সৌমী আচার্য্য
দাগ
কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলতেই চোখের সামনে সইকে দেখে হকচকিয়ে যায় রাতুল।হাতের সিগারেট টা দ্রুত এ্যাশট্রেতে নিভিয়ে ফেলতে ঘরের ভেতরে পা বাড়ায়।পেছন থেকে সই বলে,
"সিগ্রেটটা থাক রাতুলদা।গন্ধটা আমার এখনো ভালো লাগে।"
সিগারেটটা হাতে ধরেই পেছন ফেরে রাতুল।....
"কেমন আছিস সই??অণীশ কোথায়?"
...সই মুখে অদ্ভুত বিরক্তি নিয়ে টেনে টেনে বললো,...
"তোমার ফ্ল্যাটের সামনে কুকুরের বাচ্চাদের বিস্কুট খাওয়াচ্ছে।"
....কথা বলার ধরনে যে বিরক্তি ছিলো তার তেতো রাতুলকে ইঙ্গিত দিয়ে গেলো।কথা বলতে বলতে রাতুলের অনেক কাছে চলে আসে সই।ফিসফিস করে বলে,....
"আমি কেমন আছি সত্যি তুমি জানতে চাও রাতুলদা?"
....ওর চোখে চোখ রেখে রাতুল একছুটে পৌঁছে যায় গনগনে ঘেমো এক দুপুরের চিলেকোঠায় ।সইকে আদরে আদরে লাল দগদগে করে দিয়েছিলো।কিছুটা সুখ কিছুটা ভয়ে সই বলেছিলো....
"এমন কেন করলে?"
"বেশ করেছি। আবার করবো।তুই যতবার আসবি ততবার।"
"আর আসবো না যাও।"
"তোর বাড়ি যাবো।"
"কেন?"
"ভালোবাসি তোকে।"
"আমি তোমার পিসির মেয়ে, বোন হই ..... জানো না।"
হাত দিয়ে সইয়ের মুখ জোর করে বন্ধ করে দিয়েছিলো রাতুল.....
"চুউউপ,জন্মের জন্য না আমি দায়ি না তুই।তুই আমার বোন না।"
"তাহলে আমি তোমার কি?"
"জানি না।"
রাতুল সইয়ের দিকে তাকায়,সেই মুখ,সেই চোখ কত কাছে তবু ছোঁয়া যাবে না।উফ্ কি অসহ্য।রাতুল দ্রুত সরে যায়।সইয়ের চোখে অভিমান জমা হয়।কেউ নেই ঘরে,এত কাছে থেকেও একবার ছুঁলো না সরে গেলো রাতুলদা।হাতের ব্যাগটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে সোফায় বসে পড়লো সই।জানলা দিয়ে লেকের জলটা বড্ডো সুন্দর দেখায়।সইয়ের মতো ভয়ংকর সুন্দর না,স্নিগ্ধ।শুরুতেই রাতুলকে ক্লিন বোল্ড করে দিতে চাইছে সই।সেফ খেলতে দূরত্ব বাড়ায় রাতুল।সিগারেটে লম্বা টান দেয় আনমনে।
"একি ,তোমার শরীর খারাপ লাগছে নাকি?"
ভারী পুরুষ কন্ঠ শুনতে পেয়ে, ঘরের ভেতরে তাকায় রাতুল।অণীশ মাথা নীচু করে বসে থাকা সইয়ের কাছে দ্রুত এসে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।রাতুল জিজ্ঞাসা করে...
"কেমন আছো অণীশ?"
"আপনি সিগারেটটা নিভিয়ে দিন দাদা,ওর কষ্ট হয় সিগারেটের ধোঁয়ায়।"
অবাক হয়ে সইয়ের দিকে তাকায় রাতুল।সিগারেটের গন্ধ বড়ো বড়ো শ্বাসে বুকে ভরতো ওর গা থেকে যে মেয়ে তার এই গন্ধে কষ্টে হয়?
