সহেলী সেনগুপ্ত

 দু'চোখের ভিতর দিয়ে...



যেদিন তোমার এ চন্ডাল রাগ শান্ত হবে একটু, ঝুলবারান্দা থেকে উড়িয়ে দিও তিনটে টিয়া। বারান্দার এক কোণে ক্রিমরং বোগেইনভিলিয়ার যে টবটা আছে, তাতে ঝাঁঝরি দিয়ে জল দিও খানিক। গাছেরা জল বই বাড়ে না এতটুকু। ওহ, ঝাঁঝরি আছে চিলেকোঠার দেয়ালের তাকে তোলা। ধুলো পড়বে, তাই বন্ধ ঘরে রেখে এসেছিলাম। যেদিন তুমি একটুখানি শান্ত হতে পারবে, দেখো চেয়ে, রান্নাঘরের পিছনে যে এক ফালি বাগানটায় আমি টমেটো পুঁতেছিলাম, সেখানে এতদিনে মেনিটা ছানা দিয়েছে ঠিক। পোয়াতিই ছিল। একটু বেশি দুধ নিও ওদের। একখানা পুরনো প্যাকিং বাক্সে ওদের জন্যে তুলোর বিছানা করে রেখেই এসেছি বাগানের এক কোণে; শীতকাল, ঝলমলে রোদ্দুর, নষ্ট নিশ্চয়ই হয়নি। সত্যি, তুমি ঠিকই বলতে; সব কিছুর জন্যে আমার মায়া বড্ড। পুরোনো এসেন্সের শিশি, ওভালটিনের শৌখিন কৌটো, গতবার ফুলপিসিমা মশলার যে অপূর্ব সুন্দর ডালা দেওয়া বাক্সখানা এনে দিয়েছিলেন বেড়াতে গিয়ে, ফুলের নকশা কাটা, সেইটা। আমার মেনি বিড়াল, আমার বাহারি ফুলের টব, আমার নিজে হাতে তোমার জন্যে রাঁধা জুঁইফুলভাত। আমার সিঁদুরকৌটো, আমার রাতের শীৎকার, আমার শাঁখার নীচে সযত্নে লুকিয়ে রাখা অধিকারবোধের কর্কশ দাগ। সবটুকুর ওপরেই কেমন যেন এক খেলনাবাটি টান। 


তুমি যদি আমার দু'চোখে নামতে একটু - একটু, আরেকটু গভীরে, দেখতে, দীঘি বয়ে যাচ্ছে টলটল। তুমি কি কোনোদিনই কারুর চোখের ভেতর নেমেছ? নামলে জানতে, কেমন অপার শান্তি সেখানে। তোমার এই দামাল রাগ কেমন জব্দ হয়ে যায় সেখানে। একটু বসতে, দীঘির ধারে। কাকচক্ষু জলে পা ডুবিয়ে বসতে খানিক। জানো, জীবনের যত কালাহারি মরুভূমি, তাদের মাঝে আমি কেবল একজন আদররং মানুষ চেয়েছিলাম। কালাহারির দেশ থেকে কেড়ে আনা যে নিষ্করুণ রোদ দাবানল ডেকে আনে উন্মুক্ত প্রান্তরে, সে রোদের মধ্যে দিয়ে আমি নিস্তরঙ্গ হেঁটে এসেছি এত বছর, কেবলমাত্র কোনোদিন সে মানুষটার কাছে পৌঁছাব বলে। তার এই টলটলে, দীঘির জলের মতনই এক কাকচক্ষু  অন্দরমহল, তাতে একলা অবগাহন হবে বলে অপেক্ষা করে এসেছি, কে জানে কত যুগ। সহস্র বছর ধরে খুঁজে এসেছি দুটো বিষাদবিভোর, মায়াবী, হারিয়ে যাওয়া চোখ - যাদের কাছে পৌঁছতে পারলে আর কোত্থাও আমার যাবার থাকবে না কোনোদিন। তাপদগ্ধ, শেষ হতে না চাওয়া, ধুঁকতে ধুঁকতে এগোনো পথটার শেষে যদি সে চোখেদের কাছে একবার কোনোক্রমে পৌঁছনো যায়, মরুদ্যান খসে পড়ে তারাখসার মতন। ছায়া পড়ে জল শুকিয়ে যাওয়া খটখটে চোখে। হাওয়া বয়ে যায় হঠাৎ করে। বাতাবিফুলের গন্ধে ভরে যায় বুকের ভিতরটা। ঐ গভীর দীঘির জলে ডুবে যাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করা যায় সারা জীবন। সে আর হল কই! আচ্ছা, তুমি কি রাগই করে এসেছ সারাটা জীবন? কেবল রাগ? কেবল অধিকারবোধ? কেবল আস্ফালন? ভেতরে ভেতরে, তুমিও কি চাওনি, কারোর অবিরাম চলতে থাকা থামুক তোমার সামনে এসে? কারোর পায়জোড়ের মৃদু সুর তোমার একার হোক? কারোর সব অভিমান তোমার বুকেই ঢেউ হয়ে ভেঙে পড়ুক বাকি জীবনটা?


কে জানে। নরম করে ভালোবাসা কি নপুংসক? তাই কি এত আস্ফালন? এত ক্রোধ, এত ওজর-আপত্তি, এত বিস্ফোরণ আমায় বড় ক্লান্ত করে। মহাজগতের শেষ তারাও বোধ করি তেমন ক্লান্ত হয়নি কখনো। আমার মনের মাটি ভঙ্গিল পর্বতের মত। তাতে ইচ্ছে মত আঁচড় কাটা যায়, মায়া বিছানো যায়, লাথি মারা যায়। মারলেই যে মরে, তাকে মারাটাই সহজ; তাই বধ্যভূমেই নামিয়ে আনলে। দু'চোখে নামতে যদি, দীঘির শান বাঁধানো সিঁড়িতে বসতাম দু'জনে, ভালোবাসাবাসি কি এতটাই কঠিন হত? 


সবই ছেড়ে এলাম কেমন। আমার সোনালি-রুপোলি মাছ, আমার মেনি, মেনির ছানা, নিঃসন্তান সংসারে আমার সব পোষ‍্যদের। বাড়িটায় আমার মতন তুমিও থাকতে; কিন্তু কোনোদিন আবিষ্কার করলে না শীতের শেষ দুপুরে ঠিক কেমন আদুরে ভঙ্গিতে রোদ্দুর এসে পড়ে আমার পায়ে, যখন আমি শাল জড়িয়ে আরাম চেয়ারে বসি। তাই সে রোদ্দুরকে না তুমি ভালোবাসলে, না পেলে বিচ্ছেদব্যথা। আমার রান্নাঘরের রঙিন ঢাকনাওলা কৌটো, সংসার খরচ বাঁচিয়ে কেনা কেক ওভেন, তুমি হাতে করা কেক খেতে ভালোবাসো তাই, শখ করে কেনা পাথরের হামানদিস্তা, পাশের বাড়ির দিদার বারাণসী থেকে এনে দেওয়া শুকনো মশলা দেওয়া মিষ্টি পানের কৌটো, আমার ছোট্ট বাগানের ছোট্ট ছোট্ট লাল টমেটো তোলার আনন্দ ঝুড়ি ভরে, তুমি আজ বুঝি রাতে ফিরে ভালোবাসবে, আদর করবে, আর অশান্তি না করে, সেই অযৌক্তিক আশা … এই সব, সব ফেলে এলাম কেমন!


তুমি ভেবেছিলে ভালোবেসে আমার যাবজ্জীবন হয়েছে। কক্ষনো ছেড়ে যেতে পারব না। তুমি কোনোদিন জানবে না, বিচ্ছেদে কতটা যাবজ্জীবন হয়। শুধু যদি আমার দু'চোখে নামতে একবার…


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য