যুগান্তর মিত্র
মিড-ডে মিল
—ম্যাডাম, একটা কথা ছিল।
—হ্যাঁ বলুন। খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে তাকিয়েছিল চিত্রা।
টিচার্স রুমে একটা লম্বা টেবিলের দুপাশে দুটো চওড়া বেঞ্চ। সেই বেঞ্চে দিদিমণিদের সবারই নির্দিষ্ট বসার জায়গা আছে। দরজার দিকে বেঞ্চের একেবারে শুরুতেই চিত্রার বসার জায়গা। থার্ড পিরিয়ডের পরে তখন তার অফ ছিল। সেদিন এরপরে আবার ক্লাশ ছিল ফিফথ আর সিক্সথ পিরিয়ডে। সেই সময়টায় চিত্রা খবরের কাগজের শব্দছক মেলাচ্ছিল নির্দিষ্ট জায়গায় বসে। ছকের দু-তিনটে শব্দ আটকে আছে, কিছুতেই মনে পড়ছিল না। সম্ভাব্য একটি শব্দ যখন মাথায় নাড়াচাড়া করছিল, তখনই এক মহিলা তার প্রায় কাছে ঘেঁষে কথাটা বলেছিলেন। জংলা-ছাপ শাড়ি পরা মহিলার চেহারা দেখেই তাঁর আর্থিক অবস্থা বোঝা যাচ্ছিল। সাধারণত টিউশন-ফি কমানোর জন্য আসেন কেউ কেউ। তখন হেড মিস্ট্রেসের ঘরে পাঠিয়ে দিতে হয়। আবার কেউ হয়তো পারিবারিক সমস্যা বলতেও আসেন। তাঁদের অনেক বুঝিয়ে বাড়ি পাঠাতে হয়। আসলে এঁদের দুঃখযন্ত্রণা বলার মতো ভরসাযোগ্য জায়গা তেমন নেই। ভাবেন, দিদিমণিকে বললে নিশ্চিত কোনও সমাধান সূত্র বেরোবে! এছাড়া কোনও মেয়ে বাড়িতে বেয়াড়াপনা করলে গার্ডিয়ান আসেন নালিশ জানাতে। সেক্ষেত্রে কোনও দিদিমণিকে আলাদা ডেকে নেন না। স্টাফরুমে সকলের সামনেই বলেন। অবশ্য যদি মেয়ে পালিয়ে যায় কারও হাত ধরে, তখন এইরকম গোপনে ডেকে সংবাদটা দেন দু-একজন। বাকিরা সেসব জানান না। জানানোর কথাও নয়। ঢাকঢোল পিটিয়ে বলার তো কথা নয়!
—আমি রিয়ার মা। মানে রিয়া বৈদ্য…
রিয়া বৈদ্য নামটা শুনেই চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল মেয়েটার মুখ। পড়াশোনায় খুব সাদামাটা ছিল। এ বছরই আশাতীত ফল করেছে। এইট থেকে নাইনে ওঠার সময় ওর রেজাল্ট বেশ চমকে দিয়েছিল চিত্রাকে। সব বিষয়েই ভালো ভালো নম্বর তুলেছে!
—বলুন কী বলবেন!
ভদ্রমহিলা এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলেছিলেন, এখানে বলা যাবে না ম্যাডাম। একটু বাইরে আসবেন?
প্রায় ষোলো বছর শিক্ষকতা করছে চিত্রা। এসএসসি দিয়ে এখানেই পেয়েছে। বাড়ি থেকে মাত্রই দুটো স্টেশন দূরে। জায়গাটা অতি নিম্নবিত্ত অধ্যুষিত। ক্লাশের বেশিরভাগ মেয়ের পরিবারের আয় সামান্য হলেও ভাইবোন মিলিয়ে বেশ কয়েকজন। দুবেলা খাওয়া জোটে না। অথচ প্রায়ই শোনে অল্প বয়সেই বিয়ে করে নিচ্ছে। বেশিরভাগেরই বাড়ি থেকে দিতেও হয় না, নিজেরাই দেখেশুনে নেয় পাত্র। অনেক ক্ষেত্রে সেই বিয়ে টেকে না। একদিন জীবনবিজ্ঞানের বিপাশাদি একটা যুক্তি দিয়েছিলেন। কথাটা মনে ধরেছিল চিত্রার। ‘ওরা বাড়িতে তো ঠিকমতো খেতে পায় না। তাই ভাবে বিয়ে হয়ে গেলে অন্তত দুবেলা খাবারটা জুটবে!’ যুক্তিটা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। রিয়া কি কারও প্রেমে পড়ল? নাকি কোনও ছেলের সঙ্গে পালিয়েছে? মা হয়ে সবার সামনে হয়তো কথাটা বলতে চাইছেন না। রিয়াদের ক্লাশ টিচার চিত্রা, সে-কথা নিশ্চয়ই জানেন এই মহিলা। তাই তাকেই বলতে এসেছেন! বিরক্তি গোপন করে উঠে এসেছিল চিত্রা।
টানা বারান্দার একপাশে সরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন রিয়ার মা। কাছে যেতেই তিনি এমন একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যা শুনে বিস্মিত চিত্রার চোয়াল ঝুলে পড়েছিল। রিয়া শুধু পাশই করেনি, অন্যবারের থেকে অনেক ভালো রেজাল্ট করেছে। সেই রিয়াকে বলছে ক্লাশ এইটেই রেখে দিতে? সাধারণত ফেল করলে গার্ডিয়ান এসে হাতেপায়ে ধরেন পরের ক্লাশে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য। কথা দেন এবার থেকে ঠিক মন দিয়ে পড়াশোনা করবে ছাত্রী। বাড়িতে নজর রাখবেন তাঁরা। ছাত্রীও ঘাড় কাত করে আরও বেশি করে পড়াশোনা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। হেড মিস্ট্রেসের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী ক্লাশে উঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে অল্পকিছু নাম্বার কম পেলে সেক্ষেত্রেই এইরকম তুলে দেওয়ার প্রসঙ্গ আসে। যারা অনেক কম পায়, তাদের পরের ক্লাশে প্রোমোশন দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
এর ক্ষেত্রে উল্টো দাবি! রিয়ার নম্বর দেখে চিত্রা তো চমকে গিয়েছিলই, অন্যরাও জেনে অবাক হয়েছিল। বস্তুত রিয়ার এইরকম রেজাল্ট আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল টিচার্স রুমে।
—কীভাবে হল বলো তো? নকল-টকল করেনি তো? হাওয়ায় ব্যাট চালানোর ভঙ্গিতে বলেছিলেন সিনিয়র টিচার ডলিদি। অন্যরাও সমর্থন করেছিলেন কথাটা। তাঁরা নিশ্চিত, রিয়া নকল করেই বাজিমাত করেছে। জবাদি তখন বলেছিলেন, ‘এসব বোলো না। সত্যিই হয়তো পড়াশোনা করেছে রিয়া। আর যদি তোমাদের কথামতো নকল করেই নম্বর বেশি পেয়ে থাকে, তাহলে সেটা ওর ক্রেডিট আর আমাদের ব্যর্থতা। কেননা আমরা অনেকেই এইট বি-র ঘরে গার্ড দিয়েছি। আমাদের চোখ এড়িয়ে যদি নকল করতে পারে, তাহলে সেটা ওর ক্রেডিট নয়?’
কথাগুলো বলতে বলতে জবাদি বড়দির ঘরে চলে গিয়েছিলেন। পিছনে কেউ কেউ গজগজ করলেও প্রকাশ্যে জবাদিকে কিছু বলার ক্ষমতা কারও নেই। সবচেয়ে সিনিয়র টিচার তিনি। বড়দিও তাঁকে সমঝে চলেন। মুখের ওপর ট্যাঁশ ট্যাঁশ করে অনেক কথাই বলে দিতে পারেন। তবে যুক্তিহীন কথা বলেন না। কোনওদিন লেট করেন না স্কুলে আসতে। কোনও ক্লাশ কামাই করেন না। বরং অন্যের ক্লাশও অনেক সময় নিয়ে নেন হাসিমুখেই। ফলে তাঁকে কেউ ঘাঁটায় না।
রিয়ার মায়ের কথাগুলো চিত্রার অন্দরমহলে নাছোড়বান্দা মাছির ডানার ঝাপটের মতোই বেজে চলছিল। কেন যেন কাউকে বলতেও ইচ্ছে করেনি চিত্রার। এইরকম প্রস্তাব মেনে নেওয়ার প্রশ্নই নেই। তবু কথাটা তাকে ভীষণ ভাবাচ্ছে!
(২)
রাতে ছেলেকে ভাত খাওয়ানোর সময়ই চিত্রার মনের মধ্যে ভেসে উঠেছিল রিয়ার মায়ের কথাগুলো। যেন তখনই কথাগুলো আবার উচ্চারণ করলেন তিনি। শব্দগুলো ঘরের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। কথাগুলো ছেলেকে বলার প্রশ্নই নেই। সাড়ে চার বছর বয়সি পিকু বুঝবে না কিছু। আর সুবোধকে আজকাল প্রায় কোনও কথাই শেয়ার করা যায় না। সুবোধ অফিস থেকে এলে সন্ধ্যার পরে দুজনে চা নিয়ে বসে। সেসময়ই যেটুকু কথা হয়। তাও ওর অফিসের কথা বা পথঘাটের অভিজ্ঞতার কথা। সংসারের এটা নেই, সেটা লাগবে ইত্যাদি তার মধ্যেই গুঁজে দেয় চিত্রা। বেশিরভাগই নিজেই কিনে আনে। স্কুলের কথা আর বলা হয়ে ওঠে না। এখন অবশ্য বলতেও ইচ্ছে করে না। যে স্রোতা কোনওরকমে হুঁ-হাঁ করে, তাকে কিছু বলার ইচ্ছেটাও থাকে না। চিত্রার প্রায়ই মনে হয়, ওর অনেক কথাই হাওয়ায় ভেসে চলে যায় অন্যদিকে। সব কথা হয়তো সুবোধের কান পর্যন্ত পৌঁছয় না।
পিকু মুখের দুপাশে ভাত রেখে চুপ করে মোবাইল দেখছিল, যেন দুটো আস্ত ছোট আলু ভরা আছে। কিছুতেই চিবোবে না, গিলবে না! অনেক বাবা-বাছা বলে খাওয়াতে হয়। রূপকথা আর ইশপের গল্প যা জানা ছিল, সেসব তো কবেই পিকুকে বলা শেষ! একই গল্প দুবার বলা যায় না। একটু-আধটু পালটে বলতে গেলেই পিকু উঁহু উঁহু করে ওঠে, ‘এই গল্প শুনব না মামমাম।’ঠিক ধরে ফেলে। গড়গড় করে পরের অংশ বলে দেয়! কত আর গল্প বানানো যায়? এসব কি তার কাজ!
চিত্রা শুনেছে বাঙালি প্রেমে পড়লে বা প্রেমে ব্যর্থ হলে নাকি দু-চার লাইন কবিতা লেখে। তারপর সেসব চুকেবুকে গেলে কবিতাও ছুটি নেয়। ওর এক বন্ধু তো প্রেমে ধাক্কা খেয়ে কবিতা দিয়ে শুরু করে এখন গল্প লেখে। ভালোই নামটাম করেছে। চিত্রাও প্রেমে পড়েছিল। প্রেমটা ভেঙেও গেছে একসময়। সেই যন্ত্রণায় বেশ কিছুদিন কাতর হয়ে পড়েছিল। কিন্তু চিত্রার মনে কোনওদিন এক লাইন কবিতাও উঁকি মারেনি। আর এখন ছেলের পাল্লায় পড়ে ওকে গল্প বানাতে হচ্ছে! কিন্তু তার কল্পনা বেশিদূর ডানা মেলে না। মাঝে মাঝে পুতুলের সঙ্গে শিয়ালের মিলমিশ করে গল্পের মতো কিছু একটা দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু জমাতে পারেনি বলে হাল ছেড়ে দিয়েছে। ছেলেরও সেই গল্পে মন ভরে না। জীবন এক কঠিন ঠাঁই। ভাবে চিত্রা।
সব দিন নানা কথায় ভুলিয়ে খাওয়ানো সম্ভব হয় না। তাই দু-এক সময় বাধ্য হয়েই মোবাইলটা পিকুর হাতে দিতে হয়। চিত্রা জানে, এতে অভ্যেস হয়ে গেলে সমস্যা বাড়বে। একবার নেশা হয়ে গেলে মোবাইল ছাড়ানো যায় না সহজে। স্কুলের প্রায় প্রত্যেকের পরিবারেরই এই সমস্যা আছে। অনেক ছাত্রীরও মোবাইলের প্রতি ঝোঁক থাকার অভিযোগ শুনতে হয়। কোভিডের সময় অনলাইন ক্লাশ চালু হয়েছিল। সেই থেকেই শুরু হয়েছে ব্যাপক হারে মোবাইল আসক্তি।
