অপরাজিতা ভট্টাচার্য
দুশ্চর দিনলিপি
সংসারে কিছু মানুষ থাকে যারা অশান্তিকে ভয় পায়। অশান্তি এড়াতে বোবা থাকার মত ভাল উপায় আর নেই। যে কোন তর্কবিবাদ এড়িয়ে চলা যায়। সংসার সুখের হয় আসলে বোবার গুণে। আমিও তেমনই একটি মানুষ।
বাড়িতে, পাড়ায়, অফিসে এই মধ্য বয়স অবধি আমি মুখ খুলি
কম। দেখি, শুনি, বলি না। আমারই পাশের ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে একটি
মেয়েলি ছেলে, কিশোর। সে একটি মেয়ের সঙ্গে ঐ ফ্ল্যাটে থাকে। ওরা বিয়ে করে নি। কিশোরের নাচের স্কুল আছে। স্কুলটি থেকে কিশোরের আয়পয় ভাল হয়। কিশোর বেরিয়ে গেলেই একটি লোক ওদের ফ্ল্যাটে
আসে। মেয়েটির সঙ্গে লোকটির কথাবার্তা আমাদের ব্যালকনি থেকে শোনা
যায়। আমার
বুদ্ধিতে মনে হয় লোকটির তেমন রোজগার নেই, থাকলে প্রায় রোজ দুপুরে কাজ ফেলে মেয়েটির
কাছে আসা সম্ভব নয়। কিশোরকে নিয়ে
ওরা অশালীন মস্করা করে। মেয়েটি দোকান থেকে খাবার আনায়, সেও নিশ্চয়ই কিশোরেরই টাকায়। অথচ ওদের অট্ট হাসির উপজীব্যই হল
কিশোরের মেয়েলিপনা।
পয়লা বৈশাখের দিন বিকেলে কিশোর আমাকে বলে গেল যে তার নাচের প্রোগ্রাম আছে। ফিরতে অনেক রাত হবে। মেয়েটি একা আছে। আমি কিছুতেই বলে উঠতে পারলাম না, যে তোমাকে সম্মান করে না তুমি তার সঙ্গে
থেকো না। মেয়েটি তোমাকে একপ্রকার ঠকাচ্ছে।
অফিসে এক কলিগ তার খুড়তুতো ভাগ্নিকে নিয়ে রসালো আলোচনা করছিল। সেই ভাগ্নিটি
কলিগের নিজের মেয়ের বয়সী। কলিগের কাছে নাকি খবর আছে যে তার ভাগ্নি একদিন রাতে বাড়ি
ফেরে নি। প্রেমিকের সঙ্গে রাত কাটিয়েছে। ভাগ্নি তো মেয়েরই মত। অথচ মেয়েটির রাতে বাড়ি না ফেরার
বিষয়টি অফিসের টেবিলে যেভাবে পরিবেশিত হচ্ছিল তাতে মেয়েটিকে না চিনেও আমার
অস্বস্তি হচ্ছিল। কলিগটির নিজের মেয়ে শিক্ষায় সহবতে কতটা উন্নততর তা বোঝাতেই হয়ত এমন নিম্ন রুচির প্রসঙ্গের অবতারণা। আমি কিছুক্ষণের জন্য
আমার টেবিল ছেড়ে উঠে যাই। কিছুতেই বলে উঠতে পারি না এমন অশোভন আলোচনা বন্ধ করো।
আমার বৌ আমাকে অপদার্থ বলে, অকম্মার ধাড়ি বলে। কলার ধরে ঝাঁকিয়ে প্রতিটা দোষারোপের জবাবদিহি চায়। কিন্তু চুপ করে থাকি। আমার বারো বছরের মেয়ের ম্যাপ পয়েন্টিং
প্র্যাকটিসের জন্য ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্র আনতে বলেছিল। এনেওছিলাম। কিন্তু দোকানে খুলে দেখি নি। বৌ দেখে বলল ম্যাপে তেলেঙ্গানা নেই। ওটা এখন নতুন রাজ্য। আমি অপদার্থ বলেই দেখে আনি নি।
আমি ম্যাপগুলো দোকানে ফেরত দিতে গেলাম। দোকানদার ম্যাপগুলো ফেরত নেবার সময় বলল “দেখতে দেখতে গোর্খাল্যান্ডও আলাদা রাজ্য হল বলে। ম্যাপ বেচাই বন্ধ করে দিতে হবে।“
এরপর কিচ্ছুটি না বলে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে অন্য দোকানে তেলেঙ্গানা সমেত ম্যাপ খোঁজার
কথা।
কিন্তু আমি বলে ফেললাম। এই প্রথমবার আমি বলে ফেললাম।
“ভারতের রাজনীতিতে
কিছুই অসম্ভব নয়।“
সংসারের চেয়ে বড় রাজনীতি আর কোথায়! ফলে সংসারেও তাই … এটুকু আর বলা হল না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন