শুভশ্রী সাহা
ওয়াজির
নিজের হাত এখন নিজেই কামড়ে ধরছেন নিজামমুল মুলক প্রচন্ড ক্রোধে, তিনি সামান্য কয় এক দিনের জন্য দিল্লি ছেড়ে গেছেন অমনি সাজানো ঘুঁটি পালটে গেল! মহম্মদ আমিন কোন সুবাদে একেবারে ওয়াজির হয়ে গেল তিনি না থাকলে সরতো সৈয়দ ভাইরা? এখন সব জাঁকিয়ে বসে পড়ল নাহ, তিনি এক এক করে শাস্তি দেবেন সবাইকে কাউকে ছাড়বেন না! আর সেদিনের এক ছোকরা বাদশা, সুরা শিকার আর নিত্য নতুন নারীসঙ্গ ছাড়া বোঝে কি? সে ঠিক করবে ওয়াজির? তার এত বড় স্পর্ধা হল কি করে? কী বোঝে সে রাজনীতি রণনীতি আর শাসনকার্যের, নিজামমুল মুলক এসে বসলেন মখমলের গদিতে, গড়গড়ায় ইরানি তাম্বুলে মুখ দিয়ে টানলেন মৃদু মৃদু, রুপার গ্লাসের গায়ে জমা হয়েছে বরফের কুচি , সুগন্ধি আতরের গন্ধ দেওয়া সরবৎ দিয়ে গেছে খিদমদগার মুখের ঢাকনি খানি খুলে চুমুক দিলেন আহ!
--- সুবাদার সাহেব, আপনার সঙ্গে মির্জা আবদুল বেগ দেখা করতে এসেছেন, মুখ বাড়াল খাস নৌকর এনায়েত
বহত খুব! এখন বাদশার দারোগা ই দেওয়ান ই খাস হয়ে গেছে আসবেই তো! মনে মনে জ্বলে উঠলেন নিজামমুল মুলক দিল্লীর হিন্দুস্থানি ওমরাহ আমীরজাদারা ভিখারির অধম তাদের কোন রাজ রক্ত নেই ! এ যদি ইরানি তুরানি হত দেখিয়ে দিত খেল , মুখে অবশ্য বললেন
---মেহমানকে খাতিরদারি কর, বসাও মিঞা, এখানে ঘন ঘন সেলাম ঠুকে কী হবে!
নিজামমুল মুলক তার মেহমানখানায় এসে ঢুকলেন, দিল্লীর প্রাসাদ থেকে তার বাগ বাগিচা দিয়ে সাজানো এই মহল বেশি দূরেও নয় মাঝখান থেকে যমুনার এক ক্ষীন শাখা বয়ে গেছে সেই দিকে তাকালেই নিজামের কৃষ্ণা নদীর কথা মনে পড়ে, দক্ষিণ তার পেয়ারের মুলুক তার রুজি রোজগারের জায়গা আলিশান মহল ধনরত্ন হীরে জহরত শান শওকত বেগমজানেরা আমীরজাদি আমীরজাদারা সব রয়েছে সেখানেই, কিন্তু দিল্লির তখতের উপর কবজা বল নজরটুক রাখতে গেলেও এখানে থাকতে হবে। ইংলিশচানিদের দক্ষিণের বন্দরগুলির উপর তীব্র লোভ আর এই লোভকে আটকাতে হবে তাকেই!
--- সেলাম আলেহকুম সুবাদার সাহাব, আপনি দিল্লি এসে পড়েছেন শুনেই দেখা করতে এলাম
--- বহুত খুব মির্জা সাহেব! আরে কে কোথায় আছিস শরবত মিঠাই লাড্ডু নিয়ে আয় মেহমাননবাজি কোথায় তোদের , গলা তুললেন নিজাম মুল মুলক
তা, আপনি আমার দোস্ত আসবেন তো বটেই, কিন্তু বাদশা মহম্মদ শাহের মতন একটা নাকাম লোক যখন মহম্মদ আমিনকে ওয়াজিরতটা দিয়ে দিলেন চুপ থাকলেন কেন বলুন তো?আর শুধুই ওয়াজির? মুলতানের সুবাদারি ধন রত্ন কী না কি! অথচ সৈয়দ ভাইদের তাড়িয়েছি একমাত্র আমি! কার দাঁড়ানোর সাহস ছিল নয়ত? সত্যি বলুন তো!
আবদুল মির্জা চুপ হয়ে গেলেন কিছুক্ষণ তারপর বললেন,
নিজাম সাহেব ওয়াজির মহম্মদ আমিন আপনার আত্মীয়, আপনার চাচাতো ভাইজান শান্ত মানুষ মতলবী নয়!
