সোমা দত্ত



 খেচর

A poetic prose



আমার নাম উপল ব্যানার্জী। এই মুহূর্তের  প্রধান স্মৃতি এটুকুই। বাকি সব আবছা অন্ধকার প্রশ্নবোধক। আজ কত তারিখ জানি না। সময়, বার, মাস কিছুর হিসেব নেই। যা টের পাই তা হল অনেকটা ফাঁকা সময়ে কয়েকটা দিন কয়েকটা রাত ধীরে ধীরে আসা যাওয়া করছে। চিত হয়ে শুয়ে আমি পৃথিবীর বায়ুমন্ডল প্রত্যক্ষ করছি। চোখের পাতার উপরে রোদ, বৃষ্টি মেঘ যাতায়াত করছে। ধোঁয়াটে জলীয় বিন্দু নেমে আসছে স্লো মোশনে। জলের মোশন এত ধীর হয়! কুয়াশা, সম্ভবত শীতকাল অথবা হেমন্ত। একটা শিরশিরে হাওয়ার কাঁপুনি ছুঁয়ে যাচ্ছে। রোদ নেই। চতুর্দিকে শান্ত গাঢ় এক ছাই রং। অসম ঘনত্ব। কখনো খুব পাতলা হয়ে উঠছে, কখনো খুব ঘন। চারদিকে পাখির ডাক ক্রমশ বাড়ছে। মিশ্র শব্দ। কয়েকটা চড়াই খুব কাছে চলে এলো। কানের একদম পাশে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি ওদের তীক্ষ্ণ কম্পাকের ছোটো ছোটো তরঙ্গ। ঠিক যেন তেমন নয় যেমন এতদিন শুনে এসেছি। 

এতদিন শুধু মধুজা কানের পাশে রিনরিন করে বাজত।  রাতের হালকা নীল আলোর আভা আলতো করে ওর ঘরের দরজার নিচ থেকে বেরিয়ে পড়ত। সত্যম শিবম সুন্দরম সিনেমায় জিনত আমন-এর ব্লাউজ নিচ থেকে স্লিম চাঁদের বুক ঠিক ওইভাবে বেরিয়ে এসে টলটল করত। আমি ভাবতাম বুক পোশাকের নিচ থেকে বেরিয়ে আসলে আরো বেশি ভরে ওঠে কেন? শ্রীরাধিকার সেতার এসে আমার কানের ভিতর দিয়ে এ গলি ও গলি ঘুরে কোন সুফিয়ানায় পৌঁছে যেত। আমি বিছানায় বসে দেখতাম আমার চোখ দিয়ে মধুজার চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। মধুজার কথা মনে হতে ওই চড়াই এর ভাব প্রদান আরও অসহ্য মনে হল। কী বলছে পাখিটা? কি ই ই চ এরকম টানা ধ্বনিতে কিছু একটা তবে চ টা ওরকম ভাবে শেষ হচ্ছে না, সঙ্গে কয়েকটা এইচ জুড়ে দিয়ে চ উচ্চারণ করলে যেমন হবে ওরকম ভাবে কিছু বলছে। এত কুয়াশা গলা জল, এত পাখির ভাষা ভালো লাগছে না। সমস্ত শব্দগুলো আমার বুকের উপরে লাফিয়ে উঠে পড়ছে। আমি কি বাগানে? বহুদিন ধরে কি আমি বাগানেই পড়ে আছি? মাটি, কেঁচো কয়েকটা ঘুমন্ত হেলে সাপের ঠান্ডা গা, হলুদ পাতার নিঃশব্দ পতন আর অজস্র প্রি-ম্যাচিওরড হিমকণার সঙ্গে আমি কতদিন পড়ে আছি ঠাহর করতে পারছি না। আমার তো মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স। পুরুষের পঁয়তাল্লিশ বছর একটা সুঠাম ফলন্ত আমগাছের মতো। সে তো চারাজীবনের কথা এত তাড়াতাড়ি ভুলে যায়না।  মধুজা বেয়াল্লিশ বছরেই কত অসংবৃত। ওর অত সুন্দর শরীরটা কেমন অ্যাডেনিয়ামের শিকড়ের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। লাবন্যময়ী উজ্জ্বল মুখটার উপর বিবশ তারুণ্য। 

