সোমা কুশারী
আর মাস তিনেক। সুব্রত একটু গুছিয়ে নিলেই অনন্যা আর বাবিকে নিয়ে যাবে। গদাধর, প্ল্যাস্টিকের ঝাটা দিয়ে বিছানাটা ভালো করে ঝাড়বেন ভেবেও বার বার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন। প্রতিমা হসপিটালে যাওয়ার দিন থেকেই একতলার এই ছোট্ট ঘরটায় আশ্রয় নিয়েছিলেন গদাধর, তখন অবশ্য ব্যবস্থাটা সাময়িক মনে হয়েছিল। অবশ্য, সেটাই তখন স্বাভাবিক। একটা মানুষ সামান্য জ্বরজারি নিয়ে হসপিটালে ভর্তি হলো দু-চারদিন পর সুস্থ হয়ে ফিরলো এমনটাই তো হওয়া উচিত ছিল? কিন্ত কৈ আর তেমনটা হলো?
টিভির টেবিলে জল ভর্তি বোতলটা রয়েছে, শোওয়ার আগে নিয়মিত দুটো ওষুধ খেতে হয়। একটা মাইল্ড ডোসের ঘুমের অন্যটা স্ট্রেস রিলিফের। এক একদিন কী করে যেন তাও ভুল হয়ে যায়! তখন, অনেক রাত অবধি বিছানায় ছটফট করতে করতে ভোরের দিকে হয়ত একটু চোখ লেগে আসে। তাও ঐ খানিকক্ষণ! ভোরে ওঠার অভ্যেসটা আজ বহু কালের। পাঁচটার ঘরে ঘড়ির কাঁটা পৌছতে না পৌঁছতেই বিছানা ছেড়ে উঠতেই হবে। প্রতিমা বিয়ের পর পর খুব গজগজ করত...
-এই যে তুমি সাতসকালে উঠছো এতে করে আমাকেও যে উঠে পড়তে হয় বোঝো ব্যাপারটা?
-ও তো আমার অভ্যাস! তা তুমি শুধু শুধু উঠতে যাচ্ছ কেন?
ম্যাক্সির উপর শাড়ি জড়াতে জড়াতে প্রতিমা বলে চলতো...
-হ্যা তুমি উঠে বাইরে যাও আর তোমার মা সেটা দেখে ছ্যাড় ছ্যাড় করে কথা শোনাক!
মায়ের সাথে প্রতিমার সম্পর্কটা আজন্ম সাপে নেউলেই থেকে গেল! প্রতিমা এই যে আজ বছর দুয়েক নেই বুড়ি সে খবরটা কিছুতেই বিশ্বাস করে না! শুয়ে শুয়েই দুবেলার আয়ার কাছে বড়বৌয়ের গুষ্ঠি উদ্ধার করে! অনু এ বাড়ি এলে ওসব শুনলেই একগাদা অভিযোগ নিয়ে বসে,
-তুমি কিছু বলবে না বাপি? ঠাম্মাকে দেখেছ? এই এতগুলো বছর কেটে গেল এখনো মাকে নিয়ে যা নয় তাই বলে চলেছে! রাতের আয়া মেয়েটা বলছিল, ঠাম্মা নাকি ওকে বলেছে
-মা-ই ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে ওর ফিমার বোন ভেঙে দিয়েছে!
গদাধর চুপ করে আছেন দেখে অনু আরো চ্যাঁচ্যায়,
-তোমার এসব শুনতে ভালো লাগে বোধহয়! আমার লাগে না! বাইরের দুটো মহিলা কী ভাবছে বলোতো মৃত মানুষটাকে নিয়ে! ছোটো কাকিমা যে সারাদিনে একটিবারও উঁকি মেরে দেখে না তা নিয়ে কোনো প্রবলেম নেই ওনার শুধু মাকে নিয়েই যত কথা!
গদাধর সবটাই জানে, কিন্তু কী-ই বা করার আছে তার! বেভুল অসুস্থ এ্যলঝাইমার্স আক্রান্ত মাকে টান মেরে রাস্তায় তো ফেলে দিতে পারে না! ছোটো ভাই জগন্নাথ এ দিক থেকে বরাবর সরেস। মায়ের দেখাশোনার জন্যে টাকা দিয়েই খালাস। একবাড়িতে থেকেও মায়ের আয়ার ঝামেলা ওষুধপত্রের সাতসতেরো নিয়ে মাথা ঘামায় না! এই তো বছরে নিয়ম করে দু-দুবার সস্ত্রীক বেড়াতে যায় মাকে তখন কার ভরসায় রেখে যায়? অনু বলে কার আবার? জানে তো, রামচন্দ্র দাদাটি আছেন মাতৃসেবার জন্যে। গদাধর সত্যিই বাড়ি ছেড়ে নড়তে পারে না! আয়া যতই থাকুক মায়ের হাজারো প্রয়োজন তো মাইনে করা কাজের লোক দিয়ে হয় না! গদাধর হিসেব করে দেখেছেন সেই কোন ছোটোবেলা থেকেই মুখ বুজে সাংসারিক কর্তব্য করে যাওয়াই যেন তার ভবিতব্য। তিন দিদির পর গদাধর জন্মেছিল বলে কিনা কে জানে বাবা সব কাজ ছোটো থেকে গদাইকে হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন। দিদিদের পর পর যখন বিয়ে হয় তখন গদাধর স্কুলের নিচু ক্লাসের ছাত্র। অথচ, লোকলৌকিকতা থেকে দেনাপাওনা দিদিদের শ্বশুরবাড়ির যে কোনো সমস্যায় গদাধরকেই বুক দিয়ে পড়তে হয়েছে। মনে আছে পরপর তিনটে মেয়ে হওয়ায় বড়জামাইবাবু যখন একরকম বড়দিকে খেদিয়ে দিয়েছিল গদাই - ই জামাইবাবুর হাতে পায়ে ধরে সব সামলে ছিলেন। বড়দি অবশ্য সে কথা নিয়ে এখনো ঠেস মারে,
-আমার বড়ভাই ভেবেছিল তিন তিনটে মেয়ে সুদ্ধ দিদি যদি চিরকালের মতো ঘাড়ে এসে পরে তাই সাত তাড়াতাড়ি গেছিল জামাইবাবুর পায়ে ধরতে!
মেজদি অবশ্য কিছুটা হলেও গদাধরকে বোঝে, মেজ জামাইবাবুর রেফারেন্সেই ইউ ডি-র চাকরি! তবে ঐ চাকরির সুবাদেই মেজদির সামনে কেমন মাথা নিচু করে থাকতে হয়! প্রতিমা বরাবর এ নিয়ে ব্যাঁকা কথা বলতো!
-তোমার মেজদির অহংকার কম নাকি? ঐ যে নিজের বর বড়ভাইকে হাতে ধরে চাকরিতে ঢুকিয়েছে সেই গর্বে এক্কেবারে মাটিতে পা পড়ে না!
-কী যা তা বকো! মেজদির আবার কবে গর্ব দেখলে? অনুকে কত ভালোবাসে...আর তোমাকেও তো কাজে কর্মে সবসময় ডাক খোঁজ করে।
-ওসব গতরের আদর বুঝলে! জানে বড়বৌ হাঁড়ি ঠেলতে ওস্তাদ তাই প্রতিবার লক্ষ্মীপুজোয় ভোগ রাঁধতে ডেকে পাঠায়।
ছোড়দিদের সাথেই একমাত্র যোগাযোগটা ক্ষীন হয়ে গেছে। হবে নাই বা কেন? বিয়ের পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তিন্নির জন্ম আর ঠিক তার দশদিনের মাথায় ছোড়দি... জামাইবাবু বছর ঘুরতেই আবার বিয়ে করল। তবুও গদাধর পুজো পার্বনে ফোন টোন করেন। তিন্নির বিয়েতেও সাধ্যমতো সোনার গহনা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন।জগন্নাথ অবশ্য এক পয়সাও ঠেকায়নি। মাও খুব একটা উদ্যোগ দেখায়নি। তবু, গদাধর পারেননি। ছোড়দির চিহ্ন তো ঐ ঐটুকুই ! তার বিয়েতে মামা হয়ে দাঁড়াবেন না? অবশ্য, অনুর বিয়েতে ছোটো জামাইবাবু আসেননি। প্রতিমা বলেছিল,
-দেওয়ার ভয়ে আসেনি বুঝলে! সবাই কী তোমার মতো হাবা? কোনোকালে সম্পর্ক রাখে না উনি চললেন ভাগ্নির বিয়েতে গয়না গড়িয়ে মামাত্ব দেখাতে!
রাত বাড়লেই আজকাল পুরোনো কথার ঝুড়ি আজার করে বসতে ইচ্ছে করে। সেই যে পাঁচ ভাই বোনের ভিড়ে একাকার ছোটোবেলা...মামার বাড়ি চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর ধুম... শীতের দিনে মাঝদিয়ায় গ্রামের বাড়িতে ভোর ভোর রস জ্বাল দিচ্ছে ঠাকুমা... গরম গুড়ের সাথে ঘরে ভাজা মুড়ি... খেতের মটরসুটি ছিঁড়ে খাওয়া... কাকার সাথে পুকুরে ডুব সাঁতার শেখা... আর একদিন সাঁতার দিতে গিয়েই আচমকা জলে ডুবতে বসা... উফ! এখনো ভাবলে কেমন দম আটকে আসে। মা যদি সেদিন না দেখতো! মনে আছে, বিয়ের পর পুরী যাওয়া ঠিক হতেই মা ঘ্যান ঘ্যান শুরু করেছিল,
-বড়বৌমা অরে জলে নামতে দিবা না খবরদার!
না! মায়ের কথা রাখতে পারেনি মায়ের গদাই।বলা ভালো প্রতিমাই রাখতে দেয়নি! সেই যে মাথার দিব্যি দিয়েছিল সমুদ্রে না নামলে কখনো ছুঁতে দেবে না! ভেসে গেছিলেন গদাধর। নতুন বিয়ে করা বৌ বলে নাকি ছুঁতে দেবে না? হয় কখনো? আজ মনে হয়, ইচ্ছে করেই বোধহয় প্রতিমা সমুদ্র স্নানের ছবি তুলিয়েছিল ভাড়া করা ফটোগ্রাফারকে দিয়ে। তারপর মাকে দেখিয়ে... মা মুখে কিছু বলেনি। শুধু গদাধরকে ডেকে বুকে মাথায় হাত বুলিয়েছিল কিছুক্ষণ, বিড়বিড় করে বলেছিল,
-তর আগে দুই দুইখান পোলারে হারাইছি গদাই... তাই বড় ডর পাইরে বাপধন!
বাবির জন্যে আজকাল অমন অকারণ চিন্তা হয় নিজের! মেয়ে বলে,
-তুমি কী দারুণ ভিতু হয়ে যাচ্ছো বাপি! শুধু শুধু বাবিকে নিয়ে আবোল তাবোল টেনশন করো!
গদাধর বোঝাতে পারেন না কী এক আশ্চর্য মায়া ঘিরে থাকে গাছের শেকড়ে। যত গাছ মাথা চাড়া দেয় টান তত বাড়ে। এই যে বাবিকে নিয়ে পুনেতে চলে যাবে অনু, সুব্রত-র তো সারাদিন অফিসেই কাটাবে... একা মেয়েটা ঐ দুরন্ত বাচ্চা নিয়ে কী যে করবে! ভাবলেই কেমন আতঙ্ক হয়। তবে কী আরেকবার ভেবে দেখবেন ওদের প্রস্তাব! সুব্রত তো যাওয়ার আগে বার বার বলেছে...
-আপনি আমাদের সঙ্গে গেলে বড্ড ভালো হয়! অন্তত বছর দুয়েকের আগে আমার এদিকে ফেরার কোনো চ্যান্স নেই! আপনি এই সময়টা আমাদের সাথে থাকলে সত্যিই নিশ্চিন্ত হতাম।
অনু ঝাঁঝিয়ে উঠেছে,
-তুমি জানো না বাবার মাতৃদায়! মেয়ে আর নাতির যা হোক হোক মাকে ফেলে রেখে উনি কোথাও নড়বেন না!
অনু কোনোদিন-ই ঠাকুমাকে সহ্য করতে পারেনা। সে কী প্রতিমার শাশুড়ির প্রতি বিদ্বেষের জন্যে নাকি মায়ের ঐ গদাধরকে আঁকড়ে রাখার জন্যে... ঠিক হিসেব মেলাতে পারেন না গদাধর। শুধু টুকরো টুকরো ছবি ভেসে ওঠে, অনুর পাঁচবছরের জন্মদিনে এই এত্তবড় কেক এনেছিলেন নিজে। বেশ কয়েকজন নিমন্ত্রীতও এসেছিল। মা সবার সামনে বলে বসেছিল,
-মাইয়্যা মানসের আবার জন্মদিন! আমাগো মা ঠাহুমারা কইতো পায়েস টুহুও মাইয়্যা রে দিতি নাই... যমের অরুচি মাইয়্যা তার আবার ঢং-এ কমতি নাই!
প্রতিমা বড্ড কেঁদেছিল। গদাধর ও কষ্ট পেয়েছিলেন খুব। কিন্ত মাকে কিছু বলে উঠতে পারেননি। এই মা-ই অনুর বিয়ে দেওয়ার জন্যে মেয়েটা কলেজে উঠতে না উঠতেই উঠে পড়ে লেগেছিল। রোজ কানের মাথা খেয়ে ফেলত নাতনির বিয়ে বিয়ে করে। একরকম মায়ের তাগাদাতেই এম এ পড়তে পড়তে অনুর বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিমারও অবশ্য মত ছিল। সুব্রতর মতো ভালো পাত্র পাওয়া গিয়েছিল বলে গদাধর ও আপত্তি করেননি। এখন মনে হয় মেয়েটার আর দু একবছর পরে বিয়ে দিলেই ভালো হতো। এই যে আজ নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছেন... আবার তখন-ই একমাত্র নাতির মুখটা মনে পড়ে। ভাগ্যিস! সোনা দাদুভাই ছিল না হলে প্রতিমা চলে যাওয়ার পর কী নিয়ে থাকতেন!
গোটা রাতটাই আজ প্রায় না ঘুমিয়ে কেটে গেল। ভোরের দিকে রোজ-ই অবশ্য নিয়ম করে মায়ের ঘরে যান গদাধর, রাতের মেয়েটা এই সময়ে একটু ঘুমিয়ে পড়ে আর ঠিক সেইসময় মা বিছানা টিছানা নোংরা করে ফেলে এক কেলেঙ্কারি বাধায়! জগন্নাথ অবশ্য এসব শুনলে আয়া মেয়েটির উপর বড্ড চোটপাট করে, গদাধরের কোথায় যেন খারাপ লাগে! অনুর বয়সী-ই হবে মেয়েটা, ঘরে ছোটো বাচ্চাও আছে। পেটের দায়েই তো এ কাজে আসা...
আজ ও মেয়েটা মায়ের খাটের পাশের একফালি মেঝেতে অকাতরে ঘুমোচ্ছে! মা একটু আধটু উসখুশ করছে দেখেই গদাধর বুঝতে পারেন, মশারী তুলে আস্তে আস্তে পা দুটো ভাঁজ করে বেডপ্যান ধরতেই বর্জ্য বেরিয়ে আসে। মলের দুর্গন্ধে রাত শেষের বাসি বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। গদাধর, ধীরে ধীরে পুরীষ ভর্তি পাত্রটি পাশে রাখেন। তুলোর গোলা পাশে রাখা জলের মগে ডুবিয়ে মাকে যত্ন করে পরিস্কার করে দেন। মেয়েটাকে ডাকতে গিয়েও ডাকেন না! কেমন একটা মায়া জন্মায় ঘুমন্ত মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে! ঠিক তখন-ই প্রতিমার বহুবার বলা কতগুলো আরেকবার মনে পড়ে যায়...
-বোকার হদ্দ একটা! শুধু রাজ্যের লোকের উপর দরদ! নিজেরটা যে মানুষ না বোঝে...
গদাধর বার দুয়েক মনে মনে কথাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করেন সত্যিই কী তিনি বড্ড বেশি আবেগসর্বস্ব? বোকা ? হবেও বা! তাড়াতাড়ি মলভর্তি পাত্রটা হাতে তুলে নেন। এখুনি এটা ধুয়ে না ফেললে বড্ড গন্ধ ছড়াবে! মেয়েটা ঘুমোচ্ছে ঘুমোক এইটুকু কাজ তিনি নিজেই করে ফেলতে পারবেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন