নন্দিনী রায়
চালশে
মিনিট পাঁচেক ধরে ছুঁচে সুতো পরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে শেষে বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিল সুপ্তা।মাসতিনেক আগেও কোনো অসুবিধে ছিল না। দিব্যি মনে আছে।মেয়ের অ্যানুয়াল প্রোগ্রামে ড্রেস সেলাই করতে হয়েছিল। তাও রাতের বেলা। মনে হচ্ছে চোখটা এবার দেখাতে হবে।আয়নার সামনে গিয়ে ভালো করে লক্ষ্য করে চোখটা উপর নীচ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। চোখের অসুবিধে বুঝতে না পারলেও ধরা পড়ে অনেককিছু। চোখের তলায় গভীর কালিতে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। আশেপাশে থাবা বসিয়েছে শালিখের পা।অজস্র আঁকিবুকিতে ভরে গেছে মুখ। গলার কাছে চামড়ায় ভাজ। এতটা বুড়িয়ে গেল কীভাবে সুপ্তা! তাই বোধহয় সৌরদীপও তেমন কাছে টানে না। তবে কি এই চল্লিশেই বুড়িয়ে গেল, ফুরিয়ে গেল!
মুখভর্তি ফ্যানা নিয়ে বাথরুম থেকে চিৎকার করল সৌরদীপ। ' তোয়ালেটা কে দেবে? '। বিরক্ত লাগে। এত বছর হয়ে গেল! তবু, তার কখন কী প্রয়োজন, বুঝেই উঠতে পারল না এখনও।ধূর, সারাদিন অফিসের হাজারো কাজ, টেনশন সামলাতে হয়। বাড়িতে যে একটু স্বাচ্ছন্দ্য পাবে, তা নয়। সারাদিন কী করে কে জানে! ঐ তো রান্না আর ছেলে মানুষ। তাতেও কত বাহানা। আর রান্নাও তো সেই থোড় বড়ি খাড়া। কলিগেরা কত রকমারি টিফিন আনে। আর তার ভাগ্যে, আটার রুটি, তরকারি, সুজি.. ব্যাস। চেহারাটাও দিনদিন কেমন থসথসে হয়ে যাচ্ছে। ধূর! জিভের সাথে সাথে লাইফটাই দরকচা মেরে গেল পুরো।গজগজ করতে করতে বাড়িয়ে দেওয়া তোয়ালেটা টান মেরে নিয়ে নেয়।
স্নান সেরে তোয়ালে আর ভেজা পাজামা বাথরুমেই ফেলে আসে। শোবার ঘরে খাটের ওপর রাখা ইস্তিরি করা শার্ট প্যান্ট, রুমাল,বেল্ট, পার্স সব গুছিয়ে রাখা। তবু যেন কিছুতেই স্বস্তি পায়না। সব যেন একঘেয়ে, পানসে। প্যান্টে বেল্ট আটকাতে গিয়ে নজর পড়ল ভুঁড়িটা দিনদিন কেমন
বেঢপ হয়ে যাচ্ছে। বেল্ট দিয়েও বাগ মানানো যাচ্ছে না। এইরকম চেহারা নিয়ে নতুন জয়েন করা মিস রিয়ার সামনে বড্ড বিব্রত বোধ করে সে। ঠেসেঠুসে কোনোরকমে
ভুঁড়িটাকে বেল্টের আয়ত্তাধীন করে খাবার টেবিলে আসে। উফ! আবার সেই আলু! এই মহিলাই তার জীবনের একমাত্র অশান্তির কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। না কিছু শেখার ইচ্ছা, না কিছু করার ইচ্ছা। অ্যাকাউন্টস এর রজতের সাথে মিস রিয়ার হেসে হেসে কথা বলার দৃশ্যটা মনে পড়তেই জিভটা আরও তেতো হয়ে গেল।
সকাল সকাল উঠে রান্নাবান্না, ছেলেকে স্কুলের জন্য রেডি করে, তাকে স্কুলে পৌঁছে একেবারে স্নান সেরে পূজো করে নেয়। এতক্ষণে একটু থিতু হয় সে।ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁইছুঁই।বাবুই ফিরতে ফিরতে প্রায় সাড়ে তিনটে।এই সময়টা সুপ্তা একটু রয়েবসে কাটায়।কখনো হালকা হাতে ঘর গুছিয়ে। একটু গান শুনে। কখনো বা শুধু চুপচাপ শুয়ে থেকে। একটা সময়ে গল্পের বই পড়ার খুব নেশা ছিল। বিয়ের কিছুদিন পর উপহার পাওয়া বইগুলো নিয়ে পড়তে গেলেই ঠাকুমাশাশুড়ি বলতেন 'বৌ মানুষ ওমন আয়নামুখো হয়ে বসতে নেই।সংসারের অকল্যাণ হয়। ' এরা লেখাপড়া জানা পরিবার হয়েও এই মধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনার কোনো প্রতিবাদ করেনি। সেও তার সাধারণ উচ্চ মাধ্যমিক পাশের বিদ্যে নিয়ে গুটিয়ে গিয়েছিল।আজকাল আর ইচ্ছেটাও নেই।কেমন যেন ম্যাদা মেরে গেছে জীবনটা। সংসারের যাঁতাকলে পিষে নিজেকেই চিনতে পারে না। বিয়ের পরপর নিত্য নতুন রান্না করতে গেলেই শাশুড়ির মুখ তোলো হাড়ি হয়ে যেত। 'দেখো আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার। হিসেব করে মাস চালাতে হয়। এইসব নিত্য নতুন জিনিস রাঁধবার সামর্থ্য আমাদের নেই।তাছাড়া আমার বাবু আমার হাতের রুটি চচ্চড়িতেই অভ্যস্ত '। সবার প্রশংসা কুড়োনো স্যান্ডুইচ সেদিন আর সুপ্তার গলা দিয়ে নামেনি।প্রতি পদে পদে সুপ্তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হোত যে সে সে এই বাড়ির নিয়ম পালন করতে এসেছে। নিজের নিয়ম চালু করবার জন্য নয়। একে একে ঠাকুমাশাশুড়ি, শাশুড়ি মারা গেলেও সুপ্তার সংসার এখনও সেই বাঁধা নিয়মের মধ্যেই আটকে আছে।
লাঞ্চ ব্রেকে ব্যাগ থেকে স্টিলের টিফিনবাটিটা বের করে একরকম চুপিসারেই খাওয়া সারে সৌরদীপ।ক্যান্টিনে সবার সামনে খেতে লজ্জা পায় সে।থাকে তো সেই কুমড়োর ঘ্যাঁট, নয়তো আলু চচ্চড়ি। খুব বেশি হলে আলুর দম। আজ হঠাৎ এসে হাজির রজত।আরে সৌরদা! কী রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে একা একা বৌদির হাতের রান্না খাও?বলেই ছোঁ মেরে টিফিনবাটিটা কেড়ে নেয়। তার নিজের মিলটনের লাঞ্চপ্যাকটা প্রায় ছুঁড়ে দেয়। বলে আজ এটা দিয়েই কাজ চালাও।চরম অস্বস্তিতে পড়লেও কিছু বলে ওঠা যায়না। বোকা বোকা হাসি মুখ করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া।এদিকে ততক্ষণে টিফিনবাটি খুলে রুটি আর আলু কুমড়োর তরকারি বার করে ফেলেছে। নাক টেনে গন্ধ নিয়েই বলে বাহ! রুটি ছিড়ে নারকোল, বাদাম দেওয়া কুমড়োর তরকারি মুখে দিতেই মুখটা হাসিতে ভরে যায় রজতের।বলল,'সেই ভাজা মসলার গন্ধ। ' কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে থাকে।তারপর আস্তে আস্তে বলে,' জানো সৌরদা, মা বেঁচে থাকতে শেষ এমন রান্না খেয়েছি।এমন নরম, সাদা রুটি আর এই তরকারি '। ওর ছলছলে চোখের দিকে তাকিয়ে এই প্রথম রজতকে খুব কাছের মানুষ বলে হলো।রজতের কেনা দামী দোকানের স্যান্ডুইচ চিবোতে চিবোতে মনে পড়ল, তাদের বিয়ের পরপর সুপ্তা একদিন স্যান্ডুইচ বানিয়েছিল। সেটা এর থেকে অনেকগুন ভালো ছিল বোধহয়।
রজত কদিন ধরেই একটা ঘর ভাড়া দেখে দেওয়ার কথা বলছিল। ও যে মেসে থাকে, তাতে রান্নার ব্যবস্থা নেই।বাইরে খেতে হয়। বেশিরভাগ দিনই ফাস্টফুডে কাজ চালায়। তাছাড়া চারজন মিলে রুম শেয়ার করতেও ওর অসুবিধে হচ্ছে। কোনো প্রাইভেসি নেই। আজ আবার বলতেই মনে হলো, মা মারা যাবার পর থেকে ওপরে ছাদ লাগোয়া ঘরটা তো ফাঁকাই পড়ে আছে। দেবে নাকি রজতকে ভাড়া।আর তাদের তিনজনের রান্নার সাথে আর একজনের ব্যবস্থা এমন কিছু অসুবিধেরও নয়। বেশ কিছু টাকাও আসবে।আর তাছাড়া ঐ বাইরে খাওয়ার নামে মিস রিয়ার সাথে সময় কাটানোতেও রাশ টানা যাবে।এটা ভেবেই মনটা একটু ফুরফুরে হয়ে যায়। তবে এ ব্যাপারে সুপ্তার মতামতটাও জরুরি।উটকো একটা বাইরের ছেলেকে, সে যতই স্বামীর সহকর্মী হোক, দুম করে বাড়িতে থাকতে দেবার প্রস্তাবে বেঁকে না বসে।
সন্ধেয় চা খেতে খেতে কথাটা পাড়তেই, রে রে করে উঠল সুপ্তা। কোনো বাইরের ছেলেকে একেবারে ঘরের মধ্যে এন্ট্রি দিতে কোনোভাবেই রাজি হয় না।তারপর আবার খাওয়া! নিজেরা যখন যেমন তখন তেমন খেয়ে নেয়। বাইরের একটা ছেলেকে তো আর তাই দেওয়া যায় না। কিন্তু টাকার কথাটা ভাবতেই প্রতিরোধের তেজটা ঝিমিয়ে আসে।বরাবরের টানাটানির সংসারে যদি একটু স্বচ্ছলতা আসে, খুব খারাপ হবে কি!
'
যাই বলো, ছেলেটা খুব গোছানো, তোমার মত নয়।' দুদিনেই ঘরটা কেমন পরিপাটি গুছিয়ে নিয়েছে। বিছানার চাদর টানটান পাতা। টেবিলটা পরিপাটি সাজানো।জামাকাপড় গুছোনো।আবার খাবার থালাও চেটেপুটে পরিস্কার।চোখেমুখে তৃপ্তির ছাপ পরিষ্কার দেখতে পায় সুপ্তা।ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মুখে অ্যান্টি এজিং ক্রিম ঘসতে ঘসতে বলে সুপ্তা।সৌরদীপ হেসে বলে যাক,তোমার অসুবিধে না হলেই হলো। ভেবেছিলাম, টাকার কথাটা কিভাবে তুলব। ও দেখি নিজেই বলল, ' ছ-হাজার দিলে হবে তো? ' বোঝো? আমরা তো পাঁচ হাজারেই আটকে ছিলাম। বলেই আনন্দের আতিশয্যে সুপ্তাকে কাছে টেনে নেয়। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব আবেগের ঝড় ঠান্ডা হয়ে যায়।চোরের মত উল্টোদিকে মুখ করে শুয়ে থাকে সৌরদীপ। আর বড়ো দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ে সুপ্তা।
বেসন ফেটিয়ে কালোজিরে ছড়িয়ে বেছে রাখা বকফুলগুলো ব্যাটারে ডুবিয়ে গরম ডুবো তেলে ছাড়ে সুপ্তা।এখন বেশ সকাল সকাল উঠে পড়ে। প্রতিদিন নতুন উৎসাহে নানা পদ রান্না করে। মনের ভেতরকার ঝিমানো ইচ্ছগুলো আবার ডানা মেলে। খেতে খেতে রজতের চোখে প্রশংসা তাকে অদ্ভুত শান্তি দেয়। আজ বরং অফিস থেকে ফেরার পর একটু বাটার নান আর নতুন আলুর দম করে দেবেখন। ময়দার মধ্যে বাটার, নুন, মিষ্টি, ঈষ্ট নিয়ে মাখতে বসে।
ছাদে এমনি খুব একটা যাওয়া হয়না। আজ কী মনে হতে খাওয়ার পর পড়ন্ত দুপুরে অলস পায়ে ছাদে আসে।রজতের ঘরটা ছাদ লাগোয়া। অফিসে গেছে, তাই দরজা বন্ধ। খোলা জানলা দিয়ে ঘরের ভেতরটা দেখা যাচ্ছে। ছাদের দড়িতে ওর জামাকাপড় শুকোতে দেওয়া। কী মনে হতে রজতের জামাকাপড়ে হাত বুলোতে থাকে। একটা পুরুষালি গন্ধ। সিগারেট আর বোধহয় ওয়াইল্ড স্টোন এর মিশ্রণ। শক্তমুঠোয় পোশাকগুলোকে আঁকড়ে ধরে প্রাণপণ শুঁকতে থাকে। নেশাগ্রস্ত সাপিনীর মত টলতে টলতে নীচে নেমে আসে আসে কতক্ষণ পর, হিসেব থাকে না।
আজ অফিসে বসের জন্মদিন উপলক্ষ্যে একটা পার্টি আছে।হাফ ডে অফিস হয়ে, সেলিব্রেশন।ঝলমলে প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াচ্ছে মিস রিয়া।মাসকারা লাগানো চোখে স্পষ্ট আশকারা।মেঘরঙা শিফনের শাড়ির ফাঁক দিয়ে আধা উন্মুক্ত নাভি বারবার চাঁদের মত উঁকি দিচ্ছে। আর সেদিকে তাকাতে তাকাতে কেমন একটা ঘোর লেগে যাচ্ছে। পাশাপাশি সুপ্তার বেঢপ চেহারায় গর্তের মত নাভির কথা মনে আসতেই ঘোরটা কেটে গেল একেবারে। কিসের সঙ্গে কী!
বাবুইকে কোচিং সেন্টারে ঢুকিয়ে, গড়িয়াহাটে আসে। জমানো পয়সা দিয়ে ফুটের থেকে দরদাম করে কয়েকটা ব্রা, প্যান্টি কেনে। বছর বছর ধরে সেই একঘেয়ে তিলেপড়া ঢিলেঢালা ব্রা পরে কাটিয়ে দিল। আজ কিনল লাজুক গোলাপী, উন্মুখ কমলা, আবদারী লাল, বন্য বেগুনী রঙের ব্রা।
আজকাল জামাকাপড় ছাদেই শুকোতে দেয় সুপ্তা।বিশেষ করে রঙিন ব্রা, প্যান্টিগুলো রজতের অন্তর্বাসের পাশেই মেলে। শুকোলে, নিজের জামাকাপড়ের সাথে রজতের গুলোও একসাথে পাট করে ভাজ করে নিখুঁত ভাবে।দু একদিন অস্বস্তিতে রজত ঘরেই মেলতে শুরু করেছিল। কিন্তু থালা বাসনের ঝনঝনানি, চুড়ির রাগত শব্দ,আর অগ্নিবর্ষী দৃষ্টিতে সুপ্তা বুঝিয়ে ছেড়েছে যে, এ বাড়িতে থাকতে হলে সুপ্তার অলিখিত নিয়মেই চলতে হবে।তাই জামাকাপড় মেলা অব্যাহত থাকলেও আজকাল রজত বেশ দূরত্ব রেখে চলে। সুপ্তাও আর এর থেকে বাড়াবাড়ি করবার সাহস পায় না।
বাবুইকে অঙ্ক দেখাবার নামে প্রায়ই রজতের ঘরে পাঠায় সুপ্তা।আর তারপর নানা অজুহাতে নিজেও চলে যায়। বরের আড্ডার ঠেক থেকে ফেরার আগে নীচে নেমে আসে। রজতও আর আগের মত বিরক্ত হয় না। বরং ওর চোখে অপ্রত্যক্ষ প্রশ্রয় দেখতে পায়।
দোকানটা থেকে নতুন হালকা ফ্রেমের চশমা নিয়ে আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল সুপ্তা।বাহ্ , পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সব। সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর সবকিছু। ছেঁড়া ফাটা জোড়া দিতে আর কোনো অসুবিধে হবে না তার...
দারুণ লাগলো
উত্তরমুছুনবেশ ভালো
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগল।
উত্তরমুছুন