কুশল মৈত্র
দুর্গার সঙ্গে দেখা
আজ ষষ্ঠী। মনে বেশ খুশির রেশ ভেসে বেড়াচ্ছে। পাড়ার পুজোর সেক্রেটারি হওয়াতে পুজোর একটা বাড়তি চাপও আছে। মাঝে একদিনের জন্যে আবার বউ-মেয়েকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে ঘুরে আসতে হবে। তাই শেষবেলার অফিস কোনোক্রমে সেরে আমি আর অনিকেত বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঢাকের বাদ্যি আর আলোর রোশনাই খেলে যাচ্ছে। আকাশে বাতাসে দেবী দুর্গার আবাহনী সঙ্গীত আর অদ্বিতীয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সাড়া জাগানো কণ্ঠস্বর। হৃদস্পন্দন যেন আরও বেড়ে যায়।
প্রতিদিনের মতো আমি আর অনিকেত শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেনে আজ তেমন একটা ভিড় নেই। অনিকেত বলল, চল বসি গিয়ে। সিট তো ফাঁকাই আছে। বললাম, আজ আর বসতে ইচ্ছে করছে না রে! অন্যান্য দিনে এই বসার জন্য কী কাণ্ডটাই না করতে হয়। আজ মনে বেশ একটা ছুটির খেই হারানো বাতাসের গুঞ্জন বইতে থাকে।
আমার দেখাদেখি অনিকেতও পাশে এসে দাঁড়ায়। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দুজনে বেশ শরতের মৃদু ঠান্ডা হাওয়ার আগমনী উপভোগ করতে লাগলাম।
ট্রেন দমদম স্টেশনে আসতেই ভিড়ের একটা প্রবণতা তৈরি হল। অনিকেত আর আমি দরজার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালাম। এক ঝাঁক লোক ঠেলে ট্রেনে উঠে পড়ল। প্রায় বছর সত্তরের এক বৃদ্ধ কোনোক্রমে আমার জামা ধরে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তা নাহলে পিছনের চাপে উনি পড়েই যেতেন। আমি, আমার আর অনিকেতের পাশে একটা জায়গা করে দিয়ে বললাম— এইখানে দাঁড়ান, মেসোমশাই। তিনি নিজেকে কোনোক্রমে সোজা রেখে ঠোঁটের চাপা হাসিতে সেখানে দাঁড়ালেন।
ভদ্রলোকের জামা বেশ অপরিচ্ছন্ন। পায়ে হাওয়াই চটি। অনিকেত বলে উঠল, আপনি ভিতরে যেতে পারেন একটু পরেই বসতে পারবেন।
বৃদ্ধটি বললেন, না বাবা, ঠিক আছে। আমি এখানেই দাঁড়াই। একটু পরেই তো নেমে যাব। তাছাড়া উনি তো আমাকে দাঁড়ানোর একটু জায়গা করেই দিলেন। ভদ্রলোককে দেখে মনে হল খুবই বিধ্বস্ত এবং মানসিক চাপে রয়েছেন। ব্যারাকপুর আসতেই ট্রেনের ভিড় একটু কমতে শুরু করেছে।
বৃদ্ধলোকটি আমাকে বললেন, তুমি কোথায় নামবে বাবা?
আমি বললাম, নৈহাটী। আর আপনি?
—আমি! আমি জগদ্দল। এটা জগদ্দলে থামবে তো?
আমি বললাম, হ্যাঁ, এটা থামবে।
ট্রেন চলার সাথে সাথে বৃদ্ধলোকটি এপাশ ওপাশ করতে করতে আমার পিছনে এসে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ যাবার পর অনিকেত আমার কানের পাশে গুনগুন করতে থাকে।
আমি বললাম, তুই চুপ কর, আমি টের পেয়েছি। বৃদ্ধলোকটি যাতে ট্রেনের অন্যান্য লোকের দ্বারা কোনোভাবে আক্রান্ত না হন তার জন্য আমি চুপ করে থাকলাম। আর পুজোর মুখে কাউকে মারখাওয়াতে আমার বিবেকে বাধল। আসলে বয়স্ক লোকটিকে দেখে কেন জানি না, একটু মায়াই লেগেছিল।
অনিকেতকে বললাম, তৈরি থাক, আমাদের জগদ্দল স্টেশনে নামতে হবে। আর উনি যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পান।
আসলে লোকজন ওঠা-নামার সময় লোকটি আমার জিন্সের পিছনের পকেটে থাকা মানিব্যাগটি হাতিয়ে নিয়েছে। আর অনিকেত তার প্রত্যক্ষদর্শী, যদিও আমি সেটা নিজেও উপলব্ধি করেছি। কিন্তু ওঁর এই বয়সে এরকম কাজ, সেটা আমায় একটু ভাবিয়ে তুলেছে!
ট্রেন জগদ্দল আসতেই বৃদ্ধ ছলছল চোখে কাঁপা কণ্ঠে বললেন, আসি বাবারা! বলে হুড়মুড় করে নেমে পড়লেন। আমি আর অনিকেতও নামলাম। কিন্তু ওনাকে সেটা বুঝতে দিলাম না। লোকের আড়ালে আড়ালে পিছু নিলাম।
অনিকেত বলল, কী ব্যাপার! তুই লোকটাকে তো ট্রেনেই পাকড়াও করতে পারতিস। আমি বললাম, তা পারতাম। কিন্তু ওনাকে দেখে আমার কেন জানি না একটু মায়া হল। আর কথাবার্তা, বয়স দেখে মন চাইল না। একগাদা লোকের সামনে...
এখন চল এই নাটকের ক্ল্যাইম্যাক্সটা দেখি। কেমন যেন নিজেকে ফেলুদা ফেলুদা মনে হচ্ছে। অনিকেত বলল, আর আমি...
—তুই... তুই হচ্ছিস তোপসে, বুঝলি! উনি যেন আমাদের না দেখতে পান সেভাবে চলতে হবে। একটু পিছিয়ে আয়। বড্ড কাছাকাছি চলে গেছি রে।
অনিকেত বলে উঠল, বুঝলাম। তোর পাল্লায় যখন পড়েছি, ফিরতে দেরি হবে।
বললাম, আরে একটু না হয় দেরি করেই যাবি। কাল থেকে তো অফিস ছুটিই আছে। এখন বরং বৃদ্ধ লোকটির ইতিহাস উন্মোচন করি গিয়ে। আর অন্য কোনো মোটিভ বা বাজে মতলব দেখলে শালাকে...
আলো-আঁধারি মেঠো পথে লোকটি চলতে চলতে একটা স্যাঁতসেঁতে বস্তির গলিমুখো হলেন। আমরাও তার পিছু নিলাম। এরপর একটু যাওয়ার পরই একটি বেশ পুরনো বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলেন। আমরাও মিনিট দুয়েক পরে সেই বাড়ির সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালাম।
কাঠের ভাঙা দরজা। সামনেই একটা নোংরা ড্রেন। অনিকেত কড়া নাড়তেই একজন মেয়ে দরজা খুলে দিয়ে দাঁড়াল।
মেয়েটির বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। পরনের শাড়িটি ময়লা এবং ছেঁড়া। মৃদু বাল্বের আলোয় অস্পষ্ট গলির মধ্যে থেকে মেয়েটি বলল— কাকে চাই?
আমি তৎক্ষণাৎ বলে উঠলাম, মেসোমশাই আছেন, ওনাকে একটু ডেকে দিন তো?
মেয়েটি অপরিচিত দুজনকে দেখে প্রথমে একটু চমকে উঠল। মৃদু কাঁপা কণ্ঠস্বরে বলে উঠল, ভিতরে আসুন। আমরা বাড়ির বারান্দাতে দাঁড়াতেই সেই বৃদ্ধলোকটি ভিতর থেকে ছুটে এসে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, বাবারা আমায় ক্ষমা করো। আমি আজ অভাবের তাড়নায়...
বলতে বলতে আমার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়তেই অনিকেত তাকে ধরে চেয়ারে বসালো। মেয়েটিও কাঁদো কাঁদো স্বরে বলতে থাকে আমার বাবার কোনো দোষ নেই। আপনারা দয়া করে পুলিশ ডাকবেন না, প্লিজ।
অনিকেত একটু গম্ভীর গলায় বলে উঠল, আপনার এই বয়সে এসব করা কি সাজে? ধরা পড়লে তো পাবলিকের মার...। আপনি কি আর প্রাণ হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। আপনার পরিবারের লোকেদের কথা তো একটু ভাববেন, না কি?
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি বলে উঠল, আমার বাবার হয়তো এছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। বাবা আগে একটি জুট মিলে কাজ করতেন, অনেক বছর হল সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। তারপর পুজোআর্চা করে কোনোরকমে দিন চলতো। এখন বয়সের সাথে সাথে সেটি আর পারেন না। তাই পুজো করতে তেমন কেউ ডাকেও না। তার উপর আমার মাও অসুস্থ, দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী। আমার স্বামী আমাকে আর আমার এই পাঁচ বছরের মেয়েকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে আরেকজনকে বিয়ে করেছে। মা-মেয়ে আমরাও এখন বাবার ওপর বাড়তি বোঝা হয়ে উঠেছি — বলতে বলতে কাঁদতে থাকে।
শুনে কিছুক্ষণ আমরা স্তব্ধ হয়ে রইলাম।
কান্নাস্নাত সুরে বৃদ্ধ বলে উঠল, আজ বাদে কাল পুজো। আমার নাতনি, প্রতিদিন বাড়ি ফিরলেই বলে, আমার জন্য নতুন জামা এনেছ দাদু? যাদের দুবেলা ঠিক মতো খাওয়া জোটে না, তাদের আবার নতুন জামা! কিন্তু বাচ্চা নাতনির মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি বাবা! তাই তোমার এই মানিব্যাগটি আমি.... বলে কান্নায় ভেঙে পড়লেন বৃদ্ধ।
ওনার মেয়ে মানিব্যাগটি আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল— দেখুন এখান থেকে একটা টাকাও আমরা সরাইনি। আপনারা ভালো করে গুণে দেখে নিতে পারেন। আর আমার বাবাকে ছেড়ে দিন দয়া করে।
আমি কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলাম। অনিকেত টাকার ব্যাগটি নিয়ে আমাকে দিল। বলল— এবার চল।
আমি অনিকেতকে বললাম দাঁড়া। মানিব্যাগের মধ্যে থাকা এ.টি.এম কার্ড ও কাগজপত্রগুলো রেখে ব্যাগে থাকা সমস্ত টাকাটাই বৃদ্ধের মেয়ের হাতে তুলে দিলাম। বললাম— এগুলি রাখ, কাজে লাগবে। ভবিষ্যতে মেসোমশাইকে এসব কাজ করতে বারণ কোরো। তুমি নিজে একটু স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করো। আজকাল মেয়েরাও অনেক ধরনের কাজ করছে। দরকার হলে ঘরে বসে জামাকাপড় সেলাইয়ের কাজ করো...।
বেরনোর মুখে দরজার খিল সরানোর সময় ছোট্ট পাঁচ বছরের মেয়েটির দিকে চোখ পড়ল। ছোট্ট আদুরে মুখটির দিকে তাকাতেই মেয়েটি মায়ের পিছনে শাড়িতে মুখগুঁজতে চাইল। আমি মেয়েটির আদরে মাখা গালদুটো টিপে দিয়ে বললাম, তোমার নাম কী ?
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর, আদো আদো গলায় বলল— দুর্গা।
কে যেন আমার চলতি পা-দুটিকে থামিয়ে দিল। অনিকেতকে বললাম, তোর কাছে কিছু টাকা হবে? ও কোনো উত্তর না দিয়েই গোটা মানিব্যাগটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল।
বলল— বাড়ি ফেরার টাকা আছে। তুই ধর!
আমি অনিকেতের মানিব্যাগের সব টাকাটাই ওর হাতে দিয়ে বললাম— এই নাও দুর্গা। মা দুর্গা তোমায় দিলাম। নতুন জামা কিনো।
ফেরার পথে অনিকেত পিঠ চাপড়ে বলে উঠল— শাবাশ।
দূরে ঢাকের বাদ্যির আওয়াজ কানে ভেসে আসতে লাগল। আমি আর অনিকেত এক অভাবনীয় দুর্গার সন্ধান পেলাম। বাস্তবিক দুর্গার পটচিত্র আজ চোখের সামনেই। এক জ্যান্ত, সাক্ষাৎ দুর্গার ছবি বুকে নিয়ে বাড়িমুখো হলাম আমরা দুজনে। এক অনাবিল আনন্দে ভরে আছে মন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন