অসিত মণ্ডল




বোঝাপড়া 
................
(১)

পাথরডি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পা দিতেই শেষ -বোশেখের গরম হাওয়ার হলকা এসে লাগল সৈকতের চোখেমুখে। সূর্য রীতিমতো চোখ রাঙাচ্ছে এখন।বাতাসে আগুনের ছ্যাঁকা। নিঝুম দুপুরে ঝিমোচ্ছিল গোটা চত্বর। ট্রেন আসতেই আড়মোড়া ভেঙে নড়েচড়ে উঠল।
বাইরে অটো - টোটোওয়ালাদের হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি। প্যাসেঞ্জার নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে।একজনের থাকার কথা। বি এম ও এইচ ফোন নম্বর দিয়েছিলেন।ফোন করে অবস্থান জেনে নিয়ে অটো লাইনের দিকে এগিয়ে গেল সৈকত। অপেক্ষমান মানুষটা বেঁটে খাটো চেহারার।রোদে পোড়া পাথুরে মাটির মতো রুখুসুখু।মাথার চুলে, গোঁফ জোড়ায় পাক ধরেছে।মুখের হাসিটি অমলিন। 
' আইসেন, আইসেন ডাক্তারবাবু।আমার নাম খেলারাম টুডু।আমি আস্যেছি আপনারে লিতে।চলেন,হুই যে গাড়ি ',এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল লোকটা।
নমস্কার ফিরিয়ে দিয়ে তাকে অনুসরণ করল সৈকত। 

গন্তব্য পাথরডি স্বাস্থ্যকেন্দ্র।সদ্যনিযুক্ত ডাক্তার সৈকত দত্তকে নিয়ে গাড়ি ছুটে চলল মধ্যগতিতে।
সৈকত বাইরের দিকে তাকায়।ব্যস্ত শহুরে জীবন ছেড়ে এ কোথায় এসে পড়ল সে।যতদূর চোখ যায় শুধু ধূ ধূ নিফসলি মাঠ।কাছে দূরে ছোট ছোট টিলা।ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ঝোপঝাড়। মাঝে মাঝেই তাল - খেজুরের জটলা।কোথাও এক টানা পলাশের জঙ্গল। রুক্ষ মাটির দেশে পলাশের এই বাড়বাড়ন্ত সৈকতের কাছে বেমানান মনে হয়।পলাশের মরশুম শেষ হয়ে এলেও এখনো কোন কোন গাছে হিংস্র বাঘের বাঁকানো নখের মতো পলাশ ফুটে রয়েছে। এই রুক্ষ নির্দয় কাঁকুরে মাটির দেশে মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কথা ভেবে রূপসী পলাশবনকে নিষ্ঠুর প্রকৃতির নৃশংস পরিহাস বলে মনে হল সৈকতের। 
কোথাও চোখে পড়ল এক চিলতে জলাশয়।তাতেই স্নান সারছে আদিবাসী মেয়ে মরদ।ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দাপাদাপি করছে।গা ডুবিয়ে আছে গোরু মোষ।এসময় জলের প্রচন্ড অভাব এখানে। 
পেরিয়ে যাচ্ছে  আদিবাসীদের ছোট ছোট  গ্রাম। খড়, টালির চাল। মাটির দেওয়াল।দেওয়ালে অপটু হাতের আঁকা জীবজন্তু, গাছ গাছালির ছবি।যৎসামান্য মাথা গোঁজার ঠাঁই। অথচ পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন কারুকার্যময়।

একসময় ওরা পৌঁছে গেল পাথরডি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।ডাক্তার আসছে শুনে গাঁ- গঞ্জ থেকে এসে জড়ো হয়েছে বেশ কিছু লুঙ্গি -পরা, আদুল গা পুরুষ, বাচ্চা -কাচ্চা কোলে কাঁখে মা - মেয়ে।  জটলা থেকে এগিয়ে আসে একজন মোড়ল গোছের মানুষ। খেলারাম তৎপরতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় --
' এ গাঁইয়্যের মেম্বার স্যার।আপনার আসার খপর পেয়ে ....... '
প্রতিনমস্কার জানায় পাথরডি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সদ্য নিযুক্ত ডাক্তার  সৈকত  দত্ত। 
উপস্থিত মানুষগুলোর রোদ-ঝলসানো চোখে-মুখে এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল।

              ( ২)
দিনের আলো এক, আর রাতের অন্ধকার আর এক।দুইয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক।ছোট্ট কোয়ার্টার। এক ফালি বারান্দা।সামনে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ।এখন অন্ধকারের চাদরে ঢাকা।সৌরবাতির  ক্ষীণ আলো স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বাইরে বেরোয় না।ওপাশে রাস্তায়, মাঠে , বাঁশবনের জটলায় ঘন অন্ধকার। দু-একটা ছোটখাটো দোকানে এখনো টিম টিম করে জ্বলছে কেরোসিনের কুপি।
বারান্দায় চেয়ারে বসে সৈকত জরুরি কিছু ফোন করার চেষ্টা করছিল।
ফোনের ওপারে মায়ের উৎকন্ঠা। 
' তোর কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো? জায়গাটা কেমন? লোকজন?'
' সব ঠিক আছে মা।কোন অসুবিধা হচ্ছে না।তুমি চিন্তা করো না। '
মাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে সৈকত। কিন্তু মায়েদের জীবন এমনই। সন্তানের অনিষ্ট চিন্তায়  আজীবন ভীত সন্ত্রস্ত থাকা।

এসেই ফোন করে এক প্রস্থ কথা সেরে নিয়েছে স্বাতীর সাথে। ভাবতে না ভাবতেই ফোন।
' সব ব্যবস্থা হল?'
' হ্যাঁ, মোটামুটি। '
' থাকার ঘরটা কেমন? টয়লেট?  পরিস্কার তো? '
' হ্যাঁ,চলে যাবে।' সংক্ষেপে উত্তর দেয় সৈকত।
স্বাতী থামে না।সব জানতে চায়। ইলেকট্রিসিটি আছে কিনা,বিকল্প ব্যবস্থা আছে কি না,হেল্থ সেন্টারের আশেপাশে বাড়িঘর,দোকান বাজার আছে কিনা..., ইত্যাদি হাজারে প্রশ্ন। 
সৈকত বেশিরভাগটাই এড়িয়ে যায়। পাথরডি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রকৃত অবস্থা জানালে ওর বিড়ম্বনা বাড়বে বৈ কমবে না।মোটামুটি দায়সারা উত্তর দিয়ে ম্যানেজ করে।
ওর নিজের মনেও যে টানাপোড়েন কম আছে তা তো নয়।এক নিমেষে জীবনটা কেমন বদলে যেতে বসেছে। একটু তো সময় লাগবেই। ডাক্তারি ডিগ্রি পাওয়া,কনভোকেশন, মানুষের সেবার জন্য প্রথামাফিক শপথ গ্রহণ এক, আর নিজের অভ্যস্ত জীবন ছেড়ে, ছোটোবেলা থেকে বড় হওয়া বাড়ি ছেড়ে, মাকে ছেড়ে, বন্ধুতাবৃত্তের চেনা পরিসরের  বাইরে  কোন এক  পান্ডব বর্জিত গন্ডগ্রামে হাজার প্রতিকূলতা অতিক্রম করে দরিদ্র, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত অসহায় মানুষের চিকিৎসা করা আর এক।ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত ভয়,আত্মপ্রত্যয়হীনতা, অপারগতার আশঙ্কা একযোগে গভীর জঙ্গলের এক পাল বুনো কুকুরের মতো তেড়ে আসছে সারাক্ষণ।এর থেকে কিভাবে বেরোবে সৈকত?

