মৌসুমী রায়


 

সূর্যাস্তের রঙ


             হেমন্তের সন্ধ্যা । আকাশ প্রদীপের টিমটিমে আলো আর ছাতিম ফুলের গন্ধে বিধূর।আসন্ন শীতের আমেজে মনটা এইসময়ে বিবশ হয়ে থাকে। দূরের কোন বিয়েবাড়ি থেকে সানাইয়ের সুর ভেসে আসে।
না,আজকাল কেউ আর নহবত বসায় না।
ব্লুটুথে বেহাগ বাজে। রাত বাড়লে আকাশে আতশবাজির খেলা চলে। শব্দের আতঙ্ক।

                    মিত্তির মশাইদের মত সিনিয়র সিটিজেনরা যদি কোন বিয়েবাড়ির নেমতন্ন পান,মনটা অকারনেই ফুরফুরে হয়ে ওঠে। বাড়িতে যেভাবে সুগার প্রেসার আর কোলেস্টেরল এর দৌরাত্ম্য!শান্তিতে খাওয়াও যায় না ,সে এক কথা, আবার দেওয়াও হয় না,সেও আরেক। তবু যতদিন গিন্নী ছিলেন,তাও ছিটেফোঁটা জোটার সম্ভাবনা ছিল। গিন্নী গত দুবছর। এখন সেসব  দিন অতীত। ডাইনিং রুম থেকে মাঝেমাঝে বিচিত্র খাবারের খোশবাই ভেসে আসে। বাড়ির সামনে টমেটো না জোম্যাটোর ছেলেদের বাইক দাঁড়ায় এসে।মিত্তির মশাই খেয়াল করেন। তবে তাঁর ঘরে পৌঁছয় না সেইসব সুখাদ্য । বৌমা পরের মেয়ে। তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। নিজের ছেলেটার ও বোধকরি বাপের কথা মনে থাকেনা। যেহেতু তাঁর হজম শক্তি এখনো মোটের ওপর ভালোই,দুঃখ হয় বৈকি! 

                   সংসারে সেভাবে কল্কে পান না।নাতি নাতকুড় কে দুবেলা স্কুল গাড়িতে তোলা নামানো ছাড়া তেমন কোন বলবার মত কাজ নেই। মাঝেসাঝে পার্কে বিকেলের বৈঠক। তাও টুপটাপ পাতা খসে পড়ে। ছন্নছাড়া হয় দল।কটা দিন  বিষন্ন হয় মন।অফুরন্ত সময় বিফলে কেটে যায়। চূড়ান্ত ব্যস্ততা থেকে অখন্ড অবসর। ক্লান্ত করে তোলে।খানিক নির্লিপ্ত ও।
                 দায় নেই,দায়িত্ব ও নয়। নিজেকে নিয়েই খানিকটা শশব্যস্ত থাকা।আগে ভোর পাঁচটায় উঠে ছেলের তাইকোন্ডে ক্লাস বা অংকের মাষ্টারমশাই এর বাড়ি নিয়ে যাওয়া। গিন্নীর খিদমত। বাজার সেরে ফিরে নাকে মুখে দুটো গুঁজে অফিসে ছোটা।বত্রিশ বছর কলম পিষে সুগার প্রেসার স্পন্ডেলাইসিস। কুড়িয়ে বাড়িয়ে মেয়ের বিয়ে।গিন্নীর দুম করে চলে যাওয়া।বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ছেলের নিজে পছন্দ করে বৌমাকে নিয়ে আসা। ইচ্ছে ছিল,মেয়ের বিয়ের গ্যাঁটগচ্চার খানিকটা পূরণ করে নেবেন ছেলের বেলায়।সে গুড়ে বালি।উল্টে নিজের আরো কিছু খসলো। নাতি নাতকুড়ের মুখ দেখতে হবে সোনা দিয়ে। এখন আত্মীয়স্বজনের বিয়েশাদির নেমতন্ন এলে গা বাঁচিয়ে চলেন মিত্তির মশাই। যাদের সংসার,তারাই বুঝুক। তবু কি আর সবসময় বাঁচা যায়? বৌমার বিবাহ বার্ষিকী,মেয়ের তিরিশ বছরের জন্মদিন।
পিএফ বা গ্র্যাচুইটির সামান্য কটা টাকা। তার উপরে ছেলে মেয়ে সবারই কমবেশি নজর। বোঝেন মিত্তির মশাই।
"আরে বাবা, থাকলে তোদেরই থাকবে। আমার আর কে আছে!"
সে বুঝ ছেলেমেয়েরা বুঝলে তো। ভাঁড়ারে টান পড়লেই বৌমা গজগজ করে, "বাবার কাছে চাও। যত ঝামেলা আমাদের ঘাড়ে আর গোপনে টাকা দেবেন মেয়েকে"
যদিও এমন ঘটনা আদৌ কোনদিন ঘটেনি।

                         মিত্তির মশাই সব শুনেও না শোনার ভান করেন।স্থিতপ্রজ্ঞ দাঁড়কাক হয়ে চুপটি করে থাকেন। দুঃখেষুঅনুদ্বিঘ্নমনা। গিন্নীর সাবধান বাণী মনে পড়ে, "তুমি না থাকলে,হয়তো আমি চালিয়ে নেব।আমি আগে গেলে তোমার যে কি হবে!"
"ঠিক ই ভেবেছিলে গিন্নী। ভালো নেই আমি। শীতে গ্রীষ্মে বর্ষায় পাশে থাকবার একটা মানুষ লাগে। দুই  একটা কথা।একটু উষ্ণতা। রক্ত দিন দিন ঠান্ডা হচ্ছে যে!"
                প্রোস্টেটের সমস্যাটা বেড়েছে।টপ টপ করে পেচ্ছাপ হয়।সবসময় একটা চাপ চাপ ভাব। ছেলেকে বললেই বলে, 
-এই বয়সে অমন একটু আধটু হয় বাবা। বেশী অসুবিধে হলে বোনিকে বলো, ইউরোলজিস্ট দেখিয়ে আনুক।আমার এখন ইয়ার এন্ডিং এর চাপ।মরবার ফুরসত নেই!
মিত্তির মশাই বিলক্ষন জানেন, মরার ফুরসত ছেলের বোনির ও নেই।বর ছেলে আর শখের ব্যুটিক নিয়ে সেও ভয়ানক ব্যস্ত থাকে। মনে মনে হাসেন।তিনি এখন বাড়তি। না থাকলেই বরং ঝাড়া হাত পা হয় সবাই। ঠিক করেন,বিকেলের বৈঠকে কথাটা পাড়বেন।ওখানে কমবেশি সবাই এখন রুগি। অধিকাংশের ছেলেমেয়েই অ্যাব্রডে। এখানে বুড়োবুড়ির সংসার। আজ পিয়ারলেস,কাল অ্যাপোলো করে দিন কাটে।নাহ, আর ছেলেমেয়ের মুখ চেয়ে থাকবেন না মিত্তির মশাই। ঝাড়া দিয়ে উঠলেন। কালকেই আড্ডার বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন।জীবনে একটা দিশা দরকার।
আজ আপাতত বিয়ে বাড়িতে ঘুরে আসা যাক।অনেকদিন কব্জী ডুবিয়ে ভালো মন্দ খাওয়া হয় নি। 

           বিয়ে বাড়ির নামে বেশ চনমনে লাগছে।নিজের মনেই হেসে ফেলেন মিত্তির মশাই।

[মিত্তির মশাই চরিত্রটাই যা কাল্পনিক।বাকি সব...]

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য