সুস্মিতা সাহা
লাড্ডু -খিচুড়ি - সরস্বতী দিদিমণি আর হলুদ রঙের প্রেম প্রেম বসন্ত
স্কুলের সরস্বতী পুজোর প্রসাদের লাড্ডুর কথা মনে আছে?
কোন কোন বার আমাদের লুচি আলুর দম দেওয়া হতো- খিচুড়ির বদলে তবে লাড্ডু মাস্ট। এখন হলদিরাম বিকারাম ঘোষ bancharam বলরাম মল্লিক পুঁটিরাম থেকে শুরু করে পাড়া বেপাড়ার আসলি ঘিয়ের জবরদস্ত লাড্ডু খাই বটে কিন্তু ঐ স্কুলের একটু একটু তেল চিপকে গন্ধ মাখা লাড্ডুর স্বাদ আর পাই না।
সকাল থেকে সেই tradition এখনো চলছে - তাড়াহুড়োয় হলুদ ও তেল মেখে ভোর ভোর কাকস্নান তারপর গোছগাছ করতে করতেই হয় ঠাকুরমশাইয়ের অতর্কিত আবির্ভাব আর নাহলে এলেন না তো এলেন না। ব্যাস বসে থাকো অথবা ব্লক জুড়ে হেঁটে বেড়াও ঠাকুরমশাই দেখলেই পাকড়াও করার জন্য।
উফ্ফ সে এক কান্ড - একেবারে হিন্দি সিনেমার সেই ভিলেনের পিছনে হিরোর কার চেজিং আর কি। এই না না সরি সরি, তাঁরা হলেন আমাদের এই সব পবিত্র দিনের এক ও অদ্বিতীয় পরিত্রাতা।
বিভুবাবু কিন্তু এসব দায়িত্ব কিচ্ছু নেবে না।শুধু অনেক কষ্টে যদিবা একরাশ পাঞ্জাবির মধ্যে একটি গায়ে তুললো - পুজো শেষ হতেই পনির ভাজা ও পাতলা করে বেগুনি ভাজতে শুরু করলো।
হ্যাঁ, সরস্বতী পুজোর দুই শেফ আমাদের - বড়ো গিন্নিমা করবেন খিচুড়ি ও জুনিয়র শেফ করবে পনির। কি কম্বিনেশন খিচুড়ি ও পনির বাটার মশলা। তাও আবার মালাই মারকে।
আর আমি - আমি তো পুজোর আগে পরের দুটি দিন দৌড়চ্ছি ক্রমাগত।
যাই হোক্ আজ ঠাকুরমশাই একদম ঠিক সময়ে ল্যান্ড করে গেছেন। হাতে হাতে সব গুছিয়ে নিয়েছেন। খুব বাচ্চা ছেলে তো- একটু বাবা বাছা করে ম্যানেজ করে নিলাম। ভারি ভালো লাগলো।
যাক্ পুরোনো দিনের স্মৃতি কথায় ফিরি। মা'র ছিল কোচিং ক্লাসের একগাদা ছাত্র ছাত্রী- পুজো হতেই আমার শাড়ির কুঁচি ধরে দিয়ে মা ছুটতো এক হাঁড়ি খিচুড়ি - পাঁচ তরকারি - আলুর দম - বেগুনি পাঁপড় ও চাটনি পায়েসের আয়োজন করতে। আমি সবান্ধবী বেরিয়ে পড়তাম স্কুলের দিকে। তখনো বন্ধু মানে ছেলে বন্ধু জোটে নি তো। তবে হলুদ শাড়িতে সেদিন সবাই আমরা উজ্জ্বল।
এই লেখাটি লিখতে লিখতেই মনে পড়ে গেল একটি বিরাট বড়ো রেলওয়ে খেলার মাঠ পেরিয়ে স্কুলে যেতে হতো। মাঠের ধারে ছিল রুপা' দের বাড়ি। একবার রুপার মা কাকিমা আমাদের সব বন্ধুদের মাটিতে বসিয়ে গরম গরম খিচুড়ি খাইয়েছিলেন।তাতে টাটকা কড়াইশুঁটি ও ধনেপাতা কুচি ছড়ানো। ওহ্ অমৃত।
আমার মা হোলো খিচুড়ি স্পেশালিসট, তবু সেদিন উপোসী পেটে ঐ গরম খিচুড়ি অসাধারণ লেগেছিল। সরস্বতী পুজোর দিনে অনেক বাড়িতে নারায়ণ পুজোর জন্য সিন্নি হয়, এই সিন্নির কথায় ব্যানার্জি ও মুখার্জি কাকিমার হাতের মাখা সিন্নির স্বাদ মনে পড়ে গেল।
আমি আবার সিন্নির ভক্ত - সেই সঙ্গে খিচুড়ি চাটনির। অবধারিত ভাবে এই দিনে আমার মাথা যন্ত্রণা হবেই হবে। ওষুধ খেয়ে আবার এক প্রস্থ খিচুড়ি সেঁটে বাকি সিন্নি ফ্রিজে রেখে ঘুম - পরের দিন আবার দই খই খাওয়ার ধূম।
এই এতো রকম খাওয়ার পরেও আমার অধীর আগ্রহে অপেক্ষা থাকতো বাবার স্কুলের প্রসাদের প্যাকেটের জন্য। আমার বাবাও ঠিক মেয়ের জন্য ঐ প্যাকেটটি নিয়ে আসতেন। প্রধান শিক্ষক বলে কথা - সহকর্মী মাস্টারমশাই দিদিমণিরা বেশ যত্ন করে প্যাকেট গুছিয়ে দিতেন। আমার কাছে ঐ প্যাকেটের আকর্ষণ ছিল মহার্ঘ।
তবে সরস্বতী পুজোর পরের দিন এ দেশীয় মানুষদের মধ্যে গোটা সিদ্ধ খাওয়ার চল , পাড়ায় এক বাড়ি থেকে ছোট্ট একটি কৌটো করে তাও আসতো।আমার মাসির বাড়িতে আবার জোড়া ইলিশ খাওয়ার নিয়ম। এতো গেল সকাল ও দুপুরের পর্ব। দুর্গা পুজোর মতোই সরস্বতী পুজোতেও সন্ধ্যে বেলায় আমরা বন্ধুরা দিব্যি সেজেগুজে মন্ডপে মন্ডপে ঠাকুর দেখতে যেতাম। বারোয়ারি পুজোয় ঠাকুর বিসর্জনের পরের দিন একটা জমজমাট জলসা বসতো। তখন কন্ঠী'র বাজার। কিশোর কন্ঠী, আশা কন্ঠী মান্না দে'র অসাধারণ গানগুলি গেয়ে ফাঁকা মন্ডপ মাতিয়ে তুলতেন এই সমস্ত শিল্পীরা। কতো বার যে শুনেছি ফাংশনে এবং অষ্টপ্রহর মাইকে ' সে আমার গুরুদক্ষিণা' অথবা 'মিষ্টি একটা গন্ধ রয়েছে ঘরটা জুড়ে '। 'দো বুঁদ মুঝে ভি পিলাদে শরাবী..' গানের সঙ্গে একটু আধটু কোমর দুলিয়ে ছেলে বুড়োর রক্ত গরম করে দিতেন মঞ্চের অনামী গায়িকা। অল্প অল্প বাতাস দিচ্ছে - একেই নাকি বলে দখিনা বাতাস আর গান চলছে -এক দো তিন ... উফ্ফ মাধুরীর ঐ দুর্ধর্ষ গানের সঙ্গে নাচ। বাপ রে, ছেড়ে ওঠা যেত না। কিন্তু উঠতেই হতো কারণ আমার বাবার সেই নিয়মানুবর্তিতা।
রাত ঘন হয়ে আসতো - আকাশের তারাদের আজ উৎসব।
বসন্ত এসে গেছে।❤
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন