বর্ণালী ভৌমিক দে

 



ঘুম আসে নদীর কলতানে


শহুরে জীবন থেকে কদিনের মুক্তির আশায় ভ্রমণের জন্য বেছে নিয়েছিলাম এমন এক অফবিট জায়গা যেখানে থাকবে পাহাড় , নদী আর নদীর পাড়ে পাথরের তৈরি ছোটো বাড়ি। সেই ভাবনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে গতানুগতিক জীবন থেকে ছুটি নিয়ে চললাম পাহাড়ী গ্রাম টুকরে। সেখান থেকে আমাদের গন্তব্য দার্জিলিং। নির্দিষ্ট দিনে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে গাড়ি ভাড়া করে চললাম টুকরের উদ্দেশ্যে। এখানে যাওয়ার দুটি রাস্তা আছে।মিরিক হয়ে টুকরে যাওয়া যায় আবার দার্জিলিং হয়েও যাওয়া যায়। আমরা মিরিক হয়েই টুকরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যাওয়ার পথেই মিরিক লেক দেখে নিলাম। শীতের শেষে নীল আকাশের নীচে মিরিক লেক এককথায় অনবদ্য। মিরিক লেকের বুক চিরে চলে গেছে একটি  কংক্রিটের সেতু।সেতু পেরিয়ে গেলে লেকের পাড় ধরে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হেঁটে চলা এনে দেয় কিছু সুন্দর মুহূর্ত যা সারা জীবনের ভুলতে না পারা অভিজ্ঞতা। একদিকে লেকের স্বচ্ছ জল অন্যদিকে পাইন গাছের সারি মাঝখানে মাটির ছায়াঘন পথ নিয়ে যায় কোনো রূপকথার দেশে। মিরিক লেক থেকে ফেরার চলতি পথেই দেখে নেওয়া যায় গোপালধারা টি গার্ডেন। দিগন্ত বিস্তৃত চা বাগান গালিচার মতো ঢেকে আছে পাহাড়ের সর্বাঙ্গ। পাশের চায়ের দোকান থেকে গরম সুস্বাদু চা পান করলাম আর চা বাগানের এই অপরূপ সৌন্দর্য্য ক্যামেরা বন্দি করলাম নিজের ইচ্ছেমত। এবার আমাদের গন্তব্য পাহাড় ঘেরা সেই শান্ত জনপদ যেখানে ঘুম আসে নদীর বয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে শুনতে। মিরিক থেকে আমাদের গাড়ি ছুটলো টুকরের পথে। দুই দিকে পাহাড়ের ধাপে ধাপে চা বাগান ,মাঝখান দিয়ে সর্পিল পিচ ঢালা রাস্তা। রাস্তার পাশে মাঝে মাঝে দেখা যায় নাম না জানা বিভিন্ন ফুলের গাছ।।এভাবেই আমরা একসময় পৌঁছে গেলাম একটি ব্রিজের পাশে। ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে গেছে রাং ভাং নদী। ব্রিজ পার হয়ে দেখা মেলে স্বপ্নের মতো পাহাড়ী গ্রাম টুকরের। এখানে আমাদের আগে থেকেই বুক করা ছিলো খুশি"স ফার্ম হাউসে। আমরা বাং ভাং নদীকে পথের এক পাশে রেখে আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে পৌঁছে গেলাম সেই গৃহে যেখানে একসাথে অধিষ্ঠান করে মা মেরী এবং গৃহলক্ষ্মী।




উঠোনের একপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নূপুরের ছন্দ তুলে সুন্দরী বাং ভাং নদী। কোথাও সামান্য গভীর আবার কোথাও অগভীর স্বচ্ছ জলের নিচে স্পষ্ট দেখা যায় বিভিন্ন আকৃতির পাথর । নদীর পাশেই  তিনটি পাথরের ঘর । প্রাকৃতিক পাথরে তৈরি বসার জায়গা । বড়ো পাথরকে সমতল করে ব্যাবহার করা হয়েছে টেবিলের মতো । উঠোনে হরেক রকম ফুলের গাছ আর ফুলে ফুলে প্রজাপতিদের মেলা । এই খামার বাড়িতে খরগোশ, হাঁস, মুরগী, মৌমাছি প্রতিপালন করা হয়। এখানে দুটি জলভরা পুল রয়েছে পাশাপাশি। একটিতে নানা রঙের মাছেরা খেলা করে বেড়াচ্ছে আর একটি আধুনিক সুইমিং পুল। পাহাড় ঘেরা স্বচ্ছ নীল জলের এই সুইমিং পুলের ধারে বসে থেকে অথবা জলকেলি করে কেটে যায় অনেকটা সময়। পাহাড়ের কোলে এমন একটি গৃহে সময় কাটালাম হুটোপুটি ও অনেক ছবি তুলে । 


খাওয়া দাওয়া ও বিশ্রাম শেষে আমরা তিনদিক পাহাড়ে ঘেরা গ্রামটি ঘুরে দেখতে শুরু করলাম ।এই ফার্ম হাউস থেকে বেরিয়ে ডানদিকে নদীর পাড়ের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে একটা সুসজ্জিত পার্ক । সবুজ ঘাসের ওপর বসার সুন্দর ব্যাবস্থা আছে এখানে । পার্কের বাঁধানো বসার জায়গাগুলোতে বসে নদীর দৃশ্য যে কি নৈসর্গিক তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এই পার্কে একটি কৃত্রিম লেক আছে। লেকের পাশেই ঘন জঙ্গলে ঢাকা একটুকরো প্রান্তর চোখের আরাম এনে দেয়। কৃত্রিম লেকে বোটিং করার ব্যবস্থা আছে। চারদিক ঘিরে আছে চা বাগানের সবুজ। এখানে বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতেই সন্ধ্যে নামে নদীর বুকে আগুনে লাল ছড়িয়ে দিয়ে। পাখীরা সারা দিনের শেষে ঘরে ফেরে নীল আকাশে ডানা মেলে।আমরাও ধীরে ধীরে আমাদের আস্থানার পথ ধরলাম। ফার্ম হাউসে ফিরে সান্ধ্য চায়ের সাথে বারান্দায় আমাদের আড্ডা জমলো।সামনে পাহাড়ী নদী , নদীর ওপারে নিঝুম রাতের পাহাড় আর উঠোনে উড়ে চলা জোনাকিদের ঝাঁক মনে করিয়ে দেয় সেই বিখ্যাত উক্তি " স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তা এখানেই এখানেই "। বেশ ঠান্ডায় অন্যান্য পর্যটকেরা যখন ঘরে প্রবেশ করলো তখন রাতের সাথে মিশে গেলো গা ছমছমে এক অনুভুতি। অবশেষে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাথর দিয়ে তৈরি ঘরে নিজেকে বন্দী করতে হলো এই পরিবেশে আর কিছুক্ষণ কাটানোর মায়া ত্যাগ করে। টেবিলে সাজানো ছিল সুস্বাদু খাবার। রাতের খাওয়া শেষে ঘুম এলো নদীর কলতান শুনতে শুনতে।



সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখলাম একদল শিশু, কিশোর নদীতে  মাছ ধরছে। নদীর ওপর বড়ো বড়ো পাথরে বসে আছে নানা পাখি । এদের মধ্যে মাছরাঙা এবং  ফিঙে পাখী বেশি । নদীর পাড়ে গিয়ে কিনে নেওয়া হলো কিছু মাছ। হাতে অল্প সময় থাকায় আমরা আজ ফার্ম হাউসের বাঁদিকে কিছুটা পথ হাঁটতে বেরোলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখতে পেলাম বাঁশের এক ঝুলন্ত সেতু যার নীচ দিয়ে বয়ে গেছে নদী। নদী পার হয়ে ওপারে চলে যাওয়া যায় অনায়াসে। এখানে নদীতে নামারও ব্যাবস্থা রয়েছে। ফিরে এসে সকালে কেনা সেই মাছ ভাজা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা রওনা দিলাম দার্জিলিংয়ের পথে। দার্জিলিং যাওয়ার পথে আমরা দেখলাম নিস্তব্ধ এক পাইন বন। এই পাইন বনের মেঠো রাস্তা দিয়েই গন্তব্যে যাওয়ার পথ। পাইন বনে ঝরা পাতার ওপর গাড়ি চলার শব্দ আর পাখির ডাক আমাদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে আদিম পৃথিবী পর্যবেক্ষণের অনুভূতিতে। এভাবেই সুখিয়াপোখরি থেকে আমরা লেবচাজগতে এসে পৌঁছলাম একসময়। যাত্রা বিরতিতে লেপচাজগতের রাস্তায় হেঁটে বেড়ালাম কিছুক্ষন। পাইন বনের মাথার ওপর মেঘেদের আনাগোনা  মনোমুগ্ধকর। লেপচাজগৎ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় পরিষ্কারভাবে। আমরা অবশ্য মেঘের জন্য তার দেখা পেলাম না । তবুও যা পেলাম  তা অসামান্য। ওপরে নীল আকাশ নিচে পাইন বনের সবুজ, প্রকৃতির দৃশ্যকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। পরবর্তীতে এখানে রাত কাটানোর বাসনা নিয়ে পা বাড়ালাম পাহাড়ের রাণী দার্জিলিং এর দিকে। দার্জিলিং মানেই ট্রয় ট্রেন, মুখরিত ম্যাল , রক গার্ডেন , ঘুম স্টেশন । হৈ চৈ করে কাটিয়ে দিলাম পাহাড়ের রাণীর কোলে দুইটি দিন। পুরো ভ্রমণে এখানেই একদিন ভোরে দেখা পেয়েছিলাম স্লিপিং বুদ্ধর। কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ যতবার দেখি আরো দেখার তৃষ্ণা বেড়ে যায় তাইতো বার বার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে এই বিশালত্বের কাছে।টুকরে ভ্রমণের এই অভিজ্ঞতা সারা জীবনের সম্পদ হয়ে থেকে যাবে মনের মণিকোঠায়। উত্তরবঙ্গের সৌন্দর্যের টান অমোঘ তাই যতবার যাই না কেনো পরবর্তীতে আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। এই স্বপ্নের দেশে সূর্য অস্ত যায় চা বাগানে তার শেষ আলোর লাল আবির ছড়িয়ে দিয়ে। এ যে এক মনকেমনের সবুজ দেশ।



কিভাবে যাবেন :- ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে গাড়িতে টুকরে যেতে হবে। টুকরে যাওয়ার দুটি রাস্তা। মিরিক হয়ে যাওয়া যায় আবার দার্জিলিং হয়েও যাওয়া যায়।
 কোথায় থাকবেন : - টুকরেতে খুশি'স ফার্ম হাউসে থাকা যায় এছাড়া আরো দুই একটি ছোটো বড়ো হোমস্টে আছে।


মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য