যুগান্তর মিত্র



ঘুমের অতলে ##

বিপুল সরকারের চিঠি পড়ে অনেকক্ষণ থমকে থাকে দীপ্তিময়। বিন্দুর কথা লেখা আছে চিঠিতে। ভেতরে ভেতরে একটা নদী পাড় ভাঙে। ঝুরঝুর করে মাটি খসে পড়ে। একটানা মাটি খসার শব্দে তার মাথা টিপটিপ করে। অস্থির লাগে তার। মশারির নীচে শুয়ে স্লিপিং লাইটের আলো-আঁধারিতে বিন্দুকে নিয়ে ঝামেলার সেইসব দিনগুলো চলেফিরে বেড়ায়। বাবার সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনও একটা অস্বস্তিকর গুমোট হাওয়া বইয়ে দেয় ঘরের মধ্যে। সহসা ঘুম আসতে চায় না দীপ্তিময়ের।
চিঠিটা কুরিয়ারে এসেছিল দুপুরে। তখন দীপ্তিময় অফিসে কেনা টিফিন খেয়ে সবেমাত্র কাজে বসেছে। ভাই ছাড়া তাকে কেউ চিঠি লেখে না। লেখার কথাও নয়। ফেলে-আসা জীবনের সঙ্গে তেমন করে যোগাযোগ রাখে না সে। তাহেরপুরে নিজেদের বাড়িতে যায় না বহুদিন। যেতে ইচ্ছেও করে না। ভাই সুখময় প্রায় প্রতিমাসেই অফিসের ল্যান্ড ফোনে দাদাকে ফোন করে। তবুও সে চিঠি লেখে। চিঠি লিখতে ভালোবাসে সুখময়। ফোনে বলা কথাও কিছু কিছু থাকে চিঠিতে। আগে শুধু কয়েকটা কথা জুড়ে দেয়, ’তুমি তো জানো দাদা’।
কুরিয়ারে আসা চিঠি আর হাতের লেখা দেখে দীপ্তিময় বোঝে এটা ভাইয়ের চিঠি নয়। তাহলে কে লিখল? খুব কৌতূহল নিয়ে চিঠিটা খুলতে যাবে যখন, ঠিক তখনই মালিক একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রুফ ধরিয়ে দেন। ‘খুব আর্জেন্ট।’ ফলে সেইসময় আর পড়া হয়ে ওঠে না। তারপর আর মনেও ছিল না চিঠিটার কথা। ব্যাগের মধ্যেই ভরে রেখেছিল।
বাড়ি ফিরে চিঠি পড়ার পর মনটা বিষাদে ভরে উঠল দীপ্তিময়ের।  প্রথমেই বিপুল সরকার নিজের পরিচয় দিয়েছে বিন্দুর স্বামী হিসাবে। এরপর লিখেছে বিন্দুর কথা। স্মৃতি এসে ঝাপটা মারে তার চোখেমুখে। চোখ জ্বালা জ্বালা করে। বিন্দু অসুস্থ? বিছানায় শয্যাশায়ী?
দীপ্তিময়ের একার সংসার। রাগ আর অভিমানের ধূলিধূসরিত দিনযাপনের অহসনীয়তার পর তাহেরপুরের বাড়ি থেকে চলে এসেছিল কলকাতায়। নিজেদের জমিতে চাষের কাজ করে ভাই। বিএ পাশ করার পর আর পড়েনি। চাষবাসই তার ধ্যানজ্ঞান। দীপ্তিময়ের আবার চাষ, জমিজমায় মন বসে না। তাই এমএ পাশ করে চাকরির চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চাকরি তো আর বাজারের সামগ্রী নয় যে খুঁজলেই মিলবে। কোথাও কোনও কাজের সন্ধান না-পেয়ে এলাকার কিন্ডার গার্টেন স্কুলে অল্প বেতনের মাস্টারিতে ঢুকতে হয়েছিল তাকে।
বাবার সঙ্গে দীপ্তিময়ের কোনওদিনই বনিবনা ছিল না। মার সঙ্গেই তার মানসিক আদানপ্রদান ছিল বেশি। মায়ের মৃত্যুর পর তাই একটা শূন্যতা তাকে ঘিরে ধরেছিল। সেই শূন্যতা দীর্ঘদিন ছেয়েছিল তার চারপাশ। ধীরে ধীরে সয়েও গেছে সব। বাবা আবার ভাই আর বোনের প্রতি দুর্বল। সুখময়কে তিনি সুখি বলে ডাকেন। বোনের ডাকনাম মান্তু আর দীপ্তিময়ের ডাকনাম দীপ।
ভাইকে নিয়েই বাবা বেশ সুখি, বোঝা যেত হাবেভাবে। বোনের বিয়ের পর সেটা আরও প্রকট হল। বিয়ের খরচখরচায় দীপের  আর্থিক অবদান প্রায় নেই বললেই চলে। বাবার জমানো টাকা থেকে সিংহভাগ ব্যয় হয়েছিল। সুখি তার উপার্জন থেকে খরচ করতে পেরেছিল খানিকটা।
তখন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে মাসখানেক হল। একদিন সকালে স্কুলে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছে দীপ। সেইসময় বাবা বললেন, এইসব অপকর্ম না-করে চাষের কাজে মন দাও। এতে দু-পয়সার মুখ দেখবে। আমার সুখি সব জমি চাষ করে উঠতে পারে না। চাইলে তোমার নামেও কিছু জমি লিখে দিতে পারি।
‘অপকর্ম’ আর ‘আমার সুখি’ কথাদুটো বর্শার ফলার মতো বিদ্ধ করল দীপকে।
বাচ্চাদের পড়ানোটা অপকর্ম? কী বলছ এসব? ঝাঁজ বেরিয়ে আসে তার গলা থেকে।
যে কর্মের ফল শূন্য, সে কি আকাম নয়? কী বেতন পাও তা তো জানি। এতে কি আমার সংসার চলে? সুখি তবু অনেকটাই দেয়। নির্বিকার জবাব বাবার।
অর্থাৎ তুমি বলতে চাইছ ভাই সংসারে কন্ট্রিবিউট করে। আমি তেমন কিছু দিতে পারি না। তাই তো?
ঘুরিয়ে তো বলিনি, যা বলার সোজাসাপটাই বলেছি।
আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করেনি দীপের। স্কুলে চলে গিয়েছিল। তখন বাড়িতে ভাই ছিল না। বিকেলে জমি থেকে ফিরে বাবার উপর খুব রাগ দেখিয়েছিল ভাই। তবু দীপের রাগ কমেনি বাবার উপর।
এরমধ্যে বিন্দুর সঙ্গে তার সম্পর্কটা জানাজানি হয়ে গেছে বাড়িতে। বাবা প্রবল আপত্তি জানিয়েছেন। বিন্দুদের পদবি বর্মণ। তাঁরা চট্ট্যোপাধ্যায়। ফলে ব্রাহ্মণ বাড়িতে বর্মণের মেয়েকে ঢুকতে দেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। অন্যদিকে বিন্দুদের বাড়ি থেকেও আপত্তি ছিল। আসলে দীপের  বাবা সবিতাব্রত চট্টোপাধ্যায় একগুঁয়ে প্রকৃতির এবং উন্নাসিক। একথা এলাকার সকলেই জানে। কারও সঙ্গেই ঠিকভাবে মিশতে পারেন না তিনি। পাড়াপ্রতিবেশীদের কারও সঙ্গেই তেমন সদ্ভাব নেই। আবার দীপ-সুখির মাও বেঁচে নেই। এই অবস্থায় এবাড়িতে মেয়ে দিলে সে সুখে থাকবে না বলেই মনে হয়েছিল বিন্দুর বাবা-মায়ের। এই নিয়েও কম মনকষাকষি হয়নি বাবার সঙ্গে তার। দীপ ঠিক করেছিল বছর খানেকের মধ্যেই সব আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে বিন্দুকে বিয়ে করে নেবে। তার জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছিল। বিন্দুও তাতে রাজি ছিল। কিন্তু দু-বাড়ির মধ্যে এমন ঝঞ্ঝাট বাঁধল যে বিন্দুকে প্রায় গৃহবন্দি করে ফেলল তাদের বাড়ির লোকেরা। দূরে কোনও  আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল তারা। কিছুতেই আর যোগাযোগের সূত্র খুঁজে পায়নি দীপ, বিন্দু যাকে দীপ্ত বলে ডাকত। সবমিলিয়ে খুব ভেঙে পড়েছিল দীপ।
এর কিছুদিন পরে কলকাতার একটা ছোট পাবলিশারে প্রুফ রিডারের চাকরি পেল সে। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করেছিল। স্কুলের প্রশ্নপত্র আর লিটল ম্যাগাজিনের প্রুফ দেখার বিদ্যে নিয়ে কাজটা পেয়েও গেল। বেতন খুব বেশি না-হলেও স্কুলের বেতনের থেকে বেশি। তার একার পক্ষে মন্দ নয়। কলেজ স্ট্রিটে চাকরি আর বেলঘড়িয়ার মেসে থাকা, এভাবেই কয়েক মাস চালিয়ে দিল। প্রথমে সপ্তাহ দুই বাড়ি থেকে যাতায়াত করেছে। কিন্তু এত দূরত্ব যে মেসে থাকার সিদ্ধান্ত নিতেই হল। তাছাড়া বাড়িতেও আর থাকতে ইচ্ছে করছিল না। যেভাবেই হোক এই অন্ধকার গুহামুখ থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিল দীপ। মেসে থাকাকালীন মাসে এক-দুবার সে বাড়ি গিয়েছিল। কিন্তু একসময় তাও বন্ধ হয়ে গেল।
কাজটা দ্রুত ভালোভাবে রপ্ত করে নিল দীপ্তিময়। চারিদিকে খোঁজখবর রাখতে রাখতে একটু বড় এক পাবলিশারে কাজও  পেয়ে গেল একসময়। এখানে তার বেতন অনেকটাই বেশি। মালিকই একটা ভাড়াবাড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন। বেনিয়াটোলা লেনের এই বাড়িটা প্রকৃত অর্থে বারো ঘর এক উঠোন।
এই ভাড়াবাড়িতে বেশ মানিয়ে নিয়েছে দীপ্তিময়। তবে নিজস্ব বৃত্তে থাকার অভ্যেস করে নিয়েছে  সে। ছুটির দিন নাটক দেখা, অ্যাকাডেমিতে গিয়ে সময় কাটানো, আর মাঝে মাঝে  কবিতা লেখা নিয়ে দিব্যি কেটে যাচ্ছিল তার। নিজস্ব ঘেরাটোপের জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল বেশ।
আপনি যাবেন তো দাদা? আসুন না একবার, প্লিজ। বিন্দু খুব খুশি হবে। জানি না আর কতদিন থাকবে ও…
বিপুলের কথায় সম্বিত ফেরে দীপ্তিময়ের। অসহায়ের মতো মুখ করে বিপুল তাকিয়ে আছে তার দিকে। সম্মতির অপেক্ষায় চেয়ে থেকে থেকে সময় ঢলে পড়ে দিনান্তের দিকে।
বিপুলকে তার অফিসে আসতে বলেছিল দীপ্তিময়। কিন্তু অফিসে বসে ব্যক্তিগত কথাবার্তা বলা যায় না। বিশেষ করে বিপুল সরকার বিন্দুর ব্যাপারে কথা বলতে এসেছে। এমনিতেই কেউ কথা বলতে এলে দু-একজন এদিকে কান পেতে রাখে। কারও কারও এটা অভ্যেস। হাঁ-করে তাকিয়ে থেকে শুনে যায়। দীপ্তিময় চায় না বিন্দুর কথা আর কেউ শুনুক। তাই হেঁদুয়ার সুইমিং পুলের পাশের বেঞ্চিতে এসে বসেছে দুজন। কথায় কথায় সময় কেটে যায়। নদীর পাড় ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে যায় দ্রুত। স্রোত বেড়ে চলে। দীপ্তিময় সেই স্রোতের জলশব্দ শুনতে পায়।
কথাবার্তার ফাঁকেই বিপুল অনুরোধ রাখে দীপ্তিময়ের কাছে। একবার, অন্তত একবার সে যাক বিপুলদের বাড়িতে। এই অনুরোধে নদীটা থমকে যায় খানিক। নিস্তরঙ্গ, স্রোতহীন টলটলে নদী দীপ্তিময়ের চোখের সামনে দোলে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় তাহেরপুরের বাড়িতে একবার যেতে হবে। সেখান থেকে বিন্দুদের বাড়ি যাওয়া অনেকটাই সুবিধেজনক। 

(২)

প্রায় ছ-বছর পরে বাড়ির সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়াল দীপ। ঘরে ঢুকেও পড়ল দ্বিধা কাটিয়ে।
অনেকদিন পরে এই ঘরে পা রাখল সে। তাই চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখে নেয় একবার।
সবকিছু প্রায় আগের মতোই আছে। দেয়ালের রঙ যেমনটি ছিল তেমনই সাদা আছে প্রায়। ভেতর-ঘরে দুটো কাঠের চেয়ার পাতা। পার্থক্য বলতে এখন চেয়ার দুটোতে কুশন আর টেবিলে পাতা  অয়েল ক্লথ। মায়ের রঙিন বাঁধানো ছবি দেখে তার বুক টনটন করে উঠল একটু। ছবিতে রজনীগন্ধার মালা। আজ সকালেই দেওয়া হয়েছে বোঝা যায়।
ভাইয়ের বিয়ের সময়ও আসেনি দীপ। কিছুদিন পরে একরাতের জন্য এসেছিল। পরদিন ভোর-ভোর চলে ফিরে গিয়েছিল। এতদিন পরে এল বলে সামান্য যেটুকু দ্বিধা ছিল, সেটুকু প্রাণপণে ঠেলে সরিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়ে সে।
মিনিটখানেক বাদে মাঝের ঘরের পরদা দুলে উঠল। টের পেয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখে বাবা মুখ বাড়িয়ে দেখলেন তাকে। তার  মুখের ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে বললেন, আমি জানতাম তুমি আজ আসবে।
বড়দা কখন এলেন? এতদিন পর আমাদের কথা মনে পড়ল?
ভাইয়ের বউয়ের কথা শুনে ঠোঁটে  সামান্য হাসি ঝুলিয়ে দীপ জবাব দেয়, এই তো এলাম সবে। এর বেশি কথা বলার অবকাশ নেই তার। কেননা বাবার কথাটা শুনে অবাক হয় সে। আজ যে আসবে সে নিজেই জানত না দুদিন আগেও। বিপুল সরকার দিন দুই আগে এমন অনুনয় করল আর বিন্দুর জীবনের দিন গোনার কথা জানাল, তাতেই এখানে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। একথা বাবার জানার কথা নয়। বিপুলকেও আসার সম্ভাব্য দিন জানায়নি সে। শুধু বলেছিল যত শীঘ্র সম্ভব যাব। মাঝে একটা শনিবার পেরিয়েছে বিনিদ্র ও চিন্তাক্লিষ্ট। তাও বাবা দাবি করছেন জানতেন?
তুমি জানতে আমি আসব আজ?
বিন্দু মৃত্যশয্যায় আর তুমি আসবে না, তা হয় না।
বাবার মুখে কি বক্র হাসি খেলে গেল? ভাবে দীপ। নাকি তার চোখের ভুল !
কিন্তু আজই যে আসব সেটা…
গত বুধবার বিপুল নামের একজন এসে সুখির থেকে তোমার অফিসের ফোন নম্বর নিল। পরে জেনেছি ও বিন্দুর বর। তার আগে একবার এসে অফিসের ঠিকানা নিয়ে গেছে। তাতেই আন্দাজ করলাম তুমি আজ আসবে। রবিবার ছাড়া তো ছুটি থাকে না। 
এ এক সাঙ্ঘাতিক অনুমান, বুঝতে পেরে ভীষণ ক্রুদ্ধ হয় দীপ। যাকে নিয়ে ছিল চরম ক্ষোভ আর এবাড়িতে ঢুকতে না-দেওয়ার ঘোষণা, তার মৃত্যুশয্যার খবর তিনি জানেন। শুধু জানেনই না, ছেলে বিচলিত হয়ে ছুটির দিনেই ছুটে আসবে, এই সম্ভাবনাও তিনি ভেবে রেখেছেন ! মনে হচ্ছিল পুরনো দিনগুলোর ঝড়ঝাপটা ফিরিয়ে আনে। বাবাকে কোনওদিনই মুখের মতো জবাব দেওয়া হয়নি। আজ সব চুকিয়ে দিতে ইচ্ছে করল একবার। পরক্ষণেই বিন্দুর চিন্তা সব এলোমেলো করে সিদ্ধান্ত বদলে দিল তার। স্রোতহীন নদীতে একা একাই দাঁড় টেনে চলে দীপ।
ইতিমধ্যে ভাতৃবধূ চা আর বিস্কুট আনে কাপ-প্লেটে। চা খেয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। বারান্দায় নেমে এসে ডাকে 'রঞ্জা, একবার বাইরে আসবে?' ভাইয়ের চিঠিতে স্ত্রীর প্রসঙ্গে লেখা থাকে, 'তোমার বউমা রঞ্জা'। তাতেই তার নাম মনে গেঁথে গেছে দীপের।
রান্নাঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে বিস্মিত হয় রঞ্জা। কোথায় যাচ্ছেন দাদা? আপনার জন্য রান্না করছি। খেয়ে যাবেন কিন্তু।
তোমার পছন্দের বোয়াল মাছ এনেছি। দুপুরে খেও।
বাবার বোয়াল মাছ আনার খবরেও সে বাবার দিকে তাকায় না। তীব্র ঘৃণা তার মনে বিবমিষার জন্ম দেয়। বাবাকে উপেক্ষা করে রঞ্জার দিকে তাকিয়ে বলে, বেশ। আমি একটু আসছি। একজনের সঙ্গে দেখা করার কথা আছে। আশাকরি দুপুরের মধ্যে চলে আসব।
এরপর আর কোনওদিকে না-তাকিয়ে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। এখন তাকে যেতে হবে বিন্দুর কাছে। আর দেরি করা যাবে না। কেমন একটা টান অনুভব করে সে। আর সেই টানেই উদ্ভ্রান্তের মতো এগিয়ে যায় বিন্দুদের বাড়ির পথে।

(৩)

বিন্দুদের বাড়ির দিকে যেতে যেতে বিপুল সরকারের কথাগুলো মনে পড়ছিল দীপ্তিময়ের। এখান থেকে ট্রেনে মাত্র দুটো স্টেশন পরেই তাদের বাড়ি।
দশ-বারো দিন আগে বিন্দুকে বললাম, একবার দীপ্তবাবুকে আসতে বলব বিন্দু? তোমাকে একবার দেখে যাবেন। প্রথমে চমকে উঠেছিল, জানেন দাদা। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। আমি অনেকক্ষণ বিন্দুর দিকে তাকিয়েছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে ও বলল, তার খোঁজ জানা থাকলে আসতে বোলো। একবার শেষ দেখা দেখে যান যদি…
বিপুলের কথাগুলো করাতের মতো চিড়ে দিচ্ছিল তার অন্দরমহল। বুকের ভেতরে একটা  স্রোতস্বিনী জন্ম নিয়েছে টের পায় সে। আর তার জলোচ্ছ্বাস মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ছে যেন নির্জন সৈকতে।
বিপুল নিজের মনেই যেন কথা বলছে। যেন দীপ্তিময়কে নয়, নিজেকেই বিড়বিড় করে বলছে সে। নিঃসঙ্গ চরাচরে একা দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ করে নিজস্ব সংলাপ রচনা করে চলেছে। 
সুখময়বাবুর সঙ্গে দেখা করে আপনার ঠিকানা নিলাম। শুনলাম আপনি মোবাইল ব্যবহার করেন না। চিঠি পাঠানোর পর আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না।  তাই আবার গেলাম আপনাদের বাড়ি। আপনার বাবার কাছে শুনলাম ভাই জমিতে কাজ করতে গেছেন। সেখানেও ছুটে গেলাম। অনেক অনুরোধ করে আপনার অফিসের ফোন নম্বর নিলাম। তার পরপরই আপনার ফোন এল। 
আপনার চিঠিতে মোবাইল নম্বর ছিল তো। তাতেই…
হ্যাঁ দাদা, যদি দ্রুত যোগাযোগ করতে পারেন সহজে, সেই কারণেই লিখে দিয়েছিলাম।
আমার কথা আপনি জানলেন কীকরে? প্রশ্নটা না-করে পারেনি দীপ্তিময়। তার খবর জানা খুব সহজ নয় সম্ভবত। সে তো নিজেই পূর্বসম্পর্ক প্রায় মুছে ফেলেছে। কোনও বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়ের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখে না। তাই সংশয় জন্ম নেওয়া স্বাভাবিক। 
বিন্দুর আলমারি থেকে একটা ডাইরি খুঁজে পেয়েছিলাম অনেকদিন আগে। যদিও বিন্দুকে কোনওদিন সেকথা বলিনি। নিজের মনেই রেখে দিয়েছিলাম কথাটা। বলতে বলতে বিপুলের মুখের চেহারা বদলে যায়। মাথা ঝুঁকে পড়ে ঘাড়ের নীচে। যেন গভীর কোনও আবর্ত থেকে বেরিয়ে এল এইমাত্র, সেভাবেই বলল, বিন্দু আপনাকে আজও ভালোবাসে দাদা। আমি সংসারে ওর চলার পথে অভ্যেসের মতো হয়ে গেছি। ভালোবাসা পাইনি। কোনওদিনই বিন্দু আমাকে নিজের করে নেয়নি। আমার খুব অভিমান হত জানেন ! সব জানার পর বুঝেছি আমার কিছু করার নেই… একটা ভুল সম্পর্ক টেনে নিয়ে চলেছি এতদিন। হাহাকার ঝরে পড়ে বিপুলের কণ্ঠ থেকে।
বাড়ি চিনতে অসুবিধা হয়নি দীপ্তিময়ের। বিপুল যেভাবে বাড়িতে যাওয়ার ঠিকানা বুঝিয়ে দিয়েছে, তাতে অসুবিধা হওয়ার কথা ছিল না। এবাড়িতেও দ্বিধা নিয়ে প্রবেশ করে সে। টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয় তার হৃদয়পুরে।
বিন্দুকে দেখে বিস্মিত হয় দীপ্তিময়। এতটা চেহারা খারাপ হতে পারে কল্পনাও করতে পারেনি সে। চেহারায় শুধু বয়সের চিহ্নই নয়, অসুখের ছোবলও স্পষ্ট ছাপ ফেলেছে। চোখবোজা বিন্দুর দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
দেখো বিন্দু, কে এসেছেন।
অনেকটা সময় দীপ্তর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বিন্দু। কোন সুদূরে যেন তার দৃষ্টি নিবদ্ধ।
দীপ্তবাবু এসেছেন বিন্দু। তোমাকে দেখতে…। উদ্ভাসিত মুখে বলে বিপুল।
বিন্দুর চোখ চঞ্চল হয়ে ওঠে। চোখ থেকে নেমে আসে দু-ফোঁটা অশ্রু।
আমার মতো ঘৃণ্য মানুষকে মনে রেখেছ বিন্দু? কেন রেখেছ?
 আমি এর যোগ্য ছিলাম না। যে লোকটা তোমার ভালোবাসার কাঙাল, তাকে বঞ্চিত করেছ আমার জন্য ! দীপ্ত ভাবে মনে মনে। কিন্তু বলতে পারে না কিছু।
খাটের পাশের টুলে বসে সে।
বিন্দু কিছু একটা ইশারা করে বিপুলকে। বিপুল বলে ওঠে, আপনারা কথা বলুন দাদা। আমি একটু আসছি।
বিন্দুর ইঙ্গিতটা এবার বুঝতে পারে  দীপ্তিময়। বলে ওঠে, কোথায় যাচ্ছেন? আমার জন্য কিছু আনতে যাচ্ছেন? ব্যস্ত হবেন না ভাই। কিচ্ছু দরকার নেই।
ঐ আর কি। এই প্রথম এলেন। একটু মিষ্টি। আপনার কথা বলুন।
প্রথমে বারণ করলেও পরে মেনে নেয় দীপ্তিময়। বুঝতে পারে বিপুল সরকার আসলে তাদের কথা বলার সুযোগ করে দিল।
এই সুযোগটুকু বড় মহার্ঘ। তাই সে চুপ করে যায়। মাঝখান দিয়ে অনেকটা সময় বয়ে যেতে থাকে, যেভাবে তার আর বিন্দুর মাঝখান দিয়ে প্রায় তরঙ্গহীন সময় বয়ে গেছে।
বিন্দুর চোখ দিয়ে জলধারা নেমে আসছে অবিরাম। অবশেষে দীপ্তই কথা বলে ওঠে, আমাকে এতদিন তোমার মনের মধ্যে রেখেছ বিন্দু?
নির্বাক হাসে বিন্দু। যন্ত্রণা-আঁকা সেই হাসি। 
আমি অপদার্থ বিন্দু। আমি কি পারতাম না তোমার খোঁজ নিতে? উনি তো পারলেন আমাকে খুঁজে বের করতে। আমি কি আরও বেশি চেষ্টা করতে পারতাম না? হন্যে হয়ে খুঁজলে পেতাম না? কিন্তু কেন যে খুঁজিনি জানি না।
দীপ্তর হাতে তার শীর্ণ হাত রাখে বিন্দু।
সময় থমকে দাঁড়ায় দুজনের মাঝখানে। অনেকটা স্বগতোক্তির মতো দীপ্ত বলে, এই লোকটা তোমার ভালোবাসার কাঙাল বিন্দু। একে দাও। উজার করে দাও।
এখন এসব কথা থাক দীপ্ত। আমার আজ দেওয়ার মতো কিছুই নেই। নিঃস্ব আমি।
একটা ছায়া এগিয়ে আসে ঘরের দিকে। চকিতে দীপ্ত দেখে বিপুল এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়।
বসুন। দরকার আছে। নিজে দাঁড়িয়ে বিপুলকে টুলটা এগিয়ে দেয় দীপ্ত। প্রায় জোর করে তাকে বসিয়ে দেয় সেখানে। বিন্দুর হাত টেনে এনে বিপুলের হাতে রাখে। কোনও কথা বলতে পারে না কেউ। নীরবতা হাঁ মুখ হয়ে থমকে থাকে তাদের মাঝখানে।
বিন্দুর আড়ালে কারখানার সাধারণ কর্মী বিপুলকে আর্থিক সাহায্যের কথাও বলে দীপ্তিময়।
একসময় স্মিত হেসে সে বলে, আমি আসি বিন্দু। যদি পারি আবার আসব।
ফেরার পথে বিপুল তাকে এগিয়ে দিতে আসে। তখনই সে দীপ্তিময়ের হাত চেপে ধরে, আপনাকে টাকা পাঠাতে হবে না দীপ্তবাবু। বিন্দু আর বেশিদিন থাকবে আমার কাছে। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন।
ঝাপসা চোখে বিপুলের দিকে তাকিয়ে থাকে দীপ্তিময়। তারপর কোনও কথা না-বলেই বিপুলের হাত ছাড়িয়ে হাঁটতে থাকে। উদ্ভ্রান্তের মতো অনেকটা সময় পথে ফেলে আসে সে।

(৪)

ঘরে ফেরার সময় এক টুকরো অন্ধকার সঙ্গে নিয়ে এসেছে যেন দীপ। ল্যাম্পপোস্ট জ্বলে উঠেছে আলো। দু-একটা ঘরে সন্ধ্যার শাঁখ বাজছে। কিন্তু তার মনে হচ্ছে এই শাঁখ যেন বড় করুণ সুরে বাজছে। কখনও সেই শব্দ তার কাছে আর্তনাদের মতো মনে হয়।
ঘোরের মধ্যে ঘরে ঢোকে সে। সকালে এসে যে চেয়ারটায় বসেছিল, সেখানে এখন অন্য একজন বসা। এই লোকটাকে চেনে না দীপ। অবশ্য চিনতেও চায় না। হয়তো পাড়ার কেউ, নয়তো বাবার বন্ধুস্থানীয় কেউ হবেন। এসব নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। টেবিলের ওপরদিকে একটা চাবি রাখার সুন্দর কাঠের ময়ূর আছে। সেখান থেকে চাবিটা নেয় দীপ। এই চাবিটা তার চেনা। এবাড়ির অনেককিছুর মতোই তার ঘরের পিতলের তালারও বদল ঘটেনি। এবার তাকে ঘরে যেতে হবে।
দোতলায় ভাই থাকে। দোতলায়  ওঠার সিঁড়ির পাশের ঘরটা তার। এই মুহূর্তে তার কাছে নিজের ঘরে ঢুকে পড়া অনেক বেশি কাম্য। সেখানে ঢুকে নিজের বৃত্তে প্রবেশ করতে চায় দীপ। যে অন্ধকার নিয়ে সে ঘরে ফিরেছে, সেই অন্ধকার বুকে জমা করে অন্ধকারেই থেকে যাওয়া ভালো এখন।
বোস দীপ। প্রসাদ খা।
দীপ বাবার দিকে চোখ রাখে।  আজ তোর মায়ের মৃত্যুদিন। এই দিনটায় সত্যনারায়ণ পুজো দিই। তোর মা সত্যনারায়ণকে খুব মানত।
মায়ের মৃত্যুদিন আজ! এই দিনটা সে ভুলে গেল কী করে! সকালে ছবিতে মালা দেওয়া দেখেও মনে পড়ল না !
বাবা এখন তাকে তুই বলে ডাকছে। তার মানে মান-অভিমান এখন আর নেই।
নাহ্‍। ভালো লাগছে না।
এ আবার কী কথা রে। মায়ের নামে দেওয়া পুজোর প্রসাদ নিবি না?
হীমশীতল চোখে বাবার দিকে তাকায় দীপ।
একটু সিন্নি মুখে দিন বড়দা। মা ঠিক খুশি হবেন।
রঞ্জার দিকে চোখ রেখে শান্ত গলায় বলে, বেশ। দাও। সামান্য একটু… 
কোথাও খেয়ে এসেছ? বাবা আবার তুমিতে ফিরেছেন।
মাথা নেড়ে না জানায় সে। দীপ চাইছে বাবা জিজ্ঞাসা করুক বিন্দুর কথা। তাহলে ও বলতে পারবে, যাকে নিয়ে তোমার এত রাগ, যার জন্য তোমার সঙ্গে আমার এত দূরত্ব গড়ে উঠল, যাকে কেন্দ্র করে প্রায়ান্ধকার জীবন টেনে টেনে চলেছি একা, সেই বিন্দু চলে যাচ্ছে বাবা। চিরকালের জন্য চলে যাচ্ছে।
কিন্তু বাবা সেসব জিজ্ঞাসা করলেন না। দীপও সে প্রসঙ্গ তুলল না নিজে থেকে। বরং সিন্নিটা দ্রুত শেষ করে উঠে পড়ল  সে।
ধীর পায়ে ওঘর থেকে বারান্দায় এসে যখন নিজের ঘরের তালা খুলছে দীপ, তখন দেখতে পেল ভাই নামছে সিঁড়ি বেয়ে। দীপ এখন আর ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে চায় না। কারও সঙ্গেই কথা বলতে চাইছে না তার মন। বাবা মুখ বাড়িয়ে বললেন, ঘর পরিষ্কার করা আছে। মশারিটা টাঙিয়ে দেবে রঞ্জা, নাকি…
কোনও জবাব দেয় না দীপ। আলো জ্বালিয়ে একবার দেখে নেয় ঘরটা। আবার বাবার প্রশ্ন ভেসে আসে, বিন্দুর খবর কী ? এখন ভালো আছে?
শূন্য দৃষ্টি ঝুলিয়ে দীপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। নিষ্পলক চাউনি। একটু আগেই যেসব কথা বলবে বলে ভেবেছিল, সেসবও বলা হয় না তার। বিছানার দিকে চোখ বুলিয়ে লাইট বন্ধ করে দেয় সে। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে। ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ করে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে দীপ। 
আজ বিন্দুর স্মৃতির সঙ্গেই মায়ের স্মৃতিও এসে ভিড় করছে। কিছুক্ষণ পরে দীপ্তিময় অনুভব করে মা ও বিন্দু দুজনেই এসে বসেছে তার বিছানায়। মা তার পিঠে হাত রাখেন। বিন্দু পরম মমতায় দীপ্তর মাথার চুলে হাত বোলায়। সুখানুভূতিতে দীপের চোখ বুজে আসে। ক্রমশ নিঃসীম ও চিরন্তন ঘুমের অতলে ডুবে যেতে থাকে সে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য