সমর্পিতা ঘটক



 বেমিসাল বিকেলে 

 

 হেমন্ত-বিকেলে পোস্টম্যান এল। সাইকেলে পাকা ধানের তুষ জড়িয়ে গেছে। ডানাওয়ালা ডাকহরকরা কেউই দেখেনি এর আগে। আশমানিসাদাধানি রঙ মাখামাখি মখমলি ডানা। অস্তরাগ কাঁধ জুড়ে। সমস্ত গাছ জুড়ে পাখিরা মাতোয়ারা প্রেমিকের মতো। কুহরন আর খসে পড়া পাতায় বাউল-বিকেল নীরব ছিল না মোটেই কিন্তু এমন অদ্ভুত ঘটনায় হেমন্তের শেষ বেলা বড়োই ইতস্তত। সকালটা ছিল একঘেয়েঝিম-ধরা ফকির যেভাবে বসে থাকে। বিকেল এমন অসম্ভব হবে কে জানত! ওই আলোতে দেখি ওপর থেকে গলানো-ঘি ঢেলে দেওয়া মোদকের মতো টসটসে জেগে উঠেছে সার্কাস-মাঠে তাঁবুগুলোর গম্বুজ-মাথারা

 

 জল চায় তৃষ্ণার্ত মুখ। অরণ্যগ্রামনদীপথ পেরিয়ে এতদূর! পূর্বজ প্রথিতযশা কবি অরণ্যে ঘুরতে দেখেছিলেন তাঁকে! হাতে তাঁর রঙিন চিঠি... খামের ওপর সফল কারুকাজউন্মাদনা তখনও সংক্রামক হয়নি। একপাল গরু নিয়ে ফিরছিল রাখালআজিজুল নাম। মূর্খ ভারতবাসী বলেগরু নাকি একপক্ষেরই ভগবান! হাসি পায় আজিজুলের। গরুদের চরতে দিয়ে সে ছবি আঁকে। আজিজুল চিনেছিল ঠিক ভ্যান গখকে। একবার দেখেই। ঝিলম স্যারের ঘরের দেওয়ালে ঝুলে আছে হলুদ দিগন্ত বিস্তৃত খেত। অনন্ত শষ্যভূমির একটি বিন্দুতেই যে বসে থাকে আজিজুল!  দিনভর। 

 

বিকেল নিস্তেজ হতেই খসে পড়ে সফেদ পালককানের ব্যান্ডেজে সূর্য গাঢ় লাল হয়ে বসে আছে--  ক্লান্ত রক্তশূন্য মুখের কিনারায় অস্তগামী বিন্দু... তামার ঘটি ম্লান আলোয় শ্যামা মেয়ের মতোই ঝিকিয়ে ওঠেপেতল-রঙা সন্ধে বিদেশে হয় না বোধহয়। ঘটিতে কোনোদিন জল খেয়েছেন ভিনসেন্ট? তামা তামা গন্ধ প্রাচীন উপমহাদেশের  পশ্চিমবাংলার এই প্রত্যন্ত প্রান্তে কোন জাদুবল তাঁকে টেনে নিয়ে এল! এই তামা গন্ধে কোন প্রাচীন সভ্যতা জেগে উঠছে! গভীর ইঁদারায় কপিকল শব্দ গাঁথেলোহার বালতি পড়ে ঝম করেতিনি চমকে ওঠেন। 

 

 সোনালি আলো নরম হয়। গোলাপিকমলা পালকগুলো পুরিয়া ধানেশ্রীর পথেই বিস্তার করছে পরতে পরতে... তারপর নীলচে... বেমিসাল দিন নেমে আসে... সমস্ত মায়া-খেলা সম্পন্ন হবে এবার। সভা ভঙ্গের পরই বিশুদ্ধ ভ্রমরের দল বাঁধিয়েছে গোলসূর্যমুখীরা মাথা উঁচিয়ে ঠেকাতে চায় দেউলেপনাতাদেরও ছুটি আজকের মতো। ডাকহরকরার হাত থেকে লাল খাম নিয়ে মুনিয়া ফুড়ুৎ... পশ্চিমাকাশে সেই রঙ তসবির বানায়। মুনিয়া কখন যে কী ভেলকি দেখায় বুঝতে পারা সহজ নয়। সবুজ রঙের চিঠিটি ঘাপটি মেরে ওই তো... নাকি পুরনো পাতাবাহার চৌকাঠের পাশে দুষ্টু ছেলের মতো ঘন হয়ে বসে আছে আর জুলজুলে চোখে দেখে নিচ্ছে পত্র-প্রাপকের রঙ্গিলী হতচকিত মুখ। 

 

 ‘কবে নিয়ে আমার বাঁশি বাজাবে গো আপনি আসি’... গেয়ে ওঠে কেয়া তখনইতবলার স্যার এলেন বোধহয়। শাঁখ বাজে কলোনির বাড়িগুলিতে। সাইরেন নয়’ ... থ হয়ে যাওয়া পথিক বলে ওঠে-- হোলি থিং’...ইংরেজি কেনতবে কি সেও চিনতে পেরেছে! উসখুস করে ওঠেন তিনি, এবারে অন্য পথ, অন্য ডাক তাঁকে হয়তো অস্থির করে তোলে।  হাত নেড়ে চলে যান ডানাওয়ালা পোস্টম্যানঅচেনা হেমন্ত গোধূলি আজ কেমন ঘাবড়ে গেছে... অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত তার থতমত মুখ দেখতে বেশ মজা লাগে। 

 

 আজিজুলের হাতে রংতুলি আর কাগজের রোল... গুঞ্জনফিসফাস বিরাট হয়... কে এসেছিলউঠবে ঝড় এক্ষুণিমিলিয়ে যায় ডানা... ক্রমশ বাষ্পবিন্দু সবুজ সাইকেল। 

 

 

 

মন্তব্যসমূহ

  1. উত্তরগুলি
    1. ধন্যবাদ জানাই। ভালোলাগা আমার। 🙏🏼❣️
      -- সমর্পিতা

      মুছুন
  2. কবি যখন গদ্য লেখেন এরকমই হয় বোধহয়!কি অনায়াস ছবি!

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. খুব আনন্দ হল এমন প্রতিক্রিয়া পেয়ে। আপ্লুত। ❤️🙏🏼
      -- সমর্পিতা

      মুছুন
  3. নবনীতা চক্রবর্তী২০ মার্চ, ২০২৪ এ ১১:১০ PM

    অনাবিল ,অনায়াস লেখা।ভারী সুন্দর!

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. খুব ভালো লাগছে নবনীতা, তুমি পড়ে মতামত জানালে। প্রাপ্তি অনেকখানি। ❤️❤️
      -- সমর্পিতা

      মুছুন
  4. খুব সুন্দর কল্পনার মায়াডোরে ঘেরা লেখাটি হেমন্তের পাখার বিস্তার যেন। 😊💜💜💜
    পৃথা চট্টোপাধ্যায়

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. পৃথাদি, খুব আনন্দ হল। এমন প্রতিক্রিয়া প্রাণিত করে। ❤️❤️

      -- সমর্পিতা

      মুছুন
  5. বিজয় দত্ত । অসাধারণ একটি সন্ধ্যার আগমন বার্তা !

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. আনন্দিত! 🙏🏼🙏🏼😊 আমার শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা জানবেন।
      -- সমর্পিতা

      মুছুন
  6. মুক্তোর মতো শব্দকণা!

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. 🙏🏼🙏🏼❤️ পরম পাওয়া। খুবই আনন্দ হল এমন প্রতিক্রিয়া পেয়ে।
      --সমর্পিতা

      মুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য