--- তাতে আমার কী ! আমি না থাকলে হুসেন আলি আবদুল্লা খাঁকে কে তাড়াত? মতলবী নয়? বাদশা মহম্মদ শাহ সারাদিন ওয়াজিরের বাহিনীর মধ্যে পাহারাতে আছেন কী ক্ষমতা রেখেছে সুলতানের শুনি?
-- ইনশাআল্লাহ, নিজাম সাহাব হুসেন আলি যখন হায়দর কুলি খাঁকে মীর আতিশের মত জায়গায় বসালেন আপনিও চুপ ছিলেন এই জায়গা আমার আব্বাহুজুরের জন্য ছিল আপনি তো জানতেন, না?
--- শুনুন হায়দর কুলি একজন তুরানি ওমরাহ্! সেই সময় একজন হিন্দুস্থানি অভিজাতকে এই জায়গা দেওয়া যেত না
--- তওবা তওবা আপনি আমাদের হিন্দুস্থানি বলে মুঘলিয়াতের যোগ্য মনে করেন নি! বহুত খুব অথচ আমরা কিন্তু হুসেন আলি আবদুল্লা খাঁকে কোন দিন সমর্থন করিনি
--- করলে এতদিনে রাজপুত আর জাঠেদের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে হত জাগীরে গিজগিজ করত রাজপুত আর মারাঠা, একেই হুসেন আলি জিজিয়া তুলে দিয়ে সব হিন্দুগুলিদের মাথায় তুলেছে !
-- বেশক! অস্বীকার করিনা , আমি মহম্মদ আমিনের খিলাফ ও নয় আবার ওনার হয়ে ওকালতি করতেও আসিনি জনাব --- আমি বলি কী, মহম্মদ আমিন বৃদ্ধ হয়েছে উনি আর কতদিন বলুন ধৈর্য্য ধরুন নিজাম সাহেব! তবে আমার একটি অন্য কথা ছিল কিন্তু বলি কী করে বুঝতে পারছি না
নিজাম ভুরু কুঁচকালেন মনে মনে বললেন এই উল্লুক টা আবার কী চায়! ব্যাটাছেলে বাদশার খাস খিদমতগার হয়েছে কিনা জাতে উঠে গেছে, বিরক্তি চেপে রেখে বললেন ---
--- বেশ তো কি বলবেন বলুন না
--- জনাব আমার আমীরজাদা এক্রাম উদ দুল্লা বেগ আপনার ভাই সাদাৎ খানের কন্যাকে নিকাহ করতে চায় অনুগ্রহ করে কবুল করুন
নিজামুল মুলক ভয়ঙ্কর চমকে গেলেন হিন্দুস্থানের ওমরাহের এত সাহস! ইরানি মুসলিমদের বরাবরি চায় এবার,একেবারে রিস্তাদারি -- হুসেন আলি,আবদুল্লা খান এদের বাদশাহিতে জায়গা দিয়ে এত সাহস না জোগালে ---- তার মনের কথা যেন শুনতে পেল আমীর, মির্জা আবদুল্লা
-- আপনার লাভ বই লোকসান হবে না নিজাম সাহেব
-- মানে?
-- ওয়াজিরতের খেলা কে কী বোঝে বলুন ওয়াজির মহম্মদ আমিন নিজে আমার সুপুত্রকে ওনার খাস পেশকারিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে দ্বিতীয় বক্সী পদ দিয়েছেন--- হে হে ওয়াজিরের কাছাকাছি থাকা মানেই তো তখতের খবর পাওয়া জনাব! মহম্মদ শাহ তো সেদিনের বাদশা, এই বিশাল মুলকের খবর কী রাখবে? এক পেয়ালা সুরা আর এক নারীতেই সে খুশী
--- হুম! দাড়ি চুমরে নিলেন নিজাম কি করতে চান শুনি?
--- ওয়াজিরের খাস খিদমতগার হল দ্বিতীয় বক্সী, মহম্মদ আমিন বৃদ্ধ হয়েছেন তার খাওয়া দাওয়া দাওয়াই হাকিমি সবই তো দ্বিতীয় বক্সী এক্রাম উদ দোল্লার হাতে, নিজাম সাহেব কত কী হয়ে যেতে পারে চাইলে! মহম্মদ আমিন ঠান্ডা লোক হলেও বাদশার ডানা ছেটে ফেলেছেন তার ওয়াজিরত পাল্টানোর দম নাকাম বাদশা মহম্মদ শার নেই , গলা নামালেন মির্জা, জনাব বাদশাহিতে মহম্মদ আমিন কম শক্তিশালী বৃত্তে নেই, তার অনেক দোস্ত আছে তারা কেউ কেউ আপনার সরদর্দের লোক নিজাম সাহেব,তাই একমাত্র সুযোগ ---
--- বদলে আপনি কী চান মির্জা আবদুল্লা স্পষ্ট করে বলুন তো এবার
--- কী বলব! হিন্দুস্থানি ওমরাহ্ ভালা কী করে শাহী সুবাদারের কাছে পেশকাশ করতে পারেন বলুন
--- পারেন বইকি যখন আপনি শাহী ইরানিদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে যাচ্ছেন!
--- কেয়াবাত! ইনশাআল্লাহ আর আমার কী চাইবার আছে বলুন জনাব আপনি কবুল করেছেন মানে নিকাহ হয়েই গেছে
--- তারপরেও তো কিছু থেকে যাচ্ছে মনে হচ্ছে জনাব মির্জা
--- আহ হা নিজাম সাহেব একটা কথা জানতে মন চায়, আপনি ওয়াজির হলে দাক্ষিণাত্য অন্ধকার হয়ে যাবে এই দুই জায়গায় তো আপনি আর---
--- দাক্ষিণাত্যের সুবাদার আমি আছি, আমিই থাকব নির্জা! দিল্লির ওয়াজিরত আমার তাজের পালকমাত্র , তাজ নয়! আপনাদের মত দোস্তদের জন্য ক্ষমতা চাই আমার - আর সেইজন্যই -- বুঝলেন কিনা
--- কিন্তু আপনি তো দিল্লী থাকবেন জনাব
-- হা হা হা হা, দিল্লি সামান্য ব্যাপার হিন্দুস্থানের বাইরে তো যাই নি আমি দাক্ষিণাত্য আমার চোখের নূর মির্জা মারাঠা রাজপুতদের থেকে জিতে আমি নিয়েছি, দান দেয় নি মুঘল বাদশা বেহকুফ বেমর্দ মুঘল বাদশা ফারুকশিয়ার ইংলিশ্চানিদের হাতে ফরমান তুলে দিয়ে পুরো হুকুমত দিয়ে দিল সুবে বাংলায়
--- হ্যাঁ তা হামিলটন সাহেবের হেকিমিতে বাদশাহুজুর আব্বা বনেছিলেন কিনা -- মির্জা খিক খিক করে হাসল
--- থামুন! হ্যামিল্টন সাহেব না আবদুল্লা খাঁ র শয়তানি! মীরজুমলাকে কাজে লাগিয়ে সাহেবদের কাছ থেকে বাণিজ্যের নজরানা নিজে আদায় করবে বলে ---
--- তা বটে ওয়াজিরের ইচ্ছা হলে এমন নাপাক কাম করতে পারে বইকি , তবে খোদাতালা নিশ্চয় শাস্তি দেবেন তাঁদের
-- কিন্তু সুরাট মসুলিপত্তম কোচিন কালিকটে আমি ইংলিশচানিদের কোন জায়গা দেব না মুঘল সুবাদারকে রাজস্ব দিলেই কারবার করতে পারবে নইলে নয়!
--- তওবা তওবা জনাব আপনি না হলে হিন্দুস্থানের ওয়াজির কাউকে মানায়? তাহলে আপনি আমাকে বরং খান্দেশ বা বেরারের সুবাদারিটা দিয়ে দেবেন
--- খান্দেশ , বেরার? স্পর্ধা শুনে দাঁতে দাঁত ঘষলেন নিজাম মুল মুলক কিন্তু উপায় কি? মুখে বললেন
--- মালব আজমীঢ় আরো বড়,
--- মাফ করবেন নিজাম সাহেব আজমীঢ় মালব দিয়ে আমার রাজপুতদের মুখের সামনে ফেলবেন না, তাছাড়া ভেবে দেখুন আপনার মহলের একটি সিতারা আমার মহলে আসবে জনাব --- আপনার শাহজাদি দিলওয়ারা!
--- বেশক! তবে খান্দেশ রইল আপনার জন্য
--- নিজাম সাহেব মেহেরবান, রহেমদিল আহা হা হা নিকাহর শুভ দিন দেখতে হয় তাহলে ! আর আজ থেকেই মির্জা এক্রাম উদ দোল্লা কাজ শুরু করে দেবে একদম চিন্তা করবেন না, ফিসফিসালো সে, ইরান থেকেই আনা আছে
হাত তুলে ঔষধের মুদ্রা দেখাল হিন্দুস্থানি আমীর মির্জা আবদুল্লা বেগ ---
বাহ! চমৎকার গল্প।
উত্তরমুছুন