মেঘনা রায়


#যোনিমুদ্রায়নমঃ#

একটু চমকে ওঠারই কথা,, প্রকাশ্যে যোনি পূজার অনুসঙ্গে_সতীর একান্ন অংশের  ভাবনায় | ছোট বেলায় দেখেছি  ঠাকুমা দিদিমারা একটা সুন্দর ঝাঁপি রাখতেন |সেই ঝাঁপি তে থাকতো জগন্নাথের রথের রশির টুকরো, নর্মদার থেকে কুড়িয়ে পাওয়া  হয়তো শিব লিঙ্গের মতো পাথর এবং কামাখ্যা মন্দির থেকে আনা লাল কাপড়ের টুকরো  আরো অনেক  টুকিটাকি |ঐ সব জিনিসের প্রত্যেক টার একটা আলাদা আলাদা গল্প থাকতো |ছোটদের ছোঁয়া বারন, সেই সব আদুরে টোটকা  দিয়ে ঘিরে রাখতেন সংসারের সব নড়নচড়ন | একটু বড় হয়ে দেখেছি এক রহস্যময় পার্বণ "অম্বুবাচী" |যত রহস্যময়তা তত বেশি নিষিদ্ধ জিনিসের  প্রতি আকর্ষণ,জানার কৌতূহল| সেই সময় দেখেছি  ঠাকুমা,দিদারা  দারুন নিষ্ঠা ভরে অম্বুবাচী পালন করতেন|  বিভিন্ন দূরদূরান্তে থাকা  ছেলে মেয়ে আত্মীয় স্বজন সকলেই অম্বুবাচীর জন্য টাকা পাঠাতেন তাঁদের,, তাতেও নাকি পুন্য  হয়| এই অম্বুবাচীর  সুযোগে আমার মতো ছোট দের ও বেশ ফলাও করে কয়দিনের জন্য  ফলাহারী হয়ে একবাটি করে সুস্বাদু সাবু মাখা  নিশ্চিত হয়ে থাকতো|  সব ভাই বোনেরা একত্রিত হয়ে স্কুলের ছুটির আনন্দে  চিলে কোঠার ঘর হাত ছানি দিত|
   .   
    কিন্তু লক্ষ্যনীয়  কেবলমাত্র বিধবারাই সেই রহস্য ময় বিধিনিষেধের পার্বণ টি পালন করতেন|   বড় হয়ে ও পরে দেখেছি বিশেষ করে অধিকাংশ সময়ই তাঁদের ফিজিওলজিক্যাল মেনোপজ হবার পরও বিধবারাই পালন করতেন | তখন  বড়দের থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা পেয়ে ছিলাম "অম্বুবাচী" মানে"এই কয়দিনের  পক্ষকালে আমাদের ধরিত্রী মাতা ঋতুমতী হন| তাই বয়স্ক বিধবা রাই এটি পালন করেন | সধবারা এর থেকে ছাড় পেয়েছেন ,, ভালো কথা| সেই সময় প্রশ্ন মনে আসলেও তা ধামাচাপা পড়ে  গিয়েছিল|
  
    কিন্তু গোল বাঁধলো নিজের বিধবা শ্বাশুড়ী মাতা কে নিয়ে| কামাখ্যা দর্শন করা বিভিন্ন রকমারি পূজায় নিবেদিত প্রাণ হয়েও  তিনি এই ব্রতটি পালন করতে অস্বীকার করলেন|আমিও ভেবে বসলাম ধরিত্রী যদি  সত্যিই ঋতুমতীই হন তাহলে হলে তো পুন্য সঞ্চয় করতে সকল মহিলাদেরই এটি পালন করা উচিৎ| ভ্রমণ এবং জায়গায় র উৎকর্ষতা নিয়ে আমার কৌতূহল বরাবরের|  প্রথম যোগসূত্র খুঁজে পেলাম মহাবলীপুরমের "কামাক্ষী আমান" আর ব্রক্ষ্মপুত্রের ধারে "কামরূপ কামাখ্যা"| "কামাখ্যা আর কামাক্ষীএই দুই শব্দ নিয়ে ভেবেছি অনেক  দিন  কিন্তু রহস্যের সার সত্য উপলব্ধি করেছি অনেক পরে , নিজে কামাখ্যা দর্শনে এসে,, ততদিনে জীবন অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে|  ছোট বয়সের সেই অজানা রহস্যের কিনারে এসে আমি কৃতজ্ঞ,ধন্য, রহস্যের অপার মহিমায় আমি বিহ্বল! 
      কামাখ্যা দেবী এখানে বালিকা| শিবের  সাথে নির্জনে মিলিত হতে আসা এক পর্বত কন্যা__ পার্বতী| আট থেকে পনেরো শতক অবধি এটি ছিল উপজাতি বিগ্ৰহ | স্থাপত্যে তাই আর্য বিগ্ৰহের ছাপ নেই| এর  পর বহু রাজার হাতবদল , চুক্তি এবং যুদ্ধের শেষাঙ্কের শেষে ব্রাক্ষণ্য ধর্মের অনুগতে প্রতিষ্ঠিত হয় "কামরূপ কামাখ্যা" পীঠ| ক্রমে  ক্রমে তন্ত্র মন্ত্র ,সতীর আখ্যানে সতীপীঠ, মাতৃকা আচার এবং কালীর আদ্যাশক্তি একাকার হয়ে যায় ,,গড়ে ওঠে পুণ্য ভূমির মাহাত্ম্য| এই পুণ্য ভূমি সতীর যোনি পূজার র আখ্যানে  অন্যতম শক্তির পীঠস্থান হিসেবে পৃথিবী বিখ্যাত হয়|
       ইতিহাস লিখেছে ব্লিডিং গড|এই  অম্বুবাচীর চারদিন ব্রক্ষ্মপুত্র কেও রক্ত স্রোত ধারন করতে হয়| মন্দির প্রস্রবণ ও হয়ে যায় লাল | এই রক্ত ভাগ  ধারণ করতেই মোহান্ত পুরোহিত সকলেরই অঙ্গ বস্ত্র হয়ে ওঠে লাল| তাঁরা ডান এবং বাম দুই হাতেই  পূজা করেন রীতি মন্ত্র এবং তন্ত্র|
         কামাখ্যা কামাসম্পন্নে কামেশ্বরী হরপ্রিয়ে
         কামনাম দেহি মে নিত্যম
         কামেশ্বরী নমস্তুতে
         কামদেব কামরূপস্থে সুভগে সুরা সেবিতে
         করোমি দর্শনম দে্ব্যা সর্ব কামার্থ সিদ্ধায়ে||
        
    ইতিহাস দেখিয়েছে পাথরে আর স্রোতে মিলে যে যোনি রূপ ধারণ তাও এক অদ্ভুত চিহ্নের,,|আরও বিস্ময়কর তাঁকে খুঁজে পাওয়া এবং শত শত বছর ধরে  একনিষ্ঠ ভাবে তাঁকে রক্ষা করা| কামাখ্যা দেবী  হলেন অনঙ্গদেবী__তার প্রধান উপাচারই হলো ফুল__কামাহতা বালিকা বইতো নয় |ষোলো বছরের পর্বত কন্যা তো ফুল সাজের নন্দিনী| তিনি মানুষের মুক্তি দাত্রী না হয়ে যান কোথায়?তার কামনার এই নান্দনিক দিকটিই আমায় আকর্ষণ করেছিল সেই সঙ্গে বালিকার রোমান্টিকতা যার মোহময় রূপ, সুখ শান্তি বর্ষায়, সব ব্যাথার উপশম ঘটায়| এই কামাখ্যা মন্দিরে অসুস্থ শরীরে এসেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ,, আবার বহুবার গুয়াহাটি এসেও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই মন্দিরের ব্যাপারে উৎসাহ দেখাননি|
         ৫০০টাকার টিকিট কেটে প্রায় ৫ঘন্টার লাইন শেষ করে কামাখ্যার মূল গর্ভে পৌঁছে ছিলাম |বিশেষ  কোনো সুবিধা পেয়ে নেবার সুযোগ  ছিল না,,,বরঞ্চ এই পীঠস্থানে কৃচ্ছসাধনের মানসিকতা  দৃঢ় ভাবে অবিচল ছিল| পিছল পাথরে প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল সেই বালিকার প্রজ্ঞার আহ্বান,,|
আড়ম্বর অনুষ্ঠানের নিরিখে মাপলে আর পাঁচটা মন্দিরের থেকে বেশ কিছু টা ম্লান,, কিন্তু কী যেন আছে ঐ বালিকার আহ্বানে,,| মন্দিরের পেছনে এখনও উঁকি মারে কলা গাছের সারি | লক্ষ ল্ক্ষ  পুন্যার্থীর ভিড়,, রেলিং ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ঢল কি মানে বহন করে? কোন্ মানবিক দর্শন চুঁইয়ে পরে এই বিপুল জনসমাগমে!! সেই ব্যাখ্যা এখন ও অজানা| পাথরের শেষ ধাপ পেঁচিয়ে যখন বাঁ হাতে রেলিং ধরে গর্ভগৃহে প্রবেশ করলাম,, পায়ের কাছে প্রস্রবণের সজল ছোঁয়া বালিকা পর্বত কন্যা র স্বতঃস্ফূর্ত সক্ষম প্রাণ কিছু যেন  জাগিয়ে ছিল মনে;;;; ঋতুমতীর ঘ্রাণে আকুল হয়েছিলাম | কেন এমন হয় আমার? জীবনের প্রতি  তীব্র অনিচ্ছা আর গহীন কামনার বরাভয় আমায় সবার থেকে একলা করে দেয়|? নিঃসঙ্গ একা,, পরক্ষনেই আবার কামনা ই যেন  নীরব অশ্রু স্রোত হয়ে ঝরে পড়ে সর্বাঙ্গে| ঋতুউত্তীর্ণ সময়েও অনুভবে আসে তারুন্য আর ঋজুতা| সেই এক নির্ভার ছিপছিপে সময়, নীলাচলের বাতাস গায়ে মাথায় হাত বোলায়,,, লাল সিঁদুরের তীলক কাটা পুরোহিতের সাথে "অখন্ড মন্ডালাকার" মন্ত্রচ্চারণ  করতে করতে আমার়  ঘাড় ধরে সেই বালিকার যোনি মুদ্রায় কপাল ঘসে দেন,, ফুলের স্তূপ থেকে মালা নিয়ে গলায় পরিয়ে দেন| বিহ্বল হয়ে যাওয়া আমি কামাখ্যা দর্শনে সম্পূর্ণতা পাই | কারণ এই দেবীর মাহাত্ম্য__তিনি  সর্বশক্তিমান "সর্বজ্ঞ, এবং সর্বত্র বিরাজমান| তর্কের খোলোস ছেড়ে কান্না চেপে বেড়িয়ে আসি,, অদ্ভুত এক শির শির করা ভালো লাগা, লাল কাপড়ের সেই টুকরো চোখ মোছায় আশীর্বাদে র মতো| রক্ত প্রবাহ পাই নি আমি ,, তবে পরবর্তী কালে শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু সেই লাল কাপড়ের টুকরো দিয়ে গেছেন, কৃতজ্ঞ  সেই লাল কাপড় পেয়ে | ,,,সবার তো স্পর্শ করার কপাল থাকে না  ,এক জীবনে|
এই শাশ্বত উপলব্ধিটুই  সঞ্চিত হল কামাখ্যা  দর্শনে|
             কামাখ্যা বরদে দেবী
             নীলা পর্বত বাসিনী
             ত্বম দেবী জগতম মাতা
             যোনি মুদ্রায় নমস্তুতে||
             জয় মা কামাখ্যা🙏
                    

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য