নন্দিতা মিত্র
বই আলোচনা
বই: মেয়েদের কথা
লেখিকা: প্রতিভা সরকার
প্রকাশনা: নবজাতাক প্রকাশন
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১২৮
মুদ্রিত মূল্য: ২০০
"বাবার ঘরে জন্ম তার
স্বামীর ঘরে শেষ,
ছেলের হাতের আগুন নিয়ে
ছাড়বে সুখের দেশ।
আপনজন পর হয়ে যায়
পরকে করে আপন,
পরকে আপন করেই
নারীর আসল জীবনযাপন।
সিঁথির সিঁদুর, হাতে শাখা
স্বর্গ-সুখী জীবন,
এক বাসাতে জন্ম নেবে
অন্য বাসাতে মরণ।"
(অনুপমা দে)
একটা মেয়ের যাপনচিত্র বোধহয় এরকমই। ক্ষেত্রবিশেষে, জায়গা বিশেষে অবস্থা কিছুটা উন্নত হলেও মূল চিত্র কিন্তু একই থাকে তা সে নিম্নবিত্ত বা উচ্চবিত্ত যে পরিবারেরই সদস্য হন না কেন। আসলে পুরুষশাসিত সমাজের কতজন পুরুষ সাফল্যের শীর্ষে ওঠা নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান আর স্বীকৃতি দিতে পারে? নানাভাবে নারীর সাফল্যকে তুচ্ছ, খাটো করার চেষ্টা করতে থাকে পুরুষ। সাফল্যের কথা যদি বাদও দিই, মেয়েদের যে একটা আলাদা আইডেন্টিটি আছে, ধারণক্ষমতা আছে, নিজস্ব জগৎ আছে, তারাও স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে, নারী জীবনের এই সহজ, সাধারণ সত্যকে পুরুষ অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্যই করে এসেছে চিরকাল। নারীর প্রতি তাচ্ছিল্য আর অপমান আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির যেন অন্তর্গত হয়ে গেছে। কথা প্রসঙ্গে আলবেয়ার কামু একবার সিমোন দ্য বোভোয়ার কাছে মন্তব্য করেছিলেন, নারীর পিছিয়ে থাকার কারণে পুরুষরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবচেয়ে বেশি, কারণ তারা উপযুক্ত সঙ্গিনী পায় না। উপযুক্ত সঙ্গিনীর অভাবের কথা বলেছিলেন কামু। কিন্তু নারীর উপযুক্ত হয়ে গড়ে ওঠার পেছনে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো কাজ করে সেগুলোর কথা তিনি আর বলেননি। আর উপযুক্ত হলেও পুরুষতন্ত্র যে নারীকে দমিয়ে রাখতে পছন্দ করে এ-কথা চারিদিকে চোখ রাখলেই বোঝা যায়।
নারীর প্রতি পুরুষের এই লাঞ্ছনা, অবমাননার একটি সামাজিক ভিত্তি আছে। অ্যারিস্টটলও বলেছিলেন, মেয়েরা পুরুষের তুলনায় অক্ষম ও স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন। অ্যারিস্টটলকে অনুসরণ করে যুগের পর যুগ ধরে পুরুষেরা তোতাপাখির মতো একই কথা আউড়ে গেছেন। সমাজপতিদের দেওয়া অনুশাসন নারীর জীবন, স্বপ্ন, অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে বিকশিত হতে না দিয়ে যুগ-যুগ ধরে তাকে অন্দরমহলের অন্ধকারে আবর্জনার স্তূপে আবদ্ধ করে রেখেছে। মেয়েদের বুদ্ধির বিকাশের সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর সবচেয়ে বড় irony হল সব পথ বন্ধ করে দিয়ে বলা হয়, মেয়েদের বুদ্ধির বিকাশ ঘটে না। নারী প্রগতির এই সময়ে আজও আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেয়েদের অগ্রগতি, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য, কৃতিত্ব রুখে দেওয়ার জন্য সদাতৎপর। দেশের শিক্ষিত শ্রেণি নিজেরাই পশ্চাৎমুখী চিন্তাভাবনায় আজও আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। পুরুষ পশ্চাৎমুখী চিন্তাভাবনায় আচ্ছন্ন এ-কথা বললে আবার সমাজপতিরা ক্ষিপ্ত হবেন, কারণ সমাজটা আজও তাদের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। নারীর প্রতি অবজ্ঞার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়েই তাদের এই কূপমণ্ডূক চিন্তাভাবনা প্রকাশ পায়। নারী আজ যখন সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখছে, কিংবা গ্রহান্তরে যাওয়ার উপযুক্ত হয়ে উঠছে, শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, খেলাধুলা, সব রকমের পেশায় সাফল্যের পরিচয় দিয়ে নিজেকে পুরুষের সমকক্ষ প্রমাণ করেছে তখনও আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষিত রক্ষণশীল সম্প্রদায় নারীর বিকাশকে সর্বপ্রকারে স্তব্ধ করতে সদাপ্রচেষ্ট। গত প্রায় ৫০-৬০ বছরে সর্বক্ষেত্রে নারীর বিস্ময়কর অগ্রগতি সত্ত্বেও নারীকে হেয় করার প্রবণতা, নারীনির্যাতন, লাঞ্ছনা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। নারী ভোগের বস্তু, অতএব তাকে দখলে রাখতেই হবে। এখনো নারীর পরিচয় নির্ধারিত হয় পুরুষের উপভোগ্যতাসাপেক্ষে। নারীকে দেখা হয় পুরুষের পরিপ্রেক্ষিতে। কুমারী হলে পিতৃপরিচয়, বিবাহিত হলে স্বামীর পরিচয়ে কিংবা পুত্রের পরিচয়ে। নারী আজও স্বতন্ত্র পরিচয়বিহীন, নিজস্ব ঠিকানাবিহীন।
কিন্তু এই মেয়েদের কথা বলে কজন? মেয়েরা নিজেরাই কি বলে? ‘আমার স্বামী এক গ্লাস জল ভরেও খেতে পারে না’ বলার মধ্যে যে চাপা অহংকার লুকিয়ে থাকে তার সেই গর্ববোধ কি কোন আন্দোলন দিয়ে চাপা দেওয়া যাবে? এখনো কেন আমরা বলতে পারি না ‘আমরা নারী কিন্তু আমরা সব পারি না!’ উপরে চাকচিক্য আর নারী স্বাধীনতার নামে ঢক্কানিনাদ কিন্তু পাদপ্রদীপের তলায় সেই গাঢ় অন্ধকারটা থেকেই যায়। বর্তমানে বাংলা সাহিত্যে নারীদের কথা বলার জন্য যে ক’জন লেখক এগিয়ে এসেছেন তাঁদের মধ্যে প্রতিভা সরকারের নাম সর্বাগ্রে থাকবে। প্রতিভা সরকার যিনি একাধারে গল্পকার, ঔপন্যাসিক এবং প্রাবন্ধিক তিনি মেয়েদের কথাই বলেন। তাঁর প্রবন্ধে, গল্পে মেয়েদের কথা এসেছে বারবার। কারণ তিনি একজন বিশিষ্ট সমাজকর্মী হওয়ায় খুব কাছ থেকে তাদের দেখেছেন, চিনেছেন, অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছেন তাদের নিত্যদিনের কষ্টের কথা, যন্ত্রণার কথা। লেখিকার ‘ফরিশতা ও মেয়েরা’ এবং ‘সদা বাহার’ যারা পড়েছেন তারা জানেন তিনি কীভাবে একজন দক্ষ ডুবুরির মতো তাদের মনের ভিতরে প্রবেশ করে তাদের কষ্টগুলো বের করে নিয়ে এসেছেন এবং নারীমনের ছবি অঙ্কন করে ফুটিয়ে তুলেছেন তাদের ‘ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা/ছোট ছোট দুঃখ কথা।
এই বইয়ে মোট কুড়িটি প্রবন্ধ আছে। এগুলি হলঃ
লোক আদালত ও মেয়েরা
নাচনি জীবন
নাম বেনাম গুমনাম
করোনা সতী
রঙিন ছলনা
সংসার সীমান্তে
নাচ লৌন্ডা নাচ
যৌনকর্মীর মাতৃত্ব ও স্বাস্থ্য
রাজনীতি ও যৌনকর্মী
দুর্বার ও ডাক্তারবাবু
আন্দোলন ও মেয়েরা
নতুন জোড়া আইনের নাগপাশে নারী
সোনাগাছিতে এনআরসি
অনুপ্রিয়া ও এনআরসি
“মুসলমানের আন্দোলন” ও নারীর ভূমিকা
মন্দিরদেবতা ও গণদেবতার অঙ্গন
মেয়েদের দর্পণে বর্তমান কাশ্মির
ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির একশো বছরে সাম্যবাদী বাঙালিনী
ভালো তালিবান ও শরিয়তসম্মত নারীস্বাধীনতা
সিরিয়ার মেয়েরা
নভেম্বরের নারী
কৃষক আন্দোলন ও নারী
প্রত্যেকটি নারীকেন্দ্রিক এবং শুধু তাদের কথাই বলা হয়েছে। নাচনির জীবন সংক্রান্ত ধারণা পাওয়া যায় নান্দীকারের ‘নাচনি’ নাটকে। নাচনির সেই ঘৃণ্যময় জীবনের কথায় লেখিকা শোনালেন ‘নাচনির জীবন’ নামক প্রবন্ধে। পলাশ মরশুমে যেখানে প্রকৃতিতে আগুন লাগে সেখানে ঝুমুরের অগাধ সুর সমুদ্রে সাঁতার কাটতে আসা পর্যটকরা জানেন না যে নাচনি হওয়া অত সহজকথা নয়। নাচনিবিদ্যা আয়ত্ত করতে হয়। শরীরে লাস্য আনতে, বিভঙ্গ আনতে কতটা কষ্ট করতে হয়। প্রেমিক থেকেও নেই, রসিকের সংসার টানলেও সে সংসারে তার কোন জায়গা থাকে না। মরার পরও অস্পৃশ্য জ্ঞানে পায়ে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় পিটিয়ে মারা কুকুরের মতো। সময় আর সংগ্রামের ফলে এই পাশবিক প্রথার শেষ হলেও সামাজিক বিধান ‘নাচনির মেয়ে নাচনিই’ হবে। পস্তু (পোস্ত)বালা হয়তো নাচনি সম্প্রদায়ের এক আলোকবর্তিকা যে ‘লাদে মারুনি’ হওয়ার দুর্ভাগ্য থেকে বেরিয়ে এসে ‘লালনবিজেতা’। কিন্তু কিছু পুরস্কার, খ্যাতি আর সম্মানেও আসল চিত্রটা বদলায় না।
শেক্সপিয়র যতই বলে যান না কেন what's in a name নামে কি আসে যায়! কিন্তু নামে যে অনেক কিছুই আসে যায় তা লেখিকা দেখিয়েছেন তার ‘নাম বেনাম গুমনাম’ এই প্রবন্ধে। গায়ের রং বা চেহারা রোগা মোটা ফর্সা রঙচাপা যাই হোক না কেন সব কিছুরই তির্যক মন্তব্য ছুঁড়ে দেওয়া হয় মেয়েদের দিকেই। চটুল হিন্দি বা বাংলা গানেও মেয়েদের নাম দিয়ে যত গান হয়েছে তা নিয়েও অশ্লীল ঠাট্টা রসিকতা করা হয়েছে মেয়েদেরই। শুধু তাই নয় বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয়েছে মেয়েদের নামেই--বুলবুল নিলোফার তিতলি নীলম মুরজান নার্গিস নামের অন্তরালে কিকোড়া হয়েছে শুধুমাত্র অশোভন উল্লাসের জন্য? এই নামবিভ্রাটের ফলেই তামিলনাড়ুর হোস্টেলনিবাসী পাঁচটি মেয়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছিল। পিতৃতন্ত্রের এই নোংরা অশোভনীয় অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির জননেত্রী মণিকুন্তলা সেনও কীভাবে সহ্য করেছিলেন তা পড়ে রীতিমতো হতবাক হতে হয়।
সবকিছু সহ্য করেও কীভাবে যেন মেয়েরা অনেকদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে। সতীদাহ প্রথার সময়ও তাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ‘সতী’ হতে হত। তেমনি হালফিলে এক অজানা ভাইরাস গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেওয়ার সময়ও দেখা গেছে মেয়েরাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে নিকট আত্মীয়দের সেবা যত্ন করতে গিয়ে। পরীক্ষিত সত্য যে পৃথিবীতে মেয়েরা দীর্ঘায়ু। কিন্তু এক অতিমারি সব হিসেব উল্টে দিয়ে গেছে। এঈ ভয়ংকর ভাইরাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল যে সতীদাহ প্রথার আজও শেষ হয়নি, বরং ফিরে এসেছে নবরূপে, নবনামে। লেখিকা দীর্ঘদিন ‘দুর্বার’ এবং ‘আপনে আপ’ এই সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত। সমাজকর্মী হওয়ায় বিভিন্ন স্তরের মেয়েদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন। যৌনকর্মীদের সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটেছে। সেখানে বিভিন্ন মেয়েদের তিনি দেখেছেন, তাদের জীবন সম্পর্কে জেনেছেন। অন্ধগলির এই আদিম পেশার বাসিন্দাদের প্রায় সবার গল্পই এক। কিন্তু লেখিকা এই পাড়ার মেয়েদের বিশেষ কিছু গুণ সম্পর্কে গভীরভাবে আলোচনা করেছেন। তাদের শাঁখা-সিঁদুরের প্রতি মোহ, সন্তানধারণের তীব্র ইচ্ছা, তাদের প্রতিপালনের জন্য দিনাতিপাত, নানা রকম সামাজিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সন্তানের মঙ্গলের জন্য দিনগত পাপক্ষয় তা কেবলই ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ থাকার কথাই প্রতিফলিত হয়। কিন্তু রাতের অন্ধকারে যেখানে যাওয়া যায় দিনের আলোয় সেটাকে মেনে নিলে তো সমাজের চলবে না। নানা রকম প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে গিয়ে বেশ কিছু যৌনকর্মী রুখে দাঁড়াচ্ছেন দুর্বারের হাত ধরে এটা দেখে মনে আশার সঞ্চার হয়। যৌনকর্মীদের কাছে শাঁখা-সিঁদুর যেমন একটি মোহ-র বিষয় তেমনি বিবাহিত মহিলাদের কাছে এটাই স্বামী সোহাগের চিহ্ন অথবা ফ্যাশন স্টেটমেন্ট অথবা স্ত্রীটিকে স্বামীর চিরস্থায়ী সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার চিহ্নস্বরূপ। এই শাঁখা-সিঁদুর পরা নিয়ে গৌহাটি আদালতের রায় দেখে হতবাক হতে হয়। এটা দেখে লেখিকার আর্তি—
"যারা সুন্দর দেখাবে বলে সিঁদুর পরেন তারা পরুন, শুধু এটুকু জেনে পরুন যে সেটি জীবনে অনেক কিছুর মতই একটি রঙিন ছলনা। বিবাহিত জীবনের পূর্ণতা বা সার্থকতা কোথাও থেকে থাকলে তা অন্তত সিঁদুরের রঙে লুকিয়ে নেই।"
সামাজিক পট পরিবর্তন যখনই হয়েছে তখনই তার বলি হতে হয়েছে মেয়েদেরই। নোট বন্দি, এনআরসি, সিএএ সবকিছুর সরাসরি কুফল এসে পড়েছে এই অসহায় মেয়েগুলোর উপর। এনআরসি আর সিএএ-র ফলে কীভাবে তারা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা যুক্তিসহকারে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং প্রমাণসমেত পেশ করেছেন লেখিকা। লালবাতি পাড়াতেও সাম্প্রদায়িকতার বীজ কীভাবে ছড়ানো হচ্ছে এখানে তাও স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। তবে দেওয়ালে পীঠ ঠেকে যাওয়া ওরাও জোটবদ্ধ যে কোনভাবেই এই বীজকে মহীরুহে পরিণত হতে দেবে না। তাই নিজেরাই গড়ে তুলেছে নানা সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন।
যুদ্ধবন্দী হোক বা যুদ্ধ পরবর্তী সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর উদ্যত খাঁড়ার আঘাতটা প্রথমে নেমে আসে মেয়েদের ওপরই। সেই পৌরাণিক যুগের সময় থেকেই এখনো যে এই নিয়মের অন্যথা হয়নি তার প্রমাণ জ্বলজ্বল করে সিরিয়া, আফগানিস্তান, রাশিয়ার বিভিন্ন ঘটনাবলীর সময়। আফগানিস্তানে মেয়েদের তো পশুদেরও অধম বলে মনে করা হয়। এখনো এখানে শাসক বদলের সঙ্গে সঙ্গে শরিয়তি আইনের ব্যাখ্যাও পাল্টে যেতে থাকে। নারী স্বাধীনতা নামক গাজর মুখের সামনে ঝুলিয়ে রাখলেও বোরখায়, অত্যাচারে, পাথর ছুঁড়ে মারায় তালিবানিরা তাদের বর্বরতার নিদর্শন দেখিয়ে যাচ্ছে সবসময়ই।
মেয়েদের ব্রাত্য রেখে যে কোন আন্দোলনই সফল হয় না তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। বামপন্থী আন্দোলনে মেয়েদের ভূমিকার প্রসঙ্গে লেখিকা মর্মাহত হয়েছেন। যদিও মেয়েরাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিবাদে সামিল হয়েছে তাদের জন্যই কীভাবে অসাম্প্রদায়িক বাতাবরণ বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে সেটাও বলেছেন। শুধু তাই নয় অতি সাম্প্রতিককালে কৃষক আন্দোলনে মেয়েদের ভূমিকা নিয়ে দুর্দান্তভাবে আলোকপাত করেছেন ‘কৃষক আন্দোলন ও নারী’ নামক প্রবন্ধে। দেওয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় তখন আন্দোলনই যে একমাত্র হাতিয়ার তা জানে মেয়েরা। তাই ২০২০ সালের ‘তিন কৃষি আইন’ নামে কালা কানুন যখন পাস হয় তখন মেয়েরাই নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্নের আভাস পেয়েছিল প্রথমেই। কারণ তারা জানে ঘরেও বরাদ্দ কমলে আগে বলিদান দিতে হবে তাদেরই। ঘরের ভাতে টান পড়লেও পুরুষটির ক্ষুধা নিবৃত্তি করে যেতে হবে নিজে খিদের জ্বালায় জ্বলেও। পড়াশোনা থেকে শুরু করে স্বাধীনতা হরণ সবকিছুরই প্রভাব পড়বে মেয়েদেরেই ওপর। সংসারে বাজেট ছাঁটাইয়ের প্রথম কোপ পড়ে তাদেরই ওপর। এটা বুঝেই হরপ্রীত, নিকিতা জ্যাকভ, দিশা রবি, হরিন্দর বিন্দু, নওদীপরা সরাসরি কৃষক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, নেতৃত্বও দিয়েছে। সমাজের সবচেয়ে শোষিত শ্রেণি নারী জাতি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে তারা প্রতি মুহূর্তে নিগৃহীত হচ্ছে, যে রাষ্ট্রব্যবস্থা নারীকে অবদমিত করে রেখেছে, জনগণই পারে সেই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করতে। রাষ্ট্র তার সর্বশক্তি দিয়ে দমননীতি প্রয়োগ করেও এদের দমাতে পারেনি পাশে মনদীপ পুনিয়াদের মতো কিছু নির্ভীক সাংবাদিকদের থাকার জন্য। কৃষক আন্দোলনের সফলতার এবং কৃতিত্বের দাবি তাই মেয়েদেরকেও দিতে হয়।
সীতাকে অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। সর্বক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমকক্ষ প্রমাণিত হওয়ার পর আজও নারীর শরীরে লেপ্টে থাকে ‘Frailty thy name is woman..’ ধারণাটা পুরুষ নারীর মনে এমন দৃঢ়ভাবে গেঁথে দিয়েছে যে নিজের অজান্তে নারীর মনেও এই বিশ্বাস গাঁথা হয়ে গেছে। নারী একটা নির্দিষ্ট বৃত্তে বন্দি প্রাণী, তার দৃষ্টির সীমানা সংকীর্ণ, মেধাচর্চার চাইতে ঘর-গেরস্থালি, সন্তানের জন্মদান আর প্রতিপালনেই তার জীবনের সার্থকতা – পুরুষশাসিত সমাজ নারীকে এভাবেই দেখতে চায়। নারীও নিজেকে এই জীবনে মানিয়ে নেওয়ার জন্য জন্মের পর থেকে তৈরি হয়। মেয়েদের অসহায় নীরবতার আড়ালে থাকে যন্ত্রণা আর অপমান। নীরব সেই যন্ত্রণা প্রতিনিয়ত দগ্ধ করে লেখিকাকে। সেই যন্ত্রণা উপলব্ধি করে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন এই কুড়িটি প্রবন্ধে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন