সুচন্দ্রা চ্যাটার্জ্জী


             রূপসী রাঁচী

                    রূপসী রাঁচী

     “বহুদিন ধরে, বহুক্রোশ দূরে, / বহু ব্যয় করি,বহু দেশ ঘুরে/ দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা,দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু/দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশিরবিন্দু”---কবির কথা আক্ষরিক অর্থেই সত্য হয়ে ওঠে আমার ক্ষেত্রে।আগে এত জায়গায় বেড়াতে গেছি অথচ বাড়ির কাছেই যে এত সুন্দর দর্শনীয় স্থান আছে তা যেন ভুলেই গেছিলাম।পাশের রাজ্য ঝাড়খন্ডই হয়ে উঠল সেই ‘একটি শিশিরবিন্দু’ । পূজোর ষষ্ঠীরদিন রাত্রে চেপে বসলাম হাতিয়া এক্সপ্রেসে এবং পরের দিন সকালবেলা ঘুম ভেঙে দেখি ট্রেন ঢুকছে রাঁচী প্ল্যাটফর্মে।একটু ফ্রেশ হয়ে প্রাতরাশ সেরে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম ছোটবেলা থেকে শোনা সেই তিন অপরূপাকে দেখার উদ্দেশ্যে (হুন্ড্রু ,জোনহা ও দশম জলপ্রপাত )। আমাদের প্রথম গন্তব্য প্রায় ৩৫ কি.মি. দূরবর্তী দশম ফলস্ ।কাঞ্চীনদী দশটি জলধারায় ভাগ হয়ে ১৫০ফুট উচুঁ থেকে লাফ দিয়ে পড়ছে ,তারপর সে মিশেছে সুবর্ণরেখায়।প্রায় ২৫০ সিঁড়ি ভেঙে একদম কাছে গিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম স্বচ্ছতোয়া জলের ধারাকে।বর্ষার পর তার ভরা রূপ দেখতে দেখতে কখন যে অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি।তাই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়লামআমাদের পরের গন্তব্য দ্বিতীয় সুন্দরী হুন্ড্রুর দিকে। ৭৫০ সিঁড়ি পেরিয়ে পৌছলাম হুন্ড্রুর পদতলে।তাকে দেখলাম প্রাণভরে।ফেরার সময় সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠাটা বেশ কষ্টকর।উপরে ঝাড়খন্ড ট্যুরিজমের পক্ষ থেকে আদিবাসী গান ও নাচের আয়োজন করা হয়েছিল,যা দেখে আমাদের ক্লান্তি অনেকটাই দূর হয়ে গেল।দুপুরের খাওয়া ওখানেই সেরে রওনা হলাম জোনহাকে দেখার উদ্দেশ্যে।রাঁচী পুরুলিয়া সড়কে প্রায় ৪০ কি.মি.দূরে জোনহা।চারিদিকে বিশাল বিশাল গাছ।ছায়াভরা মায়াময় পরিবেশ।৫০০ সিঁড়ির চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দেখা পেলাম তার।প্রায় ১৫০ ফুট উচুঁ থেকে নেমে আসছে জলধারা।দুধেল সাদা বিশাল জলরাশি তীব্রগতিতে নেমে নীচে বয়ে যাচ্ছে অজানাপথে।মেয়েবেলা থেকে ভূগোল বইয়ে পড়া দশম,হুন্ড্রু ,জোনহা---তিন জলপ্রপাতকে চাক্ষুষ করে মোহময় হয়ে পড়েছিলাম।হোটেলে ফিরে আবার পরের দিনের জন্য প্রস্তুতি সেরে নেওয়া।
দ্বিতীয় দিনে শুরুই করলাম রাজরাপ্পার ছিন্নমস্তা মন্দিরে পূজো দিয়ে।মনে মনে খুবই আহত হলাম এটা দেখে যে এত জাগ্রত মন্দির অথচ সেখানে এখনও মধ্যযুগীয় পশুবলির রেওয়াজ প্রচলিত।মা’কে মনে মনে প্রার্থনা জানিয়ে আসলাম “তোমার চারণক্ষেত্রে এ নারকীয় প্রথা বন্ধ কর!”পিছনেই দুই নদীর—ভৈরবী নদী ও দামোদর নদের মিলনস্থল।এরপর একে একে দেখলাম টেগোর হিল, রাঁচী লেক,রক গার্ডেন,হাতিয়ার কাছে জগন্নাথ মন্দির,রাঁচী হিলের উপর শিব মন্দির।টেগোর হিল নামকরণ হয়েছে জোড়াসাকোর ঠাকুরবাড়ির জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্রামস্থল থেকে।টেগরহিল এর উপর থেকে সুন্দরী রাঁচীকে দেখলাম,অপূর্ব দৃশ্য।এর খুব কাছেই আছে এক বাঙালী পাড়া।আমাদের ড্রাইভারসাহেবের কাছ থেকেএক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেলাম যে সারা রাঁচী শহরের লোকেরাই ঐ বাঙালী পাড়ার রামকৃষ্ণ মিশনে সমবেত হয় মহাষ্টমীর দিন।মিশনে পৌঁছে দেখি সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে খিঁচুড়ি প্রসাদ গ্রহণ করার জন্য।আমরাও লাইনে দাড়িয়ে পড়লাম।প্রসাদ বিতরণ করছেন মিশনের মহারাজরা।রাজ্যের বাইরে এসে এরকম অভিজ্ঞতা সত্যই অবিস্মরনীয়।আরো দুটি জায়গা যা না দেখলে রাঁচী শহর দেখা অসম্পূর্ণ থেকে যায়,তা হল—মহেন্দ্র সিং ধোনি’র বাড়ি ও রাঁচীর বিখ্যাত Mental Assylum ।তৃতীয় দিনের গন্তব্য পাত্রাতু।এটি একটি উপত্যকা এবং উপত্যকায় পৌঁছানোর রাস্তাটিই অপূর্ব।সিকিমের সিল্করুটের মত।হেয়ার পিন বেন্ড সহ জিগ-জ্যাগ রাস্তা।উপর থেকে নামার সময় প্রথম বাঁকে গাড়িগুলি দাঁড়ায়।সেখান থেকে পুরো উপত্যকা এবং সম্পূর্ণ রাস্তা দেখা যায়।নীচে অপূর্ব পাত্রাতু লেক এবং তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র।এখানকার মনোরম লেকে ঘন্টাখানেক বোটিং সেরে ফিরে এলাম। পরের দিন নেতারহাট ও বেতলা যাওয়ার জন্য বেরিয়ে বাইবাই জানালাম সুন্দরী রাঁচীকে।                                                                                                                                                                   
   
      কখন যাবেন-জলপ্রপাতের ভরা রূপ দেখতে হলে অবশ্যই বর্ষার পর।
      কিভাবে যাবেন-সময়ের দিক থেকে দেখতে গেলে হাওড়া থেকে রাঁচী-হাতিয়া এক্সপ্রেস সবথেকে ভালো।রাত্রে উঠে সকালেই পৌঁছে যাওয়া যায়।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য