শমিত মণ্ডল
কবি রমেন্দ্রকুমার ও তাঁর কবিতা
নিজের কবিতার জন্য নিজের তৈরি ভাষা ব্যবহার
করলেন তিনি। এখনও তা আধুনিক।
জন্মের একশ বছর পার করলেন কবি রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী (১৯২২--- ২০০৯)। তাঁর কবিতার মুগ্ধ পাঠক আমরা। আমরা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি, কিন্তু খুব কাছে যেতে পারিনি,সসম্ভ্রম দূরত্ব বজায় রেখেছি বরাবর।কবিখ্যাতি তো ছিলই, তারচেয়ে বেশি ছিল তাঁকে নিয়ে গল্পকথা। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার বাড়ির ছেলে,অকৃতদার,অভিজাত
উচ্চশিক্ষিত অধ্যাপক। তাঁর বাড়িতে গেলেই হুট করে তাঁর দেখা পাওয়া যাবে না। ধোপদুরস্ত পোশাকে সজ্জিত হয়ে তবে তিনি দর্শনার্থীদের কাছে আসবেন।
কিংবদন্তীর মায়াঘোর সরিয়ে এবারে আমরা তাঁর কবিতার দিকে নজর ঘোরাই। তাঁর কবিতার কাছাকাছি আসি তবে।
রমেন্দ্রকুমারের কবিতার নিবিড় পাঠের পরে পাঠকের
অনুভব হবে তিনি একজন প্রজ্ঞা-অনুশাসিত কবির কবিতা পাঠ করলেন। তাঁর বহু-পঠনের অভিজ্ঞতার
ছায়াপাত অনেক কবিতাতেই আছে।ফলে, কবিতার
অন্তর্সত্যের কাছে পাঠককে পৌঁছতে হলে কবির সমস্তরে উঠতেই হবে তাকে। বাইরের দরজা তারপরে
অন্দরের দরজা--- কবিতার অন্তর্ভুবনে তো এভাবেই প্রবেশ করতে হয়।
"শ্যামখ্রীষ্টান বাগানে বসে আছি।
হাতে অজগর-রত্ন,কুইলার-কুচ,
মহীয়সী কাব্য সংকলন, হঠাৎ সুদূর হিম মধ্যযুগ
যেন ঘুমে গান গেয়ে ওঠে,আমি স্পষ্ট শুনলুম:
তেরো শতকের উষ্ণ আনন্দফোয়ারা---"
( কবিতা--- শ্যাম খ্রীষ্টান)।
গ্রন্থ শেষে, তাঁর স্বহস্তে রচিত শব্দকোষে 'শ্যামখ্রীষ্টান' ও
'কুইলার-কুচ' শব্দবন্ধের ব্যাখ্যা লিখেছেন। কিন্তু একই
কবিতার অন্য দুরূহ শব্দের ব্যাখ্যা লেখেননি।'ট্রেমলো'
কী, কিংবা 'ডুপ্লে' কে ছিলেন--- তা খুঁজে নিতে হবে পাঠককেই।হয়তো পাঠককে এতদূর পর্যন্ত শিক্ষিত ভাবেন তিনি। এই প্রসঙ্গে বিষ্ণু দের কবিতার বিদেশি অনুষঙ্গের কথা মনে পড়বে পাঠকের।
রমেন্দ্রকুমার ছিলেন সমাজ-দ্রষ্টা। সময় ও সমাজকে অস্বীকার করে তিনি কবিতা লেখেননি। সমসময়ের
অবক্ষয় ও মূল্যবোধের অবনমন কে তিনি কবিতায়
নিয়ে এসেছেন। কৌতুক,শ্লেষ,ব্যঙ্গ-কটাক্ষের তির্যকতায়
ভর করে এ জাতীয় কবিতাগুলি নতুন এক দ্যোতনা সৃষ্টি
করেছে।
"শখের গোয়েন্দা পিছু নিই, গুপ্তকথা হর্ন,চোখ
সব শোনে: তুমি যাও বেশ্যাবাড়িতে,
মাথা সিধে করে যাও, ঘরের বউটিও যায়, কালো
চাদর জড়িয়ে গায়ে,পাতালের টাঁকশালে মরমী উল্লাসে,
টালিগঞ্জে,কে বানাও দুই হাতে জ্যোতির্ময় জাল
রাশি রাশি টাকা, অন্ধকারে কারা ওয়াগন ভেঙে দূর শহরতলিতে
সরাচ্ছে লুটের মাল, সিংহাসনগুণ্ডা, শান্ত মানুষের ভয়,"
(কবিতা--অ্যাসট্রল বডি)।
এই নাগরিক অবক্ষয়ের বিপরীতে গ্রামীণ মানুষগুলির
কাছে যাই।কেমন আছে তারা? কী তাদের বক্তব্য?তারাও তো এই সমাজের,এই সময়ের অংশীভূত!
