস হয়। লাল শাক, পালং শাক, গাজর, টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি -- এই সব। 





ভোর সাড়ে চারটেয় ঘুম ভেঙে গেল। শার্সির ওপারে তখন আলো-অন্ধকারের খেলা। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। জুন মাসের শুরুতে ঠান্ডার কামড় তেমন তীব্র নয়। দরজা ভেজিয়ে হালকা উইন্ড চিটার গায়ে দিয়ে রাস্তায় নামলাম। এখান থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পথ একেবারে জন-মানবহীন। দু'পাশে ঘন জঙ্গলে ভরা পাহাড় আর খাদ। সমুদ্র তরঙ্গের মতো ঘন মেঘ জমে আছে উপত্যকায়। অরণ্য ক্রমশ জেগে উঠছে আর একটা নতুন দিনকে কোলে টেনে নেওয়ার জন্য। ক'দিন ধরে হাল্কা বৃষ্টি হচ্ছে মাঝেমধ্যেই। গাছপালা তাই কাঁচা সবুজ। টাটকা ক্লোরোফিলের গন্ধ জাপটে ধরছে আমাকে। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে এতক্ষণে। আর্দ্রতার ঘনঘটায় সেভাবে সূর্যোদয় দেখার সুযোগ নেই। তবে চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠেছে অগণ্য পাখির ডাকে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটপতঙ্গের সমবেত গানে। এ যেন ব্রহ্মমুহূর্তের প্রার্থনা সঙ্গীত।






গাছ-ফুল-লতা-পাতার মাঝেও যে কত আলপনা থাকে তা একা না হলে জানা যায় না। এখানে জঙ্গল জুড়ে ইতিউতি ফার্নের সংসার। তারও নিবিড় সৌন্দর্য মন কেড়ে নেয়। প্রতিটি পাতা, পত্রকণিকা, সাপের ফণার মতো পত্রশীর্ষ হতবাক করে রাখে। এই নির্জন বনভূমিতে পুষ্প কাউকে খুশি করার জন্য ফোটে না। কারুর আদেশ বা আবদারেও পাপড়ি মেলে না। তবু ঘরগুছানি অনূঢ়া কোনো মেয়ে যেন সারাবছর এই আদিম অরণ্য, শষ্পভূমি, বৃক্ষশীর্ষ সাজিয়ে মনোরম করে রাখে ফুলে, পাতায়, পাখি ও পতঙ্গে। জুন মাস এখানে রডোডেনড্রন গুচ্ছের সময় নয়, তবু বনদেবীর ভাঁড়ার কখনোই ফুরায় না। রাস্তার ধারে, জঙ্গলের ইন্দির ছিন্দির থেকে উঁকি মারে রকমারি লিলি, শতবেলি, পাহাড়ি গোলাপ, আরও হাজারো নাম না জানা ফুল। 





এদেশের মানুষেরা পাইন গাছের মতোই সরল। শীতের আঁচড় লাগে মানুষ ও গাছের গায়ে। হাজার ফাটলে ফেটে যায় ত্বক। সবুজ স্তূপের মতো পাতায় পাতায় মেঘ জমে থাকে, আর দু'পায়ে অন্ধকার। মাটি সারাবছর ভিজে নরম হয়ে থাকে। এই আদিম অরণ্যে এখনও কিছু বিরল প্রাণী কোনোরকমে টিঁকে আছে। পাহাড়ি উপত্যকার ছোটো ছোটো পোখরিগুলোতে আজও স্যালাম্যান্ডার পাওয়া যায়। গ্রীষ্মে জল শুকিয়ে আসে। তখন মাটির গভীরে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে তারা। বর্ষায় জল জমলে দেখা দেয় ফের। এই বনাঞ্চলেই আছে ধনেশ পাখির গোপন আস্তানা। সেও এক বিরল সুন্দরদর্শন পাখি। তাদের জীবনও বড়ই রোমাঞ্চকর। 







লাটপাঞ্চারের দুর্গম ভার্জিন অরণ্যে গাছের কোটরে গোপন আস্তানায় ডিম পাড়ে ধনেশের মা পাখি। তারপর ঠোঁটে করে বয়ে আনা মাটি ও নিজের বিষ্ঠা লেপে সেই কোটরের মুখ প্রায় বন্ধ করে দেয়। সামান্য ক্ষুদ্র ছিদ্র থাকে খাবার বিনিময়ের জন্য। ডিমে তা দেওয়া থেকে বাচ্ছা সাবালক হওয়া অবধি সেই বন্দীজীবন মেনে নেয় মা। অপরদিকে বাবা পাখি রক্ত জল করা পরিশ্রম করে মা পাখি ও বাড়ন্ত বাচ্ছাদের খাবার জুগিয়ে যায়। মানুষের বিষ বাষ্প থেকে বাঁচার জন্য কি প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা! 


এমন পরিবেশে কয়েকদিন কাটানো মানেই একপ্রকার ডিটক্সিফিকেশন। বিকেলবেলা দলবেঁধে হাঁটতে হাঁটতে মহালধিরাম টপে গিয়ে পৌঁছাই। পাহাড়ের গা বেয়ে ঢালু চা বাগানের প্রান্ত বরাবর ময়াল সাপের মতো পিচের কালো রাস্তা। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে দেখা যায় বহুদূরের শিলিগুড়ি শহর। মাঝে মাঝে মেঘ নেমে আসে আমাদের ঘিরে। ভিজিয়ে দিয়ে দৌড়ে চলে যায় দূরে। পথের পাশে শেডের নিচে মূঢ় মানুষের মতো বসে থাকি আমরা। একদিকে খাড়া পর্বতের গা বেয়ে সবুজ চা গাছের সারি। আরেকদিকে রহস্যময় ধোঁয়াশার আড়ালে মাঝে মাঝে উঁকি দেওয়া ছোটো ছোটো বাড়িঘর। 





পরের দিন একটা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ইতিউতি ঘুরতে। কয়েকটা পাহাড় পেরুলেই সিটং। কমলালেবু আর বড় এলাচের বাগান। আমের গুটি ধরার মতো ছোটো ছোটো ফল ধরেছে গাছ জুড়ে। তবে কমলালেবুর চাষ এই এলাকায় দ্রুত কমে আসছে। রোগ পোকার আক্রমণে ফলন খুব কম আজকাল। কাছেই কয়েক শতাব্দী পুরানো অতি প্রাচীন গুম্ফা। মাটির মেঝে। ভিতরে বিরল হয়ে আসা স্থানীয় বাদ্যযন্ত্রের সারি। বিশেষ উৎসবে ধুলো ঝাড়া হয়। সুর তাল লয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে। তবে সভ্যতার রোগপোকা এখানেও ছড়িয়েছে। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় ক্ষণিকের চাওয়া পাওয়ার হিসেব মেলাতে গিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এতদিনের বিশ্বাস ও ঐতিহ্য। বাইরে সাদা রঙের ছোটো ছোটো চোর্তেনের গায়ে লতিয়ে উঠেছে সবুজ পাতা। মাথার উপর পত পত করে উড়ছে রঙিন লুংটা। ভুটিয়া কুকুরের লেজও উড়ছে হাওয়ায়। 


১০

পাহাড়ি পথ বেয়ে গাড়ি ওঠে নামে। এক পাহাড় থেকে ছুঁয়ে ফেলে নতুন গিরিশিরা। লাল চালের ছোট্ট বাড়িটি বেশ পছন্দ হয়ে যায় আমাদের। কিন্তু ক্রমশ পাহাড়ি বাঁকে তার ঠিকানা হারিয়ে যায়। এক সময় চাকা গিয়ে থামে সিঙ্কোনা বাগানের ধারে। আমরা গাড়ি থেকে নেমে গুটি গুটি পায়ে গাছ ও চড়াই পেরুতে পেরুতে চূড়ার দিকে চলে যাই। প্রতিটি ভিউ পয়েন্টই মৃত্যুর দিকে খানিক ঝুঁকে থাকে। সেখানে ঝোড়ো বাতাস আত্মহত্যার গূঢ় ইচ্ছের আগুনে ইন্ধন দেয় ক্রমাগত। আর তখন গরম ধোঁয়া ওঠা মোমো কিংবা নুডলস-এ ভরা চিনামাটির বোউল আমাকে জীবনের দিকে টেনে নিয়ে আসে। অহলদারার চূড়া থেকে ফিরে তাকালে অনেক নিচে গ্লসি সেলুটেপের মতো তিস্তা নদী। গাঢ় সবুজের ভিতর দিয়ে যেন একফালি লতানে পারদ। মাঝে মাঝে মেঘ ও কুয়াশা সরে গেলে অনেক অনেক দূরের পর্দা সরে যায়। সমভূমির কাছে নদী প্রশস্ত হয়ে ভেঙে গেছে কত শাখায়। স্বচ্ছতার দিনে নাকি দূর বাংলাদেশ অবধি নাগাল পায় চোখ। পাহাড়ে বেলা দ্রুত ঘনিয়ে আসে। গাড়ির চাকা গড়িয়ে চলে আমাদের আস্তানার দিকে। 


