তন্ময় সরকার

                                                                               


 

                                                                    সমাপতন



কালক্ষয় একটি কষ্টসাধ্য কাজ। সেই কাজটি রোজ খুব নিষ্ঠার সঙ্গে করতে হয় মৃত্যুঞ্জয়কে। চারটেয় সে তার এনজিও অফিস থেকে বেরোয়। তারপর তিনশো মিটার ঢিমেতালে হাঁটে। তখন সে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খেয়াল করে চারপাশ। রহমানদের আমগাছটায় এবার ভাল বোল ধরেছে। মাধবদের বারান্দার কোনায় সখিনার কুকুরটা চারটে ছানা দিয়েছে। দুটো কাক বলয়দের খড়ের চালের মটকায় বসে কিছু-একটা কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে। সেই সময় যদি কেউ তাকে অতিক্রম করে, সে অবশ্যই ঘাড় ঘুরিয়ে মানুষটাকে মনোযোগ দিয়ে দেখে। যেন এভাবে পরিবেশ, পশুপাখি, গাছপালা, মানুষ ইত্যাদি মুখস্ত করা একটা জরুরি কাজ।

এর মধ্যে রশিদুলের চায়ের দোকানটা এসে যায়। রশিদুল মৃত্যুঞ্জয়কে দেখলেই উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। তার দোকানে কাস্টোমারে ছয়লাপ। কিন্তু সবাই গ্রামের দু’-পাঁচ টাকার চুনোপুঁটি খদ্দের। মৃত্যুঞ্জয় হল মালদার পার্টি। চা-বিস্কুট খেয়ে আর প্যাকেট-সুদ্ধ সিগারেট নিয়ে দশ মিনিটেই একশো দশ টাকা বিল করে। তারপর পাশের বন্ধ সাইকেলের দোকানের সামনে লোহার চেয়ারটাই বসে থাকে চুপচাপ। রশিদুল মাঝেমধ্যে গিয়ে চায়ের অর্ডার নিয়ে আসে, আর হাতে চা পৌঁছে দেয়। এভাবেই চলে দু’ঘণ্টাও বেশি। এর মধ্যে সাইকেলের দোকানদার হাবিব দিবানিদ্রা ভেঙে ফোলাফোলা চোখে এসে দোকান খোলে। মৃত্যুঞ্জয়কে দেখেই সে একগাল হাসে, “ভাল আছেন তো, স্যার? কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো? রশিদুল চা দিয়েছে? এনে দেব এক কাপ?”

“না না, দিয়েছে, দরকার হলে আবার দেবে। তুমি তোমার কাজ শুরু করো।”

মৃত্যুঞ্জয় একটার পর একটা সিগারেট ধরায়। মাঝে মাঝে পাড়ার কেউ এসে তার সঙ্গে দরকারে বা বেদরকারে কথা বলে যায়। এভাবে সাড়ে ছ’টা বাজলে সে একটা বাস ধরার কথা ভাবে।

বাস থেকে নেমে ট্রেনে। ট্রেন থেকে নেমে আবার ট্রেন। তারপর দুটো অটো চড়ে ফ্ল্যাটে ঢুকতে বেশ রাত হয়।

বিনা দরকারে রাত করে বাড়ি ফেরা অনামিকার বরাবরের অপছন্দ। বাবলাইও বাবা অন্ত প্রাণ।

ঘরে ফিরে মৃত্যুঞ্জয় মেঝের দিকে তাকিয়ে খেদের হাসি হাসে, “কী আর করা যাবে বলো! সময় তো কাটাতে হবে…”


ছেলেটা সাইকেলের দোকানে রোজ বিকেলে আসে না, মাঝেমধ্যে আসে। বয়স আন্দাজ এগারো-বারো। মজার কথা, ছেলেটাকে দেখতে একদম বাবলাইয়ের মতো। শুধু পোশাক-পরিচ্ছদ আর চেহারার যত্নে যা পার্থক্য। খালি পা, পুরনো হুক-ছেঁড়া ইংলিশ প্যান্ট, গায়ে তেলচিটে রোনাল্ডোর সাত নম্বর জার্সি। চুলগুলো রুক্ষ আর লালচে। মৃত্যুঞ্জয় ভাবে— যদি ওকে সাবান-শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করিয়ে পরিষ্কার জমাকাপড় পরানো যেত, তবে পুরো বাবলাইয়ের মতোই লাগত।