আসলে, আমি আর মধুজা একটা অতীত সম্পর্ক ভাগ করে চলি। আমাদের সমস্ত বর্তমান একটা দীর্ঘ অতীতের উপরে টিকে আছে। বটগাছ থেকে নেমে আসা ঝুরি তবু বট গাছ তো নয় সে। 

মধুজা বাংলা কবিতা পড়ে, একটা ব্যক্তিগত ডায়েরিতে কবিতা লেখে, স্কুলে পড়ায়। আজীবন মধুজা একই ভাবে সকালে উঠে জল খায়, চা করে টিফিন বানায় তারপরে স্নান করতে যায়। স্নানের পরে বাথরুমে অদ্ভুত গন্ধ রেখে আসে । ওই গন্ধটা  জানান দেয় সে আমার স্ত্রী, আমার প্রথম প্রেম। ওই গন্ধের অভিযোজন দেখেছি আমি। বছরের পর বছর একই জল আর সাবানের মিলিত ঘটনায় ওই গন্ধের আবেদন মজেছে। গেঁজে যাওয়া খেজুরের রস এবং ক্রমাগত ফেনা থেকে আরো বেশি ফেনা ওই গন্ধের ভিতরে জমে আছে। ওর স্নান আটকে রেখেছে আমার শরীরে।  আমার অবাক লাগে মধুজা আশ্চর্যভাবে একটা কাজই বছরের পর বছর ধরে করে আসতে পারে কিভাবে। একই ধরনের সাবান, পোশাক, একই সময়, রুটিন, সাজ, একই পুরুষ, একটাই স্মৃতি, একটাই চাওয়া একটাই আবর্ত মধুজার ভিতরে কিভাবে বেঁচে থাকে জানিনা। যতবার আমি ওর সঙ্গে পথ চলতে চলতে পিছিয়ে পড়েছি, ততবার অবাক হয়ে দেখেছি ও অবিচল রয়েছে একটা নির্দিষ্ট সরলরেখায়। 

আমাদের সন্তান হয়নি। পরিবর্তে বাড়ির বাগানে আমরা গাছ পুঁতেছি। আঠারোটি বিভিন্ন ধরনের শক্ত ও মোটা কান্ডযুক্ত গাছ এবং  পঞ্চাশটি গুল্মলতা ও বীরুৎ শ্রেণীর কাঞ্চন, জবা, কামিনী, গন্ধরাজ আমাদের সুগন্ধের সন্তান। পনেরো বছর ধরে মধুজা ওদের জল দেয়, সার দেয়, ডাল পাতা ছেঁটে সীমাবদ্ধ করে গতি ও প্রকৃতি। 
আমি ওর ধারাবাহিকতার সুখ গায়ে মাখি। এখনো আমি মাদকতা খুঁজে পাই ওর বুকের বাঁ দিকের লাল তিলে, নরম পেশীর ভাঁজে জমে থাকা ঘামে। মধুজা ঠেলে দেয় আমাকে, বলে,   – সরো! ওই মসৃণ শান্ত উচ্চারণ আমাকে পনেরো বছর ধরে বিভ্রান্ত করে আসছে।– সরো... কিন্তু শরীরের অতলে তলিয়ে যাওয়া শ্বাস প্রশ্বাস বলছে সরে যেও না। সে যেন বলছে সরে যাও তবে পুরোটা যেওনা যেন। কিছুটা থাকো। পরমুহূর্তে যেন আবার তোমাকে কাছে পাই, ঠেলে দিতে পারি। যেন আবার বলতে পারি, সরো...। 

আমি শিল্পী নই, কবিতা লিখিনা, ছবি আঁকিনা, সেতার, গিটার কিছুই বাজাতে পারি না। যদি পারতাম মধুজার একটা মূর্তি বানাতাম নিজে হাতে। রামকিঙ্করকে সাক্ষ্য রেখে বানাতাম। অন্ধকারের মোমবাতি আর মশার কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকত  আমাদের আঠারোটি বিভিন্ন ধরনের শক্ত ও মোটা কান্ডযুক্ত গাছ এবং  পঞ্চাশটি গুল্মলতা ও বীরুৎ শ্রেণীর কাঞ্চন, জবা, কামিনী, গন্ধরাজ। আমি রামকিঙ্করের আকাশ ছোঁয়া মাথার দিকে তাকিয়ে, মাটির মধুজা বানাতাম। ওঁর বেয়াল্লিশ বছর বয়স সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যেত। 

কিন্তু তবুও আমাদের সম্পর্কটা একটা অতীতকে ঘিরেই টিকে আছে। একবার মাত্র, মাত্র একবার ভুল করে অদিতির হাত ধরে চলে গেছিলাম টেথিস সাগরে। একবার মাত্র বোটানি অনার্সের অদিতির সঙ্গে একটা উত্তেজনার দুপুরে ভুলে গেছিলাম মধুজাকে। সম্পর্ক ছুরির ফলার মতো ঢুকে পড়েছিল সংসারে। শরীরকে আমরা হালকাভাবে নিতে পারিনা কেন? একটা স্টিমিউল্যান্ট তার কাজ করল, চলতে চলতে একটা গাছের ডাল ভেঙে পড়ল তোমার কাঁধে। পড়ল তো পড়ল, কী এমন এলো গেলো ওতে। আমি সারাটা জীবন ধরে ভালোবাসি বলে একই সাবান দিয়ে স্নান করে যাব? আমি পারিনি মধুজা, তুমি কেন পারো? একবার অদিতির হাত ধরে বহুদূর চলে গেছিলাম বলে মধুজা অর্ধেক হয়ে গেল। যতবার ওকে বুকে পাই ওর অর্ধেক বুক পাই বাকিটা ও গাছেদের দিয়ে দিল। সে দিক, তবুও আমি মধুজা সর্বস্ব। 
ও যখন জানতে পেরেছিল, বাড়িতে ফিরে আসার পর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করেছিল, কেন?  কেন গোপন করলে এ সমস্ত? 
আমি একটা ছ‍্যাঁচড়া চোরের মতো, ঘুষখোর কেরানির মতো স্বীকারোক্তি মাখানো কিছু এলোমেলো শব্দ সাজাতে চেষ্টা করছিলাম। ও বলল, – ছেড়ে যেতে চাও? ছেড়ে যেতে হলে কাগজপত্র বানাও। আমি সই দিয়ে দেব। কিছু দিতে হবে না পরিবর্তে। 
আমি দুহাত জোর করে ওর পায়ের কাছে বসে পড়লাম, ক্ষমা চাইলাম। আমার চোখ দিয়ে ওর চোখের জল গড়িয়ে পড়ল। 

ক্ষমা ছাড়া মহানুভব মানুষদের কাছে আর কী শাস্তি চাওয়া যেতে পারে? আমি তুচ্ছ শারীরিক নাশকতা এড়াতে না পারা পুরুষ। লাল রঙের পুষ্ট বিষফল আমাকে টানে। আমি সাড়া দিই। রাতে শুয়ে স্বপ্ন দেখি, ওই লাল রঙের পুষ্ট ফল আমি দুহাতে রগড়ে চটকে মুখে ঠোঁটে দাঁতে ঘষে ফেলছি। আমার নতুন লাক্স কোজি পেনটুলুন আর্দ্রতার অপরাধে ডুবে মরে। ঘুম ভেঙে উঠে সেই একই হাত জোড় করে ভগবানের কাছে ক্ষমা চাই, বলি আমার আশ্রয় কেড়ো না মধুজা, আমার একটাই আশ্রয়, একটাই ভগবান, একটাই দোতলা বাড়ি আমি রোজগার করেছি। 
আমাকে ফিরিয়ে নাও, গিঁট দিয়ে রাখো আচঁলে। শনি মঙ্গলবার দেখে সর্ষে লঙ্কা পোড়াও। 

মহানুভবতা বিষয়টা এত গ্লোরিফায়েড আমাদের কাছে যে তাদের অস্বাভাবিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। তাদেরকে বলা যায় না প্রবৃত্তি একটা শারীরিক প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। তার সঙ্গে নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। বোটানির মতো একটা বিষয়ের প্রফেসর যে নিজের সমস্ত মেধার পুষ্টি, গবেষণা আর ছাত্র পেটানোর পাতে বেড়ে দেয়,  প্রাতিষ্ঠানিক লুঠতরাজ এর বিরুদ্ধে খোলা বাজারে মত প্রকাশ করে, ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য যেকোনো রঙের ছাতা ব্যবহার করেনা তার হরমোনের শারীরবৃত্তীয় ক্ষরণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, মেডিটেশন করার সময় থাকেনা। পতন পাতা ও ফলের স্বাভাবিক ধর্ম। 

অতএব আমি মধুজার আশ্চর্য পবিত্রতা এবং মনোগ্যামি মানসিক পরিকাঠামোর কাছে ছোট হয়ে যেতে চেয়েছি নিরাপত্তার অভাবে। ঘর আমার একমাত্র আকাশ, মধুজা একমাত্র সূর্যোদয়। সে আমাকে দুহাতে তুলে নিয়েছে, বলেছে,– ওঠো, সভ্য হও পশুপালন করো, ধানের মুঠো ধরো। আমি অবাক হয়ে দেখেছি, ওর মাথা থেকে দ্যুতির প্রকাশ ঘটছে,  বৃত্তাকার আলোকবর্তিকার মধ্যে মধুজা স্বয়ং ভগবান হয়ে ধান দুর্বা আর ধর্মগ্রন্থ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অতএব হে নাস্তিক পুরুষ তুমি বৈদিক হয়ে পড়েছ মধুজার পাকরসে। এবার অশ্রুতপূর্ব হয়ে ওঠো! 

কিন্তু যে দেবী আসনে থাকেন, তিনি মানুষের কোলে বসেন না, অন্তত আমার মতো পলিগ্যামি সাপোর্ট করা পুরুষের কোলে তো রিভল্যুশন হলেও বসবেন না। মধুজাও বসে নি। তাই ওঁর অর্ধেক আলো দরজার নিচ থেকে জিনত আমনের বুকের মতো বেরিয়ে এলো। রোজ রাতে ওই আলো আমাকে পোড়ায় নরকের আগুনে। সেতার বাজতে শুরু করে আমাদের দূরত্বে। এখনো সে বাজে।

আমার চোখ দিয়ে মধুজা গড়িয়ে পড়ে জল হয়ে। আমি চশমা চোখে দিয়ে টেবিলে বসি, খাতা খুলে দেখি  সপুষ্পক উদ্ভিদের জাইলেম-এর জল ক্রমহ্রাসমান চাপের গ্রেডিয়েন্ট বরাবর নিষ্ক্রিয়ভাবে চলে যাচ্ছে। 
নিত্য ঘটনাও মেলানকলিতে অনিত্য হয়ে ওঠে বন্ধু।  

পরবর্তী দৃশ্যে যা ঘটে  তার শিরোনামে বলা যেতে পারে, শারীরিক যাবতীয় সাপ্রেশনের মানসিক ফলাফল হল ডিপ্রেশন। 

মধুজা ফুলের ইঙ্গিতে কথা বলে। আমাদের আঠারোটি বিভিন্ন ধরনের শক্ত ও মোটা কান্ডযুক্ত গাছ এবং  পঞ্চাশটি গুল্মলতা ও বীরুৎ শ্রেণীর কাঞ্চন, জবা, কামিনী, গন্ধরাজকে জল দেয়, সেবা করে, পাতা ছেঁটে দেয়। 
আমি এটিজোলা ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ এ স্ট্যান্ড নিই। ডিপার্টমেন্টের বিশ্বরূপ বলে, কাউন্সিলিং করাও, একজন সুন্দরী সাইকোলজিস্টকে দেখাও, সুস্থ হবে। 

খোঁচা জিনিসটা শরীর স্পর্শ করার আগে মন ছুঁয়ে ফেলে। হুল ফোটায়। আমার পিশাচ সর্বস্ব মন বিশ্বরূপের জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চায়। শালা প্রশাসনের দালাল। টাকাখোর, মাগীবাজ, শালার প্যান্ট টেনে ছিড়ে দিলে ফরফর করে কালো টাকা উড়ে যায় বেনামে কেনা নতুন জমি আর ঝকঝকে ফ্ল্যাটে। সে কিনা আমাকে খোঁচায়। 

ক্রমশই একটা কনশাস কেওস তৈরি হচ্ছিল আমার বিরুদ্ধে। একটা নিপাট ভদ্রস্থ ষড়যন্ত্র যা বহুদিন ধরে এভিডেন্স এর জন্য শাটার উঁচিয়ে অপেক্ষা করছে। আমি রাত হলে এটিজোলা খাচ্ছি, দিনে লোবোজম। আমার চোখের উপরে বসে জিনত আমন রাম নাম করে।  আমি প্রতিবার ভাবছি ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো। এত কালো মেখেছি দুহাতে এতোকাল ধরে'... 

তারপর সেইদিন এলো।  হেমন্তের পোস্টম্যান এসে বলল, থামো, চুপ করো!  এখন শক্তি চাটুজ্যে পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করা একটা শরীর নিয়ে তোমার মাথার ভিতরে ইজিচেয়ার টেনে বসবেন। 
হেমন্তের ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল আমার শরীরে। এই হেমন্তই তো একদিন ষড়যন্ত্র করে উপল ব্যানার্জীর সিনেমাটোগ্রাফিতে মধুজার ট্রানজিশন এনেছিল। 

আমি দু পেগ হুইস্কি গ্লাসে ঢেলে বসলাম শক্তি বাবুর সঙ্গে। তিনি মিটিমিটি হাসতে থাকলেন, ষড়যন্ত্র ভরা ওর হাসির চোখ আমার ফোনের দিকে। উপর থেকে দৈববাণী হলো, –ওরে ক্যালানে, ফোনটা খুলে দেখ। আমি যন্ত্রচালিতের মতো ফোন হাতে নিতেই দেখলাম লাল রঙের ইশারা আমাকে জিজ্ঞাসা করছে, হোয়াটস আপ ম্যান? পরপর বেশ কয়েকটা ভিডিও। একটা অন্ধকার ঘরে একটা পুরুষ প্রতিকৃতি একজন নটি বিনোদিনীর সঙ্গে! কে তুমি রাই? তোমার অঙ্গে শ্যামের নীলবর্ণ উলঙ্গ দেহ পাশা খেলে কেন? তুমি আমার যন্ত্রে এলে কিভাবে? আস্তে আস্তে ছবিগুলো ঝাপসা হচ্ছিল আমি বোধহয় ঘুমিয়ে পড়ছিলাম।

পরদিন আমার জীবনের বক্স অফিসে উপল ব্যানার্জী দ্বিতীয়বার ব্লকবাস্টার হিট হয়ে গেল। কলেজের সমস্ত টুলোপন্ডিত এবং ছাত্রদের হাতে হাতে সেইসব ভিডিও পৌঁছে গেল।  ভিডিওতে দুটি অস্পষ্ট প্রতিকৃতি খাজুরাহোর ভিডিওগ্রাফি ডিসপ্লে করছেন আর ডমিনেটিং মেল পার্ট এর গলা প্রমাণ করছে যে সে প্রফেসর উপল ব্যানার্জীর চরিত্রকে রিপ্রেজেন্ট করছে। মস্করা এতদূর যাবে আমি সত্যি ভাবতে পারিনি। সুদুরে পারি দেওয়া অদিতি সেন ছাড়া আমি আর কারো সাথে পর্বতারোহণ করিনি। আমি শুধু বাথরুমে মধুজার স্নানের গন্ধ শুঁকি। জিনত আমনের অর্ধেক বেরিয়ে থাকা বুক দেখি। কিন্তু বিশ্বাস বহুত ডেলিকেট ভিজ হ্যায় বস। আমার মনে হয় এসব আসলে স্বপ্ন অথবা আমি গুরুতর কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছি। বাড়িতে ফিরি দ্রুত।  ঘুমাতে চাই, একটা লম্বা ঘুম আমাকে সুস্থ করে তুলবে হয়ত। মধুজা স্কুল থেকে ফিরে আমাকে চুমু খেয়ে ঘুম থেকে তুলে বলবে দেখো আমার বিয়াল্লিশ বছর কীরকম তাজা হয়ে গেছে। অতএব  মাধব এটিজোলা হয়ে আমাকে ঘুম পাড়াও। ঘুমানোর আগে চলো টোস্ট করি তোমার সখ্য। 

আর এই আজ ঘুম ভাঙল যখন বুঝতে পারলাম কতদিন এভাবেই ঘুমিয়ে ছিলাম। হাওয়ার উপর ভর করে আমি যেন ভাসছি। দেখতে পাচ্ছি আমার আঠারোটি বিভিন্ন ধরনের শক্ত ও মোটা কান্ডযুক্ত গাছ এবং  পঞ্চাশটি গুল্মলতা ও বীরুৎ শ্রেণীর কাঞ্চন, জবা, কামিনী, গন্ধরাজ ঘেরা সংসার। বহু উঁচু থেকে আমি যেন নেমে আসছি ঘরের জানালায়। দেখতে পাচ্ছি আমার রাই বসে আছেন।
কিন্তু মধুজার তো এখন বাড়িতে থাকার কথা নয়। এসময় সাধারণত ও স্কুলে রওনা হয়ে যায়। আজ কেন তবে ও সোফায় এভাবে বসে? সে তো নিয়মের বিপরীতে কোনোদিন যায়না। চারপাশে অসহ্য কয়েকজন লোক ওকে ঘিরে কেন? কলেজের হেড ক্লার্ক, ইকোনমিক্স ডিপার্টমেন্টের সামন্ত, ইবলিসের ডানহাত  বিশ্বরূপ, অ্যাকাউন্টসের এইচ ও ডি আর স্বয়ং তিমির ব্যানার্জী– কী আশ্চর্য ভি সি এসে আমার বাড়িতে আমার বউয়ের সঙ্গে কথা বলছে অথচ আমি এভাবে বাগানে পড়ে আছি। 
মধুজা ভ্রমরকন্ঠে বলছে, আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি লোকটা এত নীচে নেমে যাবে। বিশ্বরূপ ওর পাশে এসে বসল, হাতে হাত রাখল নিজের।
কানের খুব কাছে মুখটা নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলল। মধুজার ঠোঁটে সেতার বেজে উঠলো। তিমির ব্যানার্জী বললেন, আমরা তাহলে উঠি। বিশ্বরূপ তুমি মধুজাকে দেখো।

"A girl arose that had red mournful lips
And seemed the greatness of the world in tears,   
Doomed like Odysseus and the labouring ships   
And proud as Priam murdered with his peers;"

প্যানিক অ্যাটাক এলে ডক্টর বোস বলেছিলেন, ডিপ ব্রেথ নিতে। আমার শ্বাসে বাতাস বইছে না কেন? সমস্ত দৃশ্য অস্বচ্ছ বলে মনে হচ্ছে।  এতসব আশ্চর্য ক্লাইম্যাক্স একসাথে সত্যি হতে পারে না। অসম্ভব! এই সমস্ত দৃশ্যমন্ডলী কি তবে একটা যেকোনো স্বপ্নের অন্তর্গত?অথবা একটা দীর্ঘ ঘুমের ভিতরে আটকে পড়া কোনো সুড়ঙ্গ? 

তবে আমি এখন কী করব? আমাকে ওই কাচের জানলা ভেঙে ঘরে ঢুকে বলতে হবে, মধুজা তুমি আমাকে চিনতে পারলে না। ষড়যন্ত্র টের পেলে না, বুঝতে পারলে  না নরকের দরজা তোমাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে আমার আকাশ থেকে? তুমি শুধু একটাই সাবান মেখে গেলে মধুজা? একটাই দৃশ্যগত ছলনা মেনে এগিয়ে চললে সেতারের ঘরের দিকে।
কিন্তু আমি যে নিজেকে বহন করতে পারছি না। আমার শরীরের তল বুঝতে পারছি না। আমার ত্রিমাত্রিক চলন অচেনা ঠেকছে নিজের কাছে। আমার শরীর যেন আমার দখলে নয়, সে যেন এখন অন্য কারো।
এক অদ্ভুত আগুন যে জ্বলছে আমার শরীরে, একে কি করে নেভাব? 
আমার নিজেকে মধুজার কাছে টেনে নিয়ে যেতে হবে, যে করে হোক।
হঠাৎ ঘাড়ের কাছে কিসের যেন টান অনুভব করলাম। কে যেন তুলে নিল আমাকে। এত সহজ তুলোর মতো হালকা হলাম কিকরে। দেখছি ঘর ছাড়িয়ে, ছাদ ছাড়িয়ে অনেকটা উঁচুতে একটা গাছের উপরে কেউ যেন ফেলে দিল আমার দেহটা। আমি মুখ উঁচু করে দেখলাম ঠোঁট ফাঁক করে  মা ঘুঘু পাখি আমার মুখের উপরে ওর দুটো ঠোঁট নামিয়ে আনছে। আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করতে চাইলাম। এক টুকরো রুটি আমার মুখের ভিতরে গুঁজে দিল মা পাখি। স্বাদ পেলাম। তবে কি আমি পাখি হয়ে গেছি? নীলবর্ণ শ্যাম প্রকট হলেন গাছের পাতায়। এক মুঠো হেমন্তের হাওয়া ঘনীভূত করে বললেন, 
"Cast a cold Eye/ On Life, on Death./ Horseman, pass by!" 

মন্তব্যসমূহ

  1. বেশ অন্যরকম। ভালো।

    উত্তরমুছুন
  2. খুবই ভালো লেখা। বিশেষ করে ইয়েটসের প্রসঙ্গ লেখাটিকে অন্য একটা মাত্রা দিয়ে দিল।

    উত্তরমুছুন
  3. অসাধারণ অভিব্যক্তির প্রকাশ... মন ছুঁয়ে গেল। অপূর্ব লেখনী।

    উত্তরমুছুন
  4. ভাবনায় ঘুরপাক খেতে খেতে থেমে গেলাম স্লোমোশনে। খুব ভালো লাগলো ❤️

    উত্তরমুছুন
  5. আবেগকে লঘুভাবে না নিতে পারার চরমতম শাস্তি হয়তো ইয়েটসের কবিতার মতো নিজের লেখা এপিটাফ! কেউ সেটা অক্ষরে লেখেন! কেউ লেখেন অবদমিত নিঃশ্বাসে। ' race' কথাটা অন্যমাত্রায় নিলে, সত্যিই ' race' আর ' soul'- এর মধ্যে বেঁচে থাকার পাশাটা গড়িয়ে দেওয়াই মানুষের নিয়তি! যাপিত জীবনই তার একমাত্র সাক্ষী! " Ben Bulben" এরই মতো! উত্তুঙ্গ হয়েও যা নিস্তরঙ্গ! দহনজ্বালার বিস্তীর্ণ " পোড়ো জমি" হোক, অথবা প্রাণহীন ক্যাকটাস- প্রান্তর, পাথুরে প্রাণহীন দেউল অথবা দেউলিয়া শিকড়হীন মূল্যবোধ, আত্মবিচ্ছিন্নতার দোলাচল জীবন ও মৃত্যুর মাঝে একমাত্র অবলম্বন! তাকে রোধ করবে কে?
    কী যে ভালো লিখেছ, সোমা! বেশিরভাগ মুক্তগদ্যের মতো এলোমেলো ভাবালুতার শিথিল আঁকিবুকি মনে করে ৪ টে অনুচ্ছেদের পর ছেড়ে দিচ্ছিলাম! দিইনি! ভাগ্যিস শেষ করলাম। মুগ্ধ! এতগুলো মাত্রাকে অনুভবে ধরেছো! Pallab Ganguly

    উত্তরমুছুন
  6. দারুণ লাগলো, একটানে পড়ে ফেললাম।

    উত্তরমুছুন
  7. দারুণ একটা গল্প। পড়ে মুগ্ধ হয়েছি আমি।

    উত্তরমুছুন
  8. কি যে ভালো লাগল লেখাটা পড়ে... নিজেকে খুঁজলাম, কিছু মাত্রায় পেলাম। নৈতিকতা আর জীবন বেঁচে নেওয়ার তাগিদের মধ্যে সবসময়ই একটা দ্বন্দ্ব চলে, কেউ কেউ হারে, কেউ জেতেও। কিন্তু পুরোপুরি হার অথবা জিৎ কারোরই হয় না। শেষটা এত্ত সুন্দর!! ভাবার বাইরে...

    উত্তরমুছুন
  9. এখন পর্যন্ত সোমার যে কয়টা লেখা পড়েছি, আমার কাছে এটা সেরা। আধুনিক, টানটান, ঝকঝকে অথচ কিছুটা কুয়াশায় ঢাকা শিউলি গন্ধ নিয়ে একটা লেখা। দ্য সরো অফ ল্যভ থেকে কোটেশন লেখাটাকে অন্য মাত্রায় উত্তীর্ণ করেছে।

    উত্তরমুছুন
  10. অসম্ভব সুন্দর গদ্য, ভাবনা আধুনিক এবং পরিবেশন অভিনব।

    উত্তরমুছুন
  11. খুব ভাল লাগল। পৃথা চট্টোপাধ্যায়

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য