যুগান্তর মিত্র
একটি পাখির মৃত্যুকথা
একটুকরো রোদ ঘরের মেঝেতে জানু পেতে বসে আছে যেন। কিছু কি বলতে চাইছে এই সূর্যালোক! এই রোদটুকু কি তার ঘরে প্রতিদিনই আসে? মনে করতে পারেনি শাশ্বত। একদৃষ্টে সেদিকেই তাকিয়েছিল সে।
মেয়েটা চলে গেল! একেবারেই চলে গেল! শাশ্বতর অন্দরমহলে কথাটা ভেসে উঠেছিল আবার।
সাধারণত ছুটির দিনে একটু দেরিতেই ঘুম থেকে ওঠে শাশ্বত। অন্য দিনগুলোতে খুব সকালে উঠে অফিস যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হয়। ট্রেন আর বাস মিলিয়ে ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগে। শনি-রবি দুদিন অফিস ছুটি থাকে। অন্যান্য ছুটির দিনেও দেরিতেই ওঠা অভ্যেস। কাজের দিদিকেও দেরিতে আসার কথা বলা আছে। মালতীদিও মেনে নিয়েছে শাশ্বতর কথা। একা মানুষ। অল্প কয়েকটা বাসনকোসন আর সামান্য রান্না! এতে আর কত সময় লাগবে তার! তাই একটু বেলার দিকে এসে সব কাজ করে দিয়ে যায়।
বিজুদের পাশের বাড়িতেই থাকে পার্থ। প্রধানত ওর সূত্রেই বিজুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। পার্থর দূর সম্পর্কের কাকা সুজিত দত্ত তাকে খুব ভালোবাসতেন। বিজু আসার পরে পার্থর ভালোবাসায় নাকি টান পড়েছে, এমনটাই মনে করে ও।
রাতের আঁধার তখন যাই-যাই করছে। ভোর আসছে হামাগুড়ি দিয়ে। এই হেমন্তের সময়টায় ভোরের দিকে হালকা ঠান্ডা লাগে। সিলিং ফ্যানের স্পিড কমিয়ে, একটা বেডসিট গায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল শাশ্বত। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে মনে পড়ে না তার। হঠাৎই মাথার কাছে রাখা মোবাইল বেজে উঠেছিল। তখনই পার্থ দুঃসংবাদটা জানিয়েছে। ‘গতকাল রাতে বিজু একগাদা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে সুইসাইড করেছে।’ খবরটা শোনার পর থেকে থম মেরে বসেছিল শাশ্বত। অনেক স্মৃতি চলেফিরে বেড়াচ্ছে তার মাথায়। স্মৃতির চলাচলের মধ্যেই বেলা গড়িয়ে চলেছে নিজস্ব নিয়মে। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে আটটা বাজে, সেইসময়ই ঘরে ঢোকে বিষ্ণু।
—একটা নতুন গল্প পড়লাম কাল রাতে। ভীষণ অন্যরকম। চেয়ারে বসতে বসতেই কথাগুলো ভাসিয়ে দিয়েছিল শাশ্বতর দিকে।
বিষ্ণু কবিতা লেখে, গল্প লেখে। কিছু-কিছু নানা পত্রপত্রিকা আর ওয়েবে ছাপাও হচ্ছে ইদানিং। তার সব লেখারই প্রথম পাঠক শাশ্বত। ও নিজে অবশ্য লেখালেখি করে না, কিন্তু প্রচুর পড়াশোনা করে। সেই কারণেই বিষ্ণু নানা গল্প-কবিতা নিয়ে শাশ্বতর সঙ্গে আলোচনা করে। তার ধারণা, শ্বাশ্বত সাহিত্যবোধ অন্য অনেকের তুলনায় তীক্ষ্ণ। বিশেষত ওর গল্প নিয়ে দারুণ আলোচনা করে। অনেক ত্রুটি ধরিয়ে দেয়।
—কার গল্প? যেন কোন্ সুদূর থেকে কথাটা উচ্চারণ করেছিল শাশ্বত।
—মোজাফফর হোসেনের। মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ। দুর্দান্ত কনসেপ্ট!
—জানি। পড়েছি। তবে এখন নয়, অন্য সময় আলোচনা করা যাবে। মনটা ঠিক ভালো নেই রে বিষ্ণু।
—কী হল আবার তোর এই সক্কাল-সক্কাল!
—পাখিটা মরিল। কোন্কালে যে কেহ ঠাহর করিতে পারিল না।
—কী বিড়বিড় করছিস রে? কে পাখি? আমি তো একটা গল্পের কথা বলছি। এর মধ্যে আবার পাখি এল কোথা থেকে? হতাশ গলায় বলে উঠেছিল বিষ্ণু।
—তার পেটের মধ্যে কেবল পুঁথির কাগজ গজগজ খসখস করিতে লাগিল।
—আরে, অ্যাই শাশ্বত, কী হল তোর?
—একটা পাখি, যে উড়াল দিতে চেয়েছিল, সে মারা গেছে!
—কোন্ পাখির কথা বলছিস? কে মারা গেল? কীভাবে?
—বিজুরি, মানে বিজু। কাল রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে মারা গেছে! কীভাবে যে এত ট্যাবলেট জোগাড় করল, কে জানে! ভোরে পার্থ ফোন করে জানিয়েছে।
—বিজু? সেই মেয়েটা? তোকে যে দাদামণি ডাকে?
—হুম্।
—কেন মরল রে? জানিস কিছু?
—না। কিছুই জানি না। কোনও সুইসাইডাল নোট লিখেছিল কিনা বলেনি পার্থ।
—তুই ডিটেলে কিছু জিজ্ঞাসা করিসনি?
—না, ও যেটুকু বলেছে, সেটুকুই জানি। এর বেশি জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করেনি।
—তুই কি এখন যাবি ওদের বাড়িতে?
—যাব, তবে এখুনি নয়। আগে ওর বডি পোস্ট-মর্টেমের জন্য যাক। তারপর যাব কিছুক্ষণের জন্য। যারা আমার প্রিয়জন, তাদের মরা-মুখ দেখতে ভালো লাগে না। যেমন চিনতাম, তেমন মুখটাই স্মৃতিতে ধরে রাখতে চাই।
বিষ্ণু জানে শাশ্বতর মায়ের মৃত্যুর কথা। ওর কাছেই শুনেছে। অনেকবার বলেছে, ‘জীবিত মাকে যতবার ভাবতে চাই, মায়ের উঠোনে-শোয়ানো মুখটাই ভেসে ওঠে!’ তবু বিষ্ণুর মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল ভিন্নস্বর, ‘এখনই গেলে পারতিস, তাহলে আমিও তোর সাথে যেতাম একটু।’
—কেন যাবি? তুই তো ওকে এখানেই দেখেছিস। চিনিসও না তেমন করে! তাহলে কী করতে যাবি? মৃত শরীর দেখতে ভালো লাগে তোর?
—আরে না না, সেরকম কিছু না। তোর এখানে দেখতাম তো। খুব মিষ্টি মেয়েটা! তাই আর কি। অপ্রস্তুত বিষ্ণু জবাব দিয়েছিল।
—আমি পরে যাব। তুই বরং এখন আয় বিষ্ণু। আমি আর-একটু ঘুমোব। বড্ড ঘুম পাচ্ছে।
মাঝে মাঝে শাশ্বতর আচরণের কোনও মানে খুঁজে পায় না বিষ্ণু। এইমাত্র জানাল একজন কাছের মানুষ সুইসাইড করেছে, আর এখন বলছে ঘুমোবে! আশ্চর্য হয়ে ওর দিকে তকিয়ে থেকেছিল কিছুক্ষণ। শাশ্বতর সাহিত্য-বিষয়ক আলোচনা থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে বিষ্ণু। অন্যান্য বিষয়েও দারুণ কথা বলে। শুধু আচমকা ওর অদ্ভুত আচরণ বুঝে উঠতে পারে না ঠিক। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নীচু গলায় বলেছিল, ‘বেশ যাচ্ছি। কাল একবার আসব না-হয়।’
—সেটাই ভালো। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জানিয়েছিল শাশ্বত।
ঘুমোবে বললেও আসলে বিছানায় গড়িয়ে পড়েনি শাশ্বত। থম মেরে বসেছিল বিছানাতেই। মনে পড়ছিল বিজুরির মুখ, ওর কথা। নানা স্মৃতি ঝাঁপিয়ে পড়ছিল চোখের সামনে।
ছুটির সকালে ঘুম থেকে উঠে চা বানিয়ে একটা বড় কাপে নিয়ে বারান্দায় চেয়ারে বসা, খবরের কাগজে চোখ বোলানো, তারপর সিগারেটে টান। একাকী জীবনে এটাই তার সকালের প্রাত্যহিক রুটিন। তারপর বাজারে যায় সে। আজ আর চা বানাতে ইচ্ছে করল না। একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিল। ধোঁয়া ছাড়ল ছাদের দিকে তাকিয়ে। সেই ধোঁয়ার মধ্যে ভেসে উঠছিল বিজুর মুখ। তবে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কল্পনা ডানা-মেলার আগেই বিষ্ণু আবার ঢুকে এসেছিল ঘরে।
—ফিরে এলাম। জানি তুই ঘুমোসনি, ওসব কথার কথা। ঘুমোতে পারবিও না। একটা ব্যাপার জানতে ইচ্ছে করছিল খুব।
চোখ সরু করে বিষ্ণুর দিকে তাকিয়েছিল শাশ্বত। দৃষ্টিতে ভাসিয়ে রেখেছিল জিজ্ঞাসা।
—বিজু যে শুধু তোর পরিচিত ছিল, তা তো নয়! আমি জানি, তুই ওকে সত্যিকারের বোনের মতোই ভালোবাসতিস।
—তো!
—তাহলে এত নির্লিপ্ত কেন তুই? জলজ্যান্ত একটা মেয়ে মরে গেল, আর তুই…
—কেন উথালপাতাল করছি না? কেন গলা ছেড়ে কাঁদছি না? কেন ছুটে চলে যাইনি ওর মরা-মুখ দেখতে? এই তো তোর প্রশ্ন? আমার যেতে ইচ্ছে করছে না! একটুও ইচ্ছে করছে না বিষ্ণু, বিলিভ মি! একটা মেয়ে স্বপ্ন দেখত, সেই স্বপ্নটা যারা মেরে ফেলল, শোকের বদলে তাদের প্রতি রাগ হচ্ছে, জানিস! ঘেন্না হচ্ছে স্রেফ। মাথাটা দপদপ করছে আমার!
শাশ্বতর কথাগুলো বিষ্ণুর মনের মধ্যে পাক খায় কয়েকবার। খানিকটা ধাতস্ত হওয়ার পরে বলেছিল, ‘তুই যে বললি সুইসাইড করেছে, কিন্তু কোনও নোট রাখেনি…’
—নোট লিখেছিল কিনা জানি না। পার্থ বলেনি সেসব। আমি শুধু ওর কথাটাই তোকে বলেছি। আমার অবশ্য সুইসাইড মনে হয় না।
—তাহলে?
—তাহলে আবার কী? স্রেফ মার্ডার! প্রত্যাশার চাপ ছিল। ও নিতে পারেনি। এরজন্যই সুইসাইড। তার মানে যারা চাপ দিয়েছিল, তারাই ওকে খুন করেছে। বা বলতে পারিস মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।
বিজুকে তেমন করে চেনে না বিষ্ণু। চেনার কথাও নয়। এই এলাকায় সে থাকে না। বেশ খানিকটা দূরে তাদের বাড়ি। স্কুলে একসাথে পড়েছে শাশ্বতর সঙ্গে। মাধ্যমিকের পর থেকে স্কুল আর কলেজ আলাদা হয়ে গেছে। আর্টসের স্টুডেন্ট বিষ্ণু, আর শাশ্বতর ছিল সায়েন্স। কিন্তু সাহিত্যের টানেই আবার তাদের বন্ধুত্ব জমে ওঠে। এখন সেই বন্ধুত্ব গভীরতর হয়েছে। নিজের লেখা শোনাতে বা নতুন ভালো কোনও লেখা পড়লে সকাল-সকাল বাইক নিয়ে চলে আসে শাশ্বতর কাছে। বিজুকে এই বাড়িতেই দেখেছে কয়েকবার বিষ্ণু। কীসের প্রত্যাশার চাপ, কে দিল, সেসব তার জানা নেই। শাশ্বত এ ব্যাপারে তাকে কোনওদিন বলেনি।
—বাপ-মা মরা একটা মেয়ে কাকা-কাকির কাছে থাকত। ওঁদের সন্তান নেই বলে ওকে সন্তানের মতোই রেখেছিলেন। কিন্তু ডাক্তার হতেই হবে, এমন একটা ইচ্ছে ওর ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন ওঁরা। অথচ মেয়েটা শিক্ষিকা হতে চায়। ওর ইচ্ছে স্কুল বা কলেজের শিক্ষিকা হওয়া। পাশাপাশি বেহালা বাজানোটাও চালিয়ে যাবে!
—ও বেহালা বাজাত?
—হ্যাঁ, খুব সুন্দর বাজায়। এই একটা সময় মেয়েটা স্থির। বাকি সময় শুধুই চরকিপাক যেন। এক মুহূর্ত চুপ থাকতে পারে না। বকবক করে চলে। চোখ ঘুরে বেড়ায়। পা নড়েচড়ে…
বিষ্ণুকে নয়, যেন নিজেকেই বলছিল শাশ্বত। বিষ্ণু খেয়াল করেছে, শাশ্বত ‘বেহালা বাজায়’ বলেছে। তার মানে মরে-যাওয়াটা ওর কাছে অতীত নয় এখনও। এইরকম একটা সিদ্ধান্ত মনের মধ্যে গড়ে নিয়েছিল সে। শাশ্বত অস্থির হাতে আবার একটা সিগারেট ধরিয়েছিল। তার চোখ ছিল ঘরের ছাদের দিকে।
কিছুক্ষণ বন্ধুর দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল বিষ্ণু। মানসিকভাবে অস্থির শাশ্বতর সঙ্গে আর কথা বাড়াতে চায়নি সে। বলেছিল, ‘আমি আসছি রে। কাল আবার এইসময় আসব।’ বিষ্ণুর বেরিয়ে যাওয়ার দিকে ফিরেও তাকায়নি শাশ্বত।
বিজুরিদের বাড়ি ছিল মথুরাপুরের এক গ্রামে। নামটা আগে শুনলেও জায়গাটা কোথায়, মনে পড়ছিল না। বিজুই জানিয়েছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সেই গ্রামের নাম। তার গ্রামের মাঠ, পুকুর, ধানি-জমির কথাও বিজু খুব বলত। আর বলত তার কয়েকজন বন্ধুর কথা।
তখন এমএসসি পাশ করে শাশ্বত টিউশনি করে। পড়াশোনায় ভালো ছিল বলে অনেক স্টুডেন্ট আসত তার কাছে পড়তে। পাশাপাশি চাকরির চেষ্টাও করত। বিভিন্ন কম্পিটিটিভ পরীক্ষার বইপত্র প্রায় রাত জেগে পড়ত আর নানা জায়গায় দরখাস্ত জমা দিত। এইভাবেই একদিন চাকরিও জুটে গেল কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানে।
একদিন সবেমাত্র টিউশনির একটা ব্যাচ শেষ করে বসে আছে। সকাল তখন একটু একটু করে বেলার দিকে এগোচ্ছে। মাঝে মিনিট তিরিশের বিশ্রামের পরে আবার একটা ব্যাচ পড়াবে। বাকি দুটো ব্যাচ বিকেলে পড়াত। পরিচিত জাভেদ আলির বেড়ার ঘর ভাড়া নিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াত তখন। জাভেদ জমি কিনে রেখেছিল। জমিটা যাতে বেহাত হয়ে না-যায়, কোনও ক্লাব বা রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের হাতে, তাই একটা ঘরও তুলে রেখেছিল। সেই ঘর শাশ্বতকে ভাড়া দেওয়ায় সবদিক রক্ষা পাবে, ভেবেছিল জাভেদ। কিন্তু পারেনি। চাকরি পাওয়ার পরে শাশ্বত টিউশনি ছেড়ে দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই জমি জবরদখল করে নিয়েছিল ক্ষমতাসীন পার্টির লোকজন।
পাতা মাদুরের ওপরই শরীর ছেড়ে দিয়ে শুয়ে থাকত শাশ্বত। এমন সময় বাইরে থেকে একটা গলা ভেসে এসেছিল, ‘ঘরে আছো নাকি মাস্টার দাদা?’
চেনা কণ্ঠ, চেনা সম্বোধন। কিন্তু ও এখন এখানে কেন? কোনওদিন তো আসেনি! ভাবতে ভাবতেই বিজু দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়ে বলেছিল, ‘এট্টা বিপদে পড়ে তোমার কাছে এলাম মাস্টার দাদা।’
—তোর আবার কী বিপদ হল রে! অবাক শাশ্বত প্রশ্ন করেছিল।
—কাকামণিকে একটু বুঝিয়ে বলবে গো মাস্টার দাদা, আমাকে যেন ডাক্তার হওয়ার জন্য চাপ না-দেয়!
—ভালোই তো। ডাক্তার হওয়া কি খারাপ নাকি?
—অত ভালো-খারাপ জানি না। আমি ডাক্তার হতে চাই না। টিচার হতে চাই।
—আমার মতো টিচার হতে চাস নাকি? হাসতে হাসতে বলেছিল শাশ্বত।
—না না, স্কুলের টিচার। কিংবা কলেজের…
—তা বেশ তো। সেটাই কাকা-কাকিকে বুঝিয়ে বল!
—অনেক বলেছি গো মাস্টার দাদা। কিন্তু শোনেই না আমার কথা! যত বলি ওসব আমার ভালো লাগে না, আমি ইতিহাসের দিদিমণি হতে চাই, কিছুতেই বুঝতে চায় না। বেহালাও বাজাতে দিতে চায় না কাকিমা। বলে, গান শেখ। বেহালা বাজিয়ে কী হবে?
—সে তো বুঝলাম, কিন্তু আমার কথা ওঁরা শুনবেন কেন?
—শুনবে মাস্টার দাদা। কাকামণি আর কাকিমা তোমাকে খুব পছন্দ করে। তুমি পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলে কিনা! তুমি বললে ঠিক শুনবে।
মুচকি হাসি মুখে ছড়িয়ে শাশ্বত বলেছিল, ‘আচ্ছা বেশ, যাব বোঝাতে। নিশ্চয়ই বোঝাব। কিন্তু তুই এখন এলি যে এখানে! আমি একা থাকি এইসময়। আর আসিস না। কে কী বলবে…’
—তাতে আমার বয়েই গেল! মুখ বেঁকিয়ে জবাব দিয়েছিল বিজু। খুব হাসি পেয়ে গিয়েছিল শাশ্বতর। ‘তুমি যেও কিন্তু প্লিজ!’ বলেই চলে গিয়েছিল সেদিন।
শাশ্বত অনেক বুঝিয়েছিল বিজুর কাকা-কাকিমাকে। কিন্তু ওঁরা কিছুতেই মানতে চাননি। স্কুলের দিদিমণি হিসাবে মায়ের একটা পরিচিতি ছিল। তাঁর ছেলে হিসাবে লেখাপড়ায় ভালো শাশ্বতকে পছন্দ করতেন ওঁরা। তাছাড়া পার্থর বন্ধু বলেও শাশ্বতর গুরুত্ব ছিল। একসময় সুজিতকাকু বলাতে মাঝে মাঝে বিজুকে অঙ্ক আর ফিজিক্সও দেখিয়ে দিত।
বারবার একই কথা বোঝাতে যাওয়ায় খুব রেগে গিয়েছিলেন সুজিত দত্ত। তারপর থেকে ওঁদের সঙ্গে সম্পর্কও খারাপ হয়ে পড়ে শাশ্বতর। সেই থেকে ও-বাড়িতে আর যায় না সে। তবে শাশ্বতর সঙ্গে যোগাযোগ রাখত বিজু। তার ধারণা, সুজিতকাকুরা এই যাতায়াত জানতেন। ওকে যে বারণ করেননি, সে ব্যাপারেও সে নিশ্চিত।
বিজুকে দেখলেই নিজের বোনের কথা মনে হত শাশ্বতর। সে-কথা বলেওছিল তাকে। এক সকালে স্নান সেরে খুব সুন্দর একটা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে এসেছিল বিজু। তার হাতে রাখি বেঁধে দিয়েছিল। কতদিন বাদে কেউ তার হাতে রাখি বেঁধে দিল! ভাবছিল শাশ্বত। আচমকা তাকে প্রণাম করে বিজু বলেছিল, ‘তুমিই আমার দাদা, ফিলোজফার আর গাইড!’ খুব খুশি হয়েছিল সে। আবার তার অন্দরমহলে হু-হু করেও উঠেছিল। বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়েছিল বিজুকে। তার দূরে বিয়ে-হওয়া বোনের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল খুব।
মেয়েটা চলে গেল? একেবারেই চলে গেল? কথাটা আবার ভেসে উঠল শাশ্বতর অন্দরমহলে। নানা স্মৃতি ঝাঁপিয়ে পড়ছে শাশ্বতর চোখের সামনে। কেমন যেন একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরছে তাকে। পায়ে চটি গলিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে সে। উল্টোদিকের বাড়ির পাঁচিলের ওপার থেকে একটা ন্যাড়া গাছ দেখা যাচ্ছে। গাছের নামটা জানে না শাশ্বত। গাছটা যেন শোকগ্রস্তের মতো একা-একাই দাঁড়িয়ে আছে। শাশ্বতর তেমনটাই মনে হল। কয়েকটা ডালপালা আছে বটে, তবে একটিও পাতা নেই তার শাখায়। পত্রহীন গাছটাকে আজই সে খেয়াল করল। এতদিন সেভাবে খেয়াল করেনি।
বাতাসে শিরশিরে ভাব। এখন হেমন্তকাল। হেমন্ত কি পাতা ঝরানোর কাল! মানুষও কি ঝরে পড়ে! এই হেমন্তেই তার মা হার্ট অ্যাটাকে চলে গিয়েছিলেন। কোনওরকম সুযোগই দেননি। নার্সিংহোমে নেওয়ার পথেই জীবনের দীপ নিভে গিয়েছিল মায়ের। বাবা অবশ্য এক বর্ষা-রাতে মারা গেছেন। মায়ের কাছে তেমনটাই শুনেছে সে। বাবার কথা সেভাবে মনে নেই শাশ্বতর, তখন তার বয়স মাত্রই সাড়ে তিন। ঠাকুরদা-ঠাকুমাও নাকি হেমন্তেই চলে গেছেন। মা বলতেন মাঝে মাঝেই। মাও সেই হেমন্তেই…
বিজুও তো হেমন্তেই আত্মহননের পথ বেছে নিল! কেন চলে গেল?
শাশ্বতর বোনের বিয়ে হয়েছে বেশ খানিকটা দূরে। মামা সম্বন্ধটা এনেছিলেন। মা আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলেটা খুব ভালো, কলেজে পড়ায়, পরিবারও বনেদি। এইসব কারণেই মা পরে নিমরাজি হয়েছিলেন। বোনকে দূরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি শাশ্বত। দুজনের খুব ভাব ছিল। সেই জুটি ভেঙে যাচ্ছে বলে খুব কান্না পেত একসময়। বোনও খুব কষ্ট পেয়েছিল। তবে মেনেও নিয়েছিল দূরবর্তী শ্বশুরবাড়ি। একটা সময় বোনের দূরে-থাকাও সয়ে গেছে তার। শ্বশুরবাড়ি থেকে ওকে আসতে দেয় না খুব-একটা। মা মারা যাবার পরে এসেছিল। তারপর আর আসেনি। অনেকদিন বাদে বিজু যখন দাদা হিসাবে তাকে গ্রহণ করেছিল, তখন ভীষণ আনন্দ পেয়েছিল শাশ্বত। সেই আনন্দটাও ফিকে হয়ে গেল! হেমন্ত কি বিচ্ছেদ ঘটাতেই চায়? ভাবতে ভাবতেই হু-হু কান্না চেপে ধরে শাশ্বতকে। ঘরে ঢুকে বিছানায় শরীরটা আছড়ে ফেলে সে।
বিজুকে যখন থেকে জোর করা শুরু করেছিলেন কাকা-কাকিমা, এবং সে বুঝতে পারছিল তার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেবেন না তাঁরা, তখন থেকেই সে মনমরা হয়ে থাকত। বেহাল বাজাতে চাইত না। একের পর এক বইপত্র কিনে এনে ঘর বোঝাই করে রেখেছিলেন কাকা।
ডাক্তারিতে চান্স পেয়েও বিজুর কোনও উচ্ছ্বাস ছিল না। খবরটা বাড়ি বয়ে এসে দিলেও শাশ্বত কোনও আনন্দ দেখতে পায়নি সেদিন। বিষণ্ণ একচিলতে হাসি ঝুলছিল ওর মুখে। সেদিনই বলেছিল, ‘জানো তো দাদামণি, আমি যেন মরেই আছি। বেঁচে আছি কিনা বুঝতে পারি না!’
শাশ্বতই তাকে বলেছিল ‘মাস্টার দাদা’ না-ডাকতে। বিজু তখন থেকে ‘দাদামণি’ ডাকত। বিজুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সে বলেছিল, ‘এসব একদম ভাববি না। যে-যা চায়, তা অনেক সময় পায় না। তুই বড় ডাক্তার হয়ে ওঠ। তোর দাদামণির চিকিৎসা করবি বিনে পয়সায়, কেমন!’ সেই মজাটুকুও বিজু নিতে পারেনি সেদিন। চুপ করে ফিরে গিয়েছিল বাড়িতে।
বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে শাশ্বত। তার মাথার মধ্যে যেন কোনও একটা পোকা ঘুরে বেড়াচ্ছে আর গুনগুন করে ডেকে চলেছে, ‘পাখিটা মরিল, কোন্কালে যে কেহ ঠাহর করিতে পারিল না।’ সেইসঙ্গে অদূরে কেউ বেহালা বাজাচ্ছে, একটানা…
সকাল সকাল চোখে জল এলো। আমার মরা বোনের কথা মনে পড়ে গেল দাদা। কি অসাধারণ প্রকাশ। ধীরে ধীরে পাপড়ির মত খুলে যাচ্ছে গল্পের অন্তর্নিহিত অভিমুখ। সময় গুলো কি ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করেছেন। খুব ভাল লাগল।
উত্তরমুছুনআপনার ভালো লেগেছে এতে ভীষণ আনন্দ পেলাম। আপনি আমার প্রিয়জন। প্রিয় লেখকও। ভালো থাকবেন। বোন তো আছেই অন্দরমহলে। সেখানেই লালিত হোক আদরে আদরে।
মুছুনশ্রীকান্ত অধিকারী
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর গল্প
উত্তরমুছুনধন্যবাদ।
মুছুনখুব সুন্দর গল্প ।
উত্তরমুছুনভালো লাগলো গল্প। বেশ টানটান। অভিনন্দন জানাই।
উত্তরমুছুনআপনার মতামত প্রাণিত করে। ভালো থাকবেন।
মুছুনপড়লাম ।মর্মস্পর্শী আখ্যান।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনমনটা ভারি হয়ে গেল গল্পটা পড়ে। খুব ভালো গল্প।
উত্তরমুছুনবাসবদত্তা কদম