' ডাক্তারবাবু আপনার খাবার রেডি হইয়েঁ গেইছে।আপনি হাত মুখ ধুয়ে লিন। আমি সাভ করে দিছি'। 
হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে আধো অন্ধকারে  দাঁড়িয়ে খেলারাম। 
চিন্তা প্রবাহ থমকে যায়।খেলারামকে দেখে ভালো লাগে সৈকতের।খাবার সার্ভ করতে সম্মতি দেয় সে।

' হরেনের দোকানের রুটি চিকেন যে একঠোবার খাঁইয়েছে, সে আর কুত্থাও খেতি পারবে  নে। আপনার আগের ডাক্তারবাবু তো ঘরে রান্নার ব্যাবস্থাই করেক লাই।ওই হরেনই দিতঅ সব।' 
গরম গরম হাতরুটি আর ধোঁয়া ওঠা দেশি মুরগীর ঝোল প্লেটে সাজিয়ে দিতে দিতে বলল খেলারাম।

মানুষটা সব কাজ বেশ নিষ্ঠা সহকারে গুছিয়ে করে।বি এম ও এইচ ঠিকই বলেছিলেন ওর সম্পর্কে।  খিদে পেটে তারিয়ে তারিয়ে খেতে খেতে ভাবল সৈকত।

           (৩)

দেখতে দেখতে মাস দুয়েক কেটে গেল।এই ক'দিনেই পাথরডি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের একমাত্র ডাক্তারবাবু পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে অনেকটাই মানিয়ে নিয়েছে। এখানে প্রকৃতি বিরূপ।সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে মঞ্জুর হওয়া ওষুধ পাতি অনেক সময়েই মরুভূমির বৃষ্টিপাতের মত  মাঝপথে উধাও হয়ে যায়।ক্লিনিক্যাল টেস্টের কোন ব্যবস্থা নেই। একজনই  নার্স, তার কামাই লেগেই আছে।আশা কর্মীরা এতদিন কাজ না করাতেই অভ্যস্থ ছিল। এতকিছু প্রতিকূলতা মেনে নিয়ে পাথরডি সহ চার পাঁচটা গ্রামের মানুষগুলোর চিকিৎসা পরিষেবার দায়িত্বপ্রাপ্ত সৈকত আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে।এই গরীব-গুর্বো মানুষগুলোর সেই ই একমাত্র ভরসা।জেলা হাসপাতালে ভ্যান  বাস ট্রেন ভাড়া দিয়ে, কাজ কামাই করে চিকিৎসা করাতে যাওয়া তাদের কাছে বিলাসিতা। 
আজ পেশেন্ট একটু কম এসেছে। হারান মাহাতোর ছেলে জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে নিজের হাতে কোপ মারে।তার হাত ব্যান্ডেজ করে, টিটেনাস ইনজেকশন দেয়।ফুলমণি টুডু পোয়াতি।রুটিন চেক আপ করাতে আসে।আর ওই জ্বর- জারি, সর্দি কাশি নিয়ে জনাকয়েক খেটে খাওয়া হাড় জিরজিরে মানুষ। 
আশা কর্মী দুজনের সাথে নার্স চম্পাকলিকে পাঠিয়েছে একজন প্রেগন্যান্ট মহিলাকে দেখতে।লেবার পেইন উঠলে হয়তো আজই তাকে জেলা হাসপাতালে পাঠাতে হবে।

মাঠের শূণ্যতার দিকে তাকিয়ে ছিল সৈকত।
বিকেল গড়াতেই মেঘ জমেছে আকাশে।বাঁশবনের মাথায় থেকে থেকে  বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে মেঘের ডাক। দূরে কোথাও দু'এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। বাতাসে তারই আভাস। 
চা নিয়ে এসে পাশে দাঁড়ালো খেলারাম।
এই কদিনে এই লোকটার প্রতি এক অদ্ভুত মায়া জন্মেছে সৈকতের মনে।সামান্য ক্যাজুয়াল স্টাফ। বলার মত কোন ডেজিগনেশন নেই। দিন রাত এক করে পড়ে থাকে এখানে।ওর সাথে কথা বলতে বেশ লাগে সৈকতের। 
' আচ্ছা খেলারাম, প্রায় বছরখানেক এখানে কোন ডাক্তার ছিল না। কি  করতো মানুষগুলো? 'চায়ে চুমুক দিয়ে জিগ্যেস করে সৈকত। 
' কি আর কইরত ডাক্তারবাবু।পোথম ক'মাস মানুষগুলার শুধু কান্না চিচকার শুনলাম।মেম্বর তো রোজই বইলত, আজই ডাক্তারবাবু আইসবেক,আজই আইসবেক।গরীব মানুষগুলান আসে, আর ফিরায়ে দিই।একদিন একঠো মরদ প্যাটের যন্তনায় কাঁইদতে কাঁইদতে আসল।উওর মোচড় মারা দেইখ্যে থাইকতে লারলাম।দিলাম কপাল ঠুকে ওষুধ খাঁওয়াইয়ে।আগের ডাক্তারবাবুদের কাছে থাইকতে থাইকতে যা শিখ্যেছি।অইমত কইরলাম।মারাংবুরু মুখ তুলি চাইলেক।রুগী ভালো হঁইয়ে গ্যালো।ওই শুরু।তারপর থে ছোট খাটো অসুখ -বিসুখের ওষুধ পাতি দিতি দিতি আমি ডাক্তার হঁইয়ে গেলাম বটে। আপনারা না থাইকলে আমিই সামাল দিই।'
একটানা বলে থামল খেলারাম। 

বুঝতে অসুবিধা হল না,এই সহজ সরল, খেটে খাওয়া মানুষগুলোর কাছে খেলারামের মত কম্পাউন্ডাররা দেবতার সমান।গ্রামের প্রতিটি পরিবারের সবাইকে চেনে ও।রাত বিরেতে পেশেন্টের প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে দেয়। গরীব মানুষ ডাক্তারি ডিগ্রির মাহাত্ম্য বোঝে না।বোঝার কথাও নয়।তার সামান্য ডাক্তারি বিদ্যা দিয়ে,দিনের পর দিন সেবা দিয়ে সুশ্রুষা দিয়ে  অসহায় মানুষগুলোর আস্থা অর্জন করেছে খেলারাম। এটা ই কি কম কথা!
 
            (৪)

আকাশে ছেঁড়া মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলছিল দ্বাদশীর চাঁদ। ক'দিন পরেই পূর্ণিমা। কি একটা পরব আছে আদিবাসীদের।পাথরডি গ্রামের মেম্বার তার সাঙ্গোপাঙ্গসহ এসে ডাক্তারবাবুকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে গেছে।পরবে থাকতে হবে।খেলারাম বলছে, 'মেয়ে মরদের ছৌ লাচ হবে,ধামসা মাদল বাইজবে। গম্ভীর মুড়ার দেশে আইস্যেছেন।মুখোশ লাচ দেইখবেন লাই? যেইতেই হবেক আপনাকে।'
ঘুম নেই সৈকতের চোখে। পাথরডি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের স্বাস্থোন্নতির জন্য তার কত না পরিকল্পনা, কত না স্বপ্ন। তার প্রপোজাল জেলা সদর হয়ে স্টেট লেভেলে পৌঁছেছে।আরও একজন নার্স, একজন ডাক্তার চেয়ে আবেদন করেছে। ইতোমধ্যেই অনুমোদিত হয়েছে পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ফান্ড।কাজ শুরু হবে খুব তাড়াতাড়ি। 
ট্রান্সফারের আবেদন না করা নিয়ে বিস্তর মন কষাকষি হয়েছে স্বাতীর সাথে। সৈকত একটাই কথা বোঝাতে চেয়েছে স্বাস্থ্য কেন্দ্রটাকে একটু গুছিয়ে গাছিয়ে দিয়ে তারপর বদলির আবেদন করবে।কিন্তু স্বাতী নাছোড়বান্দা। সে এখনও পর্যন্ত দেখে যায় নি সৈকতের প্রথম কাজের জায়গা। 
ওদের সম্পর্ক এখন তলানিতে। একটা সরু সুতোর ওপর ঝুলে।এই প্রত্যন্ত গ্রামে সৈকতের  মাটি কামড়ে পড়ে থাকাটাকে  ও মেনে নিতে পারে নি।ওর চোখে সৈকত গ্রাম্য মানসিকতার আনস্মার্ট ইডিয়ট  একটা।যার জীবনে এ্যাম্বিশান নেই তাকে ও জীবন সঙ্গী করার মতো বোকামি করার কথা ভাবতেই পারে না।

চাঁদটা অনেকক্ষণ মেঘের আড়ালে চলে গেছে। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রাখে সৈকত। একটা লন্ঠনের মৃদু আলো এগিয়ে আসছে।
' ডাক্তারবাবু, আমার ছেইল্যাটাকে বাঁচান। '
একটা করুণ আর্ত চিৎকার রাতের নীরবতা ভেঙে খানখান করে দিল।
ধরমড় করে উঠে দরজা খুলল সে।  
লন্ঠনের আলোয় চোখ ছলছল এক বাবার মুখ। পাশে খেলারাম। 
সৈকত জিজ্ঞেস করে, ' কি হয়েছে আপনার ছেলের? '
' দু'দিন ধরে ধূম জ্বর।ওই পবনা জলপড়া দিয়াছেল।আইজ সনঝে থেইকে ব্যাটায় চোখ খুইলছে না।হুঁশ লাই।'বলল লোকটা কোনরকমে।
কতবার পই পই করে বুঝিয়েছে সৈকত ওসব জলপড়া তেলপড়া ঝাড়ফুঁক না করাতে।মানুষগুলো কিছুতেই শুনবে না।
' ডাক্তারবাবু চলেন একবার।টোটোর ব্যবস্থা কইরেছি।পেশেন্ট আনার অবস্থায় লাই।আপনি না গেইলে রাইত কাইটবেক লাই উয়ার', অনুনয় করে খেলারাম। 

এবড়োখেবড়ো পাথুরে মাটি পথ।টোটো চলছে তো চলছেই। পথের দুপাশে ঝুপসি আঁধার মোড়া গাছগুলোকে প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী মনে হচ্ছে। টোটোর সামান্য শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। 
নিজের বাবার কথা মনে পড়ল সৈকতের।সামান্য চাকরি করতেন।নিজের যা কিছু উজার করে দিয়ে ছেলেকে ডাক্তারি পড়ালেন।অথচ ছেলের  ডাক্তারি পাশ করা দেখতে পারলেন না। আজকের এই রাতে দরিদ্র অসহায় মানুষের ডাকে সারা দিয়ে মরণাপন্ন ছেলেটাকে চিকিৎসা করতে যাওয়ার কথা জেনে মায়ের পরে সবচেয়ে খুশি হতেন তার বাবা।হঠাৎ করে বিনা নোটিশে  না- ফেরার দেশে চলে যাওয়া তার বাবা।

মাটির দাওয়ায় শোয়ানো ছেলেটা। কোন সাড় নেই। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। একপাশে তার মা সমানে কাঁদছে।কেরোসিন কুপির আলোয় উদ্ভাসিত দুই ছোট ছোট ভাই বোনের ভয়ার্ত, আতঙ্কিত মুখ। ঠায় বসে দাদাকে ছুঁয়ে।

সৈকতের জিদ চেপে গেল।মৃত্যুদূতের হাতের মুঠো থেকে ছিনিয়ে আনবে ও ছেলেটার প্রাণ।চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখবে না। আজ যেন ওর জীবনের কঠিনতম পরীক্ষা। 
সৈকতের অদম্য জিদ,হার -না-মানা মনোভাব, অন্তরের তাগিদ ছেলেটাকে মৃত্যুখাদের কিনারা থেকে ফিরিয়ে আনল।
পুবের আকাশ তখন ফিকে হয়ে এসেছে।

