বৈশালী চ্যাটার্জী



অসুখের সুখ 

"আরে ব্রজদা, এতো চিংড়ি কিনছেন, সঙ্গে আবার চিতলের পেটি ! বাড়িতে গেস্ট আসছে নাকি?" 
রবিবারের বাজার l বেশ ভীড় l ব্রজেশ্বর বাঁড়ুজ্যে পাশে তাকিয়ে দেখেন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার নবীন দাস l
"না রে ভাই.. গিন্নির হুকুম l আমি তো দাসানুদাস মাত্র !" 

ব্রজেশ্বর মাছের ব্যাগটা এগিয়ে দেন  মাছওয়ালার দিকে, "দে রে তাড়াতাড়ি ! দেরী হয়ে গেল কতো ! আবার ওদিকটা দেখি l" 

দাম মিটিয়ে ওয়ালেটখানা ফতুয়ার পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বলেন, "চলি ভায়া ! ফরমাশ মতন সব কিছু নিয়ে না গেলে আবার কুরুক্ষেত্র হবে, বুঝলে কিনা !"

বাজারের সামনের ভীড়টা পেরিয়ে একটু এগোতেই দেখা পাড়ার যতীন মিত্রের সাথে l
"আরে বাঁড়ুজ্যে এতো ভারী ভারী ব্যাগ টেনে নিয়ে যাচ্ছ ! তোমার না পায়ে ব্যথা ! একটা রিকশা নাওনি কেন?" 
"আর ভাই ব্যথা ! বাড়ির লোকজন বুঝলে তো? বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন বাজার লাগে তাদের l কী আর বলি !"
"এ কী কথা হে ! রোজ বাজার করার দরকারটা কী? তাহলে আর বাড়িতে ফ্রিজ আছে কী জন্যে?" 
"বলিনি ভেবেছ? বহুবার বলেছি ! কাকস্য পরিবেদনা l এদিকে মাথা ঘোরাটাও .... " বাকি কথাটুকু হাওয়ায় ভাসিয়ে মুখখানা করুণ করে দাঁড়িয়ে থাকেন ব্রজেশ্বর l
"কী কান্ড ! দাঁড়াও আমি বিনুকে বলবো l সে তো আর এখন ছোট্টটি নয় ! এসব সংসারের ভার নিতে শিখুক এবার !"
"আরে না না মিত্তির l বলতে যেও না বাপু l শেষে সংসারে অশান্তি শুরু হবে l আর যতদিন বাঁচি করে যাই l মরলে বুঝবে সব l চলি গো l আবার নাতনিকে আঁকার ইস্কুল থেকে আনতে যেতে হবে l সবই তো আমার ঘাড়ে, বুঝলে কিনা !"
"এই রোদ্দুরে এতবার করে বেরিয়ে... ছিঃ ! ছিঃ !"
"আর ছি ছি l তা বিকেলে আড্ডায় আসছ তো? তখন কথা হবে 'খন ...."


বাজারের বড়ো ব্যাগ দুখানা আর মাছের মাঝারি ব্যাগটা আর একটু বাগিয়ে নিয়ে বাড়ির পথ ধরেন ব্রজেশ্বর l প্রায় সমবয়সী যতীন মিত্র তাঁর খুঁড়িয়ে হেঁটে যাওয়া দেখতে দেখতে আক্ষেপে মাথা নাড়েন l

মোড়টা ঘুরেই একটু দাঁড়িয়ে পড়েন ব্রজেশ্বর l ভুলেই গেছিলেন কালকের আড্ডায় বলা পায়ের ব্যথাটার কথা l যাইহোক বুঝতে পারেনি ব্যাটা মিত্তির l খুঁড়িয়ে হাঁটার অভিনয় করতে গিয়ে খামোখা কতটা দেরী হয়ে গেল ! ব্যাগদুটো হাতবদল করে তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পা চালান l


"কই গো ! কোথায় গেলে?...তোর মাসিমা কোথায় রে কমলা?"
"ওই তো রান্নাঘরে ... ও মাসিমা !"
"এতো দেরী হল যে তোমার?" আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসেন নীলিমা l 
"একী ! এতো কী এনেছো দু'ব্যাগ ভর্তি করে?বাজার তো সব আছে ! শুধু একটু খাসির  মাংস আর কাঁচালঙ্কা নিয়ে চলে আসবে, তা না, পুরো বাজার তুলে এনেছ !"
"আরে এমন কিছু আনিনি l দাও জল দাও একটু l"
"ঘেমে স্নান করেছ তো একেবারে l জামাটা খুলে ঘাম মুছে আগে ফ্যানের তলায় বস দেখি একটু l আমি লেবুর শরবত করে আনি l"


একটু পরেই নীলিমা মাছের ব্যাগ খুলে অবাক হয়ে যান l 
"হ্যাঁ গো, তোমায় বললাম একটু খাসির মাংস আনতে l বিনু, টুপাই খাবে l তা তুমি দু'রকমের মাছ কী বলে নিয়ে আসলে বল তো ? মাছ তো আছে l আর এত চিংড়ি এখন কুটে বেছে রাঁধবই বা কখন? রান্না সব শেষ l শুধু মাংসটা করব বলে সব যোগাড় করে দিয়ে অরুণা গেল মেয়েকে আঁকার স্কুল থেকে আনতে l"
"ও কতক্ষণ আর লাগবে ! অরুণা এসে করবে l দেখ বাজারের ব্যাগে একটা নারকেল এনেছি l জমিয়ে মালাইকারি করো দেখি ! চিতলটা একটু তেল-ঝাল করো, ব্যস!"

"তুমি তো বলেই খালাস l এখন এসব করে কে? চিতল কালকে হবে l আজ ভেটকি মাছ রান্না হয়ে গেছে l ওই জন্যে বলেছিলাম বিনু যাক l তুমি জোর করে...ও কমলা ! ন্যাতার হাতটা ধুয়ে শিগগির আয় দেখি l দুজনে মিলে চিংড়িগুলো ছাড়াই.... তোর মেসোর কীর্তি !  " 


দুপুরে খেতে বসে টুপাই বায়না ধরে, "এম্মা ! মাংস হয়নি? আমি ভাত খাব না l"
"ছিঃ ! অমন করতে নেই l দ্যাখ কী বড়ো বড়ো চিংড়ি এনেছে দাদাই ! কী সুন্দর মালাইকারি রেঁধেছি l একবার মুখে দিয়ে দ্যাখ l" 
"তুমি খাও! আমি খাব না l সকালে বললে মাংস হবে ! রোজ রোজ মাছ খেতে আমার একটুও ভালো লাগে না l"
"মাকে বলছিস কেন? তোর দাদাইকে বল গিয়ে l পই পই করে বলে দিলাম মাংস আনতে, শুনলে তো ! নিজের যা পছন্দ ঠিক সেটাই কিনে আনবে l" নীলিমা গজগজ করতে থাকেন l
"থাক মা, বাবা শুনতে পেলে দুঃখ পাবেন l" অরুণা চাপা গলায় বলে,"আপনার ছেলেকে বলি বিকেলে একটু মাংস এনে দিতে ....আমি ওবেলা রেঁধে দেব... "
"তুমি জান না অরুণা, লোকটা সারাটা জীবন এরকম l এতদিন আমায় জ্বালিয়েছে, এবার তোমাদের পালা l"

অরুণা মৃদু হেসে সবার থালায় লেবুর টুকরো, আলুভাজা, শাকভাজা বেড়ে দিতে থাকে l টুপাইকে তাড়া দেয়, "শিগগির খাও, মাখা ভাত নিয়ে বসে থেকো না l"

বিনায়ক স্নান সেরে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে  বলে, "খাচ্ছিস না কেন রে টুপ্পুস? মাংস-ভাত তো তোর প্রিয় ! "

"কোথায় মাংস? সেই গাদাখানেক হাবিজাবি তরকারি আর মাছ l ঠাম্মা আমায় একটু  আচার দাও না !"

"কেন বাবা মাংস আনেনি?" বিনায়ক অরুণার দিকে তাকায় l কেউ কিছু বলার আগেই ব্রজেশ্বর খাবার ঘরে ঢোকেন, "কী গো ! তোমাদের হয়নি এখনো?"
"হ্যাঁ, বসে পড়ুন বাবা l সব রেডি l"
"কী রে দিদি? মালাইকারি কেমন খেলি? "
টুপাই মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ভার করে উত্তর দেয়, "ভালো না l" 
"ছিঃ টুপু ! দাদাই হাতে করে এনেছে..."

বিনায়ক চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,  "শোনো বাবা আজ খোঁজ নিয়ে এলাম l ট্র্যাভেলিং এজেন্সিটা বেশ ভালো l পুজোর চারটে দিন এখানে থেকে, চলো সবাই মিলেই  ঘুরে আসি l টুপাইয়ের আর অরুণার স্কুল ছুটি, আমিও কটা দিন ছুটি নিয়ে নেব l "

"আমরাও যাব বাবা ?" টুপাই চকচকে চোখে বলে... 

"হ্যাঁ রে টুপ্পুস !" শাকভাজা দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বিনায়ক বলে, "অরুণা আর আমি ভেবে দেখলাম তোমাদের বয়েসে হয়েছে, এতটা দূরে শুধু তোমরা দুজনে....  তারচেয়ে টুপাইটাও একটু বড়ো হয়েছে, ওর ও ভালো লাগবে...."

"সেই ভালো রে বিনু l আমি তোদের অসুবিধা হবে ভেবে বলিনি, কিন্তু আমারও একটু ভয়ই করছিল... " নীলিমার মুখটা দেখেই তাঁর মনের স্বস্তিটুকু বোঝা যায় l 

"চলো তবে সবাই মিলে l কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে..."
ব্রজেশ্বরের কথায় সবাই তাঁর দিকে তাকায় l
"বেড়ানোর সব খরচখরচা আমার l"
"না না l সে অনেক খরচ l তুমি কেন দেবে?" 
"এই নিয়ে আর একটাও কথা বলবিনা বিনু, তাহলে যাওয়া ক্যানসেল... "
"ঠিকই তো ! সংসারের পুরো খরচই এখন তুই সামলাচ্ছিস l আমাদের টুকটাক দরকারে পেনশনের আর কটা টাকাই বা খরচ হয় তোর বাবার? কী করব খালি জমিয়ে রেখে? করুক খরচ ! তুই আর আপত্তি করিস না l "
"আচ্ছা সে নাহয় হলো, কিন্তু তুমি আজও  বাজার থেকে হেঁটে ফিরেছ কেন ? তোমাকে না বলেছি এই গরমে রোদ্দুরের মধ্যে রিক্সা ছাড়া কোথাও যাবে না !"
"কে বলেছে তোকে শুনি? মিত্তির নিশ্চয়ই?" 
"সে যেই বলুক, কথাটা তো সত্যি ! আর দরকারই বা কী এই বয়েসে দোকান, বাজার যাওয়ার? আমি তো আছি, নাকি? মাথা ঘুরে রাস্তায় পড়ে যাবে কোনদিন l সবাই ভাববে বাড়ির লোক তোমায় জোর করে খাটাচ্ছে l মা তুমি বোঝাও বাবাকে l "
"তোর মা কী বোঝাবে শুনি? তুই আমার পর? আমি জানিনা আমার বাড়ির লোক আমায় কতটা ভালোবাসে? কে কী বলল বয়েই গেল l আমি তো কারোর কাছে কাঁদুনি গাইতে যাচ্ছি না ! নে খা ভালো করে l অরুণা আমায় একটু নুন দাও তো মা !" 



গন্ধরাজ গাছটায় প্রচুর কুঁড়ি এসেছে l বাগানটা ছোটোবড়ো গাছ মিলিয়ে বেশ দেখতে লাগে l অনেকেই বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখতে দেখতে যায় l বিপিনের হাত ভালোই বলতে হবে l প্রথমে যখন বিনু ওকে এনেছিল ব্রজেশ্বরের কেন যেন ঠিক ভরসা হয়নি l বাড়ির সামনে একটা বাগানের শখ সেই ভাড়া বাড়িতে থাকতেই l একটা সময় নিজের বাড়ি হলেও অফিস করে বাগান করা আর হয়ে ওঠেনি l রিটায়ারের পর প্রথম বছরটা খুব খেটেছিলেন l তারপর বিনুই কোথা থেকে খোঁজখবর করে  বিপিনকে নিয়ে এল l বাগানের কল থেকে পাইপে করে গাছগুলোতে জল দিতে দিতে সতেজ সবুজ গাছগুলোর মধ্যে তিনি প্রাণের স্পন্দনটুকু স্পষ্ট টের পান l টের পান সবকিছু মিলিয়ে শরীরে-মনে অন্য অনেকের থেকে ভালো আছেন তিনি l হঠাৎ একটা হইচই শুনে গেটের কাছটায় এসে দাঁড়ান ব্রজেশ্বর l অনাদি দস্তিদারের বাড়ির সামনে একটা অ্যাম্বুলেন্স কখন এসে দাঁড়িয়েছে? ওখানে ছোট একটা জটলা l পাড়ার বেশ কয়েকজন বেরিয়ে এসেছে l এগিয়ে যান ব্রজেশ্বর l 
"কী হয়েছে রে বিল্টু? "
"দস্তিদার কাকু বাথরুমে পড়ে গেছেন হঠাৎ l ডাক্তার এসেছিলেন l বললেন অবস্থা ভালো নয়, হসপিটালে নিয়ে যেতে... "
এতো বড়ো বাড়িটায় বিপত্নীক অনাদি দস্তিদার আর তাঁর বিধবা বোন থাকেন l দুই ছেলেই চাকরিসূত্রে দিল্লী আর পুনেতে বহুবছর ধরে l আগেও একবার অসুস্থ হওয়ায় পাড়ার ছেলেরাই সবাই মিলে নার্সিংহোমে ভর্তির ব্যবস্থা করেছিলো l পরে একছেলে খবর পেয়ে আসে l 

রাস্তার ধারে সবার মাঝে দাঁড়িয়ে ব্রজেশ্বর সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন, ভাবেন ভাগ্যিস বিনুটা এখানেই থাকে ! নইলে হয়তো তাঁরও একদিন এরকমই.... 



"কী চক্কোত্তি শরীর কেমন?" সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চটায় বসতে বসতে ব্রজেশ্বর জিজ্ঞেস করেন শীতল চক্রবর্তীকে l 
"আর ভায়া শরীর ! ওই ধুঁকতে ধুঁকতে চলছে l ছেলেরা সব তালেবর হয়েছে l বাবা-মা এখন তাদের কাছে ভাগের l ডাক্তার দেখানোর কথায় এ ওকে ঠ্যালে তো ও একে ঠ্যালে l একসপ্তাহ হলো এই চলছে l"
"তা তুমি নিজেই চলে যাও না কেন একখানা রিক্সা করে !" অজিত দত্ত পাশ থেকে বলেন l
"সে কি আর পারিনা? খুব পারি l কিন্তু সকালে  গিয়ে অ্যাডভান্স দিয়ে নাম লেখাতে হয় যে ! এতবার যাওয়া....  যদিও এখন কাশিটা তেমন নেই l কফটাও উঠে যাচ্ছে l তবু এ বয়েসে অল্পেসল্পেই একবার দেখিয়ে নেওয়া দরকার l তা কে বোঝে বলো ?" 
"তবে এক কাজ করো, খালি কাশো l একলা ঘরে নয়, ছেলে বৌমা যে যখন কাছাকাছি আসবে তখনই কাশো, কাশো আর হাঁপাও l আর তার সাথে খালি থুতু ফেলো, এ জানলা ও জানলা দিয়ে, বাথরুমে, বেসিনে... দিনদুই করে দেখো একদম মুস্কিল আসান l" উপায় বাতলান সুরসিক অজিত দত্ত l অল্পবয়েসী দুজন ভদ্রমহিলা পাশ দিয়ে যাবার সময় তাঁদের দিকে তাকাতে তাকাতে যান l 
"তোমার চেনা নাকি হে চক্কোত্তি? " অজিত দত্ত গলা নামিয়ে বলেন l শীতল চক্রবর্তী দু'দিকে মাথা নাড়লে বেশ নাটকীয় ভঙ্গীতে, "যাক বাবা ! ভয় পেয়ে গেসলাম... " বলে দুহাত তুলে দেন l একটা সমবেত হাসির শব্দ প্ল্যাটফর্ম চত্বরে ছড়িয়ে পড়ে l

স্টেশনের চার নম্বর প্লাটফর্মের এই দিকটা বেশ নিরিবিলি l পিছনের রেলপুকুরের থেকে মাঝে মাঝে একটা ঠান্ডা হাওয়া দেয় l তাঁরা কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ, সাথে অনেক সুখ দুঃখের গল্প, সোনাঝরা সেইসব পুরোনোদিনের স্মৃতিরোমন্থন, বর্তমান ঘুনেধরা প্রজন্মের দোষত্রুটির আলোচনা আর বার দুই চা l এই নিয়েই তাঁদের নিত্য বৈকালিক আড্ডা l 
কথায় কথায় পাড়ার অনাদি দস্তিদারের প্রসঙ্গও ওঠে l অনাগত ভবিষ্যতে কার কপালে যে কী আছে, আলোচনা চলে l এই আড্ডার একমাত্র চক্রবর্তী আর ব্রজেশ্বর ছাড়া আর সবার ছেলেমেয়েই বিয়ের পরে দূরে বা কাছে হোক আলাদাই থাকে l তাই ব্রজেশ্বরের ভাগ্য নিয়ে সামান্য রসিকতা হলে নিজেকে দলের মধ্যে কেন জানি ভারী ব্রাত্য লাগে তাঁর l অসুখী মনে হয় নিজেকে l হঠাৎ বলে ওঠেন, "আরে এক সংসার হলেই কী আর সুখ হয় রে ভাই? বাইরে থেকে সব ভালোই দেখায় l আসলে কে কেমন আছে তা সে নিজেই শুধু জানে l"
কথাটা শুনে অন্যেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে l একটা বড়োসড়ো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর হয়ে বাকিটুকু তাঁদেরকেই বুঝতে ছেড়ে দেন ব্রজেশ্বর l


সন্ধে পেরিয়ে বাড়ি ঢোকার মুখে বাগানের গেটখানা খুলে বারান্দায় উঠতে উঠতে নীলিমার গলা শোনা যায়, "দাঁড়াও, খানকতক রাজাউজির মেরে, দেশোদ্ধার করে তবে তো ফিরবেন আড্ডা থেকে !"

ব্রজেশ্বর ঘরে ঢুকতেই, "ওই যে এলেন...." বলে ওঠেন  নীলিমা l
"আরে হারান যে ! কখন এলে?"
"এই আধঘণ্টাটাক হবে l"
"রোসো,  আমি হাতপাটা ধুয়ে আসি আগে l"

হারান মন্ডল ব্রজেশ্বরের অফিসের পুরোনো  বেয়ারা l বরাবরই তাঁর বড়ো প্রিয় পাত্র l মেয়ের বিয়ের সময় টাকাপয়সা নিয়ে খুব আতান্তরে পড়েছিল l হঠাৎ ভালো সম্বন্ধ আসায় টাকাকড়ি যোগাড় করে উঠতে না পেরে ব্রজেশ্বরের দ্বারস্থ হয়েছিল l ব্রজেশ্বর যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন তখন l পরে সেই টাকা আর ফেরতও নেননি l তা সেই উপকার হারান ভোলেনি l সে মাঝে মাঝেই দেশের বাড়ির শাকসব্জি, কলাটা, আমটা নিয়ে হাজির হয় l   

বাইরের জামাকাপড় ছেড়ে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে এসে বসতে না বসতেই নীলিমা দু প্লেট চাউমিন নিয়ে ঢোকে l 

হারান লজ্জিত ভাবে বলে, "আবার এসব কেন বৌদি? এই তো চা মিষ্টি সব খেলাম l"
"আরে খাও l অরুণা বানালো l আমরা সবাই খাবো l"
"খাও হারান, আমার বৌমার রান্নার হাত খুব ভালো l গিন্নিও আজকাল ওর কাছে ফেল মেরে যায় l "

খাওয়া শেষ হতে ব্রজেশ্বর হারানের কাছে তার  খবরাখবর নেন l 
"আজ্ঞে আমরা একরকম ভালোই আছি বাবু l  জামাই আমার বড়ো ভালো ছেলে l আমাদের খুব খোঁজখবর নেয় l মেয়ে আমার সুখেই আছে l এবারে ছেলেটার দোকানটা মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেলেই...এতো টাকাকড়ি ঢেলে করা l চেষ্টাচরিত্র করেও কোনো চাকরী তো জোটাতে পারল না l আর চাকরীরও যা বাজার ! এমন বি কম পাশ কত ছেলে সব ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে... এতো আর আপনার বিনু নয়, পাশ করে বেরোতে না বেরোতেই চাকরী... " 

শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন ব্রজেশ্বর l  
"ছেলে নিজের পায়ে দাঁড়ালেই কী আর সব সুখ হয় হে? মনে সুখ থাকাটাই আসল হারান l সেটাই যে সবার থাকে না l" বলে আচমকা গম্ভীর মুখে মসৃণ লাল মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন l

হারান একটু অবাক হয় l কথাটার সাথে ব্রজেশ্বরের অসুখের কারণ কিছু থাকা সম্ভব কিনা তা নিয়ে চারপাশে হাতড়ায় l তারপর কিছুই খুঁজে না পেয়ে তাকিয়ে থাকে তাঁর মুখের দিকে l


