ঐন্দ্রিলা বন্দ্যোপাধ্যায়
মেঘলা দিনে পাইন বনে
স্বর্গ বলে যদি কিছু থাকে তবে তা পাহাড়। তাই পাহাড়ের কাছে ছুটে যাই বারবার। এখানে মেঘ ছুঁয়ে থাকে গাছে গাছে। এমনই এক বিকেলে নেতারহাটে পৌঁছে গেলাম মেঘ জমে থাকা অঝোর ধারা মাথায় নিয়ে। ছোটো ছোটো টিলার উপর গাছেরা মাথা উঁচু করে স্বাগত জানাচ্ছে। পৃথিবীর ওপারে আরও এক মায়াময় নিঝুম পাইন উপত্যকা ডাকছে আয় আয়!
আরও গভীর বনভূমিতে রহস্যময় ডাক শুনতে শুনতে পৌঁছে যাচ্ছি আমি। এখানে নীরবতা সর্বক্ষণ ঘিরে রেখেছে আমাকে।
যতদূর চোখ যায় সবুজে সবুজ উপত্যকায় পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম ম্যাগনোলিয়া ভিউ পয়েন্ট বা সুইসাইড পয়েন্টে। এখানে ভালোবাসা নাকি আর্তনাদ হয়ে ভেসে আসে কোন কোন রাতে। কোন এক কালে ইংরেজদের বর্ণবিদ্বেষী মনোভাব ভালোবাসায় বাধার সৃষ্টি করেছিল। ফল হিসেবে বিষ খাইয়ে উপজাতি ছেলেটিকে হত্যা করেছিল এবং সেই দুর্বিষহ যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ম্যাগনোলিয়া আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। এই সুন্দর ধূসর সবুজ পাহাড় আজ মৃত্যু উপত্যকা হিসেবে পরিচিত। হায় ঈশ্বর! সুন্দর কি তবে মৃত্যু ডেকে আনে!
"আমি সুদূরের পিয়াসী "
বিবাগী মন তখন ছুটে চলেছে সৌন্দর্য দেখার নেশায়।সন্ধে নামার মুহূর্তে পাইন উপত্যকায় চলেছি অদ্ভুত একরকম টানে। ঝিঁঝির ডাকের সাথে কাঠ ঠোকরার আওয়াজ মিলিয়ে এক অদ্ভুত রহস্য,রোমাঞ্চ শিহরণ জাগায়। ফিরতে চায় না এই মন। কি নিবিড় এই টান! জাল বিছিয়ে দেয় দূর থেকে বহুদূরে...
যেন তৃষ্ণার্ত পথিককে নিয়ে যেতে চায় অচেনা গহন অরণ্যে। এই বৃষ্টির মরসুমে ফেরার পথে দেখছিলাম ধীরে ধীরে পাহাড় ডুবে যাচ্ছে অনন্ত কুয়াশায়। আঁধার নামছে গাছেদের মাথায়,এক নির্জন শীতলতায় ডুবে যাচ্ছে অতি প্রাচীন রূপকথার বনভূমি।
রাতে হোম স্টের দিদিদের হাতের তৈরী গরম ভাত আর সুস্বাদু দেশী মুরগীর ঝোল দিয়ে পেটপুজো সেরে শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছি মায়াবী পাইন বন আমাক হাতছানি দিয়ে ডাকছে, শুনতে পাচ্ছি বন থেকে ভেসে আসা নানারকম আওয়াজ। রাত কেটে গিয়ে সূর্যিমামা ফুটে উঠলো ঘন পাইন পাতার ফাঁকে।আমরা আলো ছায়ার খেলা দেখতে সামিল হলাম পাইনের বনে। দূরের পাহাড়গুলো থেকে কুয়াশা সরে গিয়ে ঝলমলে রোদ এসে পড়ছিল নাম না জানা রঙিন সব বুনো ফুলের গায়ে। পাহাড়গুলোকে দেখে হাতির মতো মনে হচ্ছিল।
সাপের মতো আঁকাবাঁকা পিচের রাস্তা দিয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল ঘাগরি জলপ্রপাতের দিকে। পথের দু'ধারে ন্যাসপাতি বাগানে ফলে রয়েছে রাশি রাশি ন্যাসপাতি। পাহাড়ি রাস্তায় কিছুক্ষণ বাদে বাদে দেখছিলাম দুএকজন স্হানীয় পথচলতি মানুষ। তাদের কেউ কেউ ছোট বাচ্চাকে পিঠে বেঁধে কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে,আবার কেউ পাহাড়ি ঝোরা থেকে জল ভর্তি হাঁড়ি মাথায় আর বালতি হাতে মাইলের পর মাইল হেঁটে চলেছে। তাদের চোখে মুখে কোনো ক্লান্তির ছাপ দেখিনি। বরং মহানন্দে তারা তাদের কাজ করে চলেছে।
প্রায় আড়াইশো সিঁড়ি পেরিয়ে আমি দূর থেকে তাকে দেখে মুগ্ধ দু'চোখে চেয়ে থাকি। আপন ছন্দে নৃত্য পটীয়সীর মতো লাস্যময়ী রূপ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে দশম জলপ্রপাত, আর তার ঝাপটায় আমি ভিজে যাচ্ছি। শীতল এ শরীর মন জুড়ে রামধনু রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছে পাহাড়ি ফুল। ওদের দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে আমার। এ কী স্বপ্ন না সত্যি! কে যেন কানে কানে এসে বলছে " ফুলে ফুলে ঢোলে ঢোলে বহে কিবা মৃদু বায়"।
দুর্গম পথে চলতে চলতে কষ্টের থেকে তখন আনন্দ অনেক বেশি। তাই ভরপুর শ্বাস নিয়ে উপরে উঠছি বিশ্বের চৌদ্দতম উচ্চ জলপ্রপাত লোধ এর সৌন্দর্যে চোখ সার্থক করে নিতে। অবিশ্রান্ত ধারা আছড়ে পড়ছে পাথরের উপর আর খরস্রোত নিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি পথ বেয়ে। দূরে একটি পাথরের উপর এক আদিবাসী বৃদ্ধকে বসে থাকতে দেখলাম ছিপ হাতে নিয়ে। এই পাহাড়ি ঝর্ণার জল দুরন্ত স্রোত নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় এমনকি মাঝে মাঝে পিচের রাস্তার উপর দিয়েও বয়ে চলেছে। এই জলকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সব্জির চাষ করা হচ্ছে।পাহাড়ের উপরে কিছু সমতল জায়গায় জল ধরে রেখে ধান চাষ করা হয়। এছাড়া এখানকার প্রধান ফসল হল ভুট্টা।
নাম না জানা গাছেদের হাত ধরে পৌঁছে গেলাম রাঁচির জোনা জলপ্রপাতের একেবারে সামনে। মুহুর্মুহু গর্জনে একসাথে হাত ধরাধরি করে অনেকগুলি জলধারা ধেয়ে আসছে। একফালি ক্ষয়ে যাওয়া পাথর খন্ডের উপর বসে একমনে দেখতে লাগলাম সেই নৈসর্গিক দৃশ্য। যেন প্রকৃতি এখানে তার রুদ্র রূপ দেখাবার আশায় যুগ যুগ ধরে বয়ে চলেছে। ক্ষণিকের জন্য আমার গায়েও কিছু চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেল জলকণারা।
খরস্রোত নিয়ে কোয়েল নদী আমার সব দুঃখ ভুলিয়ে কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে পাথরের ফাঁক দিয়ে। এই অনন্ত যাত্রাপথে গাছে গাছে পাখিদের আসা যাওয়া দেখতে দেখতে দুপুর ফুরিয়ে বিকেল নেমে এলে পাহাড়ের কোণে সূর্যাস্তের রঙ সবুজ বনভূমিতে অপূর্ব এক মায়া সৃষ্টি করে। যেন ঈশ্বর স্বয়ং বসে এঁকে দিয়েছেন নীল আকাশে সবটুকু সবুজ রং দিয়ে,এই উপত্যকার নাম পত্রাতু উপত্যকা। ইংরেজি ইউ অক্ষরের মতো এই সবুজ গালিচা নেমে চলে গেছে শান্ত, শীতল, জমাট কুয়াশায় আচ্ছন্ন পত্রাতু লেকের দিকে। ধীরে ধীরে আমিও নেমে আসি সেখানে।
পাহাড়ি রাস্তায় পশু বলতে দু'একটা পাহাড়ি লোমফোলা সুন্দর কুকুর। এছাড়া গরু, ছাগল,ভেড়া আর মুরগী চরে বেড়াচ্ছে। চড়াই উতরাই পথের বাঁক ধরে যেতে যেতে অসংখ্য বাদরেঁর কিচকিচ আওয়াজ,অঙ্গভঙ্গি আর নিঝুম নিরালায় মাঝে মাঝে দু'একটা পাখির ডাক শুনতে শুনতে দেড়শো সিঁড়ি পেরিয়ে এলাম সীতার কাছে। উচ্চতা বেশ অনেকটাই এই জলপ্রপাতের। পাহাড় থেকে পড়ে গাছগাছালির মধ্যে মিশে যাচ্ছে। বিশাল বড় বড় গাছগুলোকে মাঝে মাঝে পালোয়ানের মতো দেখতে লাগছিল।
মোষের ঘন দুধ আর এলাচ দিয়ে তৈরি সুগন্ধযুক্ত চা শরীর ও মন অনেকটাই সতেজ করে দিলো। সন্ধের উষ্ণতা গায়ে মেখে এবার বাবা ভোলানাথের নামে পাঁচশো সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ে চড়লাম। শত শত উজ্জ্বল আলোয় গোটা রাঁচি শহর তখন আলোকময়। বাবার থানে অশথ গাছে ঢিল বেঁধে চলছে মনস্কামনা পূর্ণতার আকাঙ্খা। চরণামৃত ও প্রসাদ বিতরণ ও ঢাকঢোল বাজিয়ে নানান উপাচার।
ভরা শ্রাবণে মন বড়ই বেপথু হয়। ধ্বনি যেখানে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে প্রতি মুহূর্তে এমনই এক উন্মত্ত নেশায় ছুটে প্রায় সাড়ে সাতশোর বেশি সিঁড়ি অতিক্রম করে ইচ্ছে পূরণ হয় হুড্রুর কাছে গিয়ে। গাঢ় সবুজ রঙের পাহাড় থেকে নেমে আসছে হুড্রু জলপ্রপাত আর বিশাল বিশাল পাথরের ফাঁক দিয়ে বয়ে চলেছে আপন ছন্দে। পায়ে পায়ে উপরে উঠতে লাগলাম, এবার ব্যাথা অনুভব হতে লাগলো। পা আর চলছে না সেইসাথে শরীরও। অতিকষ্টে ধীরে ধীরে উঠে এলাম উপরে। কিন্তু অজানাকে জানতে আর অচেনাকে চিনতে গিয়ে নতুন করে আরও আকাঙ্ক্ষা জাগে এ মনে। বারংবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে এই ক'দিনের বাঁধনহীন জীবন। তবুও ঘরে ফিরতেই হয় বাঁচার একমাত্র রসদ এই স্মৃতিটুকু নিয়ে।
ভারি সুন্দর মায়াবী লেখা।
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর ভ্রমণ কাহিনি। ভালো লাগল।
উত্তরমুছুনBah darun hyeche re
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর বর্ণনা। মন ভালো হয়ে যায় লেখনী পড়ে।। 👌👌☺️☺️
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগলো পড়ে
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগলো পড়ে
উত্তরমুছুন