          (৫)
জাগতিক নিয়মে বহমান সময়ধারা।তার কোন পিছুটান নেই। থামা নেই। দেখতে দেখতে সৈকত এক বছর কাটিয়ে ফেলল পাথরডি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে।
তার অক্লান্ত পরিশ্রমে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভোল অনেকটাই বদলেছে। সপ্তাহে তিনদিন করে আসেন ডা. তাপস মুখার্জি। বরাদ্দ হয়েছে আর একজন সর্বক্ষণের নার্স,আরও চারজন আশা কর্মী। মেডিসিন সাপ্লাই আগের চেয়ে অনেক ভাল।ধারে ভারে জেলার কোন স্বাস্থ্য কেন্দ্র পাথরডির ধারে কাছে নেই। এখন রোগী আসে বাঘমুন্ডি ছাড়িয়ে আরও প্রত্যন্ত গ্রামগুলো থেকে।ক'দিন আগেও সামান্য অসুখেও সঠিক চিকিৎসার অভাবে বেঘোরে প্রাণ যেত এখানকার মানুষগুলোর।শেকড়বাকড়, ঝাড়ফোঁক, ওঝা,গুনিনের চক্কর থেকে এখানকার মানুষ বেরিয়ে আসতে শিখেছে। 
সৈকত নিজেকে শুধু স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিসরের আটকে রাখে নি নিজেকে।তার ছায়াসঙ্গী খেলারামকে নিয়ে ক্রিটিকাল কন্ডিশনের পেশেন্টকে বাড়িতে গিয়ে দেখে আসে।সহকর্মীদের নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় এ্যাওয়ারনেস ক্যাম্পেন করে।তাতে সাড়া মিলেছে দারুণ। 
সম্প্রতি স্বয়ং ডি এম নতুন ভবন উদ্বোধনে এসে ডা. সৈকত দত্তের এই কর্মোদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করে গেছেন।
স্বপ্ন এমনই। বাস্তবতার ছোঁয়া পেলেই মানুষকে নেশাতুর করে তোলে।নেশাগ্রস্ত মানুষের মতোই সবকিছু ভুলে একবগ্গা হয়ে যায় স্বপ্নদর্শী মানুষ। 
ডা. সৈকত দত্তের অবস্থাও তাই হয়েছে। হতদরিদ্র কোন মুমূর্ষু রোগীর মুখে এক চিলতে হাসি দেখার নেশা যে কতখানি মারাত্মক তা তার জানা ছিল না।
এত কিছু সত্ত্বেও তার অন্য এক সত্তা তাকে প্রতিনিয়ত ধমক দেয়।শাসন করে।তাকে এই অজপাড়াগাঁ থেকে টেনে বের করার চেষ্টা করে।দ্বিধা দ্বন্দ্বের টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে সৈকত।ভেতরে ভেতরে কাটাছেঁড়া চলতে থাকে নিরন্তর। 
' ডাক্তারবাবু চা খাবেন ত? সনঝে হতি এলঅ।বইস্যে বইস্যে ঘুমোয় গেইছেন বলে ডাকি লাই।সারাদিন এত্ব খাটনি খাটেন! মায়া লাইগলো ডাক্তারবাবু ', হাতে চায়ের কাপ প্লেট নিয়ে বলল খেলারাম। 
সত্যিই তো। একটু ঝিমুনি এসে গেছিল।নিজের চেম্বারে একা এইসব ভাবতে ভাবতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল সৈকত। অদ্ভুত এক ঘোর লাগা চোখে খেলারামের দিকে অপলক চেয়ে থাকল সৈকত। খেলারামও কিছুটা অবাক।এমন চাহনি তো কোনদিন দেখে নি ডাক্তারবাবুর।তবে পোড়খাওয়া মানুষটা মানুষের মন পড়তে ভুল করে না।সাহস করে জিগ্যেস করে,' ডাক্তারবাবু আমার একঠো কথা শুনেন।ক'দিন ছুটি লিয়ে বাড়ি থেইক্যে ঘুরি আইসেন।আর এবার মাকে পাকাপাকি লিয়ে আইসেন। কোয়ার্টার তো বড় হঁইছ্যে। থাকার অসুবিধা হবেক লাই।'
চায়ে চুমুক দিয়ে নম্র উচ্চারণে বলল সৈকত,' আচ্ছা খেলারাম,যদি আমি এবার বিদায় নিই তোমাদের কাছ থেকে '?
খেলারামের কাছে একথা নতুন নয়।এর আগে কোন ডাক্তারই এক বছরের বেশি টেকে নি।এইই তো দেখে আসছে।
' থাকার ঝন্যি ত কেউ আইস্যে না ডাক্তারবাবু। আপনিই বা থাইকবেন কেনে! পাথরডির মাইনষের কইলজায় অত জোর লাই যে আপনাকে আইটকে রাইখবেক'।
খেলারামের গলা ধরে আসে।কথা হোঁচট খায়।
একটু থেমে আবার বলে,' একঠো কথা শুনেন। আপনার সামনে পুন্নিমার চান্দের পারা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছেক।এই অজপাড়াগাঁইয়্যে আপনাকে আর মানাবেক লাই।আমরা গরীব গুর্বো মানুষ। আমাদের বাঁচা মরায় কিছু আইসবে যাবেক লাই।আপনার জীবন অন্যেক দামী বটে।আপনি অন্যেক বড় ডাক্তার হবেন একদিন। অন্যেক নাম ডাক হবে।টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ি হবেক।ইখানে সারাজীবন থাইকলে উসব কিছুই হবেক লাই। আপনি চইল্যে যান।'
আর কিছু বলতে পারে না পাথরডি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের অস্থায়ী কম্পাউন্ডার খেলারাম।তার দু'চোখের কোণ চিকচিক করে। কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়।অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সে।

সন্ধ্যা নামতে না নামতেই দূরের বাঁশবনের মাথায় তামার থালার মত চাঁদ উঠলো।আজ বোধ হয় পূর্ণিমা। হঠাৎ আলোর আভায় ভ'রে গেল স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চত্বর।কৃষ্ণচূড়া গাছটার এবার খুব বাড়বাড়ন্ত। ফুলে ফুলে একাকার।চাঁদের মিহি আলো আলতো করে পিছলে যেতে লাগল লাল টুকটুকে ফুলে ঢাকা কৃষ্ণচূড়ার শাখায় শাখায়।  কতগুলো ডাহুক বাঁশবন থেকে  সমস্বরে ডেকে উঠে স্বাগত জানালো জ্যোৎস্না স্নাত সন্ধ্যাকে।বেশ সুন্দর বাতাস বইছে আজ।
একটু পরে সারাদিন গায়ে গতরে খাটা বেশির ভাগ গরীব মানুষ ঘুমিয়ে পড়বে।
কেউ হয়তো চন্দ্রতাড়িত হয়ে আড়বাঁশির সুর ভাসিয়ে দেবে বোশেখ মাসের রাতচরা বাতাসে।

ট্রান্সফার অর্ডারটা খাম থেকে বের করে ছিঁড়ে ফেলল পাথরডি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তার সৈকত দত্ত। 

দূরে কোথাও মাদল বেজে উঠল দ্রিদিম দিম.... দ্রিমদ্রিম... দ্রিদিমদিম...দিমদিম....




মন্তব্যসমূহ

  1. খুব ভাল লাগলো

    উত্তরমুছুন
  2. অসাধারণ লিখেছেন। খুব ভালো লাগল

    উত্তরমুছুন
  3. ভীষণ ভালো লিখেছেন

    উত্তরমুছুন
  4. পড়লাম। খুব ভালো লাগল।
    পৃথা চট্টোপাধ্যায়

    উত্তরমুছুন
  5. খুব ভালো লাগলো ৷

    উত্তরমুছুন
  6. ভালো লাগল শুধু স্বাতীরা চিরকাল গ্রামে যাওয়া সৎ ছেলেদের মেনে নিতে পারেনা এটাই একটু কষ্ট দিল। অন্য রকম যদি স্বাতীরা হত ভালো হত। গল্প খুব সুন্দর। সদ্য দেখা ডাকঘর মনে পড়ে যাচ্ছিল।

    উত্তরমুছুন
  7. অসাধারণ বুনন।সৈকত ডাক্তারের প্রেমে পরে গেলাম। যদি সত্যিই এমন হয়!

    উত্তরমুছুন
  8. খুব ভালো লিখেছেন। ভালো লাগলো।
    - রাজদীপ ভট্টাচার্য

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য