সৌম্য ঘোষ






 রবীন্দ্রনাথের কবিতায় বৈষ্ণব ভাব ও ভাবনা

              

            রবীন্দ্র সাহিত্য সৃষ্টির অন্দরমহলে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন প্রসঙ্গে বৈষ্ণব কাব্য-কবিতা, গান ও কীর্তনের প্রভাব দেখা গেছে। তাঁর গান, কবিতা ছাড়াও গল্প, নাটক, উপন্যাস ও প্রবন্ধে পাওয়া যায় বৈষ্ণব প্রসঙ্গ। বৈষ্ণবপদাবলী অনুকরণে  তিনি রচনা করেন "ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী" (১২৯১)। সমালোচক অজয় কুমার চক্রবর্তী মন্তব্য করেন:----
           "বৈষ্ণব কবিতার ভাষা-মাধুর্য, ছন্দ-লালিত,তাহার লোকত্তোর মহিমা তরুণ কবির হৃদয় মথিত করিয়াছিল। তাহারই ফলে "ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী" রচিত হইয়াছিল।" 'ব্রজবুলি' ভাষার অনুকরণ দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'তে প্রথম কবিতার মধ্যেই--

"গহণ কুসুম কুঞ্জ মাঝে
মৃদুল মধুর বংশী বাজে
বিসরি ত্রাস লোক লাজে
সজনি, আও আও লো।
অঙ্গে চারু নীল বাস,
হৃদয় প্রণয় কুসুম রাশ,
হরিণ-নেত্রে বিমল হাস,
কুঞ্জ বনমে আও লো।"

              বৈষ্ণব পদাবলীর ধারক ও বাহক জয়দেব গোস্বামীর 'গীতগোবিন্দ' রবীন্দ্রনাথের সবথেকে বেশি পছন্দের ছিল। জয়দেবের ভাব, ভাষা ও ছন্দ যে শুধু কিশোরকবি রবীন্দ্রনাথকেই মুগ্ধ করেছিল তা নয়, পরিণত বয়সের রবীন্দ্রনাথকেও প্রভাবিত করেছিল। তাই দেখা যায় জয়দেবের ----

"রতি সুখ সারে      গতমভিসারে
     মদন মনোহর বেশম।
নুকুরু নিতমিবণি     গমন বিলমবন
       মনুসর তং হৃদয়েশম্।"

এই পদের প্রতিধ্বনি রবীন্দ্রনাথের ভানুসিংহে প্রতিফলিত হয় এইভাবে-----

   "সতিমির রজনী     সচকিত সজনী
                শূন্য নিকুঞ্জ অরণ্য।
   কলয়তি মলয়ে    সুবিজন নিলয়ে
                 বালা বিরহ বিষন্ন।"

কিংবা ভানুসিংহের----

               বসন্ত আওলরে!
   মধুকর গুণ গুণ,      অনুয়া মঞ্জরী
               কানন ছাত্তল রে।"

            রবীন্দ্রনাথ ভানুসিংহের পদাবলীতে ভনিতা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বৈষ্ণব কবিদের ও বৈষ্ণব পদের রীতি অনুসরণ করেছেন। গোবিন্দ দাসের পদে যে মঞ্জুরী ভাবের ভনিতা দেখা যায় তা ভানুসিংহের পদেও দেখতে পাওয়া যায় ‌----

   "নদী মগন মহী, ভয় ডর কিছু নাহি,
                  ভানু চলে তব সাথ।"
বৈষ্ণব 'ব্রজবুলি' কাব্যের সঙ্গে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদের বহিরঙ্গের মিল বেশ গভীর। গভীরভাবে না পড়লে  ও  না ভাবলে এই সাদৃশ্য সহজে ধরা যায় না।
রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ প্রশান্তকুমার পাল তাঁর "রবিজীবনী" গ্রন্থের পাদটিকাতে চন্দ্রনাথ বসুর একটি সুন্দর মন্তব্য তুলে ধরেছেন----

"The sentiment of love is expressed in these sonnets in forms which are at once
so deep, delicate, tine, fervid and in verse
so full of the luxuriance of Music and
Melody that it is difficult to decide who are the better sonneteer the imitator
Bhanusinha Thakur is, or his Model the Baisnaba poet."  ( Ref.  প্রশান্ত কুমার পাল,   'রবিজীবনী' , ২য় খন্ড। বিশ্বভারতী। পৃ:২৭৬ )

               বৈষ্ণব পদাবলী ও ভানুসিংহের কবিতা একই ধাঁচের হলেও ভাষার ক্ষেত্রে যথেষ্ট স্বাধীনতা গ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ আর এই কারণে ভানুসিংহের পদগুলি ব্রজবুলির হুবহু অনুকরণ হয়ে উঠতে পারিনি। আসলে বৈষ্ণব পদাবলী ও ভানুসিংহের পদাবলীর প্রভাবিত সম্পর্ক হল এই রকম---
          "ধ্বনির সহিত প্রতিধ্বনির যে সম্পর্ক বৈষ্ণব কবিতার সহিত 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'র সম্পর্ক তা হইতে কিছু বেশি নহে।" 
(Ref. হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত 'বৈষ্ণব পদাবলী', পৃ: ৬৫২)
           তাই রবীন্দ্র অনুভব এবং বৈষ্ণব অনুভব মৌলিকভাবেই আলাদা। আর আলাদা বলেই রাধাকৃষ্ণলীলার রসতত্ত্বের আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ না করেও বৈষ্ণবভাব প্রেরণাকে রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করে নিয়েছিলেন স্বাভাবিক প্রবণতায়।
নিজের কবিকল্পনায় উপনিষদ এবং বৈষ্ণব পদাবলীর সাহিত্য ধর্মের দ্বারা তিনি প্রভাবিত ঠিক হননি, অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। আর অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বলেই তাঁর কাব্য ধর্মীয় বাতাবরণকে ছিন্ন করে সাহিত্য হয়ে উঠেছিল, ধর্মীয় সাহিত্য নয়। বৈষ্ণব অনুভবের রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা সীমার সঙ্গে অসীমের প্রণয়লীলা। ‌ কৃষ্ণপ্রেমিকা রাধা মহাবিশ্ব জীবনের প্রতিনিধি এবং কৃষ্ণ আনন্দময় পরমাত্মার পরম পুরুষ। এই মহাবিশ্ব ও অসীমের সত্য সম্বন্ধটি রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি কাব্যে সুন্দরভাবে প্রকাশ করলেন।

"সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাইতো এত মধুর।
কতবর্ণে কত গন্ধে, কত গানে কত ছন্দে
অরূপ তোমার রূপের লীলায় জাগে হৃদয়পুর
আমার মধ্যে তোমার শোভা এমন সুমধুর।"
(Ref. 'গীতাঞ্জলি' পৃ: ৭৮)

