সোমা দত্ত
।
ঘর
একভাবে রাজু তাকিয়ে থাকে মীর এর দিকে, মীর আজ ভালো জামা পড়েছে। রুমিদি ওর চুলে তেল মাখিয়ে যত্ন করে আঁচড়িয়ে দিয়েছে আজ। আজকে ওর মা আসবে ওকে নিতে। যদি কোনও কারণে আজ নাও নিয়ে যায় তো ওকে খাবার দিয়ে যাবে, লজেন্স, বিস্কুট কেক, নতুন জামা। মীর খুশী হয়ে নাচতে নাচতে সবাইকে দেখাবে ওর জিনিসপত্র, ওর মা বাবার গল্প করবে আর তারপর দু একদিনের মধ্যে চলেও যাবে ওর বাড়ি। রাজুর আর দুঃখ হয় না এখন। আগেও তো ফন্টে, মলু, বাপ্পা, মিতু এরাও সব চলে গেছে। প্রথম প্রথম খুব কান্নাকাটি করতো, বিশেষ করে যখন মলু চলে গেলো। মলুর মতো খেলা ও কারো সাথে আর খেলে নি। সেই মলুও চলে গেছে। রুমিদি বলে একদিন রাজুও যাবে ওর বাড়ি। ওর মা বাবা এসে ওকেও নিয়ে যাবে। কতবার স্বপ্ন দেখেছে রাজু বাড়িটার, দেখেছে নতুন জামা পড়ে চকাচক সেজে রাজু নরম পরোটা খাচ্ছে মাংসের ঝোল এর ডুবিয়ে ডুবিয়ে। উফ্ কি যে স্বাদ লাগে ! একবার গতবছর সেই হয়েছিলো এখানে পরোটা আর মাংস। তাও ছোট্ট একটা টুকরো জুটেছিল। সে আর বিলু মিলে মাংস চুরি করতে গিয়ে ধরাও পড়েছিলো, সনাতনদা যা পেটান পিটিয়েছিলো এখনো রাজুর ডান কানের লতির উপরটা চাপ দিলে হালকা ব্যাথা লাগে। তা হোক। তাও সেই খাবারের স্বাদখানা এখনো জিভে লেগে আছে যেন।
খাওয়ার জন্য মার প্রায়ই খায় রাজু, তাও ওকে কেউ থামাতে পারে নি আজ পর্যন্ত। কি করবে খিদে পেলে। খিদে তার মস্ত বড় শত্রু। পাগল পাগল লাগে রাজুর খিদে লাগলে। বিলু, জগা আর কলকে তিনজনেই এব্যাপারে সাথ দেয় তাকে । কিভাবে সনাতনদা কে বোকা বানিয়ে খাবার চুরি করতে হবে সে সব কায়দা তাদের জানা। সনাতনদা বলে,- " ল্যাংড়া হারামজাদাটাই যত নষ্টের গোড়া। রাজ্যের খিদে নিয়ে এসেছে এখানে, আর তেমনই পেটে পেটে শয়তানী, সুযোগ পেলে এমন খেদানি দোবো না একদিন দুটো পা ই যাবে ভোগের মা হয়ে, তোর খাওয়া আমি তখন দেখাবো "।
রাজুর একটা পায়ে পোলিও। স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারে না ও। তবে এটাই ওর সুবিধা মনে হয় এখন। বেশ কাঠের তক্তার মধ্যে চাকা লাগানো আসনে বসে ও যত তাড়াতাড়ি যেকোনো কিছু করে ফেলতে পারে বিলু জগারা তা মোটেই পারে না। রুমিদি বলেছিলো সরকারি সাহায্য পেলে রাজুকে একটা জুতো আনিয়ে দেবে, তা সে কতদিন হয়ে গেছে। মাঝেমাঝে রুমিদিকে মনে করায় রাজু। জুতোটা পেলে রাজু প্রমাণ করে দিতো সে বিলুর চেয়ে লম্বা। এই নিয়ে প্রচুর ঝগড়া করেছে। একদিন বিলু বলে,- "তুই কি করে বুঝবি তুই তো ল্যাংড়া "। এক ঘুসি চালিয়ে দিয়েছিলো রাজু, লাগেনি বিলুর। ও চট করে সরে গেছিলো। অন্য আর কোন সুবিধা জুতোর আছে বলে তো মনে হয় না রাজুর। সব কাজই পারে সে। শুধু ওই বিলু, জগা ওদেরকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্যে সে জুতো নিয়ে দাঁড়াতে চায়, হাঁটতে চায়।
সবাই জানতো রাজুকে কেউ নিতে আসবে না কখনো, যেমন কলকে কে। কলকের একটা হাত নেই। বাবা মা রা কেউ না কি হাত পা ভাঙ্গাচোরা মাল নেয় না। এই ব্যাপারটা কয়েকবছর আগেও বুঝত না রাজু। সনাতন দা সীমাদি জয়দেবদা রা সব সময় বলতো এখনো বলে, এই দুটো পাপ যা জুটেছে না, নিষ্কৃতি দেবে না কোনো কালেই। কলকে বুঝিয়েছে এই কথাগুলো কেন বলে ওরা। আর কলকে কে, কে বুঝিয়েছিলো রাজু জানে না।
জ্ঞান হওয়া বয়স থেকে রাজু এই পাঁচিল ঘেরা ভাঙ্গাচোরা বাড়িটাকেই ওর ঘর বলে জেনে আসছে, তাই যাদের বাবা মা এসে নিয়ে চলে যায় আর সবাই বলে,- যাক, ছেলেটা একটা ঘর পেয়ে গেছে , তখন সত্যি খুব অবাক লাগে রাজুর। এটা কি তাহলে ওদের ঘর নয় নাকি। অন্য ঘরগুলো কি আলাদা হয় নাকি যেখানে ওরা যায়। হলে হতে পারে তবে এই ঘরে রাজুর কোনও অসুবিধা নেই। আগে তাও একটু খাওয়ার কষ্ট ছিলো, এখন সেটাও ম্যানেজ হয়ে গেছে। দারোয়ান শিবুদার গাঁজার নেশা, সেটা সবাই জানে শুধু ও নিজে ভাবে কেউ জানে না বুঝি। আর রুমিদি আর মাষ্টারমশাই কে ওর বেজায় ভয়। এই ভয়টাকে কাজে লাগিয়েছে রাজু, বিলু, জগা আর কলকে। ওই ভয়ের কারনেই ঠিক সময় বুঝে শিবুদা বিড়ির লোভ দেখিয়ে ডেকে নিয়ে যায় সনাতনদা কে, আর সেই সুযোগে কেল্লা ফতে। সনাতনদা রাজুকে দু চক্ষে সহ্য করতে পারে না, কোনো একটা ছোটো সুযোগ ও হারায় না রাজুকে চড় থাপ্পড় মারার। শুধু মাষ্টারমশাই আর রুমিদি প্রশ্রয় দেয় বলেই সেই সুযোগে দু চাকার কাঠের তক্তাতেই রাজুর দাদাগিরি চলতে থাকে। এই প্রশ্রয়ের একটা কারণ অবশ্য আছে। মাষ্টারমশাই এর শেখানো সব পড়াশোনা রাজু কিভাবে খুব চটপট বুঝে যায়। সে অনায়াসে মুখে মুখে দু লাইনের যোগ গুলো ফটাফট করে ফেলতে পারে, ইংরেজি ছড়া বলতে পারে, শুনে শুনেই মুখস্থ হয়ে যায় তার। বাংলা কিশলয় থেকে বেশ ভালোই গল্প পড়ে শোনাতে পারে বাকি সবাইকে। এখানে আর কেউ এসব পারে না। এসবের জন্য রাজুকে কিছুই আলাদা করতে হয় নি, কেমন করে ওর মাথা থেকে এসব হয়ে যায় যেন। মাষ্টারমশাই রুমিদিকে বলে,- এ ছেলেটা এভাবে নষ্ট হবে রুমি, দেখো কোথাও কোনো ভালো হাতে পড়ে যদি। আর একটা কারনেও রাজুকে এখানে সবাই খুব পাত্তা দেয়। সাঙ্ঘাতিক ভালো হাতের টিপ ওর। গুলি টিপ করায় রাজুকে আজ পর্যন্ত কেউ হারাতে পারে নি। একবার সনাতনদা কে এই হাতের টিপ এর জোরেই মাথায় ঢিল মেরেছিলো রাজু। এখনো সে কথা মনে করে ওরা ছেলেরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। সনাতনদা বলে, একদিন রাজুকে খুন করে জেলে যাবে ও।
মীর বসে ছিলো রাজুর পাশেই। একটু ভয় ভয় ছাপ ওর মুখে। একদিন ওকে অনেক সাহস জুগিয়েছে রাজু। আজ আর কিছু বলতে ভালো লাগছিলো না ওর। - যাচ্ছিস তো বাপ ভালো মন্দ খেতে তার আবার এত ন্যাকামি কিসের। নতুন জামা পড়েছিস, আরো পড়বি এর পর, এতদিন তো থাকতিস ছেঁড়া গেঞ্জি পড়ে, তার আবার এতো কিসের ভয় রে। থামে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে রাজু। জগা আর বিলু ডাকতে এসেছিলো দুবার, গুলি খেলার জন্য। রাজু যায়নি। ভালো লাগছে না। মন খারাপ মোটেই নয় রাজুর। কলকে এসে বসেছিলো ওর পাশে, এই কথাই জিগ্যেস করছিলো, - মন খারাপ করিস নে রাজু। চ না, খেলি। রাজু হটিয়ে দিয়েছে, এক খানা হাত নেই তাও ব্যাটার খেলার শখ দেখো। অদ্ভুত কায়দায় একটা পা আর একটা হাত লাগিয়ে টিপ লাগায় কলকে। হাসি পায় ওর ধরণ দেখে, মাঝে মাঝে বিলু এসে ওর পেছনে লাথি লাগায় একটা, সামনে থপ করে উলটে পড়ে কলকে, আর ওদের হাসির ধুম ওঠে।
