প্রতিভা সরকার




 সুলেখা সান্যাল - ভুলে যাওয়া এক নাম


মহিলা লেখক পুরুষ লেখকের তফাত আমাদের দেশে ভালোমতোই করা হয়। যেন দেশোদ্ধার, যুদ্ধবিগ্রহ, রাজনীতি প্রেমঘটিত মল্লযুদ্ধ ইত্যাদি পুরুষদের একচেটিয়া। জটিল কুটিল মানবিক সম্পর্কের উন্মোচনে তাদেরই মূল অধিকার। আর মহিলারা লিখবেন ছোটখাটো সাংসারিক বিষয়ে, প্রেমাবেগের কান্নাভেজা বর্ণনা, সন্তানস্নেহ ইত্যাদি বিষয়ে। তাদের লেখায় যেন হাতের হলুদ মোছা আঁচলের ছায়া থাকাটা একান্ত জরুরি। আর রাজনীতি!  আরে, মেয়েরা তার বোঝে কি যে লিখবে! 

ঠিক এইভাবেই বিভাজন না হলেও, বিভাজনটা কতকটা এইরকমই। মোদ্দা কথা গুরুভার বিষয়ে পুরুষের পুরুষালি দক্ষতা দরকার হয়, ছোটখাটো ব্যাপার নারী তার মোলায়েম সংবেদনশীলতা দিয়ে সামলে দিতে পারে।

আপনার লেখাগুলো ঠিক আশাপূর্ণা দেবীর মতো, এ কথা এক অনভিজ্ঞ তরুণী গদ্যকারকে বলেছিল এক কবি। জেন অস্টেনের সমতুল্য মহান কথাসাহিত্যিক আশাপূর্ণাকেও সে মেয়েলি দলভুক্ত করেছিল বলেই মিচকি হাসি সহযোগে তার এই বাক্যবাণ!  বাংলা সাহিত্য জগতে এদের মুখ বন্ধ করেছিলেন কবিতা সিংহ, মহাশ্বেতা দেবী, আরও কয়েকজন, সিংহের বিক্রমে যাঁরা লিখে গেছেন, যাঁদের লেখা পড়ে মেয়েলি ভাবার সাহস এবং সুযোগ পায়নি কোনো অতি ভুঁইফোঁড়। তাঁদের কাজটা যথেষ্ট কঠিন ছিল, কারণ তখন এবং এখনও মেয়েদের চারিত্রিক শালীনতার প্রশ্নটি জুড়ে দেওয়া হয় তার লেখার সঙ্গে। কয়েকদিন আগে নবনীতা দেবসেনের একটি লেখা নিয়ে খুব হৈচৈ হচ্ছিল। সেখানে তিনি লিখেছেন অধ্যাপকের সঙ্গে ছাত্রীর প্রেম খুবই রোমান্টিক এক সম্পর্ক, কিন্তু বয়সে বড় অধ্যাপিকার সঙ্গে ছাত্রের প্রেম দেখালে নাকি সেটা শালীনতা বিরোধী হবে। এইরকম চিত্রণ যদি আসে বিশেষত মহিলা লেখকের কলম থেকে তাহলে তো সাড়ে সর্বনাশ। সামাজিক ন্যায় নীতি সব গোল্লায় যাবে। নবনীতার বাড়ির লোকেরাও তাঁকে এইরকম লিখতে বারণ করেছিলেন। আর খ্যাতিমান তদানীন্তন লেখকেরা?  তাঁরা বেশির ভাগই নারীলেখক সৃষ্ট চরিত্রের মুখে অপভাষা শুনলে সেটা লেখিকার মর্যাদার পরিপন্থী হবে বলে ভাবতেন। তার মানে কোনো লেখিকা যদি  যৌনকর্মীদের নিয়ে গল্প উপন্যাস লেখে, তাহলেও লাল বাতি এলাকার মেয়েদের চরিত্রগুলোকে বলাতে হবে শালীন ভাষা, খেমটার বদলে তাদের দিয়ে গাওয়াতে হবে বিশুদ্ধ রবীন্দ্র সঙ্গীত। মহিলা লেখককে বাস্তবতা, রাজনীতি ইত্যাদির ধার না ধারলেও চলে। যুদ্ধবিগ্রহের মতো সৃষ্টিছাড়া ব্যাপারে তারা না জড়ালেই ভালো। ওসবের জন্য তো জীবন-অভিজ্ঞ পুং লেখকেরা আছেন। 

  কিন্তু বাংলা সাহিত্যে এই বিভাজন ওলট পালট করে দিলেন যে কবিতা সিংহ, মহাশ্বেতা দেবীরা,তাঁদের এই বিক্রম কি সত্যিই তাহলে পরম্পরারহিত? হঠাৎ করেই কি তাঁরা বাংলাসাহিত্য জগতে সাহসী মহিলা কন্ঠ হয়ে উঠলেন, আর বিশেষ করে দ্বিতীয় জন তাঁর রাজনৈতিক উপন্যাসগুলির জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে রইলেন? একেবারেই তা নয় কিন্তু। তাঁদের যে পূর্বজারা তথাকথিত মেয়েলি লেখার এই বদনাম ছিন্ন করে বৃহত্তর জীবনের প্রেক্ষিতে সাহিত্য রচনা করলেন, চূড়ান্ত রাজনৈতিক বোধ সঞ্চারিত করলেন নিজেদের গল্প উপন্যাসে, আমরা তাঁদের ভুলে গেলেও, তাঁরা ছিলেন, আছেন এবং থাকবেনও। তাঁরা হলেন সাবিত্রী রায় (১৯১৮-১৯৮৫) এবং সুলেখা সান্যাল (১৯২৮-১৯৬২)। 

আজ দ্বিতীয় জনকে স্মরণ করি। সুলেখা সান্যাল ছিলেন ক্ষণজন্মা, কিন্তু মাত্র চৌত্রিশ বছরের আয়ুষ্কালে লেখা তাঁর উপন্যাস ‘নবাঙ্কুর’ বাংলা সাহিত্য জগতে প্রথম নারীবাদী লেখা বলে স্বীকৃতি পায়। পিতৃতন্ত্রের রাজনীতি যা মিশে আছে নারী পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের সমাজের মজ্জায় মজ্জায়, তাঁর উপন্যাস নবাঙ্কুরে তা অতি চমৎকার ভাবে চিত্রিত হয়েছে। আজকের সচেতন মেয়েরা যে যে বৈষম্য নিয়ে সোচ্চার, তার শুরু যে একেবারে পরিবারের মধ্যে এ কথা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন সুলেখা। তাঁর নায়িকা ছবি ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে ঠাকুমা থেকে শুরু করে পরিবারের প্রত্যেকেই তার ভাই প্রদীপের  প্রতি বেশি যত্নবান। খাবার জামাকাপড় ব্যবহার সবেতেই যা কিছু সেরা তাতে ছেলেদের অধিকার। এমনকি বোনের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় বলে মেয়েমানুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো উচিত নয় তার, এইরকম বৈষম্যমূলক কথা ছবির সামনেই বলে বসেন তাদের নিজের ঠাকুমা। ক্ষীর ভাগ করে দেবার সময় নিজে মহিলা হয়েও নাতনিকে বঞ্চিত করেন তিনি। অথচ ছবি সাহসী, জেদী এবং মেধাবী। তার তুলনায় প্রদীপ ভীরু এবং ছিঁচকাদুনে। ছবি তাতে বিরক্ত হয়। অন্যদের পৈতে পরা দেখে তার মনে হয় সবার কেন এই অধিকার থাকবে না। এই আচারসর্বস্ব সমাজের বিপরীতে ছবি যেন ছোটবেলা থেকেই মূর্তিমতী প্রতিবাদ। তাকে বোঝেন কেবল তার মা। রুক্ষ চুলের পাড়া বেড়ানি মেয়ের প্রতি তিনিও যথেষ্ট বিরক্ত, সেটা অবশ্য ছবির জন্য সকলের কথা শুনতে হয় বলে, কিন্তু তাও মেয়ের প্রতি তার‍ কী এক মায়া! যেন নিজের সমস্ত না পাওয়া এবং বঞ্চনা থেকে তিনি মেয়েকে দূরে রাখতে চান। চান সে লেখাপড়া শিখে স্বনির্ভর জীবন পাক। শুধু সোচ্চারে তা বলতে পারেন না। চুপিচুপি তিনি তাকে ভালোমন্দ খাওয়ান, কাছে বসিয়ে শান্ত হবার অনুরোধ জানান। বোঝানোর চেষ্টা করেন। মায়ের দিকেও মেয়ের সযত্ন দৃষ্টি।  রান্নাঘরে থেকে থেকে মায়ের গায়ের রঙ যে তামাটে হয়ে গেছে এটা সে বোঝে।