"রোদেজলে শীতগ্রীষ্মে হেমন্তে বর্ষায়,
আউস আমন বোরো খারিফ বা রবিশস্য, শুধু
এটুকুই বেশ জানি।পান্তা,নুন,লঙ্কা ও পেঁয়াজ,
ভালো খাই।তবে,রায়,দুই সাঁঝ চলে না সবদিন---
আগে বস্তুটাই পাকা হোক, বাবু। মাথার উপরে,
গোলপাতা,খড়ের ছাউনি,প্রতি শাওনেই ভিজি সপসপে,
আর বছরে দুখানা চট,তার নাম বস্ত্র, মানুষ যখন,
পা থেকে কোমর অব্দি ঢাকতে হবেই।নইলে তো,ছি!
আপনাদেরই লাজ,কর্তা। ঠিক কিনা?একটু আগুন হবে?
দু-চারটে সুখটান দিই।
(কবিতা---একটি শব্দের হাতে)।
সমাজবীক্ষণের এই জীবন্ত ভাষার কাছে মুগ্ধতা নিয়ে আমাদের দুদণ্ড দাঁড়াতেই হয়!
রমেন্দ্রকুমারের কবিতায় নারীর অবস্থান কেমন? নারীর ব্যক্তিস্বরূপকে কীভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন তিনি?এই পুরুষপ্রধান সমাজে নারীর স্বতন্ত্র স্বর কি শোনা যায় তাঁর কবিতায়?
রমেন্দ্রকুমার সমাজসচেতন অনুভূতিপ্রবণকবি,তাই
নারীর প্রতি পুরুষের অত্যাচারে বিষণ্ণ হয়েছেন।এ সমাজে প্রচলিত এক অপরাধ হল নারীহত্যা, বধূহত্যা।নানান দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমে আমরা এখন সহজেই এই সমস্ত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে অতিদ্রুত অবহিত হই।আগে যখন মিডিয়া কিংবা প্রচার মাধ্যম এতটা সক্রিয় ছিল না, তখনও তো অপরাধ সংঘটিত হতো, কিন্তু তা আড়ালেই থাকতো। রমেন্দ্রকুমারের মতো অনুভবী কবি তাঁর কবিতার মধ্যে দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
"রক্তাপ্লুত যে-দেহের খণ্ডগুলি, সমস্ত আর্তি,
পুন্নাগ গাছের নীচে পুঁতে দিয়ে এলে---
তার কাছে আসনপিঁড়ি হয়ে একবার বোসো,ক্ষমা চাও,
নইলে তাও সঞ্জীব নরকে---
তুমি মানুষ তো।"
(কবিতা---বাছুর)।
অন্য একটি কবিতায় নারীহত্যার ভয়াবহ প্রচলিত ছবি--
"গোলমোহর গাছ থেকে পাতা ঝরে, খাপছাড়া পাতা:
সিঁদুররঞ্জিত খড়্গ,গোলমোহর নয়।
বৌপোড়ার গন্ধ ভাসে, পাও?বেডরুমে।"
(কবিতা---পোড়া জল)।
আবার, ভারতবর্ষের আর একটি জ্বলন্ত সমস্যা, ডাইনি
অপবাদ দিয়ে নারীহত্যার কথাও লিখেছেন কবিতায়---
"যে ভারতে
ডাইনি পোড়ায় আজও,
এ অলীক মাথাব্যথা ত্রিশোর্ধের এই উজ্জ্বলতাবাদ
সাজে কি আমাকে?"
পুরুষের ভোগ্যপণ্যের জন্যই নারীর সৃষ্টি--পুরুষকেন্দ্রিক এ সমাজের মনোগঠনই যেন এরকম। নারী যেন উৎকৃষ্ট
এক খাদ্য মাত্র।
"অদ্ভুত মানুষ?বলছো তো! তুমিও কি কম অদ্ভুত?
টাকা খাও,মদ খাও,গপাগপ মেয়ে খাও তুমি!"
(কবিতা--- জীবন চরিত)।
রমেন্দ্রকুমারের মতো সংবেদী কবির কবিতার মধ্যে
নারী-অবমাননার প্রতিবাদ ধ্বনিত হবে ,তা স্বাভাবিক।
তবে এই প্রতিবাদ কখনোই উচ্চকিত হয়ে ওঠেনি। তাঁর কবিতার নারীরা তাদের জীবন-যুদ্ধ,আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বাঙ্ময় হয়েছে।এই সমস্ত নারীদের অবস্থান সমাজের বিভিন্ন স্তরে।'পাউলি' কবিতাটি এরকমই এক সাধারণ অথচ
আত্মসংগ্রামী দৃঢ়চেতা নারীর আত্মউন্মীলনের কাহিনি।
পাউলি--- একটি ফুলকাঁসার ঘটি।এই ঘটি আর দাস বাড়ির ন-বছরের বউকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে এ কবিতা।দেশত্যাগের কষ্টজ্বালার কথাও আছে। জ্ঞাতিদের বাড়িতে ঠাঁই নাই বা হলো, পোড়োবাড়িতে
আশ্রয় নিয়ে শুরু হলো জীবনসংগ্রাম।
"ইতস্তত পোড়োবাড়ি,অঢেল বসত জমি পড়ে আছে
ভূস্বামীর চিহ্ন নেই,পলাতক তারা,
শহরে কি?আর দৈবে গৃহস্থেরা, আমাদেরই মতো,
বাস্তুহীন? হয়তো বা।বসুবৃষ্টিকরী মাতা! আমরা দশঘর,
সেখানেই বসে পড়ি।হাতের মুঠোয় যার মাটি,
কে ওঠায় তাকে?"
'সামন্ত্রতান্ত্রিক' কবিতার মধ্যেও শ্রমজীবী এক নারীর
দিনাতিপাতের লড়াই।"মাছ নিয়ে রাস্তার কিনারে বসে,
বেচুনি সে শ্রাবণ ও ভাদ্র পূর্ণিমায়/ রাখী বেঁধে পাড়ায় পাড়ায়, কিছু অর্থপ্রাপ্তি ঘটতে।"এরা শ্রমজীবী প্রান্তিক
নারী।এদের জীবনচর্যায় কোনো আত্ম-সংকোচ নেই।
কিন্তু উচ্চ কোটির নারীদের ক্ষেত্রে এরকম কোনো খোলামেলা আবহাওয়া নেই। শাস্ত্র-নির্দেশিত কঠোরতার
মধ্যে তাদের দিনযাপন।হিন্দুধর্মের আবদ্ধতার, কঠোর অনুশাসনের টুকরো ছবি ধরা আছে 'রাঙী' কবিতার মধ্যে।
রমেন্দ্রকুমার শব্দ-কুশলী কবি। নতুন,অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহারে তার কবিতা ঝকমক করে ওঠে। বাংলা ভাষার
প্রাচীন চিরায়ত(ক্লাসিক) গ্রন্থগুলি তিনি খুঁটিয়ে পড়েছেন।ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে ওই ভাষা বা অন্য ভাষা থেকে অনূদিত সাহিত্যও তিনি গভীর ভাবে অধ্যয়ন করেছেন।এই প্রজ্ঞানপরিধিকে ধারণ করে আছে তাঁর কবিতা। কখনো কখনো মনে হয়
এই প্রজ্ঞাচিহ্ন যেন তাঁর কোনো কোনো কবিতার স্বাভাবিক গতিকে রূদ্ধ করেছে।
রমেন্দ্রকুমারের কবিতার যে দিকটি এখনও নতুনতর
বলে মনে হয় তা হল তাঁর কবিতার পরীক্ষা-প্রবণতা।
আমাদের কথা-বলার অতি প্রচলিত ভাষা তাঁর কবিতায়
জায়গা করে নিল। অনায়াস এ ব্যবহার। কখনও কাহিনি ধর্মী দীর্ঘ কবিতা। সেখানেও কাহিনি ক্রম-অনুসারী নয়।উল্লম্ফন রীতি লক্ষ করা যায়। কবিতার মধ্যে
একজন বক্তার অনুপ্রবেশ।এই বক্তাকে কবি বলে মনে
হলেও তিনি কবি নন। পাঠকের সঙ্গে এ-ও এক বুদ্ধি-
চাতুর্যের খেলা বইকি! রমেন্দ্রকুমার নিজেই এ বিষয়ে তাঁর পাঠকদের অবহিত করেছেন।
"কবিতা একটি কল্পকাহিনী।তার কথক উত্তমপুরুষ হলেও তাকে কবির সঙ্গে একাত্ম করলে ভুল হবে। অনভিজ্ঞ পাঠক কিন্তু সহজেই এই ভ্রমে পড়েন। এই
কথক ---আধুনিক সমালোচনার ভাষায় পার্সোনা বা মুখোশ--- কবিতার শিল্পিক প্রয়োজনে,একটি বিশেষ অবস্থায় ভূমিকা গ্রহণের জন্য, উদ্ভাবিত কাল্পনিক চরিত্র।"
রমেন্দ্রকুমারের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'আরশিনগর' (১৯৬১)
প্রকাশিত হয়েছিল 'কৃত্তিবাস' থেকে।তবু তিনি কৃত্তিবাসের কবি নন। সম্পূর্ণ নিজস্ব এক কাব্যভাষা
তিনি আয়ত্ত করেছিলেন।মেধা আর মনস্বিতা এই
কাব্যভাষাকে আরও শক্তিশালী করেছিল।না, রমেন্দ্রকুমার অনুসারী কোনো কবিসমাজ গড়ে ওঠেনি।
সম্ভবও নয় তা। তিনি কিছুমাত্র পাঠকের নিবিষ্টতার
মধ্যে বেঁচে থাকবেন।বাংলা কবিতার জগতে এই তাঁর সম্মানিত পুরস্কার!
রমেন্দ্রকুমার পরীক্ষাপ্রবণ শব্দকুশলী কবি। গভীরে ঢোকার চেষ্টা করি। সবসময় পারি না। আমার দৈন্যতা। আপনার লেখাটি ভালো লাগলো। শুভেচ্ছা শমিত দা।
উত্তরমুছুন-- রাজদীপ ভট্টাচার্য