মণিজিঞ্জির সান্যাল
প্রবাহ
রিনি
অর্কের বিবাহিত জীবন বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। কিন্তু এখন ও মা হতে রাজি নয়
রিনি। অর্ক অনেক বুঝিয়েছে কিন্তু রিনি কেরিয়ার নিয়ে এত পাগল যে এতটুকু
ভাবনাচিন্তা নেই। অর্ক অনেক বুঝিয়েছে, সময় থাকতে ভাবা উচিত। তা না হলে তো
পরে কনসিভ করাই মুশকিল হবে। অর্কের কথাটা শেষ হতে না হতেই রিনি বলে উঠেছে
“বাচ্চা নিতেই হবে এমন কোনও ব্যাপার আছে নাকি!”
“মানে!”
“হ্যাপা কে সামলাবে এর, আমি ছুটি নিয়ে বসে থাকতে পারব না, তাছাড়া দু’বছরের মধ্যে সম্ভাবনাও দেখছি না।”
অর্ক
আর কথা বাড়ায়নি, মনে মনে ভেবেছে এমনটাই হবার ছিল, যা কেরিয়ারিস্ট রিনি তা
মা হবার কোনও ইচ্ছে কোনও দিন জাগবে বলে মনে হয় না। কিছুদিন এই নিয়ে ভীষণ
টেনসড ছিল অর্ক। তবুও হাল ছাড়েনি। যেভাবেই হোক বোঝাতে হবে। ছুটি নিয়ে যে
বাইরে ক’দিন বেড়াতে যাবে তার কোনও উপায় নেই। কী করা যায় ভাবছিল অর্ক।
অফিসে কিছুতেই মন বসাতে পারছিল না। অথচ একটা শিশু, তার আধো-আধো কথা, সারা
বাড়িতে দাপাদাপি এসব ভাবলেই বুকের ভিতরটা কেমন চিন চিন করে উঠে। বাবা হবার
প্রবল ইচ্ছেটা কেমন যেন চেপে বসে। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন। হঠাৎ একদিন
অফিস থেকে ফিরে দেখে রিনি ঘরে রিলাক্স মুডে শুয়ে আছে।
“কী ব্যাপারা রিনি শরীর খারাপ নাকি?”
“না না, আমি একদম ঠিক আছি।। তোমারে আজকে একটা কথা বলব, এ জন্যেই তাড়াতাড়ি ফিরলাম।”
রিনির
কথা অর্কের চোখটা চিকচিক করে উঠল। রিনির মনে তাহলে একটা ইচ্ছে জেগেছে।
কাজের মাসিকে দু’কাপ কফি তৈরি করতে বলে বাথরুমে গেল। বেশ ঝরঝরে লাগছে
নিজেকে। চেঞ্জ করে একেবারে কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল, “কী ব্যাপার রিনি,
আজ তোমার এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা?”
রিনিও কফিতে
আয়েশ করে চুমুক দিতে দিতে রিল্যাক্সড মুডে বলল, “আমাদের সত্যিই বাচ্চাটা
নিয়ে নেওয়া দরকার, বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে।” রিনির কথা শুনে অর্ক তাড়াতাড়ি
কফি শেষ করে রিনিকে এসে জড়িয়ে ধরল।
“কী হচ্ছে আমার কফিটা পড়ে যাবে যে!” আদুরে গলায় রিনি কথাটা শেষ করতেই অর্ক বলে উঠল, “তাড়াতাড়ি শেষ করতো?”
অর্কের ছেলেমানুষিতে রিনি হাসতে হাসতে কফিটা শেষ করে বলল, “বাব্বা! বাবা হবার আনন্দে এত আদর!”
অর্ক
এবার সত্যিই রিনির আরও কাছে এল, যতটা ঘনিষ্ঠ হওয়া যায় ততটাই। রিনিকে
বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে ওকে আলতো করে চুমু দিল। রিনি চুপচাপ লক্ষী মেয়ের
মতো অর্কের স্পর্শকে অনুভব করল। অর্কের লোমশ বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে আবেশে
চোখ বুজল। অর্কের ঘন ঘন শ্বাস যখন রিনির শরীরের সঙ্গে একাত্ম হতে লাগল, ঠিক
সেই সময় রিনি বলে উঠল, “তুমি চাও না আমার এই সুন্দর শরীরটা এমনই সুন্দর
থাক!”
আবেশে গলা জড়িয়ে অর্ক বলল, “চাই না আবার?”
তুমি চাও না আমার সঙ্গে এইভাবে রাতের পর রাত ফোরপ্লে করতে?”
“হুম।”
“আমাদের আবার একটা সুন্দর বাচ্চা হবে তাই তো?”
রিনির বুকে মুখ গুজে অর্ক বলে উঠল, “আঃ এখন এসব কথা না সোনা।”
কিন্তু আমি যে চাই আমাদের মুখে হাসি ফোটাবে এক অন্য মহিলা, যাকে বলে কি না সারোগেট মাদার। আইভিএফ সারোগেসি।”
চমকে উঠল অর্ক, “মানে?”
“সন্তান
জন্ম দিতে দরকার ভাল ডিম্বাণু, শুক্রাণু এবং জরায়ু। জরায়ু না থাকলে বা
ত্রুটিযুক্ত হলে অন্যর গর্ভে সন্তানকে বড় করে তোলা যায়। এটাই সারোগেসি।
আবার মায়ের শরীরে অসুবিধা থাকলে কৃত্রিম উপায়ে শরীরের বাইরে ডিম্বাণু ও
শুক্রাণুর মিলন ঘটিয়ে ভ্রণ তৈরি করে নিলে সেটি আইভিএফ সারোগেসি।”
“আমাদের
সন্তান হবে অন্য এক মহিলার গর্ভে। তুমি কী বলছ রিনি। চেনা নেই, জানা নেই,
অচেনা, অজানা এক মহিলার গর্ভে আমাদের সন্তান জন্ম নেবে। তাছাড়া তুমি তো
সুস্থ রিনি, তোমার শরীরে তা কোন প্রবলেম নেই।”
“প্রবলেম নেই, কিন্তু হতেই বা কতক্ষণ। তাছাড়া আমার এত ঝক্কি পোষাবে না, এছাড়া ছুটিছাটার ব্যাপার…”
শেষ
কথাগুলো বড্ড বিষাক্ত ঠেকল অর্কের কানে। ভালবাসার মানুষটাকে বড্ড দুরের
মনে হতে লাগল। এই সেই রিনি, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্কুলবেলার, কলেজবেলার
কত স্মৃতি! মজা করে অর্ক কত কথা বলত, রিনি বাচ্চার নামের কত বড় লিস্ট তৈরি
করেছিল। একদিন নাম নিয়ে কত ঝগড়াই না হয়েছিল, তার জেরে চারদিন টানা কথা
বলেনি রিনি অর্কের সঙ্গে। শুধু কি নাম নিয়ে ঝগড়া, অর্ক যখন বলত, “আমাদের
ছেলে হবে না মেয়ে হবে” রিনি তখন বলত, ছেলে হোক, মেয়ে হোক কোনও আপত্তি
নেই। বাচ্চাটা তো আমাদেরই। আর একটা বাচ্চা কেন হবে? আমাদের থাকবে
দু’-দু’টো সন্তান। এরা একসঙ্গে খেলবে, মজা করবে, সারা বাড়িটা আনন্দে
মাতিয়ে রাখবে।”
অর্কের চোখটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে
উঠল। চোখের সামনে স্বপ্নের ছবিগুলো কেমন যেন ফিকে হতে যেতে লাগল। ধূসর,
আবছা মনে হত লাগল সব কিছু।
চুপচাপ ছিল কিছুদিন, আর
কথা বাড়ায়নি, সময়ের হাতে ছেড়ে দিলে সব কিছু। ভাবল সময় অনেক কিছুকে
পালটে দেয়, হয়তো রিনির ভাবনারও কোনও পরিবর্তন আসতে পারে। অর্কের স্বভাবের
এই এক বৈশিষ্ট্য, কোনও কিছু কোনদিনই কারও ওপর চালাতে পারে না। নিজের
ইচ্ছে, নিজের চাওয়া-পাওয়াকে কোনওদিনই তেমন বড় করে দেখেনি। তাই সময়কেই সে
বন্ধু হিসেবে মেনে নিল।
দিন চলছিল তার মতো করে, অর্ক
আর রিনির জীবন এখন আগের চেয়েও বেশি ব্যস্ততার মধ্যে কাটছে। অর্ক এখন সব
কিছুকে আগের চেয়ে বেশি ভালভাবে মেনে নিতে শিখেছে। যেমন মেনে নিয়েছে
বিভিন্ন আবদারকে। তাই সময়ের হাত ধরে রিনির প্রস্তাবকেই মেনে নিতে হল আবার,
জীবনের এমন এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়েও।
নির্দিষ্ট দিনে তাদের ভ্রূণকে প্রবেশ করানো হল অন্য এক নারীগর্ভে। বাড়তে লাগল সেই ভ্রূণ সারোগেট মাদারের গর্ভে।
।। ২ ।।
তমসা
নামের সঙ্গে জীবনের কি সাঙ্ঘাতিক মিল। জীবনটাও কেমন যেন ঘন অন্ধকারে
সাজানো। স্বপ্নে ভরপুর ছিল একসময় তমসার জীবন। কিন্তু সব স্বপ্ন, সব আশার
জলাঞ্জলি দিল বাবার মৃত্যুর পর। ছোট্ট ভাই আর মাকে নিয়ে তার জীবন। টিউশনি
করে চলছিল তার পরিবার। ভাগ্যিস একটা ছোট বাড়ি করে রেখে গিয়েছিল তা বাবা।
টিউশনির পাশাপাশি কম্পিউটারটা খুব মন দিয়ে শিখছিল, যার ফলে অনেক চেষ্টার
পর একজনের সহায়তায় একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি নিল। সংসারটা যেন একটু
সুখের মুখ দেখল। তমসার একটাই চিন্তা ভাইকে মানুষ করতে হবে, বড় করতে হবে,
কত আদরের ভাই তার। বাবাকে তবুও তো তমসা পেয়েছে, কিন্তু ভাই তো তেমনভাবে
পায়নি। দু’ভাই-বোনের বয়সের পার্থক্যটা অনেক। দিদির কাছেই তার যত আবদার,
ভাই অন্ত প্রাণ দিদিও। ভাই এখন ভাল স্কুলে পড়ে। ওর মধ্যেই যেন নিজের
স্বপ্ন পূরণের ভরসা। অফিসে সেদিন খুব কাজের চাপ, নতুন ঢুকেছে, সবে পাঁচ
মাস। সবকিছু ঠিকঠাক আয়ত্তে আনতে আরও ছ’মাস লাগবে। প্রত্যেকে কী ভীষণ
পরিশ্রম করে। ভেবেছিল ভাল করে পড়াশোনা করে একটার পর একটা চাকরির পরীক্ষা
গুলো দেবে। এসএসসি, বিসিএস, কিন্তু সংসার চলে সে সুযোগ আর হচ্ছে কই। তবুও
তমসা রাত জেগে পড়াশোনা করছে। আগামী দু’বছর নিজের কাছে নিজেকে সময়
দিয়েছে। আত্মীয়স্বজন তেমন কেউ নেই। আর আজকের দিনে নিজের পরিবারের ঝক্কি
সামলে কে আর অন্য পরিবারকে দেখে। সেটা ভাল করেই বোঝে তমসা। তাই ঠিক করেছে
দু’বছরে মধ্যে কিছু একটা পেতেই হবে। তার জন্যে যত পরিশ্রম হোক করতেই হবে।
“তমসা তোমার ফোনটা বাজছে।”
সহকর্মী রূপাদির কথায় খেয়াল করল, আরে মায়ের ফোন। ফোনটা ধরতেই মা বলে উঠল, “তমসা তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়। ভাইয়ের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।”
।। ৩ ।।
ভাই
আর্য শুয়ে আছে নার্সিংহোমে। সেদিন স্কুল বাস পায়নি তাই পরিচিত একজনের
বাইকে চেপে স্কুলে যাচ্ছিল। উলটো দিক থেকে একটা মারুতির সঙ্গে এমনভাবে
ধাক্কা লাগে যে বাইকটা উলটে পড়ে যায় বাঁ দিকের একটি মাঠে। একটা গাছের
সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এমনভাবে তার ডান পায়ে লাগে যে প্রাণে বেঁচে গেলেও
ইমিডিয়েট অপারেশন না করলে কোনদিন ও স্বাভাবিক ছন্দে হাঁটতে পারবে না।
সরকারি হাসপাতাল তো আগেই হাত তুলে দিয়েছে, সুতরাং যে ডাক্তারকে দেখানো হল
তাতে নার্সিংহোম, অপারেশন সব সমেত লাখ টাকার মতো খরচ পড়বে, তার একটা
এস্টিমেট ডা. রায় জানিয়ে দিলেন। চিন্তায় পাগলের মতো অবস্থা। যে ক’টা
জমানো টাকা, আর অফিসে অনেক অনুনয় বিনয় করে দশ হাজারের বেশি কিছুতেই সম্ভব
নয়। নতুন চাকরিতে এটুকু দিতেও বস দ্বিধাগ্রস্ত।
মায়ের
জলভরা চোখ আর ভাইয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে তমসা যখন ক্লান্ত ঠিক
তখনই কীভাবে যেন কানে এল সারোগেট মাদারের কাহিনী। গুগল সার্চ করে তক্ষুনি
বিস্তারিতভাবে জেনে ফেলল সবকিছু। নির্ভরযোগ্য আইভিএফ ক্লিনিকগুলোতে
যোগাযোগ করল। একটুও দেরি না করে চুপচাপ সব ব্যবস্থা করে ফেলল। থাকারও
ব্যবস্থা করে ফেলল। ইচ্ছে করেই অন্য এক শহরকে বেছে নিল মাত্র পরিবারের কেউ
জানতে না পারে। মাকে বলল, “কোম্পানি লোন দেবে এক লাখ টাকা। তবে দশ মাসের
একটা ট্রেনিং আছে। ইমিডিয়েটলি যেতে হবে।”
“কিন্তু তুই একা একা এত দুৱে থাকবি কীভাবে?”
“মা এখন ওসব কথা ভাবার সময়? ভাইকে ঠিক করতে হবে না? তুমি চাও না আবার হাঁটুক, খেলুক, স্কুলে যাক।”
“সে কি আর চাই না। কিন্তু সারাটা জীবন তুই…”
“মা আমাদের কেউ নেই। আমাদের এই ভাবেই বাঁচতে হবে। ভাইকে বড় করতে হবে।”
মা আর কথা বাড়াল না। নির্দিষ্ট দিনে ভাইয়ের অপারেশন হয়ে গেল। অপারেশন সাকসেসফুল। অগ্রিম টাকা ক্লিনিক মাধ্যমেই পেয়ে গিয়েছিল।
।। ৪ ।।
ভাই
আর্য বাড়িতে ফিরেছে সুস্থভাবে। একটা ভ্রূণ তখন তার গর্ভে। অনেক সাবধানে
থাকতে হবে। অনেকগুলো টাকা দিয়েছে যে এই ভ্রূণের জেনেটিক বাবা, মা।
নির্দিষ্টদিনে তমসা রওনা দিলা তার নতুন ঠিকানায়, অর্ক আর রিনির সন্তান
জন্ম দিতে।
হঠাৎ তমসার মনে পড়ল মৈনাকের মুখটা, যার
সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল এই মাস চারেক আগে। সুস্থ সুন্দর নির্ভেজাল একটা
বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকলেও ধীরে ধীরে সম্পর্কের রূপটা কেমন যেন পালটে যেতে
লাগল। অদ্ভুত এক ভাললাগা তমসা অনুভব করছিল যেন। খেয়াল করেছিল মৈনাকের চোখ
সেই কথাই বলছে। চোখই তো মনের ভাষার প্রথম স্তর। মুখে কিছু না বললেও ওরা
যেন পরস্পর ওদের চোখ দিয়ে বুঝিয়েছিল ‘আমি তোমার, শুধু তোমার।’ তমসা চোখ
বুজল, মৈনাকের মুখটা শেষ একবার মনে করার চেষ্টা করল। ভাবল আমার এই অন্ধকার
জীবনে সঙ্গে মৈনাকের জীবনকে ভাগ্যিস জড়াইনি, ওর জীবন ওর মতো করেই সাজাক,
জীবন একটাই, কোন মুল্যেই একে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। শুধু মনে মনে বলল,
“মৈনাক আমাকে তুমি ভুল বুঝো না, আমাকে ক্ষমা করো মৈনাক। তুমি, যেখানেই
থাকো খুব ভাল থাকো, খুব ভালো থাকো।” আকাশ তখন অন্ধকার। বৃষ্টি হয়েছে এক
পশলা। চোখের কোণে দু’ফোঁটা অশ্রুবিন্দু। একটা অদ্ভুত মাতৃত্ব তার শরীর
আর মনকে কীভাবে যেন ছেয়ে ফেলল। নিজের মনে নিজেই বলে উঠল, “কিচ্ছু চিন্তা
করিস না সোনা, আমি তোকে আমার গর্ভে সুন্দর ভাবে বড় করব। আমি তোর আর কেউ
না হই, কিন্তু সারোগেট মা তো।”
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন