সুপর্ণা বোস

 




রুচিরাভরণা



ঘরের মেঝেতে ছড়ানো বইখাতা আর পত্রিকার স্তুপ গোছাতে শুরু করল মণিরুল।নাহ্ তার ঘরে কোনো ঝাঁ চকচকে বইয়ের র‍্যাক নেই।দেয়ালের অনেকটা উঁচুতে ঢালাইকরা একখানা সিমেন্টের স্ল‍্যাব লাগানো আছে সেটাই বইয়ের তাক হিসেবে ব‍্যবহার হয়।সচরাচর বইপত্রিকা মেঝেতেই ডাঁই করা থাকে কিন্তু আজ তৃণা আসবে।    

ঘরের এককোণে কাঠের ছোট একটা চৌকিতে মণিরুলের একার শয‍্যা।পাতলা তোষকের ওপর সদ‍্য কাচা হলুদ ফুলছাপ চাদর । বালিশটা কিঞ্চিত তেলচিটে।কভার একটা ছিল।এখন নেই।একটিই ঘর,রান্নার জায়গা আর স্নানঘর।তাইই মাসে পাঁচহাজার।প্রতি বছর একই বাড়িতে এগারোমাসের শর্তে এগ্রিমেন্ট হয়।পাঁচ পারসেন্ট করে ভাড়া বাড়ে।এই নিয়ে আটবার।বাড়িওলা ভাল।ভাড়াটা একটু বেশি।সচরাচর হিন্দুর পাড়ায় মুসলমানকে ঘর দেয় না কেউ।

মণিরুল নমাজ পড়ে না।দাড়ি রাখে না।কখনো সখনো  পাজামা পাঞ্জাবি পরলেও ফেজটুপি পরে না কখনো।মোটের ওপর তাকে পাড়ার অন‍্যান‍্যদের সাথে আলাদা করা যায় না।এ পাড়ায় সকলে তাকে মণিমাস্টার বলেই চেনে।প্রাইমারি ইস্কুলের শিক্ষকতা আর বাড়িতে অবৈতনিক ছাত্র পড়ানো।এছাড়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কবিতা গল্প প্রবন্ধ লিখে পাঠানো।এই তার কাজ।গতবছর একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করেছিল তৃণা।সেই থেকে দুজনের সখ‍্যতা।তৃণা  সাদা শাড়ি পরে খোঁপায় রজনীগন্ধার মালা জড়িয়ে মঞ্চ আলো করে মণিরুলের লেখা কবিতা একেরপর এক আবৃত্তি করে চলে। মণিরুলের মনে হয় সাক্ষাত সরস্বতী যেন ঠোঁটে তুলে নিয়েছেন তার হৃদয় নিসৃত অক্ষরগুলি।

মণিরুল মনে ও স্বপ্নে তার জ‍্যান্ত সরস্বতীর পুজো করে।সাদা শাড়ির আঁচল সরালে স্পষ্ট হয়ে ওঠে রক্ত মাংসের স্তন।কোমল মুখখানি তৃপ্তির আভায় ঝলমল করে ওঠে। মণিরুল ফিসফিস করে, কি চাও দেবী? শ্রদ্ধা ভক্তি প্রশস্তি আর পুষ্পবন্দনা? স্পর্শ চাওনা? মণিরুল স্বপ্ন দেখে।সেই স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়ে তার কবিতায় গল্পে আখ‍্যানে নভেলে।

এবছর সরস্বতী পুজোর আগে ছাত্রছাত্রীরা ঘিরে ধরে বলে,
_ ' স‍্যার আমাদের কোচিংয়ে সরস্বতী পুজো হবে না?' মণিরুল হাসে।সস্নেহে বলে, 
_' আমার এই একচিলতে ঘরে মা সরস্বতী আসলে আমি কোতায় বসাই তাকে বল দিকিনি?' বাচ্চারা আঙুল দিয়ে ঘরের কোণাটা দেখিয়ে বলে, 
_'কেন?ওই যে ওইখেনে?'
_'না রে এবারে আর হবে না। সে অনেক যোগাড়যন্ত্র সামনের বছর দেখা যাবে।'

গতরাতে তৃণা যখন মেসেজ করল, ' কাল তোমার বাড়ি যাচ্ছি! আপত্তি নেই তো?' 
_কাল? কখন? কাল তো সরস্বতীপুজো?তোমার আবৃত্তি স্কুলের পুজো ছেড়ে তুমি এখানে আসবে?
_সেসব আমার স্কুলের সিনিয়র ছাত্রছাত্রীরা  দেখে শুনে রাখবে।দু ঘন্টা আমি না থাকলে তেমন কিছু অসুবিধা হবে না।
_এসো।খুব আনন্দ পাবো।
মণিরুল নিখুঁত পথনির্দেশ দিয়ে বলে 
_বের হয়ে ফোন করো।স্টেশনে থাকব আমি।

দুপুর আড়াইটে নাগাদ আসবে তৃণা।দেড়টা বাজেনি মণিরুল পৌঁছে গেছে।বারবার ফোন দেখছে।হোয়াটসআপের মেসেজ চেক করছে।দশ বছর আগের মণি হলে হয়ত এতোক্ষণে পাঁচবার ফোন করত। কাতর হয়ে বলতো 
_আর কতো অপেক্ষা করাবে বলতে পারো?
এখন বয়েস চল্লিশ পেরিয়েছে।তৃণার হয়ত আরো দুচার বছর বেশিই।এখন  নিজের ভেতর নিজেকে ধরে রাখার সামর্থ্য হয়েছে।

তৃণা যখন ভরা দুপুর শরীরে নিয়ে লোকালট্রেণের কামরা থেকে নামল তার আগে ওই প্লাটফর্মে অন্তত দশবার মার্চপাস্ট করা হয়ে গেছে মণিরুলের।
তৃণা কপালের  ঘাম মুছে বললো 
_একটু দেরি হয়ে গেল।অনেক্ষণ অপেক্ষা করছ।তাই না?

_না না।এই তো কিছুক্ষণ।তবে আজ ছুটির দিন তো।ট্রেনও  কম চলছে।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা রিক্সা নিল ওরা।মাঘের দুপুর অথচ ঠান্ডা হঠাতই কমে গেছে।যেন একটা উল্টো হাওয়া।সেই হাওয়ায় তৃণার শরীরের ঘাম আর পারফিউমের অদ্ভুত একটা লেবুগন্ধ কেমন জানি তেষ্টা জাগায় মণিরুলের শরীরে।মুহূর্তের জন‍্যে ফুরফুরাশরিফের বাড়ির উঠোন।মা বাবা ভাইবোনেরা।একটা ফিরনি রঙের সময়।বহুকাল পর।কতকাল বাড়ি ফেরেনি মণিরুল।মা নেই আব্বা নেই।মণি বলে ডাকার কেউ নেই।

মণিরুল তালা খুলে ভিতরে ঢোকে।সঙ্গে তৃণা। খোলা দরজা জানলা দিয়ে আলোয় ভরে আছে ঘরদোর।তৃণা তক্তপোশের ওপর বসে।কাঁধ থেকে টোটব‍্যাগটা নামিয়ে রাখে
_একটু জল খাওয়াবে মণিরুল?
মণিরুল মনেমনে হাসে, তৃষ্ণা তার একার পায়নি তাহলে! জলের একটা বোতল এগিয়ে দেয় তৃণার দিকে।তৃণা বোতলটা ধরতে গিয়ে মণিরুলের হাতের পাতার ওপর হাত রাখে।চোখের দিকে তাকিয়ে হাসে
_জানলা দরজা বন্ধ কর! এতো রোদ্দুর সয় না আমার। 

মণিরুল জানলা দরজা বন্ধ করে।জানালার ছিদ্র দিয়ে লেজার বিমের মত আলোরেখা এসে কাটাকুটি খেলে ঘরের মেঝেয়।তৃণা জল খায়।তৃণা বালিশের পাশে খুলে রাখে কানের দুল। ললন্তিকা হার।বাসন্তী রং শাড়ির আঁচল।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য