"প্লিজ,দাদা।"
অণীশের কাতরতায় লজ্জা পায় রাতুল দ্রুত ব্যালকনিতে বেড়িয়ে যায়।এ্যাশট্রে তে টুকরোটা গুঁজে দেয় পিশে পিশে।হাওয়ায় দুলছে সাদা লেসের পর্দা,ঘরে চোখ যায় রাতুলের।পরম যত্নে সইয়ের কানের পাশে এলোমেলো চুল গুলো সরিয়ে দিচ্ছে অণীশ।সইয়ের বিয়েতে গিয়ে আলাপ হবার পরই রাতুল বুঝেছিলো এই ছেলেও সইতে মজে আছে।সেই মুগ্ধতা এখনো অণীশের চোখে। পকেট থেকে ফোন বার করে।দ্রুত নম্বর ডায়াল করে কানে চেপে ধরে রাতুল...
"হ্যাঁ আর কতক্ষণ?ওরা এসে গেছে তো।চলে এসো প্লিজ তাড়াতাড়ি।"
ঘরে আসে।হাসিমুখে এসে দাঁড়ায় ওদের কাছে...
"তোর বৌদি আসছে।আসলে আজ ওর এন.জিওর একটা কাজ ছিলো মাঝেরচর গঙ্গার কাছে।তুই তো চিনিস সই।"
রাতুলের গালের টোলটা জেগে উঠেছে মৃদু হাসিতেও।সই একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলে...
"পুরো কল্যানীটাই আমি চিনি।তোমার বাইক যে যে রাস্তায় নিয়ে গেছে,সেখানেই গিয়েছি,চিনেছি।"
শিউরে ওঠে রাতুল।কনকনে ঠাণ্ডায় বাইক আর চালাতে পারছিলো না তিন নম্বর মাঠের কাছটা বড্ড ফাঁকা ওখানেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো।সই বাইকের পিছন থেকে বলেছিলো....
"কি হলো?"
"হাতটা বড্ড ঠাণ্ডা হয়ে গেছেরে,একটু আগুন না পেলে গাড়ি চালাতে পারছি না।"
সেই আগুন এখন তার সামনে শুধু আজ তাতে নিজেকে আর সেঁকে নেওয়া যাবে না।সই কিছুটা মুখভঙ্গী করে বলে....
"তোমার বৌ না আসা অবধি এখানেই বসি তবে।দিল্লী থেকে ফ্লাইট আর তারপর দমদম থেকে গাড়িতে এসেছি,মোটেই ক্লান্ত নই..."
"এ কেমন কথা সই"
অণীশ আপত্তি জানায়।অপ্রস্তুত হয়ে পরে রাতুল।জয়ি নিজের হাতে গুছিয়ে গেছে সব।
"আরে আয় আয় এ ঘরে আয়।"
ড্রইং রুমের বাঁদিকের ঘরটাই গেস্টরুম।তারপাশে ছোট্ট ঠাকুরঘর তারপর রাতুলদের ঘর।ড্রইংরুমের ডানদিকে ওপেন রান্নাঘর।তারপর বড়ো স্পেসে ডাইনিং আর একদিকে লাইব্রেরী ।ঐ জায়গাটায় বেতের ছোটো ছোটো মোড়া রাখা।এরপাশেই একটু ছোটো আরেকটি ঘর ।সই আঙুল তুলে বললো..
"এটা কি স্টাডি?"
"খানিকটা তবে মা আসলে ঐ ঘরেই থাকে।"
"মামি এখন কোথায়?রুকুর কাছে নাকি মলয়ার বাড়ি?"
"আমেরিকায়,রুকুর কাছে।"
ওদের পারিবারিক গল্পে অণীশ কোনো টান অনুভব করে না।দিল্লী থেকে কল্যানীর কাছেই মোহনপুরের বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বানে সেমিনারে এসেছে।দুদিনের সেমিনার।প্রচুর কাজ আছে।আজকের দিনটা নিজেকে গুছিয়ে নিতে চায় অণীশ।ট্রলি,ব্যাগ নিয়ে ঘরে আসে।দারুণ রুচির ছাপ ঘরের রং,পর্দা,বেড কভার সবেতেই।ব্যাগ খুলে ল্যাপটপটা বাইরে রাখে।ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে সই থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে...
"কি হলো?"
ঝমঝম করে উঠলো সই....
"তুমি এত সময় কেন নিচ্ছো?আমি একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দাম্পত্য প্রেম উপভোগ করবো নাকি?"
"তুমি তো এভাবে কথা বলো না।কি হয়েছে?বৌদি ফিরেছেন?"
"ফিরেছেন???? ওঘরে গিয়ে তাকে দেখো তারপর সম্বোধন করো।রাতুলদাও সত্যি...বিয়েও করেছে বটে।...হু"
"আচ্ছা ঠিক আছে,তুমি শান্ত হও।পরে বলো সব ।চল বাইরে চল।"
"না,আমি যাবো না।ফ্রেশ হবো ।তুমি যাও।"
অণীশ বোঝে সই কিছু একটাতে অসন্তুষ্ট হয়েছে।হালকা গোলাপি পর্দাটা সরিয়ে ড্রইং রুমে ঢোকে।ভারী মিষ্টি দেখতে অল্প বয়েসী বৌ দাদার।অণীশ মনে মনে হাসে।সইএর থেকে বছর ছয় সাতের ছোট হবে মেয়েটি।ছেলেমানুষি চোখে,মুখে প্রকাশিত।ছুটে এসে অণীশের হাত ধরে....
"অণীশদা আপনি চুন্নুপন্নুদের এক প্যাকেট বিস্কুট খাইয়েছন?ভজুদা বললো।"
"চন্নু পন্নু ....মানে ঐ কুকুরছানাগুলো?"
"হ্যাঁ আমি ওদের ঐ নামেই ডাকি।লিফ্টম্যান ভজুদা দেখেছে,আমায় বললো।"
অণীশ হাসে।রাতুল বলে....
"আচ্ছা বেশ,তুমি এবার খাবারের ব্যবস্থা করো।ওরা অনেকক্ষণ এসেছে।"
"আরে নানা,আপনি বসুন তো বৌদি..."
"আপনিইইই...বৌদিইইই....ক্ষমা করুন অণীশদা...অতো সম্মান সইবেনা।জয়ি আর তুমি,তুইও চলতে পারে।"
হাতজোড় করে রীতিমতো অঙ্গভঙ্গি করে বলা দেখে,রাতুল অণীশ দুজনাই হেসে ওঠে।গেষ্ট রুমে এক চাপা নিশ্বাস ,গোলাপি সুদৃশ্য পর্দা মোচড়াতে থাকে,মোচড়াতেই থাকে।
(২)
শেষদিনেও দারুণ সফল ভাবে সেমিনারে নিজের মতামত জানিয়ে খুব তৃপ্তি নিয়ে ফেরে অণীশ।রাতুলের ফ্ল্যাটটাও জয়ি আর সইয়ের হাসি গল্পে মেতে আছে সকাল থেকে।প্রথমদিন রাতে সই ভয়ংকর অস্থির ছিলো।জয়ি যত কাছে যেতে চাইছিলো ও যেন ক্রুদ্ধ সাপিনীর মতো হিসহিসিয়ে উঠছিলো।অণীশ লক্ষ্য করেছে,রাতুল অপ্রস্তুত।চিরাচরিত ননদ সুলভ হিংসে সইয়ের মধ্যে দেখবে এ যেন অণীশের কল্পনাতীত।গত দেড় বছরে অণীশ সইকে কখনো এতো রুঢ় আচরণ করতে দেখেনি,বিছানায় সারারাত ছটফট করেছে,অণীশের আদর প্রত্যাখ্যান করেছে চরম উন্নাসিকতায় অথচ সকাল থেকেই স্থির হয়ে গেছে।একদম শান্ত।গতকাল,আজ রাতুল অণীশকে নিয়ে মোহনপুর বেরনোর আগে নিজে হাতে জলখাবার বানিয়েও দিলো সই।রাতুল সব সময় যেন পালাতে চাইছে সইয়ের থেকে অথচ ওকে ছেড়েও থাকতে পারছে না।দুই ভাইবোন কথা বলছে মেপে।
এদের সম্পর্কটা যে কোনো গভীর সুতোয় বাঁধা অণীশ বোঝে।রাতুলের বিয়ে ঠিক হবার খবর পাওয়ার পর থেকেই অসম্ভব উত্তেজিত ছিলো সই।কিন্তু মাইগ্রেনের যন্ত্রণায় বিছানা শয্যা হয়ে যায় ফলে বিয়েতে তারা আসতে পারেনি।যে কারনে এই সুযোগটা ছাড়তে চায়নি ওরা দুজনেই।প্রচুর কেনাকাটা করেছিলো দাদা বৌদির জন্য।অথচ কেন যে হঠাৎ এমন হিংসে দেখছে ওর চোখে?অণীশ ঠিক মেলাতে পারে না।আবার দ্রুত শান্ত হয়ে যাওয়া আর জয়িকে কাছে টেনে নেওয়া সবটাই যেন ধাঁধাঁ।
জয়ি তো লেপ্টে রয়েছে সইয়ের সাথে।গতকাল ওদের দস্যিপনায় রাতুল আর অণীশ জেরবার হয়েছে বারবার।এই চায়ে নুন মেশাচ্ছে তো ভাতের নীচে লুকিয়ে রাখছে ওল্টানো বাটি।আজ এই ফ্ল্যাটে শেষ রাত।কি যে প্ল্যান করে রেখেছে কে জানে? ফ্ল্যাটের বেল বাজাতেই দরজা খোলে একমুখ হাসি নিয়ে জয়ি...
"নাগো ছোড়দি,আমার উনি নন,তোমার উনি এসেছে।"
এই বলে ফিচেল হাসি দেয়।
"আসুন,আসুন প্রফেসার বাবু।আপনার উনি চিকেন কিমা রোল বানাচ্ছেন।খাবেন? আসুন।বসুন।"
বলেই একচোট হেসে গলে পরে।অণীশ হেসে হাতের ফাইলটা সোফায় ছুঁড়ে দেয়,গলার টাইটা আলগা করে রান্না ঘরে উঁকি দেয়।চমকে ওঠে।সইয়ের চুল ঘাড় অবধি ছাঁটা।
"তুমি পার্লার গিয়েছিলে?"
চোখে অদ্ভুত ঝিলিক এনে সই বলে...
"কেমন লাগছে?"
"ডিফরেন্ট..."
"বয়স কতটা কমে গেছে বলো।"
"দরকার ছিলো না।তোমার আগের স্টাইলটাও ঠিকই ছিলো।"
অণীশ পেছন ফিরতেই জড়িয়ে ধরে সই...
"এ্যাই রাগ করলে নাকি?"
আস্তে করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অণীশ বলে...
"সবার সামনে জড়িয়ে ধরা অভ্যাস করে দিওনা ম্যাডাম,দিল্লীতে গিয়ে সামলাতে পারবে না।কাল থেকে আজ পর্যন্ত ঊনত্রিশবার জড়িয়ে ধরেছে তাও আবার নিজের দাদা বৌদির সামনে।"
"বেশ করেছি।বলো না রাগ করেছো?"
"মোটেই না,মানুষটার পরিবর্তন না হলেই হলো।বাইরেটা আপেক্ষিক।যাক ....আমি ফ্রেশ হচ্ছি একটু চা হবে?"
অণীশ চলে যেতে চা বসায় সই।চোখ কুঁচকে খুঁটে তুলে দিতে চায় ননস্টিক তাওয়াটার সব কোটিং।
"ছোড়দি আমি চুন্নুমন্নুদের একটু খাইয়ে আসি।"
জয়ির গলা শুনে সই বাইরে আসে....
"এ্যাই দস্যি দাঁড়া,তোর অণীশদা চা খেয়ে নিক,ওকে নিয়ে যা আজ তোর চুন্নুমন্নুদের কাছে।কাল নিয়ে যাবি বলেছিলি ...যা দেরি করে ফিরলো ,আজ আগে এসেছে যখন ...নিয়ে যা।"
অণীশ চা খেয়ে বেশ উৎসাহের সাথে জয়ির রাস্তার পোষ্যদের দেখতে চললো।ওর নিজেরো এদের উপর বেশ টান।ওরা বেরোতেই হাত কাটা হলুদ টপ আর লাল র্যাপারটা চটপট পরে নিলো সই।ব্যাগের ভেতর থেকে বার করলো প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া একটা পারফিউম।ছড়িয়ে দিলো সন্ধিতে সন্ধিতে।বেল বাজতেই বুকের ভেতর দুরন্ত গতিতে গড়িয়ে চললো ধাতব ইঞ্জিন।দরজা খুলে চোখ তুলে দাঁড়ালো রাতুলের সামনে।শিউরে উঠলো রাতুল এ কে?হলুদ,লাল কম্বিনেশানের ষোড়শী সই নাকি তিরিশ ছুঁইছুঁই অণীশের স্ত্রী?