প্রথম যে-দিন দেখা হয়েছিল, সে-দিন অনেকক্ষণ মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে হা-করে তাকিয়েছিল ছেলেটা। যেন দিনেদুপুরে ভূত দেখেছে। কিছুক্ষণের জন্যে থমকে গিয়েছিল তার উচ্ছল গতি। তবে মুহূর্তখানেক মাত্র। তারপর আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে গিয়েছিল সে-ছেলে।

চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক পেরিয়ে আসা ছেলেটার হাতে একটা ফুটবল থাকে। পুরনো আর ছেঁড়া। সাইকেলের দোকানদারকে কোনও পাত্তা না-দিয়েই সে সুঁইসুতো নিয়ে কাজে নেমে পড়ে। প্রথমে ফুটবলটাকে সেলাই করে, তারপর পাম্পার দিয়ে হার্ড পাম্প দেয়। হাবিব মৃদু হেসে রাগের ভান করে বলে, “কী রে! আমার দোকান, আমাকে না-বলে জিনিসপত্তরে হাত লাগাস যে বড়?”

ছেলেটা কোনও কথা বলে না। যেন শুনতেই পায়নি হাবিবের কথা।

“উঁউহ্‌! জমিদার শিশির রায়…” বলে হাবিব নিজের কাজে মন দেয়।

কাজ মিটে গেলে ছেলেটা বলটাকে খুব করে চেপে দেখে ভালমতো পাম্প হয়েছে কি না। তারপর দু’পায়ে ড্রিব্লিং করতে করতে জাতীয় সড়ক পেরিয়ে ওপারের গ্রামের রাস্তায় ঢুকে যায়।

মৃত্যুঞ্জয় কল্পনা করে, পাড়া পার হলে নিশ্চয়ই একটা বড়, সুন্দর, সবুজ মাঠ আছে। সেই মাঠে এখন চুটিয়ে ফুটবল খেলছে বাবলাই… না না, বাবলাই নয়, বাবলাইয়ের মতো দেখতে ছেলেটা।

শুধু কল্পনায় কিছুতেই ছেঁড়া বলটা আসে না। আসে একটা ঝকঝকে নতুন ফুটবল।


দুই


মৃত্যুঞ্জয়ের চাকরিটা নতুন। ছ’মাস ঘরে বসে থাকার পর যখন পেটে টান পড়ল, তখন বাধ্য হয়ে চাকরিটা নিতে হয়েছে। এখানে যে-কাজটি সে করে, আগে সেই কাজ অবসরে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে করত— বিভিন্ন এনজিও-কে ফান্ড পাইয়ে দেওয়ার জন্যে প্রোজেক্টের প্রোপোজাল লেখার কাজ। আগে মৃত্যুঞ্জয় ছিল ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার একজন ডাকসাইটে সাংবাদিক। যদিও এখন প্রেস-মিডিয়ার জগতের সঙ্গে তার কোনও যোগাযোগ নেই।

বাবলাই যখন জন্মেছিল তখনও ছেলের ব্যাপারে এতটা সিরিয়াস ছিল না মৃত্যুঞ্জয়। ব্যস্ত থাকত, তার পেশা তাকে ব্যস্ত রাখত। কখন কোথায় থাকবে, কোথায় যাওয়ার ডাক আসবে— কেউ জানে না। এখানে ঝড় এল তো তিনশো কিলোমিটার দূরে বন্যা, অমুক নেতা পরকীয়া করেছে তো তমুক নেতা চুরি, কোনও সেলিব্রেটি বড় পুরস্কার পেল তো কেউ দুম করে গেল মরে, কেউ ভোটে জিতল তো কারও ঘর পুড়ল। আর সঙ্গে-সঙ্গে অফিস থেকে তলব— ছুটতে হবে স্পটে। ব্রেকিং চাই, চাই এক্সক্লুসিভ!

কিন্তু বাবলাই যখন একটু করে বড় হল মৃত্যুঞ্জয়ও নিজের অজান্তে নিজেকে পাল্টে নিতে শুরু করল। অফিসের কাজে ফাঁকি দিত না, কিন্তু যেটুকু সময় বাঁচাতে পারত, সম্পূর্ণ ব্যয় করত বাবলাইয়ের জন্যে। বাবলাইও দাবি করতে শুরু করল বেশি বেশি।

মৃত্যুঞ্জয় মেজাজি মানুষ। পান থেকে চুন খসলে বিরক্ত হয়। তাই বিয়ের পর থেকেই অনামিকা তাকে সামলে চলত। বাবলাই বড় হতেই সেই মৃত্যুঞ্জয় অদ্ভুতভাবে পাল্টে গেল। অনামিকার যে-সব কাজকর্মে সে রেগে যেত সেগুলোই বেশি-বেশি করতে শুরু করল বাবলাই।

মৃত্যুঞ্জয় অবাক হয়ে লক্ষ করল, সে একটুও বিরক্ত হচ্ছে না, রেগেও যাচ্ছে না। বরং নিজের কাজ ফেলে বাবলাইয়ের সঙ্গে রেসিং কার বা প্লে-ব্লকস নিয়ে খেলতে নেমে যাচ্ছে।

এসব দেখে টোন কাটত অনামিকা, “বেশ হয়েছে! ছেলের হাতে একদম সাইজ হয়ে গেছ তুমি! আমার সঙ্গে এতদিন যত দুর্ব্যবহার করেছ তার শোধ উঠছে এখন!” এর পর বাবলাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসে বলত, “থাক বাবা, সবসময় বাবার সঙ্গেই থাক। মনে রাখবি, তোর বেস্ট ফ্রেন্ড হল তোর বাবা।”

বাবলাইয়ের জ্বালাতনে মৃত্যুঞ্জয় পূর্ব কর্মের প্রতিফল পাচ্ছে— এটা ভেবে অনামিকার আনন্দ। কিন্তু সবটা বুঝেও মৃত্যুঞ্জয়ের একটুও খারাপ লাগত না। বরং উপভোগ করত ব্যাপারটা।

যে-দিন রাতে মৃত্যুঞ্জয় বাড়িতে থাকার সুযোগ পেত, বাবলাই দখল করে নিত বাবাকে। সে-দিন বাবার গায়ের উপর একখানা পা না-তুলে দিলে তার ঘুম আসত না। এক হাতে গলা জড়িয়ে ধরে সে ফিসফিস করে বাবার সঙ্গে গল্প করত।

কচি মৃদু স্বর কানে পৌঁছলেই অনামিকা ধমকে উঠত, “অনেক রাত হয়েছে বাবলাই, ঘুমিয়ে পড়ো!”

মায়ের ধমক খেয়ে চুপ হয়ে যেত বাবলাই, বাকস্বাধীনতা হারিয়ে বাবার মুখে মাথায় ঘাড়ে হাত বোলাত আর সর্বশক্তি দিয়ে নিজের দিকে টেনে নিত বাবাকে। যেন অন্ধকার দুনিয়ায় ভীতু বাবলাই প্রাণপণে আঁকড়ে থাকত চাইত তার সবথেকে প্রিয় মানুষটিকে। 

   

তিন


চাকরি নতুন হলেও এই অল্প ক’মাসে এলাকাটা ভাল চিনে গিয়েছে মৃত্যুঞ্জয়। মানুষজনের সঙ্গেও বেশ ভাব হয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। অফিসের কাজের পরে সময় নষ্ট করার জন্যে অনেকটা সময় এখানে কাটাতে হয়। তখন কেউ দু’দণ্ড কথা বলতে আসে। কেউ-বা আসে সুবিধা-অসুবিধায় সাহায্য নিতে। পাড়ার লোক ইদে বা পুজোয় নেমতন্ন করে। বাড়ির বাচ্চা, হাঁস-মুরগি বা কুকুরের অসুখ হলে শহর থেকে ওষুধ আনার বরাত দেয়, সরকারি অনুদানের ফর্ম পুরণ করে দিতে অনুরোধ করে। আবার কেউ স্রেফ মনের কষ্টের ভাগিদার করে মৃত্যুঞ্জয়কে।

মৃত্যুঞ্জয় সানন্দে অংশগ্রহণ করে প্রতিটা ক্ষেত্রে। যত সময় নষ্ট করা যায় ততই লাভ। আর, কিছু দিন যাওয়ার পরে সে অনুভব করে মানুষগুলো তার আত্মার আত্মীয় হয়ে গিয়েছে। ওদের সুখেদুখে ওরও মন কাঁদে। গ্রামের সরল মানুষগুলোও এই শহুরে লোকটাকে প্রাণের বন্ধু ভেবে ফেলেছে।

 

বাবলাইও যখন একটু বড় হল সে-ও তার মায়ের উপদেশ মেনে বাবাকে তার বন্ধু ভাবতে শুরু করেছিল। মনে হয় সব চেয়ে ঘনিষ্ঠ আর বিশ্বস্ত বন্ধু সে তার বাবাকেই ভাবত। তাই বয়স যখন এগারো পেরিয়েছে, সে সব থেকে গোপন কথাটা বাবাকেই বলেছিল।

একদিন খুব ভয়ে ভয়ে আর সংকোচ নিয়ে বাবলাই বলেছিল, “বাপি, একটা কথা বলব?”

“নিশ্চয়ই। বল,” মোবাইল থেকে মুখ তুলেছিল মৃত্যুঞ্জয়।

“ম্যাথ-ব্যাচের সম্প্রীতিকে দেখলেই আমার বুকের মধ্যে যেন কীরকম হয়!”

বাবলাইয়ের কথা শুনে হো-হো করে হেসে ফেলেছিল মৃত্যুঞ্জয়। বাবার হাসি দেখে বাবলাইয়ের মুখটা একদম পাংশু হয়ে গিয়েছিল। তার জীবনের এরকম একটা সিরিয়াস ম্যাটারকে বাপি হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে!

“বাপিইই... আই অ্যাম সিরিয়াস!”

“সরি বাবা, সরি! ঠিক ঠিক, এটা একটা গভীর সমস্যা। উই শুড ট্রিট দ্যা ম্যাটার সিরিয়াসলি।”

“তুমি তো আমার কথা পাত্তাই দিচ্ছ না। শুধু হাসছ,” অভিমানী স্বরে বাবলাই বলেছিল, “আজ থেকে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের লিস্ট থেকে তোমার নাম কাটা।”

“আচ্ছা এই কান মলছি, আর হাসব না।”

“অনুভব বলেছে আমার এই ফিলিংটা নাকি ‘লাভ’! সত্যি?”

এবার মৃত্যুঞ্জয় সত্যি-সত্যি সিরিয়াস হয়ে গিয়েছিল। একটু সময় নিয়েছিল উত্তরটা গুছিয়ে নিতে। তারপর বলেছিল, “না বাবলাই, এটা ‘লাভ’ নয়। একে বলে ‘ইনফ্যাচুয়েশন’। প্রকৃত ভালবাসার জন্যে এখনও অনেকগুলো বছর তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে।”


যদিও মৃত্যুঞ্জয়ের আর কোন অপেক্ষার বালাই নেই। এখন তার একটাই কাজ, সময়কে কাটিয়ে দেওয়া।

এই মুহূর্তে সে খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ছেলেটাকে। কীভাবে সে ফুটবলটা সেলাই করছে, কতটা নিষ্ঠা প্রতিটা ফোঁড়ের মধ্যে লুকিয়ে আছে। বলটার প্রতি ছেলেটার ভীষণ মমতা, খুব দরদ। যেন এই খেলার বস্তুটি জীবন্ত, আর পরম আদরে তার সব ক্ষতস্থানের শুশ্রূষা করছে বাবলাইয়ের মতো দেখতে গ্রাম্য বালক।

 

চার


“ছেলে বলল আর তুমিও ওর কথায় নাচতে শুরু করলে? এটা কি ছেলেখেলা হচ্ছে?” অনামিকা ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল।

“শোনো, ওকে সহজ ছন্দে বড় হতে দাও। গায়ের জোরে বাঁধা দিলে ওর স্বাভাবিক ডেভলপমেন্ট একদিন আটকে যাবে। তখন ওর মধ্যে একটা অপোজিং মেন্টালিটি তৈরি হবে। আখেরে এতে আমাদের সকলের লস,” মৃত্যুঞ্জয় সাধ্যমতো বোঝানোর চেষ্টা করেছিল অনামিকাকে।

তর্কটা বেধেছিল বাবলাইয়ের একটা আবদারকে ঘিরে।

খুব ছোট থেকে বাবলাই কোনও আউটডোর গেম পছন্দ করত না। ও একটু ভাবুক প্রকৃতির। শারীরিক কসরতের খেলাধুলায় সাফল্য পেতে গেলে যে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দরকার, সেটাও ওর মধ্যে একেবারে অনুপস্থিত।

সেই বাবলাই একদিন অদ্ভুত আবদার নিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ের সামনে এসে দাঁড়াল।

“বাপি আমি ফুটবল খেলতে চাই।”

বাবলাই ফুটবল খেলবে! যে-ছেলে কোনওদিন কমপ্লেক্সের লনে প্লাস্টিকের বলে একটা লাথি মেরে দেখেনি, সে খেলবে ফুটবল!

“তোর হঠাৎ ফুটবল খেলার ইচ্ছে হল কেন?” বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল মৃত্যুঞ্জয়, “তুই তো দৌড়ঝাপের খেলা পছন্দ করিস না!”

“আই ডোন্ড ফিল গুড সিটিং অ্যাট হোম এনিমোর। স্কুলের বন্ধুরা সবাই খেলে। হোয়াট ফান দে হ্যাভ!”

মৃত্যুঞ্জয় কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলল, “ঠিক আছে দেখছি। ইচ্ছেটা ভাল। তুই তো খানিকটা মোটাও হয়ে গেছিস। ফুটবল খেললে ফিটনেস ফিরে আসবে।”

দীর্ঘ লকডাউন শুধু বড়দের মধ্যে নয়, ছোটদের ভিতরেও ভীষণ একঘেয়েমি এনেছে। তাই মৃত্যুঞ্জয় বাবলাইয়ের এই ইচ্ছেকে আটাকাতে চাইল না। বরং দরকারিই মনে করল। খেলতে যখন চাইছে, বাধা দেওয়ার দরকার কী?

কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল অনামিকা। তার মনে হয়েছিল— ছেলের কথাতে অন্ধের মতো নাচছে মৃত্যুঞ্জয়। এটা ছেলেখেলা হচ্ছে।

আর মৃত্যুঞ্জয় মনে করেছিল, বাবলাইকে স্বাভাবিক ছন্দে বেড়ে ওঠার স্বাধীনতার দেওয়া উচিত।

প্রত্যেকবারের মতো সেবারও ড্রিবলিং করে অনামিকাকে ডজ দিয়ে বাবলাইয়ের পায়ে পাস দিয়েছিল মৃত্যুঞ্জয়, “ঠিক আছে আমি শান্তিনিকেতন থেকে ফিরি, তারপর সুমন্তদার সঙ্গে কথা বলে ওঁর স্পোর্টিং ক্লাবে তোকে ভর্তি করে দেব।”

“আমাকে একটা নতুন ফুটবল কিনে দেবে তো, বাপি?”

“নিশ্চয়ই দেব, বাবা!” বাবলাইয়ের নরম গাল টিপে বলেছিল মৃত্যুঞ্জয়।

“তুমি শান্তিনিকেতন যাচ্ছ?” চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিল অনামিকা।

“হ্যাঁ, কাল।”

“অফিসের কাজে?”

“হুঁ, ওখানে এডুকেশন ইস্যুতে একটা ক্রুশিয়াল ক্ল্যাশ হয়েছে। সেটাকে ডিল করে এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট তুলে আনতে হবে।”

“আমরা যেতে পারি তোমার সঙ্গে?” দুম করে প্রস্তাব পেড়েছিল অনামিকা।

মৃত্যুঞ্জয় যারপরনাই অবাক হয়েছিল। এরকম প্রস্তাব ইতিপূর্বে অনামিকা কখনও দেয়নি। সে হুটহাট কোনও সিদ্ধান্ত নেয় না। তার সব কাজের পিছনে থাকে সুনির্দিষ্ট প্ল্যানিং থাকে।

“শিয়োর!” প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি জানিয়েছিল মৃত্যুঞ্জয়, “কিন্তু হঠাৎ তোমার হল কী? একঘেয়েমি লাগছে? একটু চেঞ্জ চাইছ?”

“বা রে! তোমার সঙ্গে যেতে চাওয়াটা কি অন্যায়? ইচ্ছে হচ্ছে, তাই বললাম। তোমার যদি কোনও আপত্তি না-থাকে— তুমি তোমার কাজ করবে, আমি আর বাবলাই আমাদের মতো ঘুরব। কত বছর যাই না শান্তিনিকেতন!”

 

পাঁচ


চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক দিয়ে মৃত্যুঞ্জয়দের অফিসের হ্যাচব্যাকটা দৌড়চ্ছিল। গাড়িকে ছুটতেই হয়, সেটাই তার ধর্ম এবং গুরুত্ব। তাই বলে সে-দিনের ছুটে যাওয়া এতটা বেপরোয়া ছিল না যে, জীবনের মোড় একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যাবে।

ক্যামেরা-পার্সন তাপস ড্রাইভারের পাশে বসে নিশ্চিন্তে ঝিমোচ্ছিল। বাবলাই গ্রামের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, মানুষজন দেখে একের পর এক প্রশ্ন করছিল তার বাবাকে। মৃত্যুঞ্জয়ও ধৈর্য ধরে উত্তর দিচ্ছিল যতটা তার জ্ঞানগম্যিতে কুলোয়। অনামিকা নিরুত্তাপ তাকিয়ে ছিল জানালার বাইরে।

ড্রাইভার বেচারার যত জ্বালা। সে দীর্ঘক্ষণ ধরে সামনের পাথর বোঝাই ট্রাকটাকে সংকেত পাঠাচ্ছে— একটু সাইড ছাড় বাবা, পার হয়ে যাই। না-হলে তোর পিছন-পিছন গেলে আগামী পরশু শান্তিনিকেতন পৌঁছব।

আঠারো চাকার ট্রাকের ডানদিকের জানালা থেকে যখন পনেরো মিনিটেও কোনও প্রতি-সংকেত এল না, মৃত্যুঞ্জয়দের ড্রাইভার তখন নিজেই পথ দেখল, পথ দেখাল বাকি সওয়ারিদেরও। সে হঠাৎ তুমুল বেগে ডানদিক কাটিয়ে ওভারটেক করার চেষ্টা করল। উল্টোদিক থেকে তখন প্রবল বেগে ছুটে আসছিল একটা লোকাল রুটের ট্রেকার।

মুখোমুখি হওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না কারও।

বিকট শব্দ। জগৎ আচ্ছন্ন করা ধুলো আর ধোঁয়া। রাস্তার মাঝখানে দোমড়ানো-মোচড়ানো দুটো যানবাহনের কঙ্কাল...

ক্যামেরাপার্সন পাঁচ দিন আর ড্রাইভার দু’দিন আইসিসিইউ-তে লড়ে ক্ষান্ত দিয়েছিল। কিন্তু বাবলাই আর অনামিকা নিরুদ্দেশ হতে সময় নিয়েছিল মাত্র মিনিট-পাঁচেক।

মৃত্যুঞ্জয় খবর পেয়েছিল, উল্টোদিকের ট্রেকারের দু’জন স্পট ডেড। ট্রেকারের ড্রাইভারের প্রাণ টিকেছে, তবে ডান চোখ আর ডান পায়ের বিনিময়ে।

মৃত্যুঞ্জয়কে শুধুমাত্র একটা ফাস্ট-এইড দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল লোকাল হাসপাতাল। 

হাসপাতালের করিডোরে শূন্য দৃষ্টিতে একাকী দাঁড়িয়ে ছিল অনামিকার ঝগড়ার কলিগ, বাবলাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড...

 

ছয়


ক’দিন ধরে বড় বাজারের ব্যাগ নিয়ে ঘুরছে মৃত্যুঞ্জয়। ব্যাগের পেটটা ফুটবলের মতো ফোলা। সে রশিদুলের চা খেয়ে সাইকেলের দোকানে লোহার চেয়ারে বসে। প্রতিদিনের নিয়মে হাবিব দোকান খোলে, পথ চলতি অসুস্থ সাইকেল, ভ্যান-রিকশার চিকিৎসা করে। মৃত্যুঞ্জয় বারবার সিগারেটে টান মারে, সন্ধে হলে মোটা ব্যাগটা হাতে তুলে বাসে ওঠে। ছেলেটা আসে না। 

অনেক দিনের অপেক্ষার পর একদিন সে এল। অন্য দিনের মতো তার খালি পা, পরনে সেই পুরনো হুক-ছেঁড়া ইংলিশ প্যান্ট, গায়ে তেলচিটে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর জার্সি, কটা চুল। তার বলটা আরও শতছিন্ন হয়েছে এই ক’দিনে।

বরাবরের মতো কোনও কথায় সময় নষ্ট না-করে সে বলটা সেলাই করতে বসল। মৃত্যুঞ্জয় এগিয়ে গেল। প্রথম দিনের মতো ছেলেটা আজ একবার থমকে তাকাল মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে। পাথরের মূর্তির মতো স্থির সে-দৃষ্টি। মৃত্যুঞ্জয় ব্যাগ থেকে নতুন চকচকে বলটা বের করে বাড়িয়ে ধরল।

ছেলেটা নিল বলটা। দুই হাতে দু’টি বল পাশাপাশি অনেকক্ষণ নাড়িয়ে-চাড়িয়ে দেখল।

মৃত্যুঞ্জয়ের মুখে একটা বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠল, মেঘলা আকাশে সূর্যের উঁকির মতো। মুহূর্তের জন্যে মনে হল, বলদুটো ধরে আছে তার বাবলাই।

পরক্ষণেই ঘোর কাটল। না না, এ তার বাবলাই নয়, হুবহু বাবলাইয়ের মতো দেখতে বটে ছেলেটাকে।

একসময় নতুন বলটা মৃত্যুঞ্জয়কে ফিরিয়ে দিল ছেলেটি। সে আজ আর পুরনো বলের ছিন্ন শরীর জোড়া লাগাবার চেষ্টা করল না, হাওয়াও দিল না। ওই অবস্থাতেই বলটাকে ড্রিবলিং করতে-করতে জাতীয় সড়ক পার হয়ে পাড়ার রাস্তায় অদৃশ্য হল।

হাবিব বলল, “বড় অভিমানী ছেলে, বুঝলেন স্যার! খুব খামখেয়ালি।”

“হুম, তাই তো দেখছি,” উদাস গলায় বলল মৃত্যুঞ্জয়, “আমার উপহারটা রিফিউজ করল।”

“আসলে কী জানেন স্যার, ছেঁড়া বলটা ওর বাবা কিনে দিয়েছিল। সে-জন্যে মায়া ছাড়তে পারে না। আপনি হাজার নতুন বল দেন-না কেন, ও পুরনো বলটাকেই সেলাইফোঁড়াই করে চালাবে।”

“বলটা তো ছিঁড়ে গেছে। ওর বাবা ওকে নতুন একটা বল কিনে দিতে পারে না!” উষ্মা মাখানো গলায় বলল মৃত্যুঞ্জয়।

কথাটা শুনে কেমন যেন যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল হাবিবের চোখ-মুখ। হাতের কাজটা এক পাশে ফেলে রেখে সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, “ওর বাবা আর নেই স্যার।”

“নেই মানে?”

“বেঁচে নেই!”

“বেঁচে নেই!” চমকে উঠল মৃত্যুঞ্জয়, “এইটুকু ছেলের বাবা বেঁচে নেই কেন! কী হয়েছিল?”

“বছর-খানেক আগে এই রাস্তায় একটা মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল, স্যার। প্রেসের গাড়ির সঙ্গে ট্রেকার। সে কী বীভৎস দৃশ্য। চোখে দেখা যায় না। ওর বাবা-মা দু’জনেই ওই ট্রেকারে ছিল। আওয়ালসিদ্ধি হাট থেকে ফিরছিল। জায়গায় শেষ! খুব উপকারী লোক ছিল ওর বাবা। গ্রামের মানুষের বিপদে-আপদে সবসময় পাশে দাঁড়াত…”

হাবিব যেন আর কথা বলতে পারছে না, গলাটা বুজে আসছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে নিজেকে সামলে নিল। তারপর একটা করুণ হাসি হেসে বলল, “আর একটা অদ্ভুত কাণ্ড কী জানেন স্যার!”

“কী?”

“আমরা সবাই খেয়াল করেছি, নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনাও হয়েছে, কিন্তু কখনও আপনাকে বলিনি।”

“কী বলোনি?”

“অবাক ব্যাপার হল, ওর বাবা অবিকল আপনার মতো দেখতে ছিল, স্যার!”



মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য