ডঃ রমলা মুখার্জী
কবি নজরুলের রচনায় শ্যামাসংগীত ও গজল
নজরুলের শ্যামাসংগীত
কাজী নজরুল ছিলেন সব সম্রদায়ের উর্দ্ধে এক মহামানব।মানব ধর্মের পূজারী
নজরুল একদিকে ইসলামিক গান অপরদিকে হিন্দু দেবদেবী নিয়েও বহু গান রচনা
করেছেন।
হিন্দু ধর্মের
শাক্ত দর্শন কবি নজরুলকে ভীষণভাবে বিমোহিত করেছিল। সেই তন্ময়তা থেকেই জন্ম
নজরুলের অগুন্তি শ্যামাসংগীতের। শক্তি পুজোয় তাঁর ভক্ত হৃদয়ের অকৃত্রিম
আকুলতা ও নিবেদন আমরা তাঁর 'রাঙাজবা' কাব্যগ্রন্হের প্রতিটি গানে পাই। ১৯৬৬
সালে কবির একশটি অসাধারণ শ্যামাসংগীত নিয়ে 'রাঙাজবা" প্রকাশিত হয়।এছাড়াও
অন্যান্য বিভিন্ন কাবেগ্রন্হেও নজরুলের শতাধিক শ্যামাসংগীত আছে। বিংশ
শতাব্দীর আকাশ এক নতুন আঙ্গিকের শ্যামাসংগীতের মূর্ছনায়
উদ্বেলিত,উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।কবির শ্যামা মা সমাজতন্ত্রের
রূপকার,অশুভনাশিনী,নিরহংকারিনী, আমিত্ববিনাশিনী,মায়ের কালোরূপের মাঝে
তিনি বিশ্বরূপাকেই দর্শন করেছেন,তাই তো কালোমেয়ের পায়ের তলায় যে আলোর নাচন
তাতে তো রুদ্র শিবও পরাজিত।অপরদিকে আবার দেখি নজরুলের শ্যামা মা
ইংরেজ-বিনাশিনী রূপে অবতীর্ণা,মহাকালীর বীরত্ব যেন বাংলার জনমানসেরই
বীরত্বের প্রতীক। এভাবেই নজরুল তাঁর শ্যামাসংগীতের মধ্যে এনেছেন প্রত্যক্ষ
স্বদেশীয়ানা যার দ্বারা তিনি জনগণকে প্রতিবাদী ও বিপ্লবী মন্ত্রে দিক্ষিত
করতে চেয়েছিলেন।
নজরুল
তিন হাজারেরও বেশি সংগীত রচনা করেছেন আর তার মধ্যে প্রায় এক হাজার তাঁর
শ্যামাসংগীত।নজরুল শ্যামাকে তাঁর অসংখ্য গানে বিভিন্ন রূপে ও
চরিত্রে,বিভিন্ন ভাবধারায় প্লাবিত করেছেন।
'ধুমকেতু' পত্রিকায় প্রকাশিত 'আনন্দময়ীর আগমনে' শ্যামা মায়ের সংহারনাশিনী
রূপ বর্ণনার প্রাক্কালে নজরুল ইংরেজ শাসকদের বলেছেন,"অত্যাচারী শক্তি
চাঁড়াল......বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি"। তার ফলে নজরুল গ্রেপ্তার হলেন এবং
এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করলেন।
নজরুলের শ্যামাসংগীতে আর একটি রূপের প্রকাশ দেখি 'পূজা-বিলাসের' বিরুদ্ধে।তাঁর মতে আড়ম্বরহীন অন্তরের আকুল নিবেদনই প্রকৃত পুজো।
নজরুলের শ্যামাসংগীত জনপ্রিয় হওয়ার মূলে ছিল তাঁর একাগ্রচিত্তে কালী সাধনা ও হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত ভক্তি নিবেদনের আর্তি।
"ভক্তি আমার ধুপের মত,উর্দ্ধে উঠে অবিরত।"
কট্টরপন্হি মুসলমানদের মধ্যে নজরুল সম্পর্কে বড় অভিযোগের কারণই ছিল
নজরুলের শ্যামাসংগীত।পূর্ববঙ্গের বেতারেও নজরুলের শ্যামাসংগীত সম্প্রচার
সাময়িক নিষিদ্ধ ছিল।সব ধর্মের ওপরে অধিষ্ঠান করে নজরুলের শ্যামাসংগীত ভাবের
গভীরতা ও রচনাশৈলীর গুনে যুগে যুগে সমাদৃত হয়ে যাবে প্রকৃত ভক্ত ও
গুনীজনের হৃদমাঝারে।
নজরুলের গজল
কাজী নজরুল ইসলামকে গজল গানের প্রবর্তক বলে অনেকেই দাবী করেন কারণ তাঁর
আগে দু-একজন গজল লিখলেও গজল গানকে সম্পূর্ণতা দিয়ে শিখরে অধিষ্ঠান করিয়েছেন
একমাত্র নজরুল।তবে তাঁর বাংলা গজল যে সর্বশ্রেষ্ঠ একথা নিঃসন্দেহেই বলা
যায় কারণ বাংলার মানব-জমীনে নজরুলের গজল বাঁধ ভাঙা বন্যার মত ঢুকে পড়েছিল।
১৯২৬ সালে কৃষ্ণনগরে থাকাকালীন নজরুল গজল লিখতে শুরু করেন।উর্দু গজলের
সুরে তাঁর দুটি গান,'আসে বসন্ত ফুল বনে' ও 'দুরন্ত বায়ু......বইয়াঁ',
'সওগত' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।'বাগিচায় বুলবুলি তুই' তাঁর রচিত প্রথম গজল
গান।'বুলবুল' (১৯২৮) নজরুলের প্রথম গজলের অসামান্য সংকলন এবং এই গীতগ্রন্হে
প্রতিটি গানই ছন্দ-মিলে রচিত। 'বুলবুল' কবি উৎসর্গ করেছিলেন কবির গজল
গানের প্রচারক,বন্ধু দিলীপ কুমার রায়কে।নজরুলের গজল গানে ইরাণী মহাকবি
হাফিজ ও অমর খৈয়ামের প্রভাব দেখা গেলেও বাংলা গজলের একছত্র সম্রাট কিন্তু
নজরুল।গজলের বাণী হয় কবিতায়,সুর হয় রাগভিত্তিক।গজলের শেষে নজরুল 'কবি' নাম
উল্লেখ করেছেন।নজরুলের গজল মূলত প্রেমকেন্দ্রিক,অর্থাৎ পার্থিব
প্রেমের-'ভুলি কেমনে';কিছু অপার্থিব ইসলামিক গজলও তাঁর আছে-'খোদার প্রেমে
শরাব পিয়ে'।
বাংলা ও উর্দু ভাষা মিশিয়ে নজরুল কিছু পরীক্ষামূলক গজলও রচনা করেছেন।বাংলা হিন্দি মিশিয়েও তাঁর গজল আছে।
নজরুলের বিদ্রোহী কবি সত্তার বিপরীত কিন্তু এই গজলের আবেগ।বিদ্রোহী
কবির ঝড়ের বেগ গজলে শান্ত,সমাহিত,সংযত;এখানেই নজরুল-কবির সার্থকতা ও
বৈচিত্র্যময়তা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন