দীপশেখর চক্রবর্তী

টাইম এন্ড স্পেস

নাভি থেকে ছড়িয়ে পড়ছে এই শব্দ আমার শরীরের চারিদিকে।বিকেলের আলো মরে যাওয়া গায়ে মেখে পাখিদের দল উন্মাদের মতো পাক দিয়ে চলেছে আকাশ এবং তাদের এক একটি পাকে শেষ হয়ে চলেছে আমার একেকটি জন্ম।দূরে ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে দেখা যায় আমার আগামী বয়স কেমন তীক্ষ্ণ চোখে খুঁজে নিতে চাইছে আমার নিভন্ত মুখ।একটি পলক আর আমি গেছি পাহাড়ের সেই অপূর্ব খাদের পাশে আর আমাকে বিদায় জানাতে প্রস্তুত তিন বান্ধবী।প্রথমজন হাতে ধরিয়ে দিয়েছে তীব্র স্বাদের কমলালেবু।দ্বিতীয় আচমকা তার পাহাড়ি মেঘতুল্য ঠোঁট দিয়ে এঁকে দিলো একটা সুগভীর চুম্বন।তৃতীয়,যাকে দিয়েছি আমার সর্বস্ব সে ভালোবেসে আমাকে খাদের অতলে ঠেলে দিলো।আমি ডুবছি আর ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে উঠছে ফুলের গন্ধ।আরেকটি পলক আর আমার পতনের শরীর জেগে উঠলো স্নানের গামলায়।তার পারে এক সমুদ্রসৈকত।সেখানে লাল কাঁকড়াদের পাশে বালির শহর গড়ে তুলছে এক শিশু।প্রবল হয়ে উঠলো আমার অপত্যস্নেহসমূহ।সমস্ত জল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি তার ওপরে এবং খুলে গেলো আমার চোখের পলক।পুরোনো মসজিদের পাশের অন্ধকারে আমি মেয়েটির বুকের ঘ্রাণ সমস্ত সত্তা দিয়ে অনুভব করি।আমাদের কলঙ্ক আরও গভীর করে তুলেছে বন্ধ্যা কাঁঠালতলার অন্ধকার।একটি কুকুর খুঁজে চলেছে রহস্য,দুয়েকটি মানুষের অস্পষ্ট অস্তিত্ব আমাদের সতর্ক করে না।তার বুকের গন্ধ থেকে আজ আমি এক পিয়ানো বাদকের কথা ভাবি।আঙ্গুলের আশ্চর্য মায়ায় যে লিখে চলেছে সারি সারি গ্রাম,ছাতিমের গন্ধ,দূর নদীর বাঁধে বসে থাকা এক কিশোরের গভীর কালো চোখ।চোখের পলক।অমনি দেখি আমাদের এই ঘনিষ্ঠতার দিকে সারি সারি মশালের আলো ছুটে আসে।ঘৃণা তীব্র ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ে ওদের গলায়।আমাদের বুকের ঘ্রাণ একটি শিশিতে নিয়ে আমরা পালাতে থাকি বন জঙ্গল পার করে,ঝাঁপিয়ে পড়ি আরও আরও কলঙ্কে।আচমকা চোখের পলক পড়ে,দেখি প্রান্তিকের সেই হোটেলের বিছানায় আমরা দুজনে।নীচে প্রবল স্রোতে বয়ে চলেছে নদী।সারা বিছানা জুড়ে লক্ষ্ লক্ষ পাখির মৃতদেহ।আমি এই লেখার দুহাতে তাদের বিছানার ভেতর কবর দি।তাদের কবরের ওপর পুঁতে দিই একটি করে ফুলগাছ।একটি ফুলের জন্ম হয়,জেগে ওঠে আমার প্রিয়তমা।সে বলে এ জন্মে সে অন্য কারও সংসারে নিজের শরীর রেখে এসেছে।আমি তার বুকের গন্ধ নিতে চাই।শূন্যের ধারণা সৃষ্টি হয় আমার মধ্যে।
আমি শূন্যের ভেতর আরও প্রবেশ করি।আমার ভেতরের সমস্ত দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দেখি বিরাট শাদা বালির সমুদ্রসৈকত।একদিকে একটি উঁচু লাইটহাউস।অসংখ্য পাখি কবর থেকে জেগে উড়ছে তার চারিদিকে।একটি নৌকো বাঁধা আছে তীরে।আমি জানি এই পারাপার আমার জন্য নয়।আমি পলক ফেলি অথচ কিছুতেই বদলে যায় না দৃশ্য।এমন এক দৃশ্যের মধ্যে আমি বাঁধা পড়ে গেছি।আমি কি স্বপ্নে?জাগ্রত?আমার শরীর থেকে শরীর খুবলে নিয়ে যায় একটি পাখি।আমার চোখ থেকে দৃষ্টি খুবলে নিয়ে যায় অপরটি,আমার শিশ্ন থেকে রমণক্ষমতা খুবলে নিয়ে যায় অন্তিম।আমি বালির ভেতর পাখিদ্বারা বধ হয়ে পড়ে থাকি?
সমুদ্রের গর্জন কানে আসে,বাতাসে ভেসে আসে সেই শীতের মোহ,কিশোরীর বুকের গন্ধ।আমি উন্মাদের মতো ছুটে যাই এদিক ওদিক।অন্ধ আমি, একটি দৃশ্যের মধ্যে বাঁধা পড়ে আছি।তবু ছুটি আর শুনতে পাই চিৎকার করে হাসছে আমার সমস্ত বয়স।
আমার পলক পড়ছে না।এক জন্ম থেকে অপর জন্মে,এক দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যে অনায়াসে চলে যেতে পারছি না আমি।শুধু অন্ধের মতো বক্ষফুলের গন্ধের দিকে ছুটে চলেছি।আর আমার সমস্ত শরীর জুড়ে বেজে চলেছে প্রান্তিকের হোটেলের বিছানা।পাখিদের কবরের গান ধীরে ধীরে বয়ে চলেছে শরীরের সর্বত্র।আচমকা থেমে যায়।দৃশ্যশূন্য হয়ে পড়ে দিকবিদিক।
আমার হাতের ভেত্যর বারবার ফিরে ফিরে আসে কাঁচের শিশিটি।খুলে ফেলি তার কাঠের ছিপি।
একটি আলো ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে, সৃষ্টি হয় নক্ষত্র,গ্রহ,মহাকাশ,বিশ্বব্রহ্মান্ড,রাগ,দুঃখ,আনন্দ,প্রেম...
আমার লেখার হাত এভাবে আরও একবার সৃষ্টি করে আমাদের চেতনার-অচেতনার সমস্ত কিছু।সময় এবং শূন্যের ভেতর সে চলে যায় নিজের স্পর্শক্ষমতাকে অতিক্রম করে।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য