             এই যে রূপের সঙ্গে অরূপের মিলন অর্থাৎ জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন সংঘটিত হচ্ছে;
এতে অনেকগুলি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। এই ধাপগুলি বৈষ্ণবীয়  ভাষাতে পূর্বরাগ, অনুরাগ,
মান-অভিমান, অভিসার, বিরহ-মিলন প্রভৃতি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বৈষ্ণব কবিতায় বিষয়টি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। কবির কাছে রাধাকৃষ্ণের প্রেমের ছবি ধরা পড়েছে; যে প্রেম চিরন্তনকালের শাশ্বতপ্রেম, যে প্রেম অগ্রসর হয় দুর্গম দুস্তর পারাবার অতিক্রমের মধ্য দিয়ে। এই কারণেই রবীন্দ্র অনুভব ও বৈষ্ণব অনুভবে মৌলিক পার্থক্য থেকেই যায়। তাই প্রভাবের কোন প্রশ্ন ওঠেনা; মূলকথা অনুপ্রেরণা বা অনুপ্রাণিত হওয়ার। 
              বৈষ্ণব পদাবলীর ভাষা, সুর,ছন্দ ও রূপ, কল্পনা রবীন্দ্রনাথের কবি জীবনে ও রবীন্দ্র কবিতার দেহ গঠনে ভানুসিংহের পদাবলী ছাড়াও অন্যান্য কবিতার মধ্যে বৈষ্ণব পদাবলীর সৌন্দর্য চিত্রের অনুসরণ দেখা যায়। রবীন্দ্র দেহমনে, অবচেতনাতেও বৈষ্ণব ভাবুকতা এক মুহূর্তের জন্য পরিহার করতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। (সূত্র: বিশ্বনাথ রায় 'বৈষ্ণব পদাবলী',পৃ: ৩৯)
                 ১২৯২ সালে শ্রীশচন্দ্র মজুমদার এবং রবীন্দ্রনাথ উভয়ে মিলে বৈষ্ণবপদ সংকলন "পদরত্নাবলী" প্রকাশ করেন। এই সময়ই বৈষ্ণব কবিতা চর্চায় গভীর মনোযোগ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‌ ফলে এই সময়ে লেখা "কড়ি ও কোমল"(১২৯০-৯৩) কাব্যগ্রন্থের বহু কবিতায় বৈষ্ণব পদাবলীর মানসিকতার প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা গেল। রবীন্দ্রনাথ "মথুরায়" কবিতায় কৃষ্ণ বিরহ যন্ত্রণা সুন্দর ভাবে প্রকাশ করেন। কৃষ্ণ বিরহে রাধাকে ডাকছেন ------

      "বাঁশরী বাজাতে চাহি বাঁশরী বাজিল কই?...
       এবার রাধে রাধে ডাক্ বাঁশি মনোসাধে,
       আজি এ মধুর চাঁদে মধুর যামিনী ভায়।
       কোথা সে বিধুরা বালা, মলিন মালতী মালা,
       হৃদয়ে বিরহ জ্বালা, এ নিশি পোহায়, হায়।"
              ( 'কড়ি ও কোমল', মথুরায়)

         বৈষ্ণব পদাবলী মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা। ‌ ধর্মীয় আধ্যাত্মিক পরিবেশকে বাদ দিলে; বৈষ্ণব কবিদের রচনা প্রেম, বিরহ, যন্ত্রণার কবিতা। এই বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ আত্মস্থ করেছিলেন। হলে তাঁর নিজের প্রেমের কবিতাগুলি হয়ে উঠেছিল বৈষ্ণবময়তায় ভরপুর।
জ্ঞানদাসের পদ----

        "শেজ বিছাইয়া রহিলুঁ বসিয়া
                    পথ পানে নিরখিয়া..."
এই পদের সঙ্গে 'বিরহ' কবিতার মিল লক্ষ্য করা যায়----

    "আমি নিশি নিশি কত রচিব শয়ন  
                  আকুল নয়ন রে..."
    
                বৈষ্ণব পদাবলীর মূলবাণী প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা; যে প্রেম অনন্ত অনাদি, যা দিয়ে আমরা ভগবানকে ভালোবাসি। 'প্রেম' বৈষ্ণব সাহিত্যে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন, যা রবীন্দ্রনাথ 'অনন্ত প্রেম' কবিতায় লিখলেন---

       "তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি
                         শত রূপের শত বার 
        জনমে জনমে, যুগে যুগে    
        অনিবার।..."

বৈষ্ণব পদাবলীর প্রেম ও প্রকৃতি বর্ণনার ধরণের সঙ্গে কবির মনে দানা বেঁধেছিল। 'মানসী' গ্রন্থে 'একাল ও সেকাল' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখলেন--

"আজও আছে বৃন্দাবন মানবের মনে।
                    শরতের পূর্ণিমায়
                    শ্রাবনের বরিষায়
 উঠে বিরহের গাঁথা বনে উপবনে।
 এখন যে বাঁশি বাজে যমুনার তীরে।
                   এখনো প্রেমের খেলা
                   সারাদিন, সারাবেলা‌ এখনো কাঁদিছে রাধা হৃদয় কুটিরে।"

বৈষ্ণব পদাবলীর ভাব ভাষা মাধুর্যের চরম উৎকর্ষের প্রভাব দেখা যায় "সোনার তরী" কাব্যের বহু কবিতার মধ্যে। বৈষ্ণব পদাবলী যে রবীন্দ্রনাথকে সর্বদা টানতো তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ জয়দেবের "গীতগোবিন্দ"; বিদ্যাপতি ও গোবিন্দ দাসের পদাবলী সুর করে বারে বারে পাঠ করতেন। রবীন্দ্রনাথ শুধু তাঁর কবিতার মধ্যেই নয়, বিভিন্ন প্রবন্ধ, উপন্যাস ও নাটক, গল্পের মধ্যেও বৈষ্ণব পদাবলীর পদ ও অনুসঙ্গ বারবার ব্যবহার করেছেন। বৈষ্ণব সাহিত্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই গভীর আত্মীয়তা প্রকাশ পায় 'ব্যর্থযৌবন', 'প্রত্যাখ্যান' ও 'লজ্জা' কবিতার মধ্যে। চন্ডীদাসের পদ ---
             "সই কেমনে ধরিব হিয়া।
  আমার বধুয়া আনবাড়ি যায়
             আমার আঙ্গিনা দিয়া।"

রবীন্দ্রনাথের 'প্রত্যাখ্যান' কবিতা---

      "সকাল বেলা সকল কাজে
       আসিতে যেতে পথের মাঝে
       আমারি এই আঙ্গিনা দিয়া..."
                                    
             বৈষ্ণব পদাবলী শুধুমাত্র দেবগীতি নয়, মানবজীবনের কাহিনীর বহিঃপ্রকাশও বটে। কারণ সকল মহাজনপদাবলীকার গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্রেক্ষাপটে পদ রচনা করেননি। ‌ চৈতন্য পূর্বকালে জয়দেব-বিদ্যাপতি-চন্ডীদাস তার প্রমাণ। কেবলমাত্র রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাই তাঁদের প্রধান কাব্যপ্রতিবিম্ব। চৈতন্য পরবর্তী কালে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের বাতাবরণে জ্ঞানদাস, গোবিন্দ দাস, বলরাম দাস, রায়শেখর প্রমুখ বৈষ্ণব পদাবলীকার তাঁদের ব্যক্তিগত প্রেমভাবনা কবি মনের অবচেতন অবস্থাতেই প্রকাশ করেছেন। তাই বৈষ্ণব পদাবলীর অতীন্দ্রিয় প্রেমকল্পনার মধ্যে মানবমানবীর চিরন্তন প্রেমলীলাকেই প্রত্যক্ষ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। পদাবলীর প্রকৃতিচেতনা তাঁর সৌন্দর্যব্যাকুল কবিমানসকে উতলা করলেও ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে তিনি পা বাড়াননি। আসলে বৈষ্ণব গান শুধুমাত্র দেবতার গান নয়; মর্তবাসী নর-নারীর প্রেমতৃষ্ণার গানও বটে। তাই কবি লিখলেন----

    "... একি শুধু দেবতার।
    এ সঙ্গীত রসধারা নহে মিটিবার
    দীন মর্ত্যবাসী এই নরনারীদের
    প্রতি রজনীর আর প্রতি দিবসের
    তপ্ত প্রেমতৃষ্ণা।"
_______________________________


ঋণ স্বীকার:

(১) অজয় কুমার চক্রবর্তী -- "রবীন্দ্রসাহিত্যে বৈষ্ণব প্রভাব"
(২) প্রশান্তকুমার পাল-- "রবিজীবনী"
      ২য় খন্ড। বিশ্বভারতী।
(৩) শশীভূষণ দাসগুপ্ত -- "বাংলা সাহিত্যে নবযুগ"।
(৪) ক্ষুদিরাম দাস --" বৈষ্ণব রস প্রকাশ"।

_______________________________


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য