পিকু মোবাইলে ইউটিউব চালিয়ে কার্টুন দেখে। কখনও আবার ফাইভ মিনিটস ক্র্যাফট দেখে। এটা অবশ্য চিত্রারও ভালো লাগে। ছেলের হাতে থাকা মোবাইলে দেখতে দেখতেই ওকে খাইয়ে দেয়। পিকুও দ্রুত খেয়ে নেয়।
সুবোধ আগে প্রায়ই রাগারাগি করত। ‘ছেলেকে এত আশকারা দিও না। ওকে নিজে হাতে খেতে দাও। খেলে খাবে, না-খেলে খাবে না। এত খাইয়ে দেওয়া, মোবাইল দেওয়ার কোনও মানে নেই।’ চিত্রা চেষ্টা যে করেনি, তা নয়। অনেক বুঝিয়েসুজিয়ে পিকুকে বসিয়েছিল খাওয়ার টেবিলে। নিজে হাতে যেটুকু খেয়েছে, তার থেকে বেশি ছড়িয়েছে। থালাতে থেকেও গিয়েছিল অনেকটা। আর খেতে চায়নি। এরপর থেকে সুবোধের কথামতো নিজে হাতে খাওয়ানোর চেষ্টা করেনি। নিজেই খাইয়ে দেয়।
সেদিন রাতে খাওয়াতে গিয়ে হঠাৎই মাথাটা গরম হয়ে গেল। কেউ খেতে পায় না বলে খায় না, আর পিকুর মুখের সামনে খাবার ধরলেও খাবে না! মুখ থেকে ভাতের দলা থু-থু করে ফেলে দিল? সারা টেবিল জুড়ে ওর মুখের ভাত! চিত্রার হাতে মাছের ঝোল দিয়ে মাখা ভাত লেগেছিল। সেই এঁটো হাতেই ঠাস-ঠাস করে চড় কষিয়ে দিয়েছিল কয়েকটা। গালে হাত ঠেকিয়ে পিকুর চিল-চিৎকারে এ ঘরই শুধু নয়, পাশের ঘরও কেঁপে উঠেছিল। ল্যাপটপ ছেড়ে দৌড়ে এসেছিল সুবোধ।
—আমি অনেকবার বলেছি এভাবে আশকারা দিও না। ওকে নিজের হাতে খেতে দাও। শুনেছ আমার কথা? এখন অধৈর্য হলে হবে? এইটুকু বাচ্চাকে মারলে! ছেলেকে কোলে তুলে সুবোধ বলেছিল। ইশারায় দেখিয়েছিল পিকুর গালে আঙুলের ছাপ পড়ে গেছে। তারপর ছেলেকে নিয়ে চলে গিয়েছিল পাশের ঘরে। আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব হয়ে পড়েছিল চিত্রা। সারা ঘরে কয়েক লক্ষ ঝিঁঝিঁপোকা একটানা ডাকছিল তখন। এর মধ্যেই রিয়ার মায়ের কথাগুলো ঘরের মধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছিল যেন।
(৩)
—ঐ বুড়ো দাদুটা কে ম্যাডাম?
—কোন্ বুড়ো! এখানে তো কোনও বয়স্ক মানুষ থাকেন না। কার কথা বলছিস? প্রশ্ন করে চিত্রা। একটা তিন থাকওয়ালা টিফিন বক্সে রিয়ার মায়ের জন্য খাবার গুছিয়ে রাখছিল সে। পিকুও মায়ের পেছন পেছন রান্নাঘরে চলে গিয়েছিল সেসময়। তখনই কেউ এসেছিল? কে আসবে? দরজা তো লক করা!
—এক দাদু। সাদা চুল আর দাড়ি। আমি যখন খাচ্ছিলাম, তখন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। আর বিড়বিড় করে কী যেন বলছিল।
যেখানে কোনও বুড়ো মানুষই থাকেন না, সেখানে এক বুড়ো এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল? আবার বিড়বিড় করে কিছু নাকি বলেওছে! রিয়ার কি মাথার গোলমাল আছে? নাকি দৃষ্টিবিভ্রম রোগ আছে? এইরকম রোগ কি আছে আদৌ?
—কি বিড়বিড় করছিল? প্রশ্নটা ভাসিয়ে দিল চিত্রা।
স্কুলের রেজাল্ট বেরোনোর পরে এখনও ক্লাশ শুরু হয়নি। চিত্রা রিয়ার মাকে বলে দিয়েছিল তিন-চারদিন বাদে তার সাথে দেখা করার জন্য। সেইমতো রিয়া এসেছিল দেখা করতে। টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে খানিকটা দূরে নিয়ে গিয়েছিল রিয়াকে। ওর মা কথা দিয়েছেন আর একই ক্লাশে রেখে দিতে চাইবেন না। চিত্রার পরিচিত শুভ্রাদির সঙ্গে কথা হয়েছে। সেখানে একটা কাজে ঢুকিয়ে দেবেন রিয়ার মাকে। শুভ্রাদির এনজিও আছে। সেখানেই কাজ। ‘আপাতত হাজার পাঁচেক দিতে পারব। কাজটা করুন উনি। পরে বাড়িয়ে দেব।’ বলেছেন শুভ্রাদি। রিয়াদের বাড়ি থেকে খুব দূরেও নয়। অসুবিধা হবে না। রাজি হয়েছেন রিয়ার মা।
—কাল একবার চলে আয় আমাদের বাড়িতে। তোর মা যাবেন শুভ্রাদির ওখানে কথা বলতে। তোকে দিয়ে যাবেন আমাদের বাড়িতে। ফেরার সময় নিয়ে যাবেন। ম্যাডামের কথায় ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়েছিল রিয়া।
আজ সকালে কথামতোই রিয়ার মা ওকে দিয়ে চলে গেছেন শুভ্রাদির ওখানে। চিত্রা শুভ্রাদিকে বলে রেখেছে, ‘তিন-চার ঘণ্টা কোনও অছিলায় ওনাকে আটকে রেখো দিদি। রিয়াকে আমি মনের মতো করে খাওয়াতে চাই। ওর সাথে আলাদা করে কথা বলতে চাই।’
সুবোধ গেছে মেদিনীপুরে ওর গ্রামের বাড়িতে মাকে দেখতে। একা থাকেন চিত্রার শাশুড়ি। বাড়িঘর ছেড়ে ছেলের কাছে এসে থাকবেন না কিছুতেই। তাই দেড়-দু-মাস বাদে সুবোধই যায় মায়ের কাছে। এই সুযোগটাই নিয়েছে চিত্রা। সুবোধ থাকলে কিছুতেই রিয়াকে আনা যেত না এ বাড়ি। ‘দুম করে কাউকে ঘরে ঢোকানো ঠিক নয় চিত্রা। দিনকাল ভালো নয়। কে কী মতলবে আসে বোঝা যায় না।’ এক ছুটির দুপুরে একজন ভিখারি বৃদ্ধকে ঘরে বসিয়ে খাইয়েছিল চিত্রা। তখনই কথাটা বলেছিল সুবোধ। আরও একদিন একই কাণ্ড করেছিল। একজন অচেনা মহিলা বড়ি আর পাঁপড় বিক্রি করতে এসেছিল। সেদিন ছিল চিত্রার গরমের ছুটির এক দুপুর। সেই মহিলার আর্থিক অবস্থা শুনে আর সবদিন বিক্রি তেমন হয় না জেনে ঘরে ডেকে খেতে দিয়েছিল সামান্য কিছু খাবার। কথাটা ছেলের থেকে শুনে খুব বিরক্তি প্রকাশ করেছিল সুবোধ। রিয়ার কথাটাও নিশ্চিত জানতে পারবে। তখন যা বলে বলুক। চিত্রা না-হয় দুটো কথা শুনবে! রিয়ার কথা আগে থেকে জানালে সুবোধ হয়তো বাধা দেবে না। কিন্তু বলা তো যায় না! একবার যদি না-করে দেয়, তাহলে চিত্রার পক্ষে আর রিয়াকে আনা সম্ভব হত না।
খাওয়া থামিয়ে রিয়া কী যেন ভাবছে। ওর কথার কোনও জবাব দেয় না। চিত্রা অধৈর্য হয়ে ওঠে। ‘কী রে? চুপ করে আছিস কেন? বল কী বিড়বিড় করছিল?’
—অন্ন চাই প্রাণ চাই চাই মুক্ত বায়ু… আর মনে নেই ম্যাডাম।
চোখ চিকচিক করে ওঠে চিত্রার। অন্ন চাই প্রাণ চাই… এসব কী বলছে ও? সত্যিই কি তিনি এসেছিলেন রিয়ার কাছে? আসা সম্ভব?
ছুটে পাশের ঘরে যায় চিত্রা। দেয়াল থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবিটা নামিয়ে এনে এ ঘরে এসে প্রশ্নটা প্রায় আছড়ে ফেলে রিয়ার সামনে, ‘দ্যাখ তো মা, এই বুড়োটা কিনা!’
