তপন রায়চৌধুরী
বলতে নেই
হ্যাঁ, ঠিক কথা। সত্যিই বলতে নেই। খারাপ কথা বলতে নেই। দুঃখের কথা বলতে নেই। বললেই দুঃখ পাবে মানুষটা। ভালো কথাও বলতে নেই। কেন ভালো কথা বলতে নেই? ভালো কথা শুনলে তো ভালো লাগবে। ঠিক কথা। আজ ভালো লাগবে, কিন্তু কাল ভালো লাগতে নাও পারে। সে আবার কীরকম?
সুছন্দার কথাই বলছি। আমার বউ সুছন্দা। বিয়ের দশ দিন বাদেই সুছন্দাকে আবেগের বশে বলে ফেললাম, “জানো সুছন্দা, মনে হচ্ছে, দশ দিন নয়, কত যুগ যুগ ধরে তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক! কী ভালো লাগছে, তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না।“
সুছন্দা পরম মুগ্ধতায় চেয়ে থাকে আমার দিকে। অস্ফূটে বলে ওঠে সুছন্দা, “আমারও তাই মনে হয়!”
পাঁচ বছর কেটে গেছে।
আমার সেই কথাটা মনে এল আজ। আমি কি আজ সুছন্দাকে সেই কথাটা সেই আবেগ নিয়ে বলতে পারব? কিংবা সুছন্দাও আমাকে কি ...? আমি কি সুছন্দাকে একবার জিজ্ঞেস করব, সে কি আমাকে ...? কেমন বোকা বোকা লাগবে না? কই, সেদিন তো আমার নিজেকে একেবারেই বোকা বোকা মনে হয়নি? তবে আজ কেন? কী এমন ঘটল এই পাঁচ বছরের ব্যবধানে? কোনো উত্তর নেই আমার কাছে। আমি নিশ্চিত, সুছন্দার কাছেও এর কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিছু বলতে গেলে সুছন্দা হয়তো কয়েকটা এমন কথা বলবে তাতে আমার দুঃখ বাড়বে বই কমবে না। সেই ভয়ে সুছন্দাকে আমি আজ ওইসব নিয়ে কিছু বলতে পারব না। তার চেয়ে এই বেশ আছি। এইভাবেই বোধহয় আমাদের ভেতরে ‘বলতে নেই’-এর পাহাড় জমতে থাকে!
তবুও ভাবি, নিজেকে বিশ্লেষণ করি, আমি কী করে সুছন্দাকে সেদিন সেই কথাটা বলতে পারলাম? আর, আজ পারছি না কেন? তাহলে কি সেদিন ভুল বলেছিলাম? নাকি সেদিনই ঠিক বলেছিলাম, আজ আমার অধঃপতন হয়েছে, তাই বলতে পারছি না? সেদিনের আমি ঠিক, নাকি আজকের আমি? এক অদ্ভুত সংকটের মধ্যে নিজেকেই ফেলে দিয়েছি আমি! তাই মনে হচ্ছে, সেদিন ওই কথাটা না বললেই যেন ভালো হত! তাহলে আজ এই সঙ্কটের মধ্যে পড়তে হত না। বড্ড মেকি, অভিনয় আর বড় বেশি উচ্ছ্বাস ছিল কথাগুলোর মধ্যে! আমার আমি বোধহয় ঠিক কথা বলেনি সেদিন! নাহলে আজ এরকম সঙ্কট কেন? আর, এমন সঙ্কটের মধ্যে থাকলে মনের ভারসাম্য নষ্ট হয়, কাজের ক্ষতি হয়। তাই সোজাসাপটা ভাবনা, বেশি কিছু কথা বলতে নেই। অন্তত বলার আগে ভাবনা-চিন্তা করা উচিত। যা আজ বলতে পারছি, তা দশ বছর বাদেও যেন বলতে পারি। কিন্তু তা হয় কি? তা কি সত্যিই কোনোদিন হয়?
সেদিনের কথাই ধরি না কেন, রবিদা গল্পপাঠের আসরে মৃণালের গল্পের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। বাকিরা সবাই কম-বেশি নিন্দা এবং প্রশংসা করলেন। আমারও গল্পটা তেমন মনে ধরেনি। তবে রবিদার সঙ্গে আমার তুলনা! কোনো মানেই হয় না। সাহিত্যিক রবিদাকে আমরা সবাই উচ্চাসনে বসিয়ে রাখি, সাহিত্যে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য। রবিদা একাধারে গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, কী নয় রবিদা! গল্পটা মোটেও তেমন জুতসই ছিল না, অন্তত আমার সেরকম মনে হয়েছে। কিন্তু আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে রবিদা কত সব ভালো ভালো কথা বলে গেলেন গল্পটি নিয়ে!
অনুষ্ঠান শেষে রবিদাকে চেপে ধরলাম, “কী ব্যাপার রবিদা, এত দারুণ দারুণ সব কথা বললেন, গল্পটি নিয়ে! সত্যিই কি ...”
রবিদা হেসে বললেন, “আরে বাবা! আমারও গল্পটা বাজে লেগেছে, কিন্তু ইচ্ছে করেই বলতে পারিনি খারাপ কথাগুলো।“
“কেন?”
আমি ছাড়ার পাত্র নই। রবিদা বললেন, “দুঃখ পেত মৃণাল।“
বললাম, “এটা কি মৃণালের জন্য ভালো হল? ওর কাছে তো ভুল বার্তা গেল।“
রবিদা বললেন, “সব কথা সবসময় বলতে নেই।“
সেই ‘বলতে নেই’-এর গাড্ডা! রবিদাও সেই গাড্ডায় পড়ে গেলেন! রবিদার মতন মানুষ! রবিদা কি ঠিক করলেন? রবিদা আমাদের আদর্শ। আমি কি সুছন্দাকে সেদিন কথাগুলো বলে ভুল করেছিলাম? আমারও কি না-বলা উচিত ছিল? কারণ, আজ তো আমি কথাগুলো বলতে পারছি না! কেন? তাহলে কীভাবে চলব আমি ভবিষ্যতে? কীভাবে? আমি জানি না। আমি কিছুই জানি না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন