শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়



 আলো

   

ইভনিং ওয়াক সেরে বাড়ি ফিরে দেখি মামাতো ভাই দেবো, মানে, দিবাকর এসে মায়ের ঘরে বসে মেজদার সঙ্গে গল্প করছে। মেজদা বরাবরের লাজুক মানুষ। আমায় দেখে সে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
' দেবো, তাহলে বোস। আমি একটু ওদিকটা থেকে বুঝলি...যাই খানিক চক্কর মেরে আসি..নইলে পেটটা আবার গরবর করে..'
'হ্যাঁগো অনুপ দা, এই যে যাচ্ছো আর তো বাবা আসবে না জানি।'
আমাকে সামনে এগিয়ে দিয়ে মেজদা তার স্বভাবসিদ্ধ, কাষ্ঠ লাজুক হাসি হেসে বিদায় নেয়।
' অনুপদার রকমসকম...সত্যি, রিটায়ার করে গেল...আজও একইরকম.. হা হা হা!'
আড়ালে থাকা মানুষ মেজদার চরিত্রের দিক গুলিকে ঘিরে এমন সব রঙ্গরসাত্মক উপাদান ছড়িয়ে রয়েছে যা শুনলে না হেসে পারা যাবে না।
হাসতে হাসতেই উত্তর দিলাম,' অনেকদিন পরে এলি যা হোক। আগে বিজয়ার প্রণাম করতে আসতিস, মা কে দেখতে আসতিস, ওপাশের ঐ চৌকিতে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বাবা বসে থাকতো, কত গল্প হতো, আড্ডা, রসিকতা, খেতে ভালোবাসিস বলে মুড়ি দিয়ে নারকোল নাড়ু ছাপা সন্দেশ এসব বরাদ্দ থাকতো তোর জন্য  ...সেসব কাল, সেসব গল্প গাছা কবে বিদায় নিয়েছে..!  আসিস না কতদিন হয়ে গেল! আমারও যাওয়া হয় না, একথাও ঠিক। সেই যে মেজো মাইমার কাজের দিন গিয়েছিলাম, তারপর আর...'
' সদর দরজা ছাড়িয়ে  একতলার উঠানের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে দেখি বুড়ো দার ঘরটা খাঁ খাঁ করছে... জানলাগুলো বন্ধ...এর আগে শেষ যেবার এসেছিলাম, ছেলেরা ছিল... বৌদি এসে চা দিয়ে গেলেন...ওরা কেউ নেই? '
' বড় দার দুই ছেলে এখন আর এখানে থাকে না। চাকরি সূত্রে অনেকদিন হয়ে গেল বাইরে...যে যার মতো ঘর সংসার করছে...বৌদি বড় ছেলের কাছে থাকে...'
' বুড়ো দা র ছবিটা এখনো জলজ্যান্ত চোখে ভাসে...আমি এলেই মুখে একগাল হাসি..." দেবো এসেছিস ? বোস বাবা বোস..."
তারপর দেখি বুড়ো দা নেই...তোমাকে ভিড়িয়ে দিয়ে কোথায় যে কেটে পড়তো...আমার বোন বলতো " মুকুল দা হলো পিসেমশাইয়ের কার্বন কপি...গপ্প পেলেই হলো, ব্যাস....অনুপ দা, বুড়ো দা ঠিক তার বিপরীত স্রোত...এ হলো পিসিমার বাড়ির স্পেশাল ট্রেন্ড...এটাই মজা...এ মজা আর কোথাও পাবি না..."
সত্যি, দিনগুলো কোথায় চলে গেল..!'
' বাবা মায়ের অবর্তমানে দাদা ছিল এ সংসারে ছাতার মতো। ওঁর চলে যাওয়া বাড়িটাকে অনেক একা করে দিয়েছে রে! আমার ছেলে বলে, " বাবা চলো...কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে আমরা সেখানে...তাতে আমার অফিস যাতায়াতেরও সুবিধে হবে..."
এ বয়সে শেকড় ছিঁড়ে যাবো কোথায় বলতে পারিস? একটা স্টেজে এসে জীবনের কাছে এ প্রশ্নটাই বোধহয় সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে...একদিন এ ঘরখানা গমগম করতো লোকের ভীড়ে.... একসাথে বসে আনন্দ, হৈ-হুল্লোড়, টিভি দেখা, এই ষাট পঁয়ষট্টি  বছর আগের চিড় ধরা,রঙ চটে যাওয়া মেঝেতে গোল হয়ে পাত পেরে খেতে বসা...সময়গুলো যেন আলো হয়ে দরজার চৌকাঠে এসে পড়ে...সন্ধ্যা হলে মেজদা আর আমি এই চৌকিটাতে বসে টিভি দেখি...আগে মেজদা এসব দেখত না...ঘরেই আসতো না তেমন...অফিস থেকে ফিরে এসে খবরের কাগজ মুখে করে ঘরের কোণে বসে থাকা, খাওয়া দাওয়া সেরে খানিক পায়চারি...এর বাইরে আর কিছু...এখন আসে...চা খেতে খেতে হয়তো বা খানিক গল্পগাছা...পুরোনো দিনের কথা, আত্নীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশি, এর ওর কথা, টিভির খবরের কথা...আমি বলি, মেজদা শোনে...কখনো বা নিজে থেকে টুকটাক মন্তব্য... জানি, গল্প করার মানুষ মেজদা নন...তবু সন্ধ্যা হলে এ ঘরে চা মুড়ি খেতে খেতে এই যে এসে বসা...বুঝতে পারি কোথায় যেন অভ্যেস করে নিয়েছে মেজদা...ইভনিং ওয়াক সেরে কখনো কখনো আমার আসতে দেরী হলে একা একাই বসে অপেক্ষা করে থাকে...যেভাবে দাদা একসময় আমাদের আসার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকতো...মায়ের ঘরের সেই সন্ধ্যেবেলার চা...রান্নাঘর থেকে বৌদিদের হাঁকডাক.." এই তো এক প্রস্থ খেলে সব...এবার খেতে হলে বাইরে চায়ের দোকানে..."
সেই সব জড়িয়ে থাকা মুহুর্ত কবে, কোন অগোচরে বাড়িটাকে একা করে দিয়ে চলে গেল...
অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। কেন সেটা নিজেও জানি না। কতদিন পর এ বাড়িতে পা রাখলো দেবো! আগে দুতিন মাসে একবার করে আসতো। এখন আর...যে মানুষ গুলো একদিন অপেক্ষা করে থাকতো, সেই হারিয়ে যাওয়া অপেক্ষমান পৃথিবী..." দেবো এসেছিস? বোস বাবা বোস..."
এভাবেই কি ছোট হয়ে আসে সময়? চারিধারের বৃত্ত?

ঘরের দেওয়ালে টাঙানো বাবা, মায়ের ছবিটার দিকে খানিক তাকিয়ে থাকে দেবো। কি যেন ভাবে। সন্ধ্যার অন্ধকার ছায়া ফেলেছে মরচে ধরা জানলার গরাদে। লতাপাতায় শেষ আশ্বিণের হালকা জড়ানো হাওয়া। দূরে কোথায় বিসর্জনের পটকা ফাটছে। ঢাকের ছেঁড়া ছেঁড়া বাদ্যি। গতকাল অবধিও উৎসব শেষের আলোর কিছুটা আভা জানলার এধারে এসে পড়তো। বাতিগুলো আজ থেকে আর নেই। সেই চেনা আবহাওয়া। একটা প্রজাপতি উড়ে এসে টিউবের আলোর দিকে গিয়ে আবার মিশে গেল বাইরের অন্ধকারে, চেনা চৌহদ্দির আড়ালে।
অন্যমনস্ক সুরে দেবো বলে, ' মানুষ চলে যায়। বাড়িগুলো একা পড়ে থাকে। ঘরগুলো আরো নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। দোতলার কোণের স্টোর রুমটা ভেঙে ফেলবো স্থির করেছি। কে করবে? কে দায়িত্ব নেবে? অনেক তো দেখলাম। এবারও আমাকেই করতে হবে। যা দেখলাম,  ও ঘরের আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সেদিন ভেতরে ঢুকে দেখি মাথার ওপরকার পাথরের চাঙর খসে পড়ছে, দেওয়ালে দেওয়ালে ফাটলের বিস্তার, যে কোন সময় একটা বড় অ্যাক্সিডেন্ট...
দেড়শো বছরের ইতিহাস, সে আর কতদিন...! পুরোনোর মধ্যে ঐ একটা ঘরই অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছে, মিস্তিরি ডেকে খুব তাড়াতাড়ি.... '
দেবোর কথাগুলো কেড়ে নিয়ে কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করি, ' ভাটপাড়ার বাড়ির দোতলার কোণের ঘর...মানে দাদা যে ঘরটাতে জন্মেছিলেন...?'
' হ্যাঁ, পিসিমার মুখে শুনেছি, বাবার মুখেও শুনেছি ঐ ঘরেই বুড়ো দা... '
সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়। নস্টালজিয়া স্মৃতির সুর বয়ে আনে কোন অগোচরে। তারই রেশ যেন ঘরের চৌকাঠ ছাড়িয়ে দূরে...বহুদূরে ঘুরে বেড়ায় আবছায়া পথ ধরে.... হাতড়ে বেড়ায় জীবনের মানে...
ভাটপাড়ার বাড়িটা ছিল আমার শৈশব কৈশোরের এক অফুরন্ত, অনাবিল খুশির জায়গা। ভালোবাসার জায়গা। বাড়িতে ঢুকতেই দুপাশে দুই ফটকের ওপর ইয়া বড় হাঁ মুখওয়ালা পাথরের সিংহমূর্তি মনে হতো এখুনি বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়বে, বড় বড় থামওয়ালা সেই উঁচু চওড়া উঠোন চত্বর, উঠান পার্শ্বস্থ লেবু, কাঁঠাল, জামরুল গাছের হাওয়া, রঙবেরঙের পাখিদের কলরব, পাতার ফাঁকফোকড় দিয়ে ঠিকরে পরা চৈত্রের রোদ, আলো মাখা উঠানের কোণে চাটাই পেতে বসে মেজো মাসিমার একমনে রামায়ন পড়ে চলার সুর, উঠান ছাড়িয়ে, নাটমন্দিরের রোয়াক ছাড়িয়ে রান্নাঘরের পাশ দিয়ে বেয়ে বেয়ে ওঠা পাথরের খাড়াই সিঁড়ি, সিঁড়ির আশপাশের সুড়ঙ্গের মতো চোরকুঠুরি, দুপুরবেলা কার সেই চিলেকোঠার ছাদ, কার্ণিশ ভাঙা ছাদের ফাটলে ফিরে ফিরে আসা ঘুঘুর ডাক, ' সিল কাটাও' বলতে বলতে বহুদূরে মিলিয়ে যাওয়া মানুষ,  আলসের গায়ে গায়ে সূক্ষ্ণ লতাপাতা, কারুকার্য সমন্বিত অজস্র পাথরের জাফরি, খোদাই করা বহুযুগ আগেকার সব মূর্তি...মানব মূর্তি, পশুপাখিরমূর্তি, রাজারাজরা, ডানা মেলা জিন পরীদের মূর্তি, দোতলার কোণার ঘরের বিশালাকৃতির গরাদওয়ালা জানলার ফাঁক দিয়ে দেখা অনেক দূরের বকশিবাড়ির পুকুর ঘাট, পুকুর পাড়ের মেঠো রাস্তা, তালবাগান, কালবৈশাখীর ঝড়ে হেলে পরা তালগাছের পাতায় পাতায় ঝাপটাঝাপটি, ঈশাণ কোণে বিদ্যুতের চমক,আষাঢ়ের ঘনিয়ে আসা মেঘ, ঝড়ে বর্ষায় উঠানময় ইতিউতি ঝরে পড়া জামরুল কুড়োনোর সেই সব দিন....এ সব কিছু যেন এখনো চোখ বুজলেই ছবির মতো ভেসে ওঠে। মা বলতেন, ' ও বাড়ির বয়স আড়াইশো বছরেরও বেশি...সীমানার পাঁচিলের গায়ে একটা গোয়ালঘর ছিল...নড়বড়ে, ইঁট পাথর খসে গিয়ে হেলে পড়েছে প্রায়...শুনেছি অনেক আগে ওখানে গরু রাখা হতো..ঠাকুর্দার ছিল গরুবাছুর পোষার শখ...সেই শখের প্রকাশ লক্ষ্য করেছি বাবার মধ্যেও...পরে ঘরটাকে ভেঙেই দেওয়া হলো...গরুগুলোকে সেই যে বিক্রি করে দেওয়া হলো তারপর আর ও বাড়িতে কখনো গরু আসেনি...কলতলার চাতালের কোণে একটা বড়  ইঁদারা ছিল...আগাগোড়া পাথরের...শুনেছি ওটা নবাবি আমলের...জল শুকিয়ে গিয়ে সেটা আর ব্যবহার হত না...পরে বুজিয়ে দেওয়া হয়...বাড়ির পেছন দিকে ছিল অনেকটা জায়গা জমি...ওখানে একটা ধান ভাঙার একচালার ঘর ছিল...আর ছিল ঢেঁকি...সে ঢেঁকি খানা পরে আমাদেরই আর এক দাদুর বংশের কে যেন এসে নিয়ে গিয়েছিল। এসব আমাদের বহু ছোটোবেলায় দেখা...তারপর সেই ছিল সিঁড়ির নীচ দিয়ে গোপন সুড়ঙ্গ... একেবারে গঙ্গা পর্যন্ত চলে যাওয়া যেত...ঘন বনজঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল তখনকার এই ভট্ট এলাকা...তার সঙ্গে ডাকাতের উপদ্রব...দস্যুর কবল এড়ানোর জন্য পূর্বপুরুষের হাতে গড়া ঐ সুরঙ্গ...পালানোর গুপ্ত পথ... একবার হয়েছে কি...তখন আমার নতুন বিয়ে হয়েছে... বাবা বেঁচে..ভাটপাড়ায় এসেছি তোর বাবার সঙ্গে..এসে দেখি সবার চোখে মুখেই কিরকম যেন চিন্তার কালো ছায়া...কলরব, কোলাহল সব যেন কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে...বাবা কপালে ভাঁজ নিয়ে অহরহ পায়চারী করছেন বারান্দার এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো...দিনের বেলাতেই দরজায় সব খিল আঁটা..জানলার কপাটগুলোও প্রায় তাই। এমন সময় বাবা আমায় ডাকলেন.." জামাই বাবাজীবন কোথায় রে? একবার ডাক তো খুকি.."
বাবার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে সাহস হলো না আর কোনো প্রশ্ন করার। তবে কিছু একটা গুরুতর ব্যাপার যে ঘটেছে বেশ বুঝতে পারছি। দুরুদুরু বুকে ঘরের দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে শুনি বাবা ফিসফিস করে বলছেন, " একটা ভয়ানক ব্যাপার ঘটে গেছে হে... এই কাগজের টুকরো খানা কাল রাতে দলা পাকানো অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা গেছে...যেই না খুলেছি..একবার দ্যাখো, তাহলেই বুঝবে.."
তোর বাবার তো দেখামাত্রই চক্ষু চড়কগাছ!
" এ যে রক্ত দিয়ে লেখা হুমকি চিঠি! " খুব হুঁশিয়ার, কাল আসছি.."
বাবার কথায়, এ নির্ঘাত ডাকাতের কাজ! জানলা খোলা পেয়ে ছুঁড়ে মেরে চলে গেছে...খাঁড়ার ঘা নেমে আসার আগেই বাড়ি খালি করে পাততাড়ি গুটোতে হবে...! পাশের কঙ্কালীতলাতেও মজুমদার বাড়িতে ঠিক এই কায়দায় হুমকি চিঠি ফেলে রেখে গিয়েছিল।  ডাকাতরা এসেছিল পরের দিন। মজুমদার বাড়িতে নয়। তার দুটো বাড়ি পরে। ধোঁকা খেল মজুমদার, আর ঘরে ধনসম্পদ যা ছিল সব দিয়ে শেষকালে প্রাণে বাঁচলো পাশের প্রতিবেশী কালীকিংকর।
ঠিক হলো বাড়িতে সোনাদানা, টাকাকড়ি যা আছে সব পোঁটলা বেঁধে গোপন সুড়ঙ্গের ভেতর অন্ধকার কুঠুরিতে সরিয়ে ফেলা হবে। তারপর ডাকাতের পায়ের আভাস পেলেই বাড়িসুদ্ধ লোকজন মিলে গভীর সুড়ঙ্গ পথে সোজা গঙ্গাবক্ষে পাড়ি। গঙ্গার ওপারে পিসিমার বাড়ি। দরকার হলে সেখানেই বেশ কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে তারপর না হয়....
সকলের ভয়, আতঙ্কে জল ঢেলে শেষমেশ ডাকাতের দল অবশ্য আর আসে নি। তবে যখনকার কথা বলছি, তখন এসবের উপদ্রব অনেকটাই প্রশমিত হয়ে এলেও একেবারে বন্ধ হয়নি। গ্রাম, মহল্লায় আলেকালে এক দুটো ডাকাতির ঘটনা ঘটলে মাইলকে মাইল সাড়া পড়ে যেত। যে কারণে ঘটনার চাইতে আতঙ্ক ছিল অনেক বেশি। পূর্বপুরুষের মুখনিসৃত সেসব আতঙ্কের কাহিনী মানুষকে নাড়া দিত অহরহ।  নদীতীরের শ্মশান ঘাট ছাড়িয়ে লোকালয়ের বাইরে বিস্তৃত ঘন জঙ্গল, বনবাদাড়, বাঘ শেয়ালের আনাগোণা, ডাকাতের হাতে প্রাণ হারানো, বাঘে খাওয়া ছিন্নভিন্ন পচাগলা ঝোপেঝাড়ে পড়ে থাকা মৃতদেহ, চারপাশে শকুনের পাল... ওসব আমাদের জন্মেরও আগের কথা। আমাদের কালে এসব আমরা দেখিনি। যা ছিল, যা দেখেছি তাও একদিন বিদায় নিল। ডাকাতের ভয় বিদায় নিল, বাঘের ভয় বিদায় নিল...। লোক যেত না বহুকাল। ভাটপাড়ার বাড়ির চারপুরুষ আগেকার সে সুড়ঙ্গ পথ পরিত্যক্ত হতে হতে সাপখোপের বাসায় পরিণত হলো। তারপর একদিন সিমেন্ট, পাথর এনে মিস্তিরি ডাকিয়ে...বাবা বলতেন, ওসবের বয়স আড়াই শো,তিনশো বছরের বেশি বৈ কম হবে না...আরো কত কি ছিল...কালে কালে সব মিস্তিরি ডেকে ভেঙে দিতে হয়েছে....ওর ওপরে নতুন ভিত তৈরি হয়েছে... মাটি খুঁড়লে হয়তো আরো অনেক কিছু...তোদের কালে তোরা যেগুলো দেখেছিস..ঘরদোর, নাটমন্দির, দালান, চিলেকোঠা, উঠান...ওগুলো অনেক পরেকার...পিতামহ, প্রপিতামহ এঁদের আমলে তৈরি...তাও একশো দেড়শো, কোনো কোনোটার দুশো বছর হয়ে গেল...যেমন বারান্দা আর ছাদের রেলিঙের গায়ে গায়ে ঐ মার্বেলের মূর্তি গুলো আর সদর দরজার দুপাশের পাথরের গম্বুজের ওপর ঐ হাঁ করা সিংহের মূর্তিদুখানা...বাবা বলতেন," তাবৎ ভাটপাড়া অঞ্চলে চৌধুরী বাড়ি বাদ দিলে এত পুরোনো বাড়ি আর খুঁজে পাওয়া যাবে না..."
ভাবলে কিরকম সব গল্পের মতো মনে হয়..! '
হয়তো সত্যিই তাই। মায়েদের কালে মা যেগুলো দেখে এসেছেন, আমার শিশুবেলায় ঐ বুজে যাওয়া ইঁদারার টুকরো অংশটুকু ছাড়া সেসবের কিছুই দেখা হয়ে ওঠে নি। বদলে যা কিছু দেখেছি, যা চোখে ভেসে এসেছে তার সবটুকু  নিয়েই থেকে গিয়েছে আমার শৈশবের মামারবাড়ি। আমার হারিয়ে যাওয়া দিনের এক দুষ্প্রাপ্য ভালোলাগার জগৎ। তারপর যখন দেখলাম আমার চোখের সামনেকার সেই জগৎ আর তার অস্তিত্বের স্মারকগুলো এক এক করে নড়বড়ে, দূর্বল, ভগ্নদশা প্রাপ্ত হতে হতে সময়ের স্রোতে বিলীন হয়ে যেতে বসেছে ততদিনে আমি চাকরি জীবনের অনেক কটা বছর পার করে এসেছি। মামা বাড়িতে আগের মতো সে যাতায়াত আর নেই। তিন মামা, মামীমা, মাসিরা, মাসতুতো ভাই, দিদি, বোনেরা মিলেমিশে যে বাড়ি একদিন মুখর হয়ে থাকতো সদা প্রাণোচ্ছলতায় সে পরিবেশ, সেসব দিন আর নেই। দুই মামা গত হয়েছেন, ছোট মামা বাড়ির বাইরে বহুদিন নিরুদ্দেশ, মাসীমা, মাসতুতো বোনেদের মধ্যে  দুজন বাদে প্রায় সকলেরই বিয়ে হয়ে গেছে...বাড়িতে পুরুষ মানুষ বলতে তখন মেজো মামার দুই ছেলে দেবো আর ওর ভাই কুনাল, আর বড় মামার একমাত্র ছেলে গণেশ দা।  আমার দাদু, স্বর্গত প্রসন্ন কুমার রায় ছিলেন বাড়ি অন্ত প্রাণ। আড়াইশ তিনশো বছরের বাড়ির মেরামতির যে কাজ তাঁর হাত ধরে শুরু হয়েছিল, পরবর্তী কালে মেজো মামা সেই কাজকেই আরো অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যান। দেবো ডাক্তার হবার পর বাড়ির খোলনলচে আরো বদলে যায়।
অস্তিত্ব আর অনস্তিত্বের মাঝে আজ আর সত্যিই বোধহয় কোনো পার্থক্য নেই। যা ছিল, যা নেই... সবটাই গল্পের মতো লাগে, শুধু... ' পুরোনোর মধ্যে ঐ একটা ঘরই অবশিষ্ট.. '
তারই রেশটুকু বুকে নিয়ে দেবোকে জিজ্ঞেস করলাম, '  আমি অনেককাল আগে একবার ঐ ঘরে ঢুকেছিলাম..সে অনেকবছর....বড় মামীমা তখন অসুস্থ...  ও ঘরটাতেই থাকতেন...সেদিন অবিশ্যি ছিলেন না। বোধহয় কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নিস্তব্ধ ঘর। একটা ছোট চৌকি ছাড়া আর কিছু নেই। জানলার সেই ছোটছোট খুপরি গুলো...দেওয়ালের গায়ের সেই ঘুলঘুলিটা.. দিনের আলো ফুরোলে যার ভেতর সেজ বাতি জ্বালিয়ে রাখা হতো...আগুনের তেলচিটে দাগগুলো পর্যন্ত অ্যাজ ইট ইজ রয়ে গেছে...তখনকার দিনের সেজের আলো...কি অদ্ভুত! নীচের লাল কালো চড়কা কাটা মেঝেটার দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম...চারিপাশে আমি আর দাদা মিলে সেই ছেলেবেলাকার নীল লাল হলুদ রংপেন্সিলের দাগগুলো আজও ঠিক তেমনি...মায়ের আঁতুড়ঘরের শেষ চিহ্ন....'
জানলার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবে দেবো। তারপর ধীর কন্ঠে বলে, ' বড় জেঠিমা  ছিলেন হিস্টিরিয়ার পেশেন্ট। বাবা নিজে ট্রিটমেন্ট করতেন। বাড়ির দুএকজন ছাড়া আর কেউ বিশ্বাস করে নি সে কথা। খবর রটে যায় ওনাকে ভূতে পেয়েছে। তাই মৃত মানুষ দের মতো গলা করে রাতবিরেতে ওরকম অদ্ভুত ভাবে কথা বলতে থাকেন। কখনো বা কান্না, কখনো বা হাসি। সে হাসি, কান্নার সুরেও মৃত মানুষেরই ছায়া।  দোতলার কোণের ঘর থেকে সেই অদ্ভুত কন্ঠস্বর নাকি পাড়া প্রতিবেশিদেরও কানে এসে পৌঁছেছে...! বাড়িতে ওঝা ডেকে আনার কথা হলো। বাবা ভয়ংকর রেগে গিয়ে পত্রপাঠ সে ওঝাকে বিতাড়িত করলেন। আর তারপর থেকেই ভূত যেন আরো ঘাড়ে চেপে বসলো। হামাগুড়ি দিতে দিতে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে নীচে নেমে আসা, নাকেসুরে কথা বলা, ঘরের জানলা দিয়ে মুখ বের করে ভর সন্ধ্যেবেলায় মৃত মানুষের গলায় ভয় দেখানো...কিছুই বাদ গেল না। আত্নীয় স্বজন, চেনা পরিচিত মানুষ বাড়িতে এলেও পারতপক্ষে কেউ আর সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতো না। কারন উঠলে পরে সামনেই সেই দোতলার কোণের ঘর...যে ঘর জুড়ে  বড় জেঠিমার অবাধ পদচারণা। নাম হয়ে গেল ' ভূতে পাওয়া ঘর।' চেনা পরিচিত, পাড়ার লোক বাড়িতে এলেও পারতপক্ষে কেউ আর দোতলার দিকে ঘেঁষতে চাইতো না।
কি বলবো একে? অজ্ঞতা? সেকেলে মানসিকতা? বাজে কুসংস্কার না কি অন্য কিছু? সে যা ই লুকিয়ে থাকুক, বাস্তবটা হলো এই... বড় জেঠিমার মৃত্যুর পর থেকে দিনের পর দিন ঘরটা অব্যবহৃত হয়ে পড়ে রইলো। খালি, শূণ্য, শব্দহীণ। একসময় বাড়ির তালাবন্ধ স্টোররুম। সেসব নেহাৎ আজকের কথা নয়। তবু অদ্ভুত ভাবে প্রাসঙ্গিক! ঐ যে বললাম, বাড়ি একা হয়ে গেলে সে বাড়ি হয়তো আবার কখনো লোকজনে ভরে উঠতে পারে, না ও পারে....ঘর একা হয়ে গেলে সেখানে নিঃসীম শূণ্যতা ছাড়া আর কিছুই থাকে না। শেষের দিকে মাঝেমাঝে দুপুরবেলা বড় জেঠিমাকে দেখতাম জানলার গরাদ দুটো আঁকড়ে ধরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে...ঘরটার দিকে এলোমেলো দৃষ্টিতে কি যেন খুঁজে বেড়াতে...চারিদিকে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। সে নিস্তব্ধতার একরকম ভাষা। তুমি যে চোখে বুড়ো দা, মানে বড় পিসিমার আঁতুড়ঘরের দিকে তাকিয়ে ছিলে সে নীরবতার আর এক মানে। পরিত্যক্ত তালাবন্ধ ভূতে পাওয়া ঘর হয়ে পড়ে থাকা দোতলার স্টোররুম..সে নিঃস্তব্ধতার ভাষা...সে ভাষা পড়ার মতো ইচ্ছে বা আকাঙ্খা এই মূহুর্তে কোনোটাই আমার নেই...ভাঙাভাঙির কাজটা যত তাড়াতাড়ি শুরু করা যায় ততই মঙ্গল।'
...' ভূতে পাওয়া ঘর...' নামটা যদিও আমার কাছে নতুন নয়। কাহিনীও নতুন নয়। মা বলতেন,
....' সে দৃশ্য নিজের চোখে দেখা...আজও ভাবলে বুকের ভেতরটা কিরকম করে ওঠে! সে আমার কোনকালে এক বড় পিসিমা ছিল...কবে মরে হেজে গেছে! বড়দি মারা গেছে তা ও তো সে বহুবছর! যাদের সঙ্গে সাতজম্মে বড় বৌদির দেখা হয় নি, দেখা হবার কথাই নয়, তাদের মতো অবিকল গলা করে,  এক মাথা ঘোমটা টেনে মাঝ রাত্তিরে সকলকে চমকে দিয়ে আচমকা ঐ ডাক...ভূতে পাওয়া কান্ড ছাড়া কি বলবো? তার তো কারণও আছে। বৌদির জমজ বোন তখন সদ্য মারা গেছে। আমাদের পাশের মাঠে চুপি চুপি গিয়ে নিমগাছতলায় একা বসে ভরদুপুরে এলো চুলে বৌদির ঐ বিনিয়ে বিনিয়ে কান্না...ঐ অমঙ্গলের হাওয়া বাতাসগুলো লেগে লেগেই তো এমনটা হলো...মেজদা কত চিকিৎসা করলেন...কিছুতেই কি কিছু হলো? ওঝাটাকে তো তাড়িয়েই দেওয়া হলো। শেষকালে একদিন দেখা গেল চোখ উল্টে মেঝেতে মরে পড়ে আছে বৌদি। আলুথালু বেশ। মণি দুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে এসেছে! সে কি ভয়ানক দৃশ্য...! বড়দার সাহসও ছিল! ঐ ভূতে পাওয়া মানুষকে নিজে হাতে খাইয়ে দিয়েছে, স্নান করিয়েছে, শাড়ি জামা সব বদলে দিয়েছে...তারপর যখন মরে গেল, বড়দাকে দেখতাম, কিরকম যেন একা হয়ে গেল...একটু একটু করে শরীর ক্ষইলো...মন তো আগেই...নিজে গিয়ে দাদাটাকেও নিয়ে চলে গেল...'
এ কাহিনী আমাদের বাড়িতে অনেকেই শুনেছে। আমার ছেলে এত বড় হয়ে গেল, তবু ভাটপাড়ার কথা উঠলে আজও সেই কিশোর বেলার কৌতুহল চলকে ওঠে ওর চোখেমুখে...' সত্যিই কি তোমার বড় মামীমাকে ভূতে পেয়েছিল বাবা? ঠাকুমা যে বলতেন...ভাবলে কিরকম অস্বাভাবিক লাগে! '
' ওসব তখনকারদিনে চলতো। তখন মানুষ অনেককিছুই বুঝতো না, যা এখন বোঝে। তাছাড়া পরিবেশগুলোও অন্যরকম ছিল। এইসবকিছু মিলিয়ে...'
'তাহলে  ভূতে পাওয়া ঘর কেন বলতো বাবা? ঐ ঘরে তো বড় জেঠুর জন্ম হয়েছিল, সেটা কেন ভূতে পাওয়া হতে যাবে? '
' সবই মানুষের রটনা আর কল্পনা। '
' আচ্ছা বাবা, তোমার সেই বড় মামীমা কি সত্যিই মাঝরাতে মৃত মানুষের মতো গলা করে...ঠাকুমা যে বলতেন..'
' আমি কি দেখেছি সেসব নাকি সেই সময়গুলোতে ওখানে ছিলাম? কি করে বলবো বলতো?'
এতদিন পর, এত বছর পর, এত যুগ পর আজ আর সত্যিই এ প্রশ্নকে মানুষের দরজায় নিয়ে যাবার কোনো ইচ্ছে বা আকাঙ্খা আমার নেই। কোনোদিনই কি ছিল? জানি না।

সন্ধ্যার অন্ধকার গভীর হয়ে আসে। ঝাপসা আলোয় ঝিঁ ঝিঁ পোকার মৃদু ডাক ভেসে আসে মায়ের ঘরের জানলার বাইরে সীমানার পাঁচিলের এদিক ওদিক থেকে। দেবো উঠে পড়ে।
' তোমাদের কথা খুব মনে পড়ছিল, তাই ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম। একদিন পারলে এসো। কত বছর যাও না! গেলে তো তুমিই যেতে। শেষের দিকে কচিত কদাচিত উৎসব অকেশানে হয়তো বা দেখা হতো কারো কারো সঙ্গে। এলে আমি থাকতে থাকতে একদিন এসো।'
' তার মানে? কোথায় যাবি তুই?'
' একটা বাড়ি কিনেছি। গঙ্গার দিকে। ওখানেই শিফট করবো। '
' তাহলে ও বাড়ি?'
' ওপর তলায় ভাই রয়েছে। রিটায়ারমেন্টের পর ঐ যা যেটুকু পেয়েছে...সংসারটা চলে যায় আর কি। নীচতলায় আমার প্রপার্টিটা যেমন আছে থাকবে। ছেলেটার যদ্দিন না চাকরি বাকরি কিছু হয়, ওটা ওর ভবিষ্যৎ হয়ে থাকলো। ইন ফিউচারে ভাড়া দিয়েও...তার জন্য বাকি যে অংশটুকু রয়ে গেছে সেটা ডিমোলিস করা একান্ত জরুরি। লোকের কাছে ভূতে পাওয়া ঘর হয়ে পড়ে থাকলে তারা কেনই বা আসবে সে বাড়ির খোঁজে?
সেদিন বিকেলে পাশের বাড়ির চক্রবর্তী বাবুর ছেলে একটি বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়ি এসেছিল নিজের ছেলের পৈতের নেমন্তন্ন করতে। বাচ্চাটির বয়স বছর দশেকের মতো। তাদেরই কোন এক দূরের আত্নীয়। বেড়াতে এসেছে। গল্পের ফাঁকে হঠাৎ আমাদের খেয়াল হয় শিশুটি নেই। এই তো ওদিকটায় ছিল...কোথায় গেল...খোঁজ খোঁজ..! শেষকালে কি মনে করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে দেখি ছাদে কার একটা ছায়া ঘোরাফেরা করছে, ইতস্তত পায়ের আওয়াজ! বাচ্চাটি কখন কোন ফাঁকে ছাদে উঠে আপন মনে খেলতে শুরু করেছে তা আমরা কেউই টের পাই নি। রিনোভেট করা ওয়েল প্রটেক্টেড ছাদ, মানুষ সমান রেলিং...ভয়ের কোনো কারণ নেই, তবু বেলাশেষের সে আলোয় কে যেন অতর্কিতে সামনে এসে দাঁড়ালো এক অন্য অতীতের ছায়া হয়ে... যখন সন্দীপ, মানে চক্রবর্তী বাবুর ছেলের মুখ থেকে প্রায় তীরের ফলার মতো শব্দগুলো ছিটকে এলো... ' তোমার তো সাহস কম নয়... একা একা ছাদে গিয়ে... জানো, এই ছাদের নীচে একটা তালাবন্ধ ঘর আছে...সেখানে ভূত থাকে? সত্যি দাদা, কত দিন পর এ বাড়িতে পা রাখলাম! তোমাদের বাড়িটা কত নিরিবিলি, শুনশান হয়ে গিয়েছে...!'
ন্যাচারেলী, এসবের প্রতিক্রিয়ায় একটা বাচ্চা, সে তো তার সরল অভিব্যক্তিই প্রকাশ করবে।
...' কোন ঘরে ভূত আছে, কখন বেরোয়, দেখতে কেমন, তোমরা কি দেখেছো সেই ভূতকে...'
শিশু মনে যেসব প্রশ্ন আসে আর কি...
ইনফ্যাক্ট বড় জেঠিমার মৃত্যুর পর থেকে ও ঘরে আর কেউ বাস করে নি একথা যেমন ঠিক, আবার এও ঠিক, সময়ের সাথে সাথে ভয়, আতঙ্ক, কৌতুহল, জিজ্ঞাসা...এসব শব্দ গুলো বলতে গেলে মুছেই গিয়েছিল...একটু একটু করে মিশে গিয়েছিল বাড়ির অন্দরমহলের নিত্যদিনের জীবন চর্চায় অব্যবহার্য জিনিসের স্টোররুম হয়ে। আজ এতবছর পর সন্দীপ যে খেয়ালেই কথাগুলো বলে থাকুক না কেন, দেড়শো বছর আগের একটা ভেঙে পড়া স্ট্রাকচার আজও কি অদ্ভুত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে, মানুষের চর্চায়.. একবার ভাবো..! "নিরিবিলি... শুনশান..." বাড়িতে একটা বহুকালের পুরোনো গ্র্যান্ডফাদার ক্লক ছিল। পিতামহের আমলের। ছোটোবেলা থেকে একতলার বারান্দায় দেখে এসেছি। ঘরদোর নিস্তব্ধ হয়ে গেলে খাঁ খাঁ উঠোন জুড়ে পেন্ডুলামের টিকটিক শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যেত না। যেই না রাত বারোটার ঘন্টা পড়তো, তার ঠিক পরে পরেই দোতলার কোণের ঘর থেকে বড় জেঠিমা খোনা গলায়...এক অদ্ভুত রিলেশন! আজ আর সে দিন নেই। ঘড়ির আয়ুও শেষ হয়েছে। বাড়িটা সেদিন নিরিবিলি ছিল না। আজ হয়েছে। রিলেশনের সংজ্ঞা বদলেছে। সে জায়গায় দাঁড়িয়ে একজন বাইরের মানুষের পক্ষে মরচে ধরা বন্ধ দরজার তালা খুলে সে চৌকাঠ পেরোনো দুঃসাধ্য শুধু নয়, অকল্পনীয় তো বটেই! এনি ওয়ে, আমায় তো আসতেই হবে। রাস্তার সামনের ঘরটাতে যেমন চেম্বার করি, ওটা তো থাকবেই...'
বলতে বলতে ঘরের চৌকাঠের দিকে এগিয়ে যায় দেবো। কি একটা ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ে। ঘাড় ফিরিয়ে বলে, ' সম্ভবত ও বাড়িতে এটাই আমার শেষ কাজ। স্ট্রাকচারাল ডিমোলিশন। সেটা কমপ্লিট হয়ে গেলে নিজের কাছে আর আমার কোনো দায়িত্ব থাকে না...'
আস্তে আস্তে উঠোন পেরিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে যায় দেবো। খাঁ খাঁ বাড়িটা নিঃস্তব্ধ হয়ে আসে আরো। মহিলারা বাবার তরফের এক আত্নীয়ের বাড়ি সাধের নেমন্তন্ন খেতে গেছে। ফিরতে দেরি হবে হয়তো আরো কিছুটা। ছেলেরা নেই। যে যার কাজে বাইরে। থাকার মধ্যে আমি আর মেজদা বাড়ি আগলে। এইভাবেই ক্রমশ যেন ছোট হয়ে আসছে জীবন বাইরের পৃথিবী থেকে এক দিন এক দিন করে। কাছের মানুষ দূর থেকে দূরে সরে আসছে। তত এগিয়ে আসছে এই বাড়ি ঘরদোর, সিঁড়ি, উঠান, চিলেকোঠা...। চায়ের কাপ হাতে মেজদার জন্য অপেক্ষা করে থাকা সন্ধ্যাটুকু এক ভিন্নতর ছায়ার সামনে দাঁড়িয়ে আজ কোন অগোচরে পেরিয়ে চলে গেল বুঝতেও পারলাম না।
দেবোকে সদর দরজা পার করে এগিয়ে দিলাম। রাস্তায় লোক কমে এসেছে। একটা হালকা হিমেল হাওয়া সামনে পুকুর ঘাটের ধার বরাবর ব্র্যাডলি ট্যাঙ্কের মাঠ পেরিয়ে এদিকেই আসছে। রাস্তা ছাড়িয়ে ঐ মাঠের ওপর দিয়ে এগোতে থাকে দেবো। কাছেই' রেলস্টেশন। আরো কাছে রেললাইন। এগোতে এগোতে অন্ধকারে গাছগাছালীর আড়ালে একটু একটু করে মিলিয়ে যায় তার ছায়ামূর্তি।
....' ও বাড়িতে সম্ভবত এটাই আমার শেষ কাজ...স্ট্রাকচারাল ডেমোলিশন...'
মানুষ চলে যায়। মিশে যায় অবয়ব হয়ে। কথাগুলো ছড়িয়ে থাকে হালকা জড়ানো হিমেল হাওয়ার মতো, উড়ো খই হয়ে।

মেজদা আসছিলেন ।
' দেবোকে দেখলে দাদা?'
' কই চলে গেল নাকি?'
' তুমি যেদিক দিয়ে এলে ঐ দিক দিয়েই তো গেল...এই তো সবেমাত্র '
' দেখেছিস, তাহলে অন্ধকারে টের পাই নি'
' তাই হবে।'
পুকুর পাড়ে ঐদিকের স্কুল মাঠে ষোলোর পল্লীর ঠাকুর ভাসান হয়ে গিয়েছে। লাইটিংয়ের বন্যায় জল আলো হয়ে ছিল এইকটা দিন। আমাদের সামনের মাঠে বিরাট মেলা। প্রতিবারই হয়। পুজো হয়ে গেলে আবার সব চুপচাপ। চেনা পরিবেশ অচেনা করে তোলে পাশের মানুষকে ঝুপসি অন্ধকারে।
' মুকুল।'
' কিছু বলবে দাদা?'
মেজদার গলায় কিসের যেন ইতস্তততার সুর।
' একদিন যাবি ভাটপাড়ায়?'
' তুমি যাবে দাদা?'
' শেষ কবে যে গেছি তা আজ আর মনেও নেই রে। '
' দেবো থাকতে থাকতে তাহলে চলো একদিন।'
' কেন? কোথায় যাবে ও?'
' দেবো শিফট করছে। অন্য জায়গায় বাড়ি কিনেছে। '
' মেজো মাইমা নেই। ওর আর পিছুটান কিসের। '
' তাই হয়তো হবে। পারিবারিক ব্যাপার। '
মেজদা চুপচাপ। কিছুটা অন্যমনস্ক। একটা ট্রেন দূর থেকে হুইসিল মারতে মারতে এগিয়ে এসে ঝড়ের বেগে মিলিয়ে যায়।
' কালকে যদি যাওয়া হয়..মানে, তোর কোনো কাজটাজ নেই তো? না গেলে হয়তো অনেক দেরী হয়ে যাবে..!'
অবাক হয়ে তাকালাম। যে বাড়ির সিংহদরজায় বিগত তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছরে যে মানুষ ভুলক্রমেও কখনো প্রবেশ করেছে কিনা জানা নেই সে কিনা....এই কি আমার সেই মেজদা!
' মায়ের সেই আঁতুড় ঘরটা, বুঝলি মুকুল, অনেক ছোটোবেলায় দেখেছিলাম, দেওয়ালের কুঠুরির গায়ে গায়ে সেজ বাতির সব কালো তেলচিটে দাগ...দেবো বলছিল, ওগুলো নাকি একই রকম রয়ে গেছে। শুনেছি, দাদার জন্ম হয়েছিল রাতের দিকে। সেজের আলোয় পৃথিবীর মুখ দেখা। কি জানি, সেই থেকে কি একটা মনে হচ্ছিল...মনে হচ্ছিল এতক্ষণ ঐ আলোটুকুর পেছন পেছনেই যেন হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম...রাস্তা, সেখান থেকে স্টেশন, এই মাঠ...কাল যদি একবার সকাল সকাল তুই, আমি মিলে....ভেঙেই যখন দেবে বলেছে তখন কি আর সে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকবে? পৃথিবীতে কে ই বা কার জন্য অপেক্ষা করে থাকে...'
একা না হলে আমার এই মেজদাকে হয়তো আজ এভাবে আমি চিনতে পারতাম না।।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য