ময়ূরী মিত্র
পাগল দুনয়ন
রাত বারোটায় বৃদ্ধ বর ধড়ফড়িয়ে উঠলেন --! ইদানিং স্মৃতিভ্রষ্ট বউটার জন্য শান্তিতে ঘুমুতে পারেন না ৷ যৌবনে বউটার ওপর বড্ড রাগ হত -- বাচ্চা বউটা তুলোর স্তূপের মতো নরম শরীর নিয়ে দুলে দুলে হাঁটত ৷ কাজকম্ম একদম পারত না ৷ বরের কাছে বকুনি খেয়েই দিন কাটত ৷ তাই কি এখন টানটা বেশি টের পান বর ? নাকি কষ্টটা - বউটা আর তাঁকে বর বলে চিনতে পারবে না বলে ! সিঙ্গল বেডে চাঁদের আলো ভরে রয়েছে ৷
বউয়ের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলেন বর -একটু হলেও কি স্মৃতি ফিরল ! ফিরবে না জানেন -তবু রোজ ওই একটু ঝাঁক মেরে যাওয়া ৷ চিনতে পারছ --তুমি কি আমায় আর একটুও চিনতে পারো না ---ইত্যাদি প্রশ্ন করে করে পথভোলা রোগীকে জেরবার করা ৷ যদি বিব্রত হয়ে বউটা কিছুক্ষণের জন্য চাঁদ চিনতে পারে -- বিবাহের পর বাগানে যত্ন করে পোঁতা সুপুরি গাছটাকে মনে করতে পারে ! বর বউয়ের সঙ্গে গাছটাও বুড়ো হয়ে গেল ৷
নাহ ! এমন চাঁদও জাগাতে পারেনি বউকে ৷ বুড়িবেটি ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েই যাচ্ছে ৷ দুদিকে সরু দুটো বেণী ৷ এত সরু যে পাখার হাওয়ায় বেণী কাঁপছে ৷
কী হল ---? প্রেম হয়ে গেল ? একা একা চাঁদ খাবে বলে জানলার দিকে এগোচ্ছ যে বড় ! মহা স্বার্থপর তো তুমি ! --- মোটা গলায় মোটা পুতুল বলল ৷
দেখো পুতুল --রোজ রোজ আমাকে এভাবে জ্বালাবে না তুমি ৷ আমি কী করি না করি -সে বিষয়ে তোমার এই সবসময় নাক গলাবার অভ্যেস ছাড় ৷ একবার যদি জানতাম কে তোমাকে এখানে এনেছে - কোন দেশ থেকে এনেছে -- ফেরত পাঠিয়েই ছাড়তাম তোমায় ৷ ঝঞ্ঝাটে পুতুল কোথাকার ! নেহাত তোমার নাচ দেখে বউটা হাসে -তাই তোমায় হজম করি ৷
বলতে বলতে বর দেখলেন -- সারা সময় কথা বলা ফ্যান্সি পুতুল কাঁদছে নিঃশব্দে ৷
----আহা -আহা -কাঁদ কেন গ ? বকেছি বলে ?
---তুমি বকলে আমার রাগ হয়না ৷ আসলে চাবি ঘুরোলে তবে আমি নাচতে পারি গো ৷ নিজে তো নাচতে পারি না ৷ তাই নাচের কথা মনে করালে আমার খুব ব্যর্থ লাগে ৷ এই দেখো না --তোমার বউ যখন আমার নাচ দেখে হাসে --তখন ওর হাসিটা সত্যি হয় -কিন্তু আমার নাচটা তো মিছে ৷ বল --আমি ঠিক বলছি কিনা --বল না --- --- এই শয়তান বুড়ো বল না --আমার নাচ -আমার ঘাড় ঘোরানো - চোখের ঘূর্ণি বরাবরের জন্য মিছে কিনা ! মুখের ওপর সত্যি বলতে মানুষের এত অসুবিধে কেন হয় গ ! খালি সান্ত্বনা --খালি সোনা পুতুল -মিঠে পুতুল বলে ন্যাকামি ৷ লজ্জা করে না --রুগী মানুষটার মন
ভোলাতে একটা নির্জীব মাল ঘরে এনে রেখেছ !
---- পুতুল ফের মোটা গলা করে কান্না থেকে সরে ঝগড়ায় মেতেছে ৷
--আরে দূর ! আমার বউয়ের হাসির কোনো মানে আছে যে তাই দেখে তুমি মন খারাপ করছ ! স্মৃতিহারা মানুষ কখন কী দেখে হাসে তা কি সে নিজে জানে ! --
--- বরের এই কথায়ও শান্ত নয় পুতুল ৷
মৃদু গলায় বললে --বরভাই তোমার বউয়ের হাসিটাও নিজের -হাসির মানে না থাকাও নিজের ৷ আমার হাত পা মাথানাড়া - সব কলে নয় ব্যাটারিতে ৷ এত সুন্দর জামা যে মাথা গলিয়ে খুলে একবার কাচব তারও জো নেই ! নোংরা জামাটা কত বছর ধরে পরে আছি ! কী করব ! হাত পাগুলো প্লাস্টিকের ৷ প্লাস্টিকের ক্ষয় নেই ৷ বুঝলে ?
উ উ উ ---এই রে বউটা জেগে গেছে তাদের কথায় !
কুঁজো থেকে ঠাণ্ডা জল দিলেন বর ৷ বোধহয় স্বপন দেখছিল ! জিভটা শুকিয়ে গেছে ৷ আঙুলে জল নিয়ে বউয়ের ঠোঁট সিক্ত করতে লাগলেন বর ৷ বারবার জল খেয়ে খেয়ে ঢেকুর তুলল বউ ৷
পুতুল অনেকক্ষণ কথা বলেনি ৷ প্লাস্টিকের আঙুলহীন হাতটা বুড়ির ঢাউস পেটের ওপর রাখা -পেট উঠছে নামছে ৷ সুপুরিগাছের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে পুতুল ৷ চাঁদের আলো - তার কালোরঙে আঁকা চোখে ৷
গাছের স্মৃতি নেই ৷ তবে সে মানুষের স্মৃতি তৈরী করতে পারে ৷
অজানা সাফল্যের আশায় পুতুল হাসল ৷
প্লাস্টিকের মুখ ফাঁক হল ৷
আনন্দ তার ৷
সেইমুহূর্তে চাঁদ প্রাণ ও প্রাণহীনে পূর্ণ স্পর্শ দিচ্ছে ৷
দারুণ দারুণ দারুণ
উত্তরমুছুন❤️❤️ ❤️❤️ ❤️❤️