অর্পিতা বোস
প্রিয় বন্ধু
কাকলি
আর মঞ্জরী হাতের ওপর হাত রেখে একে অপরকে নিঃশব্দ সান্ত্বনা দিচ্ছে । আজ
তারা বন্ধুত্বের অটুট বন্ধনে জড়িয়ে আছে যার জন্য সেই দীপশিখাকে নিয়েই
একসময় তাদের রেষারেষি ছিল।কার বেশি আপন -ঐ শান্ত মৃদুভাষী সুন্দরী
দীপশিখা। হ্যাঁ , মঞ্জরী 'দীপা' নামে আর কাকলি তাকে 'শিখা' বলে ডাকতো।
সেই স্কুলজীবনের থেকেই মঞ্জরী আর কাকলির এই দ্বন্দ্ব।
বরাবর
তাদের দুজনের মধ্যে পড়াশোনা ও এই সখ্যতা নিয়ে এক অলিখিত যুদ্ধ
ছিল।তাদের দুজনের ঈর্ষার মাঝে দীপশিখার ভারসাম্য বজায় রাখতে যে কষ্ট হতো
সেটা তারা দুজনেই অনুভব করত। কিন্তু ঈর্ষাকাতর হয়ে দুজনেই দীপশিখাকে
প্রায় একই কথা বলত, " আমার কাছে এসেছিস কেন?তোর প্রাণের বান্ধবীর কাছে যা।
"
নতমুখে দীপশিখা বলতো ,
-- তোরা দুজনই আমার প্রিয় বন্ধু ।
কিন্তু একটা অব্যক্ত কষ্টের ছাপ ফুটে উঠতো দীপশিখার মুখে। দুজনই সেটা দেখে একটা অদ্ভুত আত্মতৃপ্তিবোধ করতো।
আজও জানে না কেন! হয়তো বা ঈর্ষা অথবা বন্ধুত্বের অধিকার!
দুজনের চোখ আজ ভিজে আর মুখে কোনো কথা নেই। দুজনেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবছে--
সেইসব দিনগুলো ,তাও কতো ভালো ছিল। ঈর্ষার মাঝেও অনেক কিছু প্রাপ্তি ছিল।
অসহায় দুজনই জলভরা চোখে তাকিয়ে আছে চুল্লির দিকে। ওর ভেতরে ওদের প্রিয় বান্ধবীর দেহটা...
নাহ্, নতুন করে আর কি পুড়বে!
ওর বর আর শ্বশুরবাড়ির লোকজন মিলে তো পুড়িয়েই দিয়েছে শরীরের অধিকাংশ অংশটা টাকার জন্য।
শুধু কি শ্বশুর বাড়ির লোকজন! তার বাবা-মাও তো দায়ী এই দাহকাজে।
শান্ত
সুন্দরী এই দীপশিখা তো ভালোবাসতো মলয়দাকে । কিন্তু উচ্চ বংশমর্যাদার জন্য
নমঃশূদ্রের ছেলের সাথে বিয়ে দেননি তার বাবা-মা। আজ তাদের চোখ বেয়ে নেমে
আসা জলকে বড়ো অসহ্য লাগছে তাদের।
নাহ্! শ্বশুর বাড়ির অত্যাচারের কথা শেষ সময়েও
পুলিশের কাছে বলেনি সে।
কিন্তু তারা দুজন তো জানে কোনোদিনই নিজের কষ্টের কথা কাউকে বলতো না সে।
শুধু মনে আছে বিয়ের দিন সকালে তাদের দুজনের কাছে সেদিন খুব কেঁদেছিল সে।
ওরা তবুও সেদিন চেয়েছিল, যেন স্টেশনে অপেক্ষমান মলয়দার সাথে দীপশিখা পালিয়ে যায়।
হ্যাঁ, সেদিন ওরা এক হয়েছিল দীপশিখার নতুন সুন্দর জীবনের সূচনা করার ইচ্ছায়।
কিন্তু স্বেচ্ছায় সেই সুন্দর জীবনের আহ্বান পরিত্যাগ করে দীপশিখা
পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে। যখন দীপশিখার বিয়ে হচ্ছিল, সেদিন ও তারা দুজন
একসাথে হাতে হাত রেখে অসহায়ভাবে দেখেছে তাদের প্রিয় বান্ধবীর মুখে
অব্যক্ত কষ্ট।
তারপর দীপশিখার সাথে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়।
আর আজ! আজ সেই দীপশিখার মৃত্যু আবার ওদের একসাথে করেছে।
খবরটা প্রথম মঞ্জরিই পেয়েছিল দীপশিখার বোনের কাছে।সেই কাকলীকে ফোনে জানায়।আর তারপর
দুজনেই ছুটে গিয়েছিল হাসপাতালে দীপশিখার কাছে। আর শুধুমাত্রই তাদের দুজনের সাথেই শেষ দেখা করতে চেয়েছিল দীপশিখা--
মনে
পড়ছে ওদের। বার্ণ ইউনিটের বাইরে দাঁড়িয়ে দীপশিখার পরিবারের লোকজনদের
ভীড়। অসহ্য লাগছিল তাদের এ কান্না। একটু দূরে কোণায় দুই বন্ধু হাতে হাত
রেখে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন সময় সিস্টার বেরিয়ে বলল,
মঞ্জরি আর কাকলি বলে যদি কেউ থাকেন , পেশেন্ট শুধু মাত্র এদের দুজনের সাথেই দেখা করতে চেয়েছে।
তারা পরিশোধিত পোশাক পরে যখন তার কাছে যায়-- দুজনই চিনতে পারে না তাকে। তাদের সুন্দরী বান্ধবীর কী চেহারা!
একে
অপরের হাত জড়িয়ে ধরে কেন জানেনা! চোখের জল সামলে নিজদের নিয়ন্ত্রণে
রাখতে নাকি অন্য কিছু-- জানেনা। শুধু অনুভব করেছিল নিজেদের
অসহায়তা আবারও একবার।আর কানে এসেছিল সেই মৃদু গলায়, তোরা দুজনই আমার প্রিয় বন্ধু।
হ্যাঁ, দীপশিখার নশ্বর শরীরটা শেষ হয়ে যাচ্ছে যখন, ঐ চুল্লির ভেতরে।যে
দুজোড়া হাত একে অপরকে জড়িয়ে আছে, তারা দুজনেই দীপশিখার প্রিয় বন্ধু
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন