শমিত মণ্ডল



 দিনযাপনের কথামালা


একজন কবিকে ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত থাকতেই হয়।
আমাদের যে চিরায়ত সাহিত্য,তার প্রতি কবির অবলোকন থাকে, অন্তত থাকা উচিত।কবি দেবজ্যোতি রায়ের লেখা' 'শরীর বেড়াতে গেছে পাইনের বনে' ব‌ইটি
পড়তে গিয়ে সেই ঐতিহ্য চেতনার পরিচয় পাওয়া গেল।
ব‌ইয়ের প্রথম কবিতা 'চণ্ডীমঙ্গলের পৃষ্ঠা থেকে'। এখানে মঙ্গলকাব্যের আধুনিক ব্যঞ্জনা। মঙ্গলকাব্যের যে রূপান্তর এখানে ঘটেছে তা সমসময়কে ছুঁয়ে আছে।
মঙ্গলকাব্যের ফুল্লরা বনচারিনী, সমাজের প্রান্তিক নারী।
দারিদ্র তার নিত্যসঙ্গী। দেবজ্যোতির কবিতার ফুল্লরাও
প্রান্তবাসিনী, দারিদ্রকে কিছুটা কমানোর জন্য তার লড়াই।সে বনচারিনী নয়, ক্যানিং লোকাল ধরে সে 
বাবুদের বাড়ি কাজ করতে আসে।সে একজন পরিচারিকা।কেমন তার দিনাতিপাত ? আমরা ফিরে
যাই কবিতার কাছে ---
চডীমঙ্গলের পৃষ্ঠা থেকে ফুল্লরার মতো
তুমি উঠে এলে ক্যানিং লোকালে
তীব্র হুইসেলে জাগে সমকাল,রামতনু লাহিড়ির পরবর্তী
বঙ্গসমাজ।

ফুল্লরার শ্রমজ্যোৎস্নায় 
ফ্ল্যাটবাড়ি পরিচ্ছন্ন হয়
বেলা বাড়ে,কাক ডাকে
আঁশবটি ঘুমিয়ে পড়ে নিস্তব্ধ দুপুরে
( চণ্ডীমঙ্গলের পৃষ্ঠা থেকে)

শুধু চণ্ডীমঙ্গল‌ই নয়, দেবজ্যোতির কবিতায় এসেছে
মনসামঙ্গলের বেহুলার কথাও।তবে ওই কবিতার ফুল্লরা যেমন কবিতায় প্রধান, কবিতাটির নিয়ন্ত্রক‌ও
সে, বেহুলা সেভাবে এ কবিতায় আসেনি।---
রক্তঝরা পায়ে লাল আলপনা।
বেহুলার উত্তরাধিকার
চুইয়ে পড়ে
বরিশালে,গৈলাগ্রামে, নদীয়ার চৈতন্যধুলায়
( বাঘের সুদৃশ্য থাবায়)
অন্য একটি কবিতা, 'বড়দিনের কবিতা ' সেখানেও পথ
হারানো নারীদের কথা। মুম্বাই থেকেও দূরে এক অচেনা শহরে কারা যেন নিয়ে যায় নাসরিন খাতুন কিংবা সোনালি সাহাকে।তারা আর ফিরতে পারে না অখিল বিশ্বাস বাইলেনে। বড়দিন তাই আনন্দের পরিবর্তে
বয়ে আনে বিষাদ। 
তাহলে শুধু বেহুলাই নয়, বরিশালের গৈলা গ্রামের
মনসামঙ্গলের কবি বিজয় গুপ্ত‌ও এলেন,এলেন নদীয়ার
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। আগেই এসেছেন রামতনু লাহিড়ি---
একজন চিন্তক,সমাজ সংস্কারক।


দেবজ্যোতির কবিতায় একটা অন্ধকারের কথাও থাকে।
এই অন্ধকার লুকিয়ে থাকে না, স্পষ্ট ভাবেই থাকে। প্রথমে এই অন্ধকার থাকে ব্যক্তিগত অন্ধকার; তারপরে
এই অন্ধকার চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকে পড়ে আমাদের ভিতরে।
কবির সঙ্গে সঙ্গে আমরাও, কবিতার পাঠকেরাও আহত
হ‌ই।বেশ কয়েকটি কবিতায় আছে এই অন্ধকারের কথা।
অন্ধকার একটু একটু করে জড়িয়ে ধরে কবিকে ---
ঢুলু ঢুলু চোখে নিজের তৈরি করা সংসার দেখি
কামারশালায় সংগীত রচিত হচ্ছে।
পুবের বারান্দা থেকে পশ্চিমের ব্যালকনি
ঝমঝম লোহার শেকল।

স্ত্রী পুত্র পরিবার হুইসল্ দিয়ে যায়
তবু স্বভাববশত ট্রেন ফেল করা

তোমার দু-চোখে সাঁড়াশির আলো
গাছের রক্ত দেখে কুড়ুলের স্বস্তি হয়।
অনন্ত বটির সঙ্গে গল্প করে
মৃত শোল মাছ।
( সাংসারিক)
তবে এই অন্ধকার-ভাবনার অসহায়তার চূড়ান্ত রূপ ধরা
পড়েছে 'আশ্চর্য বাজার ' কবিতার মধ্যে। একটা
অসহায়ত্বের ঘেরাটোপে আমাদের জীবন আবর্তিত হয়।
যে দিক দিয়েই আমরা এই ঘেরাটোপের থেকে মুক্ত হতে চাই না কেন পারি না, আবদ্ধতাই আমাদের নিয়তি।এর
থেকে পরিত্রাণ নেই আমাদের।---
পালাতে গেলেও
উত্তরে সবজির হাট
দক্ষিণে হকার্স কর্নার

মন্থর ভেড়ার দলে মাথা নিচু করে হাঁটি
অজ্ঞাতপরিচয়
পিঠে বোঝা।

বাজার ছাড়িয়ে চলে যেতে হবে

অথচ লিকলিকে পা-দুটির পথশ্রম
ঢুকে পড়ছে গভীর বাজারে।
( আশ্চর্য বাজার )
এই বাজারে যেন নৈরাশ্য ও বিবিক্তির কেনাবেচা হয়।
আমাদের অনিকেত জীবনচারণার রূপক হয়ে থাকে
আশ্চর্য বাজার।

এতক্ষণ বললাম দেবজ্যোতির কবিতার অন্ধকারের কথা। এবারে খুঁজি আলো। একজন সংবেদী কবি তো
শুধু অন্ধকারের কথাই বলবেন না। তিনি তো তার
পাঠককে আলোও দেখাবেন। বিশেষত দেবজ্যোতির
মতো সমাজ-স্পর্শী কবি।
' দিনলিপি ' কবিতায় আমরা দেখা পাই একজন
মনস্তাত্ত্বিকের, ড.ঘোষ--- " তাঁর মুখে বাবলাগাছের
কাঁটা ফুটে আছে"। নিজেকে তিনি বলেন ---দগ্ধ বৃক্ষ।
কিন্তু ' ভুবনবাবুর কথা' কবিতার ভুবনবাবু সকল মানুষকে আলো দেখান। ক্লিষ্ট,কষ্ট-প্রাণের দুঃখ হরণ
করেন।মানব জীবনের দিনযাপনের ক্লান্তির উপশম
তার কাছেই আছে--- 
তিনি যেন পান্থশালা
তাঁর শূন্যতায় এলে মনে হয় --- 
ত্রিপিটক থেকে যাত্রা শুরু করেছেন
ভোরের আগেই পৌঁছবেন সুফিসংগীতে।

দেবজ্যোতির কবিতায় তত্ত্বজ্ঞান থাকে না। থাকে অভিজ্ঞান।এই জ্ঞান জীবন-বাহিত। আমাদের চারপাশের মানুষ ও মানুষকেন্দ্রিক যে জীবন তাই তাঁর কবিতার উপজীব্য। দেবজ্যোতি কবিতা লেখেন অতি
সহজ কথ্য ভঙ্গিতে।তাই পাঠকের সঙ্গে সংযোগ রক্ষায়
তাঁর কোনো অসুবিধাই হয় না।'শরীর বেড়াতে গেছে
পাইনের বনে'ব‌ইটি পড়ে পাঠককে ব‌ইটি সযত্নে সংরক্ষণ করতে হবে।
-

শরীর বেড়াতে গেছে পাইনের বনে। দেবজ্যোতি রায়।
প্রকাশক বান্ধবনগর কলকাতা ৭৮ কলকাতা ব‌ইমেলা
২০২২, ৫০ টাকা।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য