সোমা কুশারী



অপনাঘর



লাল বুটিদার শালটা ইশাক মেলে ধরতেই অদিতির চোখের কোনে খুশির আঁচ টের পেলো শর্মিলা, ততক্ষণে তিথি হাত বাড়িয়েছে শালটার দিকে.. 

ইশাকভাই ঠিক করে দাম বলুন বলে দিলাম আমরা কিন্তু সব পুরোনো খদ্দের

জয়তির আর তর সইছে না যেন নিজেই গাঁটরির ভেতর থেকে টেনে বের করছে প্লাস্টিক আঁটা একেকটা শাল। হলদে, কুসুম রঙা, গাঢ় নীল কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবে অন্তরা যেন ঠিক করতে পারে না... 

আমি কিন্তু কাশ্মিরী কাজের স্টোল নেবো, এত ভারি ভারি শালের মতো ঠান্ডা এখানে মোটেই পড়ে না!

কে বললো শীত নেই? তেড়ে ওঠে রুচিরা থাকো তো লবণহ্রদে ঠান্ডা টের পাবে কী করে বলো? থাকতে আমার মতো গাঁয়ে পড়ে বুঝতে ঠান্ডা কাকে বলে?

রুচিরাকে হৈ হৈ করে চেপে ধরে জনা পাঁচেক নানান বয়সী দিদিমণির দল... এই এই কী বলছিস? বারাসত আবার কবে গ্রাম হলো রে?যত সব ভাটের কথা!

শুচিস্মিতার আর বছর ছয়েক চাকরী আছে এই ছোটো ছোটো মেয়েগুলো প্রায় তার হাঁটুর বয়সী তবু এই শীত পড়তে না পড়তেই শাল সোয়েটার কাশ্মীরীকাজের চুড়িদার কেনার জন্যে হামলে পড়াটরা তিনি বেশ উপভোগ করেন। প্রয়োজন থাক আর না থাক পুজোর ছুটি শেষ হলেই তাই স্কুলের সব্বাই অপেক্ষায় থাকে ইশাক আর ওর দাদা সেলিম বাটের। এই ছোট্ট শহরের একপ্রান্তে ঘর ভাড়া নিয়ে ঠিক পুজোর পর পর হাজির হয় ইশাক সেলিম আলাদীনের মতো জনা চার পাঁচ শাল বিক্রেতা, নয় নয় করে তাও বছর কুড়ি বাইশ তো হবেই এরা আস্তানা গাড়ছে এ শহরে। প্রথম প্রথম মাথায় গাটরি নিয়ে শহরের অলি গলি পাক মারতে হলেও আজকাল সব বাঁধা খদ্দের এই যেমন কামিনী গার্লস হাইস্কুল, যোগ্যদা বয়েজ, অন্নপূর্ণা প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইউ বি আই এর স্থানীয় শাখা, পোস্ট অফিসের মহিলা কর্মীরা, এছাড়া তো এলাকার বাসিন্দাদের বাড়িটারি আছেই।

মাথায় গাঁটরির কাল কবেই কেটে গেছে ইশাক এখন একটা ছোট্ট স্কুটির পিছনে তিন চারটে গাঁটরি চাপিয়ে ঘোরে। বেলা এগারোটা নাগাদ দুটো খেয়ে বেরিয়ে সেই সন্ধ্যে নাগাদ ফিরে এসে সক্কলে মিলে একসাথে খানপান। ডালভাত বা রোটির পাশাপাশি তখন আন্ডা কী চিকেন রেঁধে ফেলা আর ফোন ঘুরিয়ে বাড়ির খবরাখবর নেওয়াটাই একমাত্র কাজ।

এ বছর জুলাইয়ে হঠাৎ যে কী হলো ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই পুরো ভূ- স্বর্গ যেমন থম্ মেরে গেছিলো তাতে ইশাকের তো চিন্তার শেষ ছিলো না এবছর ব্যবসা পত্তর বুঝি সব লাটে উঠলো। দাদা সেলিম তো জরুর ভয়ে এলোই না! বললে.. ইস শাল নাকা! ইশাকের ফ্যামিলি ও কি ছাড়তে চেয়েছিল নাকি? দুটো সমর্থ মেয়ে তা বিবি তো ভয়ে আধমড়া, কোথায় কী গন্ডগোল বাধে কী না কী হয়! এ বছর থাক্ ! ইশাক নয় এবার গমের খেতেই কাজ করুক! রোজগার ধান্দা এসব ভাবতে গেলে কী দুঃসময়ে চলে? আগে তো জান! তার পরে নয় মাল! তবু ইশাক এসেছে এই বাঙাল মুলুকে... পেটের তাগিদে তো বটেই কোথাও কী একটা চোরা টান ও আছে? ই উঁচা উঁচা পাহাড় ডিঙিয়ে এতো দূরে অন্য ভাষার মানুষের মধ্যে কী পায় ইশাক? বিবিজান তো মুখ বেঁকিয়ে বলে.. খুদগর্জ ইনশান! ইশাক মুচকি হাসে, টের পায় বিবির বুকে জ্বলছে মেয়েমানুষের সেই আদিম প্রবৃত্তি এককথায় যাকে বলে, "কসুর"-হিংসে। এ চল্লিশ পার করেও হুর পরীর মতো রূপ নিয়েও সাহিলিবিবি ইশাককে ঠিক ভরসা করতে পারে না! পারবে কী করে? লোকটা যে হরসাল বাঙাল মুলুকে যাওয়ার জন্য কেমন ছট্ ফট্ করে না দেখলে কে বিশ্বাস করবে? কে জানে বড়িবেটির বিয়ের জোগাড় করতে নাকি বাঙ্গালনদের প্রেমে বাওড়া হয়েই এই দূর্দিনে বাঙ্গাল যাচ্ছে এই ইনসান! খোদা মালুম কেয়া বাত! 

এবার ইশাকের সঙ্গে মাত্র হাজার পঁচাশ ষাটের মাল। প্রতিবার নয় নয় করেও লাখ দুয়েক টাকার জিনিস সঙ্গে থাকেই, বলতে নেই বিক্রি বাট্টা যা হয় তাতে করে চোখ বুজে মাস ছয়েক মোটা ভাত মোটা রুটি জুটেই যায়। এবারে কপাল মন্দ, মাল যা আছে তাও বেশিরভাগটাই চন্ডীগর লুধিয়ানার ফ্যাক্টরির মাল ঐ সোয়েটার জ্যাকেট এসবই বেশী। শালের মধ্যে একটা মাত্র জামেয়ার, কয়েকটা কমদামী দোশালা আর পশমিনা বলে যা বিক্রি করছে তা কিন্তু অসলি চিজ নয়! আরে অসলি চিজ বেচা কী মুখের কথা? সেই কাগির্লের পাহাড়ী ছাগলের লোম থেকে পাওয়া যায় উমদা পশম তবে না পশমিনা! অতো দাম কে দেবে? কিনবে এমন শৌখীন - ই বা কৈ? ইশাক শুনেছে তার দাদাসাহিব নাকী আসল শাহমিনা বিক্রি করেছে কলকাতার বড় বড় সব খানদানি ঘরে। আজ থেকে ষাট সত্তর বছর আগেই নাকি সেসবের দাম দশ বিশ হাজার। ইশাকের খদ্দেররা সব সাধারণ চাকুরে মহিলা তারা বোঝে রং চঙে ঝকমকে স্টোল, যাতে ফ্যাশন হয়। ওসব রইসী এদের করলে চলে?দো তিন চার হাজারে কে দেবে পশমীনা? জামেবার? আর ঐ সব সুন্দর কাজ? 

আজ যেমন এই অদিতি জয়তি রুচিরাদের কামিনী গার্লস স্কুলে তিনটে স্টোল আর একটা ফেরহান বিক্রি হলো। না নগদানগদি কারবার চলে না এখানে, পুরোটাই ঐ মাস চারকের কিস্তি। মার্চের পনেরো ইশাক দেশে ফেরার আগেই সবটা চুকিয়ে দেবে এইসব খরিদ্দার। তবে, প্রতিবছর এরা নেয় ও বেশ কয়েকটা করে, আর একজনের দেখাদেখি অন্যজন ও দিব্যি খদ্দের হয়ে যায়।অল্প অল্প করে দিতে পারার সুবিধা আছে বলেই লালের পরে নীল,নীলের পরে গোলাপী শীত পড়ুক না পড়ুক বঙ্গললনা শাল কিনতে ভোলে না! ইশাকের বিলে তাই পর পর নাম লেখা হয় জয়তি, রুচিরা, চৈতী, প্রীতি... ।

ইশাকের মনটা আজ বেশ খুশি খুশি, গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ডালে রসুন ফোড়ন দিচ্ছে দেখে নিজের দলের - ই করিবী দোস্ত আব্দুল বাট বললো, আরে ইয়ার বড়া খুশ দিখ রাহা হৈ? কে বাত হৈ? ইশাক হেসে বললো ' কাল এক পিকনিক মে জানা হৈ! কোন সা পিকনিক? কি নে বুলায়া তুমকো? ইশাক হাসতে হাসতে বলে জেনানা লোগো নে বুলায়া হামকো ভাই! আরে! ভাবিজানকো বোলনা পড়েগা... আব্দুল লাফিয়ে ওঠে! খবরটা মুহূর্তে ছড়িয়ে যায় দলের সকলের মধ্যে। আরে বড়িয়া খবর! এক শালওয়ালা যাবে পিকনিকে? তাও আবার বাংঙ্গালনদের সাথে? ইশাক মজার গলায় বলে সে শুধু যাবে তাই নয়, সঙ্গে নেবে নিজের তৈরী কাশ্মীরি দমআলু।

সত্যি সত্যি সকালে ঘুম থেকে উঠেই ইশাক আলু ছাড়িয়ে বাড়ি থেকে আনা গুঁড়ো আদা ধনিয়া দই আর পেঁয়াজ কসিয়ে রাঁধতে বসে যায় দমআলু, তারপর সাইকেলে অন্যদিনের মতো গাঁটরি না চাপিয়ে নতুন কিনে আনা টিফিন বাক্সে গরম গরম দম আলু রেঁধে ঝুলিয়ে রওনা দেয়। রোদে জ্বলা মধ্য পঞ্চাশের ইশাকের দীর্ঘ মূর্তিটা মোড় ঘুরে এগিয়ে যেতেই দলের ইরফান বলে ওঠে...

একদম বাওরা বন গেয়া ইয়ে ঈনসান!

ইশাকের প্লেটে এখন গরম গরম কড়াইশুটির কচুড়ি, পাটিসাপটা, নলেন গুঁড়ের পায়েস আর চিকেন কসা তুলে দিচ্ছেন শুচিস্মিতাদি, পাশে কলকল করে কথা বলে চলেছে অদিতি, রুচিরা, অন্তরা, চৈতী সহ নানান বয়সের দিদিমণির দল। আসলে প্রতিবছর স্কুলে এইসময়ে বাৎসরিক পরীক্ষার পর খাতা দেখা আর নম্বর টোকার কাজ চলে, আগের সেই দশটা চারটের টানটান ডিসিপ্লিন তাই আর নেই, এই জন্যেই আয়োজন হয়েছে পট লাক পিকনিকের। মানে ঐ যে যা পারে বাড়ি থেকে রান্না করে এনে হৈ হুল্লোর করে একসাথে খাওয়া দাওয়া। আর এই পিকনিকেই নিমন্ত্রীত অতিথি সুদূর কাশ্মীরের ইশাক মহম্মদ ।

চামচে করে এ ওর পাতে ইশাকের নিজের হাতে তৈরী কাশ্মীরী দম আলু তুলে দিতে দিতে ওরা যখন হাত পা নেড়ে রান্নার প্রশংসা করতে থাকে কেউ কেউ চোখের ইঙ্গিতে, জিভের টাকনায় বুঝিয়ে দেয় বড্ড ভালো হয়েছে....... কে জানে কেন ইশাকের মনটা ভরে যায়, ইশাক টের পায় এতদিন ধরে চেপে রাখা যে কষ্টটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো সেটা কেমন ফুস মন্তর হয়ে গেলো।

ইন্ডিয়ান আর্মি, পাথর ছোঁড়া, ছররার আঘাত, থ্রি সেভেনটি, ইন্টারনেট বন্ধ, লাগাতার বন্ধ.... ব্যবসার মন্দা, বড় মেয়ের বিয়ের জোগার সব সব এদের এমন উষ্ণ খাতিরদারিতে কোথায় যেন মিলিয়ে যেতে থাকে। শীতের এই নরম দুপুরে নিজের চিরচেনা লালচৌক থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের এই জেনানা ইস্কুলের সব্বাইকে বড় নিজের মনে হয়! বড় কাছের, আপনজন! ইশাক মহম্মদ, নিশ্চিন্ত মনে বড় ভালোবেসে শুচিস্মিতাদির যত্নে বানানো পাটিসাপটায় কামড় বসায়...

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য