"এসো,ওরা দুজনেই একটু বেরোলো কুকুরদের খেতে দিতে।"
দরজাটা এমনভাবে ধরে দাঁড়িয়ে আছে যে ওকে প্রায় ছুঁয়ে ঘরে ঢুকতে হয় রাতুলের।আর তখনি গন্ধটা পায়...নাইটিঙ্গেলের।এই গন্ধ সইয়ের...কিশোরী সইয়ের।খুব খুব ক্লান্ত লাগে রাতুলের।গত দুদিন দুই নারীকে চোখের সামনে অহরোহ দেখতে দেখতে নিজের সাথে আর যুদ্ধ করতে পারছেনা।সইকে বুঝতে পারছেনা কি চায় ও!রাতুলের সামনেই অণীশকে জড়িয়ে চুমু দিচ্ছে,রাতুলের সাথে কথাই বলছে না।জয়ির সাথে প্রথমদিন যথেষ্ট খারাপ ব্যবহার করেছে,জয়ি ধৈর্য ধরে সামলে নিয়েছে সবটা।আর আজ দুদিন ধরে জয়িকে পুরো ভালোবাসায় আদরে জাপটে রেখেছে।মাঝেমাঝে কেবল তাকাচ্ছে রাতুলের দিকে।সইয়ের সেই চোখ যেন বারমুডা ট্রাঙ্গেল গিলে নেবে রাতুলের সব বর্তমান। সোফায় শরীরটা এলিয়ে দেয়।সন্ধ্যের আকাশটা লাল হয়ে আছে।হাওয়ায় ব্যালকনির পর্দা উড়ছে।ঝাপটালো গন্ধটা নাকে।
"চিকেন কিমা রোল করেছি,খাবে?"
রাতুল হাতটা ধরে সইয়ের। মুহূর্তে ছাড়িয়ে নেয় সই এক ঝটকায়।রাতুলের জেদ বেড়ে যায়,উঠে দাঁড়িয়ে ওর ছোট করে ছাঁটা চুল মুঠো করে ধরে.....
"কি চাইছিস তুই হ্যাঁ?তোর বরের আদরের নমুনা আমার বৌকে বলেছিস কেন?যাতে সে আমায় বলে আর আমি জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাই তার জন্য?"
"কেন তুমি জ্বলবে কেন?তুমি তো চেয়েছিলে আমি যাতে অন্য কোথাও বিয়ে করি।"
"তুই জানতিস না,কেন এই সিদ্ধান্ত?"
"তাই যদি হয় তবে জ্বলছো কেন?"
"জানিনা,জানিনা।"
"জানো খুব ভালো জানো।চাইলেই অধিকার ছাড়া যায় না।এই আস্ত আমিটা অন্যের দখলে এটা মানতেই পারছো না।"
চুলটা ছেড়ে দেয় রাতুল।মুখ ঢেকে বসে পরে চেয়ারে।
"আমি পারছি না সহ্য করতে ।"
"আজ রাতটুকু সহ্য করো।কাল তো চলেই যাবো।চেষ্টা করবো আর না আসতে।"
রাতুল অসহায়ের মতো তাকায়।
"আর আসবি না।"
"না।.... তোমার রাগ,অভিমান,আদর সবটুকু আমার জানা রাতুলদা।সেটা জয়ির মুখ থেকে শুনতে আমারো আনন্দ হয় না।আমাদের সম্পর্কের সবটুকুই তোমার সিদ্ধান্ত।নিজেই কিচ্ছু না মেনে কাছে টেনেছো,নিজেই বাড়ির চাপে,সমাজের চাপে সম্পর্কে ইতি টেনেছো।আমি হাজার বলেও তোমার মত ফেরাতে পারিনি।.....আজ যখন বুঝতে পেরেছি তুমি জয়িকে নিয়ে সুখি তখন কেন আর কষ্ট পাবো?"
"জয়ি ভালো খুব ভালো আমি হয়তো ওকে ভালোবাসি কিন্তু তোকে আমি ভুলতে পারিনা।"
"ও আমাকে ভুলতে পারো না!কেবল এটুকু!ভালোবাসো না আমাকে?বেশ বেশ।"
বাইরে জোরে হাওয়া ওঠে।পতপত করে উড়তে থাকে পর্দা।সইয়ের নিজেকে ভয়ংকর অপমানিত লাগে।রাতুল জয়িকে ভালোবাসে,তাকে নয়?তোলপাড় করতে থাকে বুক।গরম নিশ্বাস বের হয়ে আসতে চায়।ছুটে যায় গেস্টরুমে।রাতুল বুঝতে পারে ভুল করে ফেলেছে আবার।জয়িকে যে ও ভালোবাসতে শুরু করেছে গত এক বছরে একটু একটু করে একথা না বললেই চলতো।কি করবে বুঝে পায়না।সইকে কি একবার কাছে টেনে নেবে?না না ,সইয়ের শরীরের নেশায় আর নিজেকে ডোবাবে না।এভাবে জীবন চলে না।নিজেকে শক্ত করতেই হবে।হাওয়ায় দুলে ওঠা পর্দা দিয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকা সইকে দেখে বুক মুচড়ে ওঠে তবু নিজেকে সামলায় রাতুল।কলিংবেল বাজে।
(৩)
বৃষ্টির পর ব্যালকনির চারটে বেতের মোড়ায় সুদৃশ্য কাঁচের গ্লাসে রঙিন তরলে ঢেউ ওঠে।দীর্ঘ গল্প হাসির পর ঘুমাতে চলে যায় জয়ি,অণীশের বুকের সাথে লেগে বসে রয়েছে সই,ভেতরটা চিড়বিড় করে ওঠে,রাতুল উঠে ঘরে যায়।ততক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে জয়ি।ঘুমন্ত হাতটা নিজের হাতে তুলে নেয় আলতো করে ধরে বসে থাকে।মাথার ভেতর কত ছবি বারবার আঘাত করছে।মোহ থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন।সইকে দেখার পর থেকে ওকে মুঠোর মধ্যে আগের মতোই পেতে লোভ হয়েছে এই সত্যিটাই উগড়ে দিতে ইচ্ছা করে।অথচ মাথার ভেতর কেউ যেন বলেছে অন্যায় ,অন্যায়,। কাউকে বলতে পারলে কি হালকা হওয়া যেতো?মাথাটা যন্ত্রণা করে ওঠে।ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ব্যালকনিতে।রেলিং এ ভর দিয়ে একা দাঁড়িয়ে সই।দেখেই রাতুল ফিরে যেতে নেয় পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে অতীত।
"একবারো ছোঁবে না আমায়।এতো ভালোবাসো জয়িকে।আমায় এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে তুমি।"
নাইটিঙ্গেলের মায়াজালে আচ্ছন্ন হয় রাতুল।ব্যালকনিতে ফিরে আসে পনেরো বছর আগেকার চিলেকোঠা।দগদগে করার দক্ষতা সই পটুতার সাথে প্রকাশ করে।জোয়ারে ভাঙতে থাকে রাতুল।
১০.১৫ র এয়ার ইণ্ডিয়ার ফ্লাইট ধরবে বলে সকাল সাতটায় বেরিয়ে পরে অণীশরা।স্বাভাবিক নির্বিকার ভাবে গাড়িতে ওঠে সই।রাতুলের এলোমেলো মুখ এতটুকু যেন ছোঁয় না ওকে।ফ্ল্যাটের নীচ থেকে উপরে উঠে আসার পথ সত্যিই এত দীর্ঘ।রাতুল স্নানের জল ঢালতেই থাকে শরীরে ।ধোয়া যায় নাকি সব?টাওয়ালটা জড়িয়ে ঘরে ঢোকে পেছন থেকে জয়ি বলে ওঠে....
"এবাবা কাল রাতে আমি এতো দুষ্টুমি করেছি?তোমার পিঠের কি অবস্থা করেছি....ইস্ কিচ্ছু মনে নেই আমার।"
পিঠের লাল দগদগে দাগে হাত ছোঁয়াতে চায় জয়ি,ছিটকে যায় রাতুল........দাগটা পুরোপুরি মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত .....
অসম্ভব ভাল প্রেক্ষাপটের ওপর লেখা মানব জমিনের গল্প। অজাচার ঈর্ষা আর প্রেম। শেষটা অনব।। গল্পের নামের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ায় লেখাটি
উত্তরমুছুনসার্থক ছোটগল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
ধন্যবাদ
উত্তরমুছুনপরিপূর্ণ হয়ে উঠছে তোমার লেখা। আদ্যন্ত নির্মেদ একটা গল্প। যত পড়ছি শেষ টা জানার জন্য তত উদ্গ্ৰীব হয়ে উঠছে মন।
উত্তরমুছুন