রাজুর ভালো লাগছে না কারণ মাষ্টারমশাই আর রুমিদি ওর সাথে দুদিন ধরে কথাই বলছে না কিছুতেই। কাল ও পড়াতে এসে মাষ্টারমশাই ওকে কিশলয় পড়তে দেয় নি। গোলা যে প্রায় পড়তেই জানে না ওকে দিয়ে পড়িয়েছে। পড়া বা না পড়া নিয়ে রাজুর মোটেই কোনো মাথাব্যাথা নেই, কিন্তু ও যখন পড়ে তখন সব কটা আকাট ছেলে কথা বলা থামিয়ে মন দিয়ে শোনে, আর তারপর শেষ করার পর মাষ্টার মশাই এর চোখে একটা খুশীর হাসি দেখতে পায় রাজু ওটাই ওর লোভ। এখানে জগা, বিলু , কলকে বা আর যারা আছে তারা ছাড়া কেউ কখনো ওদের দেখে খুশী হয় না, রাজুকে তো নয় ই। একমাত্র ওই দুটো মানুষের কাছ থেকেই ওটা পেয়েছে রাজু। মা বাবা কেমন হয়, মারে না আদর দেয় জানা নেই, ভালো খেতে দেয় এটা নিশ্চিত, কারণ বেশ কিছুদিন আগে দেবু ওর মা বাবা কে নিয়ে এখানে ওদের দেখতে এসেছিলো , ও বলেছিলো একদিন অন্তর অন্তর মাংস খায় নাকি। চেহারাখানাও বেশ পরিষ্কার পরিষ্কার লাগছিলো দেবুর। বেশ বোঝা যাচ্ছিল যে ও আর ওদের একজন নয়। এখান থেকে যারা যায় আজপর্যন্ত কাউকে আসতে দেখে নি রাজু এক ওই দেবু ছাড়া।
মীর কে ডাকতে এসেছে রুমিদি, - মীর চলে এসো। রাজু মুখ তুলে তাকায়, রুমিদি ওর দিকে তাকালো না একবার ও। মীর ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালো, রাজুর কনুই এ একটা হাত রাখলো, -যাই রাজুদা? -এ আবার জিগ্যেস করে, হাসি পায় রাজুর। মাথা নাড়ে ওর দিকে তাকিয়ে। তাও যায় না মীর।– যা না যা। ডাকছে দেখছিস না। অন্যদিকে মাথা ঘুরিয়ে নেয় রাজু। মীর আস্তে আস্তে চলে যায়।
আচ্ছা, রুমিদি আর মাষ্টার মশাই কি আর কথা বলবে না ওর সাথে, ওরা যদি ওকে আর না দেখে, ও শিবুদাকেও ভয় দেখাতে পারবে না, সনাতন ওকে বাগে পেয়ে যাবে। এইটাও যদি হয়, তাহলে এখান থেকে পালিয়ে যাবে রাজু। কোথায় যাবে? সে দেখা যাবে নাহয়। হঠাৎ কান্না আসে রাজুর। কাঠের তক্তাটাকে চাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে যায় পিছনে বাড়িটার ভাঙ্গা সিঁড়ির দিকটায়। এদিকটায় কেউ আসে না বড় একটা, পাঁচিলে মাথাটা ঠেকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে রাজু। এভাবে অনেকদিন পর কাঁদল সে। সেই আগে কিছুতেই খিদে মিটত না, তখন এরকম কাঁদত রাজু। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়তো। হঠাৎ নিজের সরু জীর্ণ পা টা দেখে প্রচণ্ড রাগ হতে থাকলো রাজুর। মনে হোলো ইঁট মেরে ভেঙ্গে গুড়ো করে দেয় ওই পা টাকে ।ডান হাত দিয়ে জোরে জোরে ঘুসি মারতে থাকে রাজু পা টা কে। ভেঙ্গে যাক ওটা। যত মারে তত কান্না আসে রাজুর। জোরে জোরে কাঁদতে থাকে সে।
মীর আজ বাড়ি যাচ্ছে যাদের সাথে, আসলে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই মা বাবা নিতে ছেয়েছিলেন রাজুকে। রাজুর গল্প রুমিদির মুখে শুনে আর তারপর ওকে দেখে কিভাবে যেন ভালো লেগে গিয়েছিলো ওদের। এক ই সঙ্গে মীর কেও পছন্দ ছিলো তাদের। কিন্তু দুজনের মধ্যে একজনকেই নিতে পারেন ওরা তাই রাজুকেই বেছে নিয়েছিলেন। রুমিদি লাফাতে লাফাতে এসে খবরটা দিয়েছিলো হোম এ। কিন্তু মীর?