চা নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে নীলিমার কানে যায় ব্রজেশ্বরের শেষেরদিকের কথাগুলো l
"হ্যাঁ গো, কবে থেকে তোমার বুকে ব্যথা ? কই বলোনি তো!"
"আরে না না, তেমন কিছু নয় l" অপ্রস্তুত ব্রজেশ্বর বলে ওঠেন তাড়াতাড়ি l
"না না বাবু l গাফিলতি করবেন না l ডাক্তার দেখিয়ে নেন l" 
"দাঁড়াও, আমি আজই বিনুকে বলছি l"


খানিক পরে হারান যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায় l হঠাৎ চোখ যায় নতুন এসি-টার দিকে l 
"নতুন লাগালেন বাবু ?" 
"ওটা বিনু কিনে দিয়েছে এবার l আমি আপত্তি করেছিলাম, আমাদের বয়েস হয়েছে, তারপর একতলার দক্ষিণ খোলা ঘর, এসির কী দরকার ? তা ছেলে শুনলো না l বলে দোতলায় ওদের ঘরে আছে যখন আমাদের ঘরেও থাক..."  নীলিমা হাসি মুখে বলেন l 

হারান একবার মুখ নিচু করে বসে থাকা ব্রজেশ্বরের দিকে অবাক হয়ে তাকায় l তারপর বলে, "আসি আজ তাহলে l অনেক রাত্তির হয়ে গেল l"


নিজের ঘরে বসে একটা কথা বলার জো নেই ! সঙ্গে সঙ্গে এসে খপাৎ করে ধরবে ! মা-ছেলেতে মিলে আজই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছিল আরেকটু হলেই l অনেক কষ্টে বুঝিয়েসুঝিয়ে নিরস্ত করেছেন ব্রজেশ্বর l মাঝখান থেকে অমন ভালো চিংড়ির মালাইকারিটা রাতের বেলা আর খাওয়া হলো না তাঁর l
"তুমি আর রাতে মালাইকারি খেও না বাবা l বয়েস হয়েছে, রাতেই হজমের সমস্যাটা বেশী হয় l বরং তরিতরকারি আর একটুকরো ভেটকিমাছ দিয়ে খাও l"
"আপনার জন্যে মাংস আর মালাইকারি তুলে রেখেছি বাবা l কাল দুপুরে খাবেন এখন l"

কী জ্বালা ! এগুলো কোনো কথা হলো !
নীলিমাও এমন, তাঁর সামনে বিনুকে মালাইকারি দিয়ে বাটিটা তুলে নিয়ে চলে গেল ! সব শত্তুর l


রোজ রাতে খেয়েদেয়ে বারান্দায় গিয়ে একটু বসেন ব্রজেশ্বর l ঘরে পরিপাটি বিছানা করা l মশারি টাঙানো l নীলিমার খেয়েদেয়ে আর মশারি টাঙানোর হ্যাপা ভালো লাগে না l তাই কাজ আগেই সেরে রাখেন l কী মনে হতে ব্রজেশ্বর খাবার ঘরে উঁকি মেরে দেখেন শাশুড়ি-বৌ মিলে সবে খেতে বসেছে l ওহ ! এখনো অনেক দেরী l ঘর থেকে ফোনটা নিয়ে বারান্দায় ইজিচেয়ারে এসে বসেন l

"কী হে শোভন, খাওয়াদাওয়া হলো? এখন আছো কেমন? .... আর আমার কথা বোলোনা হে, আছি মানে রাজার হালে আছি, হ্যাহ l কথায় বলে না ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার ! সেই রকম আর কী l....আরে ছেলে বাড়িতে থাকলেই বা সবই তো আমার ঘাড়ে l এদিকে  পান থেকে চুন সবাই মিলে যা তুলকালাম করে যে বাড়িতে টেকাই দায়.... না হে শরীর আমারও ভালো নেই মোটেই তায় সংসারের হ্যাপা... " 

জোৎস্নারাতে বাগানটাকে কেমন মায়াবী লাগে l গন্ধরাজ, বেলফুল, কামিনীফুলগাছ আলো করে ফুল ফুটে রয়েছে l বাতাসে তাদের গন্ধ l নারকেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে বারান্দায় l হাওয়ায় পাতাগুলো দুলে দুলে এক একবার একেক রকমের নকশা ফুটিয়ে তুলছে l ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে রাতের এই রূপটুকু উপভোগ করতে করতে ব্রজেশ্বর বাঁড়ুজ্যে নিজের বুকে পেটে হাত বোলান আর পরম সুখে নিজের অ-সুখের বৃত্তান্ত বলে চলেন l

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য