সোমা দত্ত


 


প্যাথলজিক্যাল পলাশ


                  

একজন প্যাথলজিস্ট সম্পর্কে আপনি কী জানেন?  রক্ত, মল, মূত্র, থুতু, কফ ইত্যাদি যেকোনো ধরনের ফ্লুইড  যখন আপনার, দেহ থেকে অন্যের দখলে যায়, তখন দখলকারী হলেন প্যাথলজিস্ট। আর আপনি প্যাথোস। একটি সিমপ্যাথিটিক চলন। রোগ বা মৃত্যুর গেটওয়ের সাপেক্ষে অত্যন্ত তুচ্ছ এবং লঘু একটি বিষয়। তাতে প্যাথলজিস্টের অবশ্য কিছু আসে যায় না। সে শুধু সিরিঞ্জে সূঁচের সাফল্য নিয়ে চিন্তিত।


পুরোনো কথা বলি। পুরোনো থেকে সবুজ রংটি নিয়েছি বলেই আজও এক পায়ে দাড়িয়ে থাকি ক্লাসের কোণায়। মিঠে জলের মত গড়িয়ে গিয়েছে ক্রমিক সংখ্যা। বেঞ্চের উপরে ব্লেড দিয়ে লেখা আছে নর্মদা পশ্চিমে বয়ে যায়।  যেসব নামেরা যোগচিহ্নে দেওয়ালে ইতিহাস লেখার চেষ্টা করেছিল তাদের অধিকাংশের উত্তর মেলেনি। যেসব নামেরা স্লোগান লিখে উষ্ণতা ফেরি করেছিল, তাদের রক্তাল্পতা সারেনি। হিমোগ্লোবিন একটি ক্যাপিটালিস্ট তরল বটে। এই আগ্রাসন প্রবল অনুসন্ধানী। শরীর একটা পৃথিবী, শরীরই মূলত প্রকৃতি। এখান থেকেই প্রজ্ঞা পায় এই বিশ্বসংসারের তাবৎ দর্শন এবং রাজনীতি। শান্তনু স্যার এভাবেই শুরু করতেন বায়োলজি। বায়োলজি ক্লাসে ফাঁকি দিই নি কখনো, ব্যাঙের শরীরটাকে স্ক্যালপেল দিয়ে চেরার সময় স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হব। ব্যাঙের ডিসসেকটেড দেহটা ডাস্টবিনে পড়ার সময় মিচকে হাসল। হলাম প্যাথলজিস্ট। 


এবার আসল কথাটা বলি। একটা সমস্যার কথা। সমস্যাটা গুরুতর। আমি মানুষের ভিতরটা দেখতে পাই। আরে! হাসছেন? সম্পূর্ণ সত্যি কথা। কোনো শ্লেষ, রহস্য, ইঙ্গিত, সংকেত কিস্যু নেই এর মধ্যে। সহজ সত্যি আছে কিন্তু আপনি বুঝতে চাইবেন না। আপনি কী আদৌ বিশ্বাস করবেন যখন আপনার শিরায় আমার সিরিঞ্জের সূঁচটা ঢোকে আমার চোখ আপনার ডারমিস, এপিডারমিস ভেদ করে শিরার ভিতরে রক্তের চলাচলে পৌঁছে যায়। খরস্রোতা লাল নদী কীভাবে দ্রুত বয়ে চলেছে, তার ধূমায়িত হিম কণাদের ভাঙন এবং গঠন, এবং আরো মাইক্রোস্কোপিক গঠনে দেখতে পাই গরম অক্সিজেনের ইলেকট্রন দান। অপূর্ব সিগমা বন্ডিং। আমি একটি প্যাথোজেন হয়ে বসে থাকি হিমোগ্লোবিনের শিরদাঁড়ায়। আপনি বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু গত একবছর ধরে এটা আমার জীবনের চরম সত্যি। আমি মানুষের শরীরের ভিতরে পৌঁছে যাই। নানা ভুমিরূপ দেখি। নদী, নালা, নর্দমা পার করে চলতে থাকি। সে এক বিচিত্র পৃথিবী। এই তো সেদিন সন্তোষ লাহার হার্টে পৌঁছে গেছিলাম। অ্যাটাক এসেছিল ওর। দেখলাম হার্টখানা তিরতির করে কেমন কাঁপছিল। কীরকম ক্ষয়াটে বাদামি রঙের হার্ট। চারপাশে কেমন যেন ছ্যাতলা পড়ে গেছে। একটা রক্তনালী কেমন খিঁচ খেয়ে গেছে। একবার ভাবলাম ঠিক করে দিই, তারপর ভাবলাম, দুশ্চরিত্র লম্পটটাকে বাঁচিয়ে হবেটা কী, বরং দিই আরেকটু প্যাঁচ কষে, ভবলীলা সাঙ্গ হোক ব্যাটার। কিন্তু কী আশ্চর্য কিছুতেই ছুঁতে পারলাম না রক্তনালিটা। কে যেন আটকে দিচ্ছে। অদৃশ্য একটা শক্তির তুমুল বাঁধা। তারপর ও পাড়ার বিশু মিত্তিরের রক্ত নিতে গিয়ে তো কেলেঙ্কারি অবস্থা। ভালো স্পষ্ট একটা শিরা দেখে সিরিঞ্জ ঢুকালাম, হঠাৎ দেখি একটা রক্তাক্ত পুলের মধ্যে আমি বসে আর চারদিক থেকে কিলবিল করে পোকা উঠছে আমার গায়ে, মাথায়। মাগো বলে ছিটকে সরে গিয়ে দেখি, বিশু মিত্তিরের বউয়ের ঘাড়ে গিয়ে পড়েছি। রক্ত নেওয়া দূর, গালে চড় নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। সত্যি বলছি বড় প্যাথেটিক হয়ে উঠেছিল এই প্যাথলজিক্যাল জীবন। লোকে আমাকে পাগল বলতে শুরু করেছে আজকাল। সেবার মায়ের জ্বর বুঝতে কপালে হাত দিয়ে দেখি মায়ের ব্রেনের ভিতরে একটা ছোট্ট তিল সাইজের অসংখ্য কালো টিউমার, কেমন যেন ঘিনঘিনে । বাড়িতে বলতেই দাদা মেরে তাড়ানোর যোগাড়। মা স্তব্ধবাক। মা চিরকালই একপেশে। তার সর্বসময়ের রুদ্রাক্ষ হল দাদা। অতএব চেপে যেতে হল। বেকার বসে দাদার ভাত সাঁটানোর সময়তেও এত অসহায় বোধ করিনি। দিনরাত সর্বক্ষণ অসহ্য যন্ত্রণা। মানুষকে স্পর্শ করতেই মুহূর্তে তার শরীরে পৌঁছে যাই আমি। কারো যকৃতের নোংরা ক্ষয় দেখি তো কারো পচে যাওয়া পাকস্থলী। কারো অন্ত্রের ভিতর থেকে লাফিয়ে উঠে অদ্ভুত পোকা। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। একমাত্র পাশের বাড়ির ভাইদা পাশ ঘেঁষে ছিল সবসময়। মসজিদে নিয়ে গিয়ে ঝাড়াত, কত বাবার থানে হত্যে দিতে হত। কোথায় কী! মানুষের নোংরা পুঁতিগন্ধময় শরীর আমার চোখ থেকে সরে না।  তবে একদিন টের পেলাম পৃথিবীর কিছু আশ্চর্য ঘটনা আমার সাথেও ঘটে। গেছিলাম হরিদ্বার ঘুরতে  ভাইদার সাথে আমি। তবে বলপূর্বক। আমার প্যাথোস আমাকে সঙ্গ দিচ্ছিল না। পৌঁছানোর পরদিন ঘাটে এসে দাঁড়িয়েছি একা । হঠাৎ দেখি পাশে দাঁড়ানো এক বুড়োর মুখে মিটিমিটি হাসি। চোখ আমার দিকে ফিরানো। মেজাজ মনে ছিল না এমনিতেই। দিলাম পিছন ফিরে হনহন করে হাঁটা।  বুড়ো দৌড়ে এসে হঠাৎ আমার হাতখানা নিয়ে সটান নিজের বুকে। টেনে সরিয়ে নিতে যাব হঠাৎ দেখি সারা শরীর রিনরিন করছে। মুহূর্তের মধ্যে যথারীতি আমি পৌঁছলাম একটি হৃৎপিন্ডে। ঠান্ডা কোমল হাওয়া বইছে চারদিকে। অবাক হয়ে দেখলাম সবুজ ঘাসের মধ্যে একটা গাছে রাশিরাশি পলাশ ফুটে। চতুর্দিক ঠান্ডা শান্ত বাসন্তিকা অক্সিজেন যেন ঝাপটা মারছে আমার চোখে মুখে। কত বছর পরে টের পেলাম বসন্ত এসেছে। শরীরটা কেমন যেন শান্ত ঠান্ডা মনে হতে লাগল। তারপর বৃদ্ধ আমার হাতটা নিজের বুকের উপর থেকে সরিয়ে হুকুম করল, আপনা সিনা দেখ পহেলে। আপনা কিচর খোদ। তার দীর্ঘ চোখের মণি যেন ঠিকরে আমার উপরে উঠে এল। সম্মোহিতের মত হাতটা  রাখলাম নিজের বুকে । অমনি সারা শরীরে তুমুল আলোড়ন। মাথাটা ঘুরে উঠলো। বসে পড়লাম সিঁড়ির উপরে। দেখলাম নিজের বুকের ভিতরে পৌঁছে গেছি আমি। কী বিশ্রী গন্ধ চারদিকে। পাঁজরের হাড়ের ভিতর থেকে গলগল করে কালো রঙের পোকা বেরোচ্ছে, অলিন্দের ভালবগুলোতে হলদে সবুজ ছত্রাক পড়েছে। রক্তনালিগুলো দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে কালো রঙের তরল। সেই তরলে ডুবে যাচ্ছি আমি। ক্রমশ নাক, মুখ, মাথা... না, না চিৎকার করতে করতে, জোরে মাথা নাড়তে থাকলাম আমি। বৃদ্ধ লোকটা আমার হাত আরো জোরে চেপে ধরলো আমার বুকের উপরে। আমি দেখলাম আমার বুকের রক্তনালী, পাঁজর, চামড়া সব ভেদ করে রাশি রাশি পোকা উড়ে যাচ্ছে চারিদিক থেকে। চোখ বন্ধ হয়ে এল আতঙ্কে।

প্রাথমিক আশ্চর্যবোধ কাটিয়ে উঠতে উঠতে কয়েকটা দিন নদীর সাথে চলে গেছে। একদিন আবার হাত রাখলাম নিজের বুকে। ধুকপুক শব্দ হচ্ছে। ভালো করে শোনার চেষ্টা করলাম ত্রিকোণ লাবডাব। ক্রমশ কাছে আসছে শব্দটা আর একটা আশ্চর্য বৃদ্ধমুখ যেন ভেসে উঠছে চোখের সামনে। ভাইদাকে ডাকলাম। ওর বুকে, পেটে গলায় হাত দিয়ে দেখলাম। দেখলাম কুলকুল করে রক্ত বইছে এক সুগন্ধের নদীবুক জুড়ে। কিন্তু কোথাও সেই ভয়ঙ্কর শারীরিক দুর্যোগের ছবি খুঁজে পাইনি। এরপর আর কোনোদিনই প্যাথলজিক্যাল বিভ্রাটে পড়তে হয়নি। তবে যখনই কোনো মানুষের বুকে হাত দিয়েছি চোখের সামনে দেখতে পেয়েছি এক অপূর্ব পলাশ গাছ ফুলে ভরে আছে। আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না। নাই বা করলেন!







মন্তব্যসমূহ

  1. আহা এমন লেখায় বাক রুদ্ধ হয়ে থাকে। মন পূর্ণ থাকে আলোকিত বোধে। 🙏🙏❤️

    উত্তরমুছুন
  2. লেখাটি চমৎকার। খুব নির্মেদ ও সংবেদী।

    উত্তরমুছুন
  3. চমৎকার লেখা। গভীর ও ব্যঞ্জনাময়।

    উত্তরমুছুন
  4. এমন ব্যতিক্রমী গদ্যের জন্য নাম হোক আপনার।

    উত্তরমুছুন
  5. অভুতপূর্ব লেখা পড়লাম, অভিভূত আমি

    উত্তরমুছুন
  6. খুব বাল লাগল।একদম অন্যরকম।

    উত্তরমুছুন
  7. রঞ্জনা ভট্টাচার্য৩১ মে, ২০২৩ এ ১০:৫৬ PM

    আশ্চর্য লেখা সোমা! আমি বিস্মিত

    উত্তরমুছুন
  8. খুব ভালো। মেধাবী লেখা।
    - রাজদীপ

    উত্তরমুছুন
  9. এমন লেখা ফেসবুকে কেন, অন্য কোথাও পড়েছি বলেও মনে পড়ছে না। সম্ভ্রম রাখলাম তোমার কলমে, সোমা

    উত্তরমুছুন
  10. অদ্ভুত সুন্দর! ব্যতিক্রমী!

    উত্তরমুছুন
  11. খুবই উচ্চ মননের লেখা।👍

    উত্তরমুছুন
  12. আপনার প্রতিটি লেখাই পড়ি, অসাধারণ অসাধারণ সব লেখা

    উত্তরমুছুন
  13. একদম ভিন্ন স্বাদের চমৎকার লেখা

    উত্তরমুছুন
  14. সোমার লেখা মানেই কখনো হতাশ হ'তে হবে না। ব্যতিক্রম নেই এখানেও।❤️

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য