সে যদি চলে যেত এই ছেলেটার কি হোতো তাহলে। কি করে বাঁচত মীর ওই যন্ত্রণা থেকে। হোম এর সব ছেলেরা জানে মাঝে মাঝেই সনাতন দা রাতে এক একজনকে ডেকে নিয়ে যায় নিজের ঘরে, বাইরে থেকে দু একজন লোক আসে, আর তারা যে অসহ্য কাজ করে তা একদিন চুরি করে দেখেছে রাজু নিজে চোখে। অসহ্য যন্ত্রণা হয় তারপর বিলু,জগা সকলেই বলেছে। হোমে নতুন কেউ আসলে তার ওপর আগেই চোখ পড়ে সনাতন দার। যেমন এই মীর। আর ছোটো এই ছেলেটা এসে থেকে রাজুর পেছন পেছন দাদা দাদা করে ঘুরত। এখানে কেউ ওকে দাদা বলে না, এখানে কেউ কারো দাদা নয়, ভাই ও নয়। রাজু নিরুপায় চোখে দেখে যাচ্ছিলো মীর এর যন্ত্রণা, আর সনাতন দা দের খ্যাক খ্যাক হাসি। শালা, মোসলমানের বাচ্চা এদের কিচ্ছু হবে না, চালাও এটারে ক’দিন। কতবার রাজু রুমিদিকে মাষ্টার মশাই কে বলতে চেয়েছে, ওরা বুঝেও বুঝতে চায় নি। শুনেও শুনতে চায় নি। শুধু রাজুর ব্যাপারে ওদের কড়া নির্দেশ ছিল। মাষ্টার মশাই বলে,- রাজু আমি তোকে যতটা পারবো হেল্প করবো, তুই শুধু মন দিয়ে পড়ে যা আর অন্যের ব্যাপারে কম নাক গলা। আমি তোর রুমিদি এতজনকে চাইলেও সবসময় দেখতে পারবো না, তুই ও পারবি না। শুধু ভালো ভাবে থাক।
কিন্তু সেটা রাজু পারে নি মীর এর জন্যে। যখন সুযোগ এলোই তখন বাঁচুক ছেলেটা। ও যে মরে যেতো নাহলে যেমন অনেকদিন আগে বলাই মরে গেছিলো। ছেলেটা যে রাজুদা বলে ডাকতো ওকে।
ওরা রাগ করে কথা বলছে না রাজুর সাথে কারণ অনেক বুঝিয়েও রাজুকে রাজি করানো যায় নি, সে বারবার বলে গেছে মীর যাবে মা বাবার কাছে, আমি যাবো না।
-রাজু এরপর আর এমন সুযোগ আসবে না রে তোর। তেরো বছর বয়স তোর। বড়দের কেউ আর নিতে চায় না। তার ওপর তোর এমন পা। এটা তোর জায়গা নয় রে। অনেক বুঝিয়েছিলো মাষ্টার মশাই। রাজুর ওই এক কথা। মীর যাবে, আমি কোথাও যাবো না। মাষ্টার মশাই কি জানে রাত্রিবেলা যখন ওই লোকগুলো জোর করে জামাকাপড় খোলায় আর তারপর মীর আর তার মতো আরো অনেক ছেলেগুলো যন্ত্রণায় ভয়ে চেঁচাতে থাকে তখন কেমন লাগে। প্রথম যেদিন সে দেখেছিলো ওই দৃশ্য সারা রাত বিছানায় কেঁপেছিলো। তার হাত পায়ে যেন তার নিজের জোড় খাটছিলো না। মীর কে প্রথম যেদিন নিয়ে যায় ওরা রাজু ওর কাঠের তক্তা নিয়ে আটকানোর আপ্রান চেষ্টা করেছিলো। পারেনি। সনাতন লাথি মেরে সরিয়ে দিয়েছিলো রাজুকে। একদিকে ছিটকে গেছিলো ওর দুচাকার কেঠো বাহক আর অন্যদিকে রাজু। পরদিন রুমিদিকে বারবার অনুরোধ করেছিলো রাজু, মীর কে বাঁচানোর জন্য। রুমিদি বরাবর এর মতো এবার ও বলেছিলো , -রাজু আমি কিছুই করতে পারি না রে, তোর রুমিদির ক্ষমতা খুব সামান্য। তুই এসব আমায় বলিস না আর। লক্ষ্মী হয়ে থাক তুই বাবা, তোর জন্যে অনেক চেষ্টা করছি , যদি কিছু করতে পারি। আর অন্য কিছু বলিস না আমাকে।
রাজু কিছু করতে পারে নি মীর এর জন্য। ধুম জ্বর নিয়ে যখন কাতরাতো মীর , রাজু ছেঁড়া ন্যাকড়া, জলে ভিজিয়ে লাগাতো ওর কপালে। আর তারপরই একদিন এক বাবা মা এসে পছন্দ করে বসলো রাজুকে। তারপর চোখ পড়লো মীর এর উপর। এরা নাকি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বাবা মা। রাজু, মীর কে এগিয়ে দিলো রুমিদির দিকে। অনেক বোঝানোর পর ও সে অনড়।
এর জন্য শাস্তি দিচ্ছে ওরা রাজুকে। এর জন্য ওরা কেউ ফিরে তাকাচ্ছে না। এর জন্য হয়তো আরো অনেক কিছু হবে, তাও রাজুর মনে হবে না সে ভুল করেছে। কম খেতে পেলেও না। এই খোঁড়া পা টা যদি ঠিক থাকতো তাহলে সে সব ঠিক করে দিতে পারতো। হয়তো মেপে দেখলে সে সনাতন দার মতো লম্বা হয়ে যেতো, তখন লাথি মেরে মুখ ভেঙ্গে দিতো ওর। বুকের ভিতর দলা পাকানো ব্যাথাটা যায় না। যদি মা বাবা পেতো সে তাহলে মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁদত। মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো। যেমন দেবুর মা দেয়। দেবু বলেছিলো ওর মা ওকে খাইয়ে দিতো, পেট ভর্তি খাবার,আর নরম বিছানায় ঘুম ও পাড়িয়ে দিতো। জল ভরা চোখ বুজে আসে রাজুর। ক্লান্তি নেমে আসে, মাথাটা ঢলে পরে সিঁড়ির উপর।
একটা অস্পষ্ট দরজা খুলে যায়। ওপারে নরম বিছানা, আলোর হাসি মেখে কে যেন তাকায়, কাছে ডাকে। আশ্চর্য ভাবে ওই দুই পায়ে ভর করে হেঁটে এগিয়ে চলেছে রাজু, কত লম্বা হয়ে গেছে সে। কেউ যেন ডাক দিলো পেছন থেকে....অস্ফুট কোনো গোঙানি, যেন কান্নার মতো....রাজুদা আ আ...... সামনে নরম আলোর মতো মুখ কেমন ঝাপসা....
একভাবে রাজু তাকিয়ে থাকে মীর এর দিকে, মীর আজ ভালো জামা পড়েছে। রুমিদি ওর চুলে তেল মাখিয়ে যত্ন করে আঁচড়িয়ে দিয়েছে আজ। আজকে ওর মা আসবে ওকে নিতে। যদি কোনও কারণে আজ নাও নিয়ে যায় তো ওকে খাবার দিয়ে যাবে, লজেন্স, বিস্কুট কেক, নতুন জামা। মীর খুশী হয়ে নাচতে নাচতে সবাইকে দেখাবে ওর জিনিসপত্র, ওর মা বাবার গল্প করবে আর তারপর দু একদিনের মধ্যে চলেও যাবে ওর বাড়ি। রাজুর আর দুঃখ হয় না এখন। আগেও তো ফন্টে, মলু, বাপ্পা, মিতু এরাও সব চলে গেছে। প্রথম প্রথম খুব কান্নাকাটি করতো, বিশেষ করে যখন মলু চলে গেলো। মলুর মতো খেলা ও কারো সাথে আর খেলে নি। সেই মলুও চলে গেছে। রুমিদি বলে একদিন রাজুও যাবে ওর বাড়ি। ওর মা বাবা এসে ওকেও নিয়ে যাবে। কতবার স্বপ্ন দেখেছে রাজু বাড়িটার, দেখেছে নতুন জামা পড়ে চকাচক সেজে রাজু নরম পরোটা খাচ্ছে মাংসের ঝোল এর ডুবিয়ে ডুবিয়ে। উফ্ কি যে স্বাদ লাগে ! একবার গতবছর সেই হয়েছিলো এখানে পরোটা আর মাংস। তাও ছোট্ট একটা টুকরো জুটেছিল। সে আর বিলু মিলে মাংস চুরি করতে গিয়ে ধরাও পড়েছিলো, সনাতনদা যা পেটান পিটিয়েছিলো এখনো রাজুর ডান কানের লতির উপরটা চাপ দিলে হালকা ব্যাথা লাগে। তা হোক। তাও সেই খাবারের স্বাদখানা এখনো জিভে লেগে আছে যেন।
খাওয়ার জন্য মার প্রায়ই খায় রাজু, তাও ওকে কেউ থামাতে পারে নি আজ পর্যন্ত। কি করবে খিদে পেলে। খিদে তার মস্ত বড় শত্রু। পাগল পাগল লাগে রাজুর খিদে লাগলে। বিলু, জগা আর কলকে তিনজনেই এব্যাপারে সাথ দেয় তাকে । কিভাবে সনাতনদা কে বোকা বানিয়ে খাবার চুরি করতে হবে সে সব কায়দা তাদের জানা। সনাতনদা বলে,- " ল্যাংড়া হারামজাদাটাই যত নষ্টের গোড়া। রাজ্যের খিদে নিয়ে এসেছে এখানে, আর তেমনই পেটে পেটে শয়তানী, সুযোগ পেলে এমন খেদানি দোবো না একদিন দুটো পা ই যাবে ভোগের মা হয়ে, তোর খাওয়া আমি তখন দেখাবো "।
রাজুর একটা পায়ে পোলিও। স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারে না ও। তবে এটাই ওর সুবিধা মনে হয় এখন। বেশ কাঠের তক্তার মধ্যে চাকা লাগানো আসনে বসে ও যত তাড়াতাড়ি যেকোনো কিছু করে ফেলতে পারে বিলু জগারা তা মোটেই পারে না। রুমিদি বলেছিলো সরকারি সাহায্য পেলে রাজুকে একটা জুতো আনিয়ে দেবে, তা সে কতদিন হয়ে গেছে। মাঝেমাঝে রুমিদিকে মনে করায় রাজু। জুতোটা পেলে রাজু প্রমাণ করে দিতো সে বিলুর চেয়ে লম্বা। এই নিয়ে প্রচুর ঝগড়া করেছে। একদিন বিলু বলে,- "তুই কি করে বুঝবি তুই তো ল্যাংড়া "। এক ঘুসি চালিয়ে দিয়েছিলো রাজু, লাগেনি বিলুর। ও চট করে সরে গেছিলো। অন্য আর কোন সুবিধা জুতোর আছে বলে তো মনে হয় না রাজুর। সব কাজই পারে সে। শুধু ওই বিলু, জগা ওদেরকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্যে সে জুতো নিয়ে দাঁড়াতে চায়, হাঁটতে চায়।
সবাই জানতো রাজুকে কেউ নিতে আসবে না কখনো, যেমন কলকে কে। কলকের একটা হাত নেই। বাবা মা রা কেউ না কি হাত পা ভাঙ্গাচোরা মাল নেয় না। এই ব্যাপারটা কয়েকবছর আগেও বুঝত না রাজু। সনাতন দা সীমাদি জয়দেবদা রা সব সময় বলতো এখনো বলে, এই দুটো পাপ যা জুটেছে না, নিষ্কৃতি দেবে না কোনো কালেই। কলকে বুঝিয়েছে এই কথাগুলো কেন বলে ওরা। আর কলকে কে, কে বুঝিয়েছিলো রাজু জানে না।
জ্ঞান হওয়া বয়স থেকে রাজু এই পাঁচিল ঘেরা ভাঙ্গাচোরা বাড়িটাকেই ওর ঘর বলে জেনে আসছে, তাই যাদের বাবা মা এসে নিয়ে চলে যায় আর সবাই বলে,- যাক, ছেলেটা একটা ঘর পেয়ে গেছে , তখন সত্যি খুব অবাক লাগে রাজুর। এটা কি তাহলে ওদের ঘর নয় নাকি। অন্য ঘরগুলো কি আলাদা হয় নাকি যেখানে ওরা যায়। হলে হতে পারে তবে এই ঘরে রাজুর কোনও অসুবিধা নেই। আগে তাও একটু খাওয়ার কষ্ট ছিলো, এখন সেটাও ম্যানেজ হয়ে গেছে। দারোয়ান শিবুদার গাঁজার নেশা, সেটা সবাই জানে শুধু ও নিজে ভাবে কেউ জানে না বুঝি। আর রুমিদি আর মাষ্টারমশাই কে ওর বেজায় ভয়। এই ভয়টাকে কাজে লাগিয়েছে রাজু, বিলু, জগা আর কলকে। ওই ভয়ের কারনেই ঠিক সময় বুঝে শিবুদা বিড়ির লোভ দেখিয়ে ডেকে নিয়ে যায় সনাতনদা কে, আর সেই সুযোগে কেল্লা ফতে। সনাতনদা রাজুকে দু চক্ষে সহ্য করতে পারে না, কোনো একটা ছোটো সুযোগ ও হারায় না রাজুকে চড় থাপ্পড় মারার। শুধু মাষ্টারমশাই আর রুমিদি প্রশ্রয় দেয় বলেই সেই সুযোগে দু চাকার কাঠের তক্তাতেই রাজুর দাদাগিরি চলতে থাকে। এই প্রশ্রয়ের একটা কারণ অবশ্য আছে। মাষ্টারমশাই এর শেখানো সব পড়াশোনা রাজু কিভাবে খুব চটপট বুঝে যায়। সে অনায়াসে মুখে মুখে দু লাইনের যোগ গুলো ফটাফট করে ফেলতে পারে, ইংরেজি ছড়া বলতে পারে, শুনে শুনেই মুখস্থ হয়ে যায় তার। বাংলা কিশলয় থেকে বেশ ভালোই গল্প পড়ে শোনাতে পারে বাকি সবাইকে। এখানে আর কেউ এসব পারে না। এসবের জন্য রাজুকে কিছুই আলাদা করতে হয় নি, কেমন করে ওর মাথা থেকে এসব হয়ে যায় যেন। মাষ্টারমশাই রুমিদিকে বলে,- এ ছেলেটা এভাবে নষ্ট হবে রুমি, দেখো কোথাও কোনো ভালো হাতে পড়ে যদি। আর একটা কারনেও রাজুকে এখানে সবাই খুব পাত্তা দেয়। সাঙ্ঘাতিক ভালো হাতের টিপ ওর। গুলি টিপ করায় রাজুকে আজ পর্যন্ত কেউ হারাতে পারে নি। একবার সনাতনদা কে এই হাতের টিপ এর জোরেই মাথায় ঢিল মেরেছিলো রাজু। এখনো সে কথা মনে করে ওরা ছেলেরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। সনাতনদা বলে, একদিন রাজুকে খুন করে জেলে যাবে ও।
মীর বসে ছিলো রাজুর পাশেই। একটু ভয় ভয় ছাপ ওর মুখে। একদিন ওকে অনেক সাহস জুগিয়েছে রাজু। আজ আর কিছু বলতে ভালো লাগছিলো না ওর। - যাচ্ছিস তো বাপ ভালো মন্দ খেতে তার আবার এত ন্যাকামি কিসের। নতুন জামা পড়েছিস, আরো পড়বি এর পর, এতদিন তো থাকতিস ছেঁড়া গেঞ্জি পড়ে, তার আবার এতো কিসের ভয় রে। থামে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে রাজু। জগা আর বিলু ডাকতে এসেছিলো দুবার, গুলি খেলার জন্য। রাজু যায়নি। ভালো লাগছে না। মন খারাপ মোটেই নয় রাজুর। কলকে এসে বসেছিলো ওর পাশে, এই কথাই জিগ্যেস করছিলো, - মন খারাপ করিস নে রাজু। চ না, খেলি। রাজু হটিয়ে দিয়েছে, এক খানা হাত নেই তাও ব্যাটার খেলার শখ দেখো। অদ্ভুত কায়দায় একটা পা আর একটা হাত লাগিয়ে টিপ লাগায় কলকে। হাসি পায় ওর ধরণ দেখে, মাঝে মাঝে বিলু এসে ওর পেছনে লাথি লাগায় একটা, সামনে থপ করে উলটে পড়ে কলকে, আর ওদের হাসির ধুম ওঠে।
রাজুর ভালো লাগছে না কারণ মাষ্টারমশাই আর রুমিদি ওর সাথে দুদিন ধরে কথাই বলছে না কিছুতেই। কাল ও পড়াতে এসে মাষ্টারমশাই ওকে কিশলয় পড়তে দেয় নি। গোলা যে প্রায় পড়তেই জানে না ওকে দিয়ে পড়িয়েছে। পড়া বা না পড়া নিয়ে রাজুর মোটেই কোনো মাথাব্যাথা নেই, কিন্তু ও যখন পড়ে তখন সব কটা আকাট ছেলে কথা বলা থামিয়ে মন দিয়ে শোনে, আর তারপর শেষ করার পর মাষ্টার মশাই এর চোখে একটা খুশীর হাসি দেখতে পায় রাজু ওটাই ওর লোভ। এখানে জগা, বিলু , কলকে বা আর যারা আছে তারা ছাড়া কেউ কখনো ওদের দেখে খুশী হয় না, রাজুকে তো নয় ই। একমাত্র ওই দুটো মানুষের কাছ থেকেই ওটা পেয়েছে রাজু। মা বাবা কেমন হয়, মারে না আদর দেয় জানা নেই, ভালো খেতে দেয় এটা নিশ্চিত, কারণ বেশ কিছুদিন আগে দেবু ওর মা বাবা কে নিয়ে এখানে ওদের দেখতে এসেছিলো , ও বলেছিলো একদিন অন্তর অন্তর মাংস খায় নাকি। চেহারাখানাও বেশ পরিষ্কার পরিষ্কার লাগছিলো দেবুর। বেশ বোঝা যাচ্ছিল যে ও আর ওদের একজন নয়। এখান থেকে যারা যায় আজপর্যন্ত কাউকে আসতে দেখে নি রাজু এক ওই দেবু ছাড়া।
মীর কে ডাকতে এসেছে রুমিদি, - মীর চলে এসো। রাজু মুখ তুলে তাকায়, রুমিদি ওর দিকে তাকালো না একবার ও। মীর ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালো, রাজুর কনুই এ একটা হাত রাখলো, -যাই রাজুদা? -এ আবার জিগ্যেস করে, হাসি পায় রাজুর। মাথা নাড়ে ওর দিকে তাকিয়ে। তাও যায় না মীর।– যা না যা। ডাকছে দেখছিস না। অন্যদিকে মাথা ঘুরিয়ে নেয় রাজু। মীর আস্তে আস্তে চলে যায়।
আচ্ছা, রুমিদি আর মাষ্টার মশাই কি আর কথা বলবে না ওর সাথে, ওরা যদি ওকে আর না দেখে, ও শিবুদাকেও ভয় দেখাতে পারবে না, সনাতন ওকে বাগে পেয়ে যাবে। এইটাও যদি হয়, তাহলে এখান থেকে পালিয়ে যাবে রাজু। কোথায় যাবে? সে দেখা যাবে নাহয়। হঠাৎ কান্না আসে রাজুর। কাঠের তক্তাটাকে চাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে যায় পিছনে বাড়িটার ভাঙ্গা সিঁড়ির দিকটায়। এদিকটায় কেউ আসে না বড় একটা, পাঁচিলে মাথাটা ঠেকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে রাজু। এভাবে অনেকদিন পর কাঁদল সে। সেই আগে কিছুতেই খিদে মিটত না, তখন এরকম কাঁদত রাজু। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়তো। হঠাৎ নিজের সরু জীর্ণ পা টা দেখে প্রচণ্ড রাগ হতে থাকলো রাজুর। মনে হোলো ইঁট মেরে ভেঙ্গে গুড়ো করে দেয় ওই পা টাকে ।ডান হাত দিয়ে জোরে জোরে ঘুসি মারতে থাকে রাজু পা টা কে। ভেঙ্গে যাক ওটা। যত মারে তত কান্না আসে রাজুর। জোরে জোরে কাঁদতে থাকে সে।
মীর আজ বাড়ি যাচ্ছে যাদের সাথে, আসলে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই মা বাবা নিতে ছেয়েছিলেন রাজুকে। রাজুর গল্প রুমিদির মুখে শুনে আর তারপর ওকে দেখে কিভাবে যেন ভালো লেগে গিয়েছিলো ওদের। এক ই সঙ্গে মীর কেও পছন্দ ছিলো তাদের। কিন্তু দুজনের মধ্যে একজনকেই নিতে পারেন ওরা তাই রাজুকেই বেছে নিয়েছিলেন। রুমিদি লাফাতে লাফাতে এসে খবরটা দিয়েছিলো হোম এ। কিন্তু মীর?
সে যদি চলে যেত এই ছেলেটার কি হোতো তাহলে। কি করে বাঁচত মীর ওই যন্ত্রণা থেকে। হোম এর সব ছেলেরা জানে মাঝে মাঝেই সনাতন দা রাতে এক একজনকে ডেকে নিয়ে যায় নিজের ঘরে, বাইরে থেকে দু একজন লোক আসে, আর তারা যে অসহ্য কাজ করে তা একদিন চুরি করে দেখেছে রাজু নিজে চোখে। অসহ্য যন্ত্রণা হয় তারপর বিলু,জগা সকলেই বলেছে। হোমে নতুন কেউ আসলে তার ওপর আগেই চোখ পড়ে সনাতন দার। যেমন এই মীর। আর ছোটো এই ছেলেটা এসে থেকে রাজুর পেছন পেছন দাদা দাদা করে ঘুরত। এখানে কেউ ওকে দাদা বলে না, এখানে কেউ কারো দাদা নয়, ভাই ও নয়। রাজু নিরুপায় চোখে দেখে যাচ্ছিলো মীর এর যন্ত্রণা, আর সনাতন দা দের খ্যাক খ্যাক হাসি। শালা, মোসলমানের বাচ্চা এদের কিচ্ছু হবে না, চালাও এটারে ক’দিন। কতবার রাজু রুমিদিকে মাষ্টার মশাই কে বলতে চেয়েছে, ওরা বুঝেও বুঝতে চায় নি। শুনেও শুনতে চায় নি। শুধু রাজুর ব্যাপারে ওদের কড়া নির্দেশ ছিল। মাষ্টার মশাই বলে,- রাজু আমি তোকে যতটা পারবো হেল্প করবো, তুই শুধু মন দিয়ে পড়ে যা আর অন্যের ব্যাপারে কম নাক গলা। আমি তোর রুমিদি এতজনকে চাইলেও সবসময় দেখতে পারবো না, তুই ও পারবি না। শুধু ভালো ভাবে থাক।
কিন্তু সেটা রাজু পারে নি মীর এর জন্যে। যখন সুযোগ এলোই তখন বাঁচুক ছেলেটা। ও যে মরে যেতো নাহলে যেমন অনেকদিন আগে বলাই মরে গেছিলো। ছেলেটা যে রাজুদা বলে ডাকতো ওকে।
ওরা রাগ করে কথা বলছে না রাজুর সাথে কারণ অনেক বুঝিয়েও রাজুকে রাজি করানো যায় নি, সে বারবার বলে গেছে মীর যাবে মা বাবার কাছে, আমি যাবো না।
-রাজু এরপর আর এমন সুযোগ আসবে না রে তোর। তেরো বছর বয়স তোর। বড়দের কেউ আর নিতে চায় না। তার ওপর তোর এমন পা। এটা তোর জায়গা নয় রে। অনেক বুঝিয়েছিলো মাষ্টার মশাই। রাজুর ওই এক কথা। মীর যাবে, আমি কোথাও যাবো না। মাষ্টার মশাই কি জানে রাত্রিবেলা যখন ওই লোকগুলো জোর করে জামাকাপড় খোলায় আর তারপর মীর আর তার মতো আরো অনেক ছেলেগুলো যন্ত্রণায় ভয়ে চেঁচাতে থাকে তখন কেমন লাগে। প্রথম যেদিন সে দেখেছিলো ওই দৃশ্য সারা রাত বিছানায় কেঁপেছিলো। তার হাত পায়ে যেন তার নিজের জোড় খাটছিলো না। মীর কে প্রথম যেদিন নিয়ে যায় ওরা রাজু ওর কাঠের তক্তা নিয়ে আটকানোর আপ্রান চেষ্টা করেছিলো। পারেনি। সনাতন লাথি মেরে সরিয়ে দিয়েছিলো রাজুকে। একদিকে ছিটকে গেছিলো ওর দুচাকার কেঠো বাহক আর অন্যদিকে রাজু। পরদিন রুমিদিকে বারবার অনুরোধ করেছিলো রাজু, মীর কে বাঁচানোর জন্য। রুমিদি বরাবর এর মতো এবার ও বলেছিলো , -রাজু আমি কিছুই করতে পারি না রে, তোর রুমিদির ক্ষমতা খুব সামান্য। তুই এসব আমায় বলিস না আর। লক্ষ্মী হয়ে থাক তুই বাবা, তোর জন্যে অনেক চেষ্টা করছি , যদি কিছু করতে পারি। আর অন্য কিছু বলিস না আমাকে।
রাজু কিছু করতে পারে নি মীর এর জন্য। ধুম জ্বর নিয়ে যখন কাতরাতো মীর , রাজু ছেঁড়া ন্যাকড়া, জলে ভিজিয়ে লাগাতো ওর কপালে। আর তারপরই একদিন এক বাবা মা এসে পছন্দ করে বসলো রাজুকে। তারপর চোখ পড়লো মীর এর উপর। এরা নাকি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বাবা মা। রাজু, মীর কে এগিয়ে দিলো রুমিদির দিকে। অনেক বোঝানোর পর ও সে অনড়।
এর জন্য শাস্তি দিচ্ছে ওরা রাজুকে। এর জন্য ওরা কেউ ফিরে তাকাচ্ছে না। এর জন্য হয়তো আরো অনেক কিছু হবে, তাও রাজুর মনে হবে না সে ভুল করেছে। কম খেতে পেলেও না। এই খোঁড়া পা টা যদি ঠিক থাকতো তাহলে সে সব ঠিক করে দিতে পারতো। হয়তো মেপে দেখলে সে সনাতন দার মতো লম্বা হয়ে যেতো, তখন লাথি মেরে মুখ ভেঙ্গে দিতো ওর। বুকের ভিতর দলা পাকানো ব্যাথাটা যায় না। যদি মা বাবা পেতো সে তাহলে মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁদত। মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো। যেমন দেবুর মা দেয়। দেবু বলেছিলো ওর মা ওকে খাইয়ে দিতো, পেট ভর্তি খাবার,আর নরম বিছানায় ঘুম ও পাড়িয়ে দিতো। জল ভরা চোখ বুজে আসে রাজুর। ক্লান্তি নেমে আসে, মাথাটা ঢলে পরে সিঁড়ির উপর।
একটা অস্পষ্ট দরজা খুলে যায়। ওপারে নরম বিছানা, আলোর হাসি মেখে কে যেন তাকায়, কাছে ডাকে। আশ্চর্য ভাবে ওই দুই পায়ে ভর করে হেঁটে এগিয়ে চলেছে রাজু, কত লম্বা হয়ে গেছে সে। কেউ যেন ডাক দিলো পেছন থেকে....অস্ফুট কোনো গোঙানি, যেন কান্নার মতো....রাজুদা আ আ...... সামনে নরম আলোর মতো মুখ কেমন ঝাপসা....
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন