সৌমী আচার্য্য


 'আয়নাবাজি' ও সৎ প্রচেষ্টা



যে নিভৃতক্ষণের গায়ের উপর দীর্ঘদিনের আলসেমি ছড়িয়ে বসেছি তার গায়ে কমলালেবুর মতো আলো। জানালার গরাদ বিহীন পথে গাছেদের চিরায়ত গতায়াত। ইষ্টিকুটুম পাখি বুকের ভেতর গান ধরে। খানিক আগে গত রাতের জঘন্য নাটকের ভাড়া করা পোশাক খুলতেই আমার শরীর জুড়ে আলোর উল্লাস। আয়নায় খুঁটিয়ে পরখ করল যে চোখ, সে মোটেই বিচার করল না আমার শরীরের মাংস মেদ রক্ত হাড় বরং খুলে খুলে দেখলো মাথার ভেতরের গলি ঘুঁজি। মুখোশের কারখানায় উৎপাদন প্রায় শূন্য দেখে খুশি হয়ে বিশ্রাম নিতেই আমি লজ্জায় মাথা নত করি সব সত্যি আসলে নিজেও জানিনা তবে!

আধুনিকতম সভ্যতার পৈশাচি উল্লাস আমার ধমনী জুড়েও। শিশু মৃত্যুর করুন হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে ডাইনিং রুমে ম্যাচিং আলো জ্বালাই, রোজ রোজ। নিভৃতক্ষণের আলোটুকু আমার, তাতে ভাসবার জন্যেই অপেক্ষা নবনব রূপে পল্লবায়িত হয়। মুখোশ গড়ার কাজে ফাঁকি দিলে একা হতেই হবে। অপরের ভাঙা কাঁধে সুখের জরিবোনা আলোয়ান কাউকে কাউকে পীড়া দেয়। তবু হৃদয় ভাসে লবণ জলে। 'হে আমার অনন্ত দুঃখ তোমাকে জড়িয়ে রাখি সুদৃশ্য আতরদানে।' চুপ করে হেলান দিই ভোরের নদীর গায়ে। নদী আমার বরাবরের প্রিয়। বুকে অনন্ত সাগর দেগেছে সময়। তৃষ্ণা মেটাই নদীর কাছে।

দু একটা কাঁচপোকা চোখে মুখে আশ্রয় খোঁজে, আমার ইচ্ছে হয় না তাড়াই বরং ছোটখাটো এই উদারতায় ভরে উঠি। বড়োসড়ো দান করবার মতো সামর্থ্য না ইচ্ছে কোনটার অপ্রতুলতা তার হিসেব মেলাতে পারি না কোনদিন। বেলা বাড়লেই মাটি তেতে ওঠে, পোষাক পরি লোক দেখানো। যেদিন মনের ভিতর ভিখারির অধিবাস সেদিন ললিত কলা উৎসবে আমি রঙিন হবার ঠিকা পাই। আবার যেদিন উদ্দাম বহ্নি হতে চাই জোর করে পরানো হয় শোকের বৈরাগ্য। সূর্য মাথায় আগুন ঢালে ফোঁটায় ফোঁটায় ঘি পড়ে। কে বা কারা যেন যাওয়া-আসার পথে জোগান দেয় রসদ। আমিও পোশাকের উপর পোশাক ভাড়া করি। মুখোশের প্রলোভন বাড়তে থাকে। তখন মিছিলে হাঁটতে হয় একা ক্লান্ত অবসন্ন।

যে নিভৃতক্ষণের কাছে বারবার ফিরতে চাই তার দেওয়াল জুড়ে সোমলতা, মাথার উপর কালো অন্ধকারে জেগে থাকে অসংখ্য তারা। ঘাসেরা পায়ের কাছে বসে, ভুল ঠিকের বিচার চলে তবু গুনগুন করে গান ধরে কেউ। শব্দ অক্ষর অতলে হারিয়ে ভেসে ওঠে সুর। 'আমি চিনি গো এই সুর। কেবল মনে করতে পারি না।' কে যেন আমার যন্ত্রণায় স্বপ্নের জাদুকাঠি ছুঁইয়ে বলে, 'আহা, মনে করে কি লাভ! সব কি মনে রাখতে হয়!' মনে রাখতে নেই, না!

মুখোশ ভেসে যায় স্রোতের টানে। অপ্রয়োজনের ভাড়া করা পোশাক আহুতি দিতেই সূর্যদেবতা প্রাণ ঢেলে দেয়। তপ্ত মাটি আদরে থালা সাজায়। ধোঁয়া ওঠা জীবনের গন্ধ, মন জুড়িয়ে গ্রাস তুলি, যেন বিগত জন্মের মায়ের যত্নে মাখা পরমান্ন। নিশ্চিন্ত ঘুমের চাদরে নিজেকে মুড়ে নিতে পারলেই ব্যর্থ অপমান গ্লানির ছায়ারা বুদ্বুদের মত মিলিয়ে যায়। অতি ধীরে অতীত হয় বর্তমান। নিভৃতক্ষণে যে একমাত্র দোসর হয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের চাবুক হাতে রাখে, তার সাথে প্রাত্যহিক সম্পর্কের সেতুপথ, 'আরশি'। যে মুহূর্তে আয়নাবাজিতে সত্ত্বা ভিন্ন তখনই সম্পূর্ণ আত্মদর্শন।

আত্মদর্শনে মায়া অবাঞ্ছিত এবং হন্তারক। নির্মমতা এক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ দাবিদার না হলেই মায়া পেলব আলপনায় ঢেকে রাখে ভুল তখন কেবল বিভ্রান্তি! নিভৃতক্ষন জুড়ে আমিত্বের প্রবল দাপট। ভুলের দাগে এঁটেল মাটি যত্নে মাখানোর কাজেও ফাঁকি পরে বিস্তর। কমলালেবু রঙে ধীরে ধীরে পচন লাগে। ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে থাকে সময়, অস্ফুটে বলে, 'এবারে মুখোশের রমরমা দাপট হে! নিজেকে আর সারিয়ে তুলতে পারলে না। গভীর অসুখ হে, এই আমিত্ব! তোমার নিভৃতক্ষন বাজেয়াপ্ত হল।' এখন ভিখিরি হওয়া ছাড়া গতি থাকে না।

এসব কথার প্রলাপ আমায় শুনিয়েছিল যে , সাঁকোর ওপারে তার বাসা। নিভৃতক্ষণ, কমলালেবু আলো, অনিন্দ্যসুন্দর শান্তিময় চরাচর উপহার পেয়েছিলাম তারই অংশীদার হয়ে। এখন ভরসা কেবল 'আয়নাবাজি', হয় ফক্কা নয় আত্মদর্শন।

মন্তব্যসমূহ

  1. সুন্দর লেখা। তবে বেশ কিছু বানান ভুল চোখে পড়লো। প্রুফ দেখার ব্যাপারে সম্পাদক আরেকটু যত্নবান হবেন আশা করা যায়।

    উত্তরমুছুন
  2. দায় সম্পাদকের নয় লেখকের । কিছু টাইপো আর কিছু আমার সমস্যা। যেমন সত্ত্বা বানান ওটা সত্তা লিখতে আমার ব্লকেজ আছে হয়তো।

    সৌমী

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য