অর্থাৎ লিঙ্গভিত্তিক যে সামাজিক নির্মাণগুলি পিতৃতান্ত্রিক সমাজে খুব শৈশবেই আমাদের মনে ভেদাভেদের বীজ বপন করে সুলেখা সান্যাল সেগুলো তাঁর উপন্যাস নবাঙ্কুরে পুঙখানুপুঙখ তুলে ধরলেন। আর একটি ব্যাপার আমার খুব চমকপ্রদ লেগেছে। একটি সরল জেদি শিশুকন্যার চোখে পরতে পরতে এই পৃথিবীর গোপন রহস্যগুলোর উন্মোচন। ছবির চিরকালের সহানুভূতি গরীব খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি, সে তাদের সঙ্গে মিশতে চায়, নিবিড় ভাবে জানতে চায় তাদের যাপন। বাড়ির তীব্র অমতেও জড়িয়ে পড়ে দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের সেবায়। তীব্র  ভাবে রাজনৈতিক হয়ে পড়ে তার জীবন। সেইদিনের বাঙালি মেয়ের পক্ষে অনেক কঠোর, প্রায় অসম্ভবও বটে, এইরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারে জেদি ছবি, তার নিজের জীবন সম্বন্ধে। নিজের বিয়ের সম্বন্ধ প্রত্যাখ্যান করে সে, বাবার হাতে মার খায়, তবু নিজের জীবনের রাশ অন্যের হাতে তুলে দেয় না। অথচ  জীবনেরই নিয়মে তার মধ্যে প্রেম আসে। কৈশোর থেকে যৌবনে পৌঁছবার রাস্তায় একাধিক জনকে তার ভালো লাগে। কোনটিই পরিণতি পায় না, তবে শেষে সে তার দয়িতকে খুঁজে পায় বিপ্লবী কর্মকান্ডের সঙ্গী তমালের মধ্যে। পরস্পরের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার প্রতিশ্রুতিতে এই উপন্যাস শেষ হয়। 

সময়ের থেকে বহু এগিয়ে থাকা এই সৃষ্টিতে সুলেখা নিজের জীবনের ছায়াকে সুস্পষ্ট করেছেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ফরিদপুরে তাঁর জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা, পরে কলকাতায় ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউটে পড়তে আসা, এ শহরে কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগদান, তারপর পড়া অসমাপ্ত রেখে ফিরে যেতে বাধ্য হওয়া, স্বল্পকালীন বিবাহিত জীবন এবং বিচ্ছেদ, সব শেষে রক্তের ক্যান্সারে মৃত্যু, সব না হলেও অনেক কিছুর ছায়াই নবাঙ্কুরের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। উপন্যাসের শেষে ছবি একাই উচ্চতর শিক্ষালাভের জন্য কলকাতায় পাড়ি জন্মায়, ট্রেনে বসে শেষমুহুর্তে তার চোখ জলে ভরে ওঠে, তার গ্রাম, বাবা মা আত্মীয়স্বজন চোখের সীমানার বাইরে চলে যাচ্ছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সে ভাবে, “ওখানে না গেলে পৃথিবীটাকে ধরতে পারবে না তুমি,--কে যেন একদিন বলেছিল কথাটা। কোন পৃথিবী! সেখানে জায়গা হবে তো ছবির ! সেই স্বার্থপর জগতের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্গে টিকে থাকতে পারবে তো সে! যে নতুন ভাবনাটা তাকে চঞ্চল করে তুলেছে সেটা আনন্দের না দুঃখের,নাকি আশঙ্কার ! কিসের সঙ্গে তার মিল? বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় সে মিলটাকে খুঁজে পায় গাড়ির গতির সঙ্গে চলার তালে - চলাটাই আসল, চলতে হবে। ততক্ষণে নতুন আর এক প্রতীক্ষায় উদগ্রীব হয়ে উঠেছে তার মন আর সমস্ত চেতনা।”

এই গতি, সামনে এগিয়ে চলা, নতুনকে জানা, এরই নাম জীবন। ছবির মধ্য দিয়ে এতদিনের অবরুদ্ধ বঙ্গনারী অবরোধ ঘুচিয়ে হয়ে উঠল নতুন দিনের দ্যুতি, দুহাতে আলিঙ্গন করে নিল স্বাধীন, স্বয়ংবৃত জীবনকে। ভালো মন্দ যাইই ঘটুক না কেন, তাকে মোকাবিলা করবার ধকটুকু সে কখনও হারিয়ে ফেলবে না।

প্রায় একশ বছর ছুঁই ছুঁই সময়ে জন্মানো সুলেখা সান্যালের লেখা আজও অত্যন্ত সুখপাঠ্য। মৃত্যুর পর প্রকাশিত উপন্যাস দেওয়াল পদ্ম এবং ছোট গল্পের সংকলন সিঁদুরে মেঘ এই সাক্ষ্য দেয়। যে সাহিত্যের প্রাণ নারীর মুক্তি চিন্তা, সুলেখা সেই ধারার সাহিত্যের পথিকৃৎ। 

অক্সফোর্ড ইন্ডিয়া প্রেস থেকে প্রকাশিত উইমেন রাইটিং ইন ইন্ডিয়া (ভলিউম ২)-তে সম্পাদকদ্বয় সুসি থারু এবং কে ললিতা সসম্মানে সুলেখার নবাঙ্কুরকে জায়গা করে দিয়েছেন কতগুলো অধ্যায়ের ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে। অনুবাদক মধুছন্দা কার্লেকরের কলমে নবাঙ্কুর হয়ে উঠেছে দ্য জারমিনেটিং সীড। 

সুলেখা সান্যালের নাম আমরা তেমন ভাবে মনে রাখিনি। একজন পথিকৃৎ-কে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিইনি। আর অল্প কয়েক বছর বাদেই তাঁর জন্মশতবর্ষ। আমরা কি পারি না যথোচিত মর্যাদায় এই বছরটিকে পালন করতে? তাঁকে নিয়ে আলোচনা, পাঠ ইত্যাদির মাধ্যমে আমাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে? 

এই ক্ষুদ্র নিবন্ধটি তার সূচনা হয়ে থাকলে খুবই আনন্দ পাব। 


মন্তব্যসমূহ

  1. আপনার লেখা পাঠ করে অনেক জানলাম অনুভব করলাম, আনন্দ পেলাম।

    উত্তরমুছুন
  2. ধন্যবাদ নীলিমবাবু।

    উত্তরমুছুন
  3. যোগ্য উত্তরসূরির কলমে সুলেখা মূল্যায়নে ঋদ্ধ হলাম। এইভাবে অচলায়তন ভেঙে যাক।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. আনন্দ দিল আপনার মন্তব্য। ধন্যবাদ।

      মুছুন
  4. অতীব সুপাঠ্য এবং জরুরী লেখা। সুলেখা স্যানালের উপর আলোকপাত করার জন্য ধন্যবাদ। ভালবাসা নিও ❤️

    ~ শামীম।

    উত্তরমুছুন
  5. কী চমৎকার লিখেছেন! সুলেখা সান্যালের নামও জানতাম না, পড়া তো দূরের কথা! কিন্তু আপনার লেখাটা পড়ে এটুকু বুঝলাম, ওঁকে পড়তেই হবে। এই হল সত্যিকারের গুরুদক্ষিণা, একজন গদ্যলেখকের লেখা পড়ে পূর্বজ আরেকজন গদ্য লেখকের লেখা পড়তে চাইছি, এর চেয়ে ভালো আর কিছু হয় না!

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য