১১

আমাদের হোম স্টে-তে ফিরতে ফিরতে সন্ধে নেমে আসে। বড় বাটি ভর্তি করে চিকেন মোমো আর সস নিয়ে আসে প্যসম দিদি। তার ঝাল স্বাদ জিভ টপকে মাথায় পৌঁছে যায়। সেসব শেষ করে ক্রমশ শীতল হয়ে আসা অন্ধকার ঠেলে সিঁড়ি বেয়ে আমরা তিনতলার ছাদে উঠে পড়ি। চাদরে ঢেকে রাখি নিজেদের। খাদ ও অরণ্যের ওইপারে উত্তুঙ্গ ছায়া ছায়া গিরিশিরার গায়ে একঝাঁক জোনাকির মতো জনপদ। দূরের কোনো পাহাড়ি বস্তি থেকে ভেসে আসছে অপরিচিত কথা আর গানের সুর। রাতচরা কোনো পাখির কর্কশ ডাক সময়কে ফালা করে কাটছে মাঝে মাঝে। ঝিঁঝিঁর একঘেয়ে ডাক হঠাৎ থেমে যাচ্ছে কখনো কখনো। প্যসম দিদির তিন তলায় ছোটো হলঘরে শুরু হল তথাগতের আরাধনা। ভারি গলার গাঢ় সুর পাহাড়ের এক ঢাল থেকে গড়িয়ে নামছে আর চড়াই বেয়ে উঠে যাচ্ছে আরেক ঢালের দিকে। সিঁড়ি দিয়ে গুটিগুটি নেমে আসি আমাদের ঘরে। দেখতে দেখতে আমাদের তিনদিনের নির্জনাবাস ফুরিয়ে আসে। 


১২

ভোরবেলা উঠে আজও বেরিয়ে পড়েছিলাম পথে। একাই। গুম্ফা ছাড়িয়ে চলে গেছে রাস্তা। দুইদিকে ঘন পাইনের বন। তারই মাঝে মাঝে গাছ কেটে পথের ধারে গড়ে উঠছে একটি দুটি হোম-স্টে। পূর্ব হিমালয়ের এই প্রত্যন্ত প্রান্তরও যে আর বেশিদিন তার নির্জনতা ধরে রাখতে পারবে না তা বোঝা যাচ্ছে। হয়তো পাঁচ বছর পরে আবার এখানে ফিরে এলেই হতাশ হতে হবে। বাজারঘাট দোকানপাটে ভরে যাবে। লেপচা ও ভুটিয়াদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি জীবনযাত্রা - সব মিশে যাবে আধুনিক সভ্যতার আগ্রাসী আগুনে। বড় বড় ট্রি-ফার্ণ আমাকে মুহূর্তের জন্য বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল প্রাগৈতিহাসিক সময়ের মোড়ে। বৃদ্ধ পাইন গাছের গায়ে অসংখ্য ফুলেল অর্কিড। ঘন জঙ্গলের ভিতরে এক একটা অতি দীর্ঘ বৃক্ষচূড়া যেন উঁচু মন্দিরের মতো সটান দাঁড়িয়ে আছে। এই অরণ্যের বুকে লুকোনো আছে অনেক ছোটো ছোটো জলাশয় আর ঝোরা। সেগুলিই নিউট বা স্যালাম্যান্ডারের শেষ আশ্রয়স্থল। ক্রমবর্ধমান দূষণ প্রতিদিন একটু একটু করে কেড়ে নিচ্ছে তাদের বেঁচে থাকার সুযোগ। 


রাস্তায় এবার একটি দুটি গাড়ি চলতে শুরু করেছে। সবই স্থানীয় শাকসব্জি, দুধ নিয়ে ছুটে যাচ্ছে কার্শিয়ং বাজারের দিকে। সাড়ে নটা নাগাদ এমনই একটা গাড়িতে আমাদের কার্শিয়াং হয়ে শিলিগুড়ি ফেরার কথা। 


১৩

গরম গরম পরোটা আর চিকেন দিয়ে ভারি ব্রেকফাস্ট করে তৈরি হয়ে নিলাম সবাই। ব্যাগপত্র বাইরে এনে এবার অপেক্ষার পালা। ছোদেন হোমস্টের সামনে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি। প্যসম দিদির মা আমাদের গলায় পরিয়ে দিলেন সাদা ধবধবে ধাগা। আজ আবার কার্শিয়ং-এ হামরো পার্টির মিটিং আছে। তাই প্রতিটি গাড়িতে বেশ ভিড়। তারই একটায় উঠে বসলাম। স্থানীয় লোকজন এখনো খুব সরলমনা। নিজেদের ভালো সিট আমাদের ছেড়ে দিয়ে দুধের ড্রামের উপর চড়ে বসল। প্যসম দিদি আর তার লাল গালের ছোট্ট মেয়েটা হাত নেড়ে বিদায় জানালো হাসিমুখে। এভাবে আর কোনোদিন দেখা হবে না একথা জেনেও আমরা বারবার ফিরে আসার মোড়ে দাঁড়িয়ে বলি - 'আবার দেখা হবে'। যদি সত্যিই ফিরে যাই কখনো এই দৃশ্য, এই মুগ্ধতা আর কী ফিরে পাওয়া যায়! প্যশম দিদির ওই ছোট্ট মেয়েটি কী ছোটই থাকবে তখনো? এই নির্জনতা, সরল মানুষজন, এত ফুল, গাছপালা, এমনকি এই ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশামাখা জুন মাসের প্রকৃতি! 


পাহাড়ি পথ বেয়ে গড়িয়ে চলল চাকা। কিছুদূর যেতে না যেতে থমকে দাঁড়ালো পথের বাঁকে। বেশ বড় একটা সাপ রাস্তা পেরুচ্ছে ধীরে ধীরে। চড়াই উৎরাই, মানুষের ওঠা নামা, গাড়ির সামনে হামরো পার্টির অচেনা পতাকার রং দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চললাম দিলারাম হয়ে কার্শিয়ং -এর দিকে। 









মন্তব্যসমূহ

  1. রাজদীপ,আমি তোমার এই ভ্রমনকাহিনীটি পড়ে যার পর নাই মুগ্ধ হয়েছি। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো যেন প্রথিতযশা কোনো লেখকের লেখা পড়ছি। একদম অন্য জগতে চলে গিয়েছিলাম। তোমার গদ্যের হাত ভীষণ ভালু। ' ইন্দির সিন্দির' আহা !!

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. থ্যাংকিউ। মীরা দি। বুঝেছি। খুব ৎসাহ পেলাম আপনার কথায়।
      -রাজদীপ

      মুছুন
  2. কী অনবদ্য গদ্য! আবিষ্ট হয়ে গেলাম। অনিন্দিতাদি।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক ধন্যবাদ দিদি। আপনার ভালো লাগা আনন্দের।
      - রাজদীপ

      মুছুন
  3. অসাধারণ একটি ভ্রমণ কাহিনী মূলত: লেখকের অপূর্ব ভাষা শৈলীর সৌজন্যে।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক ধন্যবাদ জানবেন। আনন্দ পেলাম। - রাজদীপ

      মুছুন
  4. ভ্রমণের বর্ণনায় এক অসাধারণ সাহিত্য রচনা পাঠককে সম্পৃক্ত করে নিল প্রকৃতির অপার রহস্যে। খুব সুন্দর কথা- ওখানে প্রকৃতি কথা বলে, শহরে আমরা বলি।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই।
      - রাজদীপ

      মুছুন
  5. রঞ্জনা ভট্টাচার্য১ জুন, ২০২৩ এ ১২:২৩ PM

    পুরো লেখাটা জুড়ে মায়াবী সুরের পাহাড় ভ্রমণ

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক ধন্যবাদ জানবেন। আপনার ভালো লেগেছে জেনে আনন্দ পেলাম।
      - রাজদীপ

      মুছুন
  6. রাজদীপরাজদীপের লেখা খুব মোহময়ী। অপূর্ব।
    মুগ্ধতা রেখে গেলাম 💚💙💜

    উত্তরমুছুন
  7. রাজদীপ, আপনার ওয়ালে এই লেখাটা কি আগে পড়েছিলাম? হয়তো এমনই একটা! অতটা মনে নেই! উত্তরবঙ্গ ভ্রমণ নিয়ে! এটাও সম্পূর্ণ পড়লাম। কী চমৎকার লেখা! নিবিড় অনুভব আর মায়াময় অনুভূতি নিয়ে শব্দেরা ঝরা পালকের মতো নিঃশ্চুপ সেজেছে গদ্য শরীরে! নিসর্গের ধুপছায়া ঘোর জাদুকরী মায়ায় আমাদের স্নায়ুকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলে এমনই মায়াময় গদ্য দরকার তাকে শব্দশরীরে তুলে আনতে! নিসর্গের মুগ্ধতা আর গদ্যচলনের কোথায় যেন সমাপতন হয়েছে একই কম্পাংকে! খুব ভালো লাগল! ----পল্লব গাঙ্গুলি

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. শ্রদ্ধা জানবেন। আপনার ভালোলাগা আমার পুরস্কার।
      - রাজদীপ

      মুছুন
  8. অসাধারণ লাগলো! অপূর্ব এই কাব্যিক ভ্রমন কাহিনী মন ভাসিয়ে দিল ।

    সুস্মিতা গোস্বামী সরকার

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য