—হ্যাঁ তো। একদম এইরকম দেখতে। এই লোকটাই তো!
চিত্রার দু-চোখ ভরে জল আসে। ভেজা গলাতেই জিজ্ঞাসা করে, ‘তুই চিনতে পারিসনি? বইতে ছবি দেখেছিস, স্কুলেও তো এনার ফটো আছে! তাও চিনতে পারলি না দাদুটাকে!’
—রবি ঠাকুর? তিনি কি বেঁচে আছেন ম্যাডাম?
—এমনিতে বলতে গেলে নেই। তবে আছেন। আছেন রে! তেমন কাউকে ভালো লাগলে হয়তো আসেন। তোর কাছে যেমন এলেন।
বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে রিয়া তার ম্যাডামের দিকে। চিত্রা রিয়ার থালার দিকে তাকিয়ে দেখে, পাশে বাটিতে বাটিতে সাজিয়ে দেওয়া সুক্তো, মুড়িঘণ্ট, এচোড়-চিংড়ি খেয়ে নিয়েছে মেয়েটা। মাছ দিয়ে খাওয়াও প্রায় শেষের দিকে। পায়েসের বাটিটায় হাত পড়েনি স্বাভাবিকভাবেই। রিয়ার মাথায় হাত রেখে চিত্রা জিজ্ঞাসা করে, ‘আর ভাত নিবি মা? আর-একটু খাবি?’
হ্যাঁ-সূচক ঘাড় নাড়ে রিয়া। আরও ভাত দেয় চিত্রা। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে, যেভাবে রবীন্দ্রনাথ রিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন।
—দ্যাখ পিকু, দিদিটা কেমন সুন্দর করে খাচ্ছে! তুই পারবি এইভাবে নিজে হাতে খেতে?
‘হ্যাঁ’ বলে লম্বা করে ঘাড় নাড়ে ছেলে।
তাড়াতাড়ি রবীন্দ্রনাথের ছবিটা আবার দেয়ালে টাঙিয়ে দেয় চিত্রা। তার আগে আঁচল দিয়ে ধুলো ঝাড়ে। প্রণাম করে টুল থেকে নেমে ধীরপায়ে পাশের ঘরে আসে, যেখানে রিয়া ভাত-তরকারি-মাছের সঙ্গে আনন্দ মিশিয়ে খাচ্ছে।
ক্লাশ নাইনে উঠলে মিড-ডে মিল বন্ধ হয়ে যাবে। তাই রিয়ার মা চেয়েছেন রিয়া যেন ক্লাশ এইটেই থেকে যায়। দুবেলা অন্ন জোটাতে পারেন না বলে এইরকম ভাবনা মাথায় এসেছে। কথাটা ভেবেই বুকটা টনটন করে উঠেছিল চিত্রার।
আজকের মিড-ডে মিলটা এখানেই খেতে পারল মেয়েটা! স্কুল ছুটি থাকলে মেয়েকে দুপুরের খাবার দিতে পারেন না রিয়ার মা। খুব কষ্ট পান। বলছিলেন সেদিন। স্কুল থাকলে অন্তত সেই দিনগুলোর দুপুরে রিয়ার খাবারের চিন্তা থাকে না। সুবোধের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ওর প্রতিদিনের খাবারের ব্যবস্থা করা যায় না? দুবেলাই? যদি এখানে এনে রাখা যায়! কাছাকাছি কোনও স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া যায় যদি! সুবোধের খুব মেয়ের শখ! চিত্রার পক্ষে তো আর মেয়ে জন্ম দেওয়া সম্ভব হবে না! সাঙ্ঘাতিক কার অ্যাক্সিডেন্টের পর ডাক্তার বলেই দিয়েছেন। মেনে নেবে না সুবোধ? বোঝাতে পারব না আমি? আকুল হয়ে ভাবে চিত্রা। এমন সময় কলিং বেল বেজে ওঠে। দরজার দিকে এগিয়ে যায় চিত্রা। হয়তো রিয়ার মা এলেন! রিয়া তখনও খাচ্ছে। খুশিমাখা ভাত!
খুব ভালো লাগল গল্পটি
উত্তরমুছুনভালো লাগলো ৷
উত্তরমুছুনবাহ্, বাস্তব ঘটনার চিত্রায়ণ গল্পের মাধ্যমে, খুব ভালো লাগল।
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগলো
উত্তরমুছুনবেশ ভালো লাগলো গল্পটি |
উত্তরমুছুন