রবীন বসু



 মায়া সরে যায় সন্ধ্যার আঁধারে


গতকাল দুম করে একটা ছুটির অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে দিল অনির্বাণ। দিন দশেকের জন্য।  কলিগরা সব হা হা করে ওঠে। "তুমি পাগল? এখন জানুয়ারি। এই মাসের শেষেই প্রোমোশন লিস্ট বের হবে। এখন ছুটি নেওয়া মানে নিজের পায়ে কুড়ুল মারা। ভেবে সিদ্ধান্ত নাও।"

অনির্বাণ যে ভাবেনি তা নয়।  এমনকি এখনও ভাবছে। কিন্তু সে নিরুপায়। একটা গলা, হারিয়ে যাওয়া হাসিময় রিনরিনে একটা গলা‌। সব সময় কানে বাজে। ঘণ্টা নাড়ার মত অনবরত তার বেজে যাচ্ছে অনির্বাণের ভিতরে। "তুই কী বোকা রে অনিদা !"

আসলে একটা স্বপ্ন তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। প্রায় ভোররাতে সে স্বপ্নটা দেখে। ধান কাটা হয়ে গেছে। মাঠে খড়ও পড়ে নেই। বিস্তৃত সবুজ কলাইখেত। লকলক করছে কচি কলাইশাকের ডগাগুলো। তার ভিতরে পা ডুবিয়ে মাঠের আলপথ ধরে সে আর এক কিশোরী দৌড়চ্ছে। পৌষ শেষের ছোট্ট বেলা তার হলদেটে ম্লান অল্প আলোটুকু নিয়ে যাই যাই করছে। এবার ঝুপ করে সন্ধ্যে নামবে। সংক্রান্তির মেলা ফেরত দুটি ছেলেমেয়ে দৌড়চ্ছে পরস্পর হাত ধরে। অন্ধকার হবার আগেই বাড়ি ফিরতে হবে। না হলে পিঠে বাড়ি পড়বে। বাড়ির গিন্নি আর দাদারা খুব কড়া। কাউকে বলে আসেনি। এতক্ষণ হয়তো হুলুস্থুল পড়ে গেছে। শীতেও ঘামে ভিজে গেছে দু'জন। 

"আয় তাড়াতাড়ি, আয়!" কিশোর তাড়া দেয়। হাঁপাচ্ছে কিশোরী। দম নেই, পারছে না আর। তবুও চেষ্টা করতে গিয়ে হোঁচট খেল। দু'জনে ছিটকে পড়ল কলাইখেতে। কিশোরের বুকে কিশোরী। গরম নিঃশ্বাস পড়ছে মুখে। ওঠানামা করছে বুক হাপরের মত। পরস্পর শরীরের গন্ধে আবিষ্ট হচ্ছে তারা। গভীর আবেগের গোপন স্পর্শ বয়ঃসন্ধির নিষিদ্ধ দরজা খুলে দিল। কিশোর  অস্ফুটে বলল, ''জল''।

"জল কোথায় পাব?" কিশোরী কিশোরের বুক থেকে উঠে বসল। ফ্রক খুলে ফেলল। তারপর ওর সদ্যফোটা পদ্মকলি বুকের ওপর চেপে ধরল কিশোরের মুখ। "নে খা"‌। আশ্চর্য এক শীতলতায় ডুবে গেল কিশোর। অমৃত সুধার ধারা ঝরে পড়ল মাঠে মাঠে। উপরের নক্ষত্রভরা আকাশ নেমে এলো মাটিতে। মায়া স্পর্শ পেয়ে গেল পৃথিবী। মোহময় এক চন্দনের গন্ধ জন্ম নিল বালিকার বুকে। বালক পাগল হয়, বালিকা আতুর। অধরে অধর রেখে জন্ম হল ব্যথাতুর প্রেম।

কিন্তু যত দিন গেল, স্বপ্নের সেই কিশোরী, মনে না পড়া আবছা ফেরিঘাট, আকুলিবিকুলি স্মৃতি, অনির্বাণকে তোলপাড় করে। অফিসের কাজে মন বসে না। প্রায়ই ভুল হয়‌। উদ্দেশ্যহীন ভাবে বেরিয়ে পড়ে। আনমনে রাস্তা হাঁটে। অন্ধকারে সাঁতার কাটতে কাটতে গতকাল সে খড়কুটোর সন্ধান পেয়ে আঁকড়ে ধরেছে। এই স্বপ্ন আর স্মৃতিকে সে খনন করবেই। 

অনুসন্ধানের প্রথম ধাপ অফিসে ছুটি নেয়া, যেটা সে গতকাল করেছে। এবার গাঁইতি শাবল কোদাল নিয়ে খনন আর উত্তোলন। গভীর থেকে আরও গভীরে প্রোথিত ওই চন্দন গন্ধের উৎস তার চাই। যা হারিয়েছে সেই কৈশোরে। যা অমূল্য। ফিরে পেতে হবে আবার।

পরদিন খুব ভোরে, তখন কাকও ডাকেনি, একমাত্র দিদিকে একটা চিঠি লিখে বাড়ি ছাড়ল অনির্বাণ। শহরের কেন্দ্র থেকে একটা দূরপাল্লার বাসে চেপে বসল। এক সময় শহর ছেড়ে বাস ছুটে চলল শ্যাওলাসবুজ গ্রামের পথ ধরে। অনির্বাণ ফিরে চলল, ফেলে আসা তার ফসিল জীবনের দিকে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ম্লান রোদে ছায়া। নেমে পড়ল মাধবপুর। এখান থেকে আর তিন কিলোমিটার গেলে পলাশপুর।

এই পলাশপুরেই তার শৈশব কেটেছে। বাবার বদলির চাকরি। মা অসুস্থ, তাই দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়র বাড়িতে থেকে পড়াশোনা। এত বছরে খুব পাল্টায়নি গ্রাম। ফেলে যাওয়া স্মৃতির জায়গাগুলো একই আছে। স্কুলে যাওয়ার পথঘাট। ভ্যানরিক্সা এবার বড় উঁচু রাস্তা ছেড়ে মাঠের মাঝের অপেক্ষাকৃত নিচু সরু রাস্তা ধরল। বিকেল আরও পড়ে এসেছে। দিনশেষের রাঙা আলো দু'পাশের সবুজ আর বিস্তীর্ণ কলাইখেতে যেন জাদু জাগিয়েছে। এবার স্মৃতির কুঠুরি খুলে গেল। জ্বলে উঠল আলো। অনির্বাণ ফিরে পেল স্বপ্ন। জলের গভীর তলদেশ থেকে বুড়বুড়ির মত জেগে উঠল এক ইন্দ্রধনু। কিশোরীর মুখ। স্বেদাক্ত দুটো অধর। বয়ঃসন্ধিকালের উত্তাপ। কুয়াশাজড়ানো সন্ধ্যার অলৌকিক আঁধারে জেগে উঠল সে মুখ। তৃণা। আর তার বুকের সেই চন্দনগন্ধ প্রাগৈতিহাসিক গাঢ় বিভায় জড়িয়ে  ধরল সেদিনের কিশোর, আজকের মেদুর অনির্বাণকে। গন্ধের উৎস ছুঁতে সে এখন পলাশপুর গ্রামে ঢুকল।


সন্ধ্যা নেমে এসেছে। বাড়ি বাড়ি শাঁখ বাজছে। চেনা বাড়িটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল অনির্বাণ। সে যেন গুপ্ত গুহামুখে এসে গেছে। এবার চিচিং ফাঁক বললেই সরে যাবে প্রাচীন পাথর। বিপুল ঐশ্বর্যে আলোকিত হবে জীবন। ভাঙা পাঁচিল পেরিয়ে সদর দরজা দিয়ে উঁকি দিল অনির্বাণ। টালি ঘরের এক পাশটা ভেঙে পড়েছে। উঠোনে অনেক দিনের আবর্জনা। শুকনো পাতা।  কোন ঘরে কোথাও আলো জ্বলছে না। তাহলে বাড়ির লোক সব গেল কোথায়? কাকিমা, দাদারা, তৃণা…! অনির্বাণ এবার জোরে ডাকল, "কাকি-মা...আ...আ…"।  কোন সাড়া নেই। আস্তে আস্তে পা টিপে ভিতরে ঢুকল। এবার আর একটু জোরে ডাকল, "তৃ...ণা...আ...আ..। আমি তোর অনিদা এসেছি। তোরা কোথায়?" কোন সাড়া নেই। নৈঃশব্দ্যের ঘোর স্তব্ধতায় সে ডুবে গেল। স্মৃতির যে আলোয় অনির্বাণ এতক্ষণ পথ হাঁটছিল, তা যেন সহসা নিভে গেল। অন্ধকার আরো গাঢ়। স্বপ্নটা কোথায় যেন কুয়াশায় হারিয়ে যাচ্ছে । কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল খেয়াল নেই। দূর থেকে একটা আলোর রেখা। মোমবাতি ধরা একটা হাত এগিয়ে এলো। "কে বাবা, তুমি? কাকে ডাকছো? আজ দু'দিন হলো ঝড়ে তার ছিঁড়ে গেছে, তাই কারেন্ট নেই। কাকে খুঁজছো।" মোমবাতির আলো মুখে পড়তেই অনির্বাণ চিনতে পারল, পাশের বাড়ির উমা জেঠিমা। মুখে যদিও এখন বলিরেখা। অনির্বাণ এবার সচেতন হয়। আলোর সামনে নিজের মুখটা এগিয়ে নিয়ে বলে, "দেখো তো জেঠিমা, চিনতে পার? আমি সেই অনি, তোমাদের এখানে থাকতাম ছোটবেলায়। তারপর কলকাতা চলে গেলাম।"

"না বাবা, ঠিক ঠাওর হচ্ছে না। বয়স হয়েছে তো, সব ভুলতে বসেছি।"

অনির্বাণ মরিয়া হয়, "জেঠিমা, এ বাড়িতে থাকত রমা কাকিমারা, ওর মেয়ে তৃণা...ওরা সব কোথায়?"

"ওঃ, তুমি রমাদের বাড়িতে থাকতে।" একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জেঠিমা। "সে খুব খারাপ খবর বাবা। রমার ওমন সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটা, কলেজে পড়ত। হঠাৎ ক্যানসারে মারা গেল। শোকে দুঃখে রমাও বেশিদিন আর বাঁচল না। মা-বোন মারা যেতে রমার দুই ছেলে শহরে চাকরি পেয়ে চলে গেল। আগে ছুটিছাটায় আসত। বে'থা করে এখন আর কেউ আসে না। আমি বাস্তু পাহারা দিচ্ছি।"

দমকা হাওয়ায় মোমবাতি নিভে গেল। হঠাৎ ভূমিকম্পে অনির্বাণের পায়ের তলায় মাটি কাঁপছে। তার এত দিনের যত্নে ধরা স্বপ্ন আলেয়ার কুহেলিকায় হারিয়ে যেতে বসেছে। অনির্বাণ মুখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়ল। অনেকক্ষণ পর অনুভব করল, সেই হারিয়ে যাওয়া চন্দন গন্ধ আবার ফিরে আসছে। তার খুব তৃষ্ণা পেল। সে তৃণার পালকনরম বুকের শীতলতায় ডুবে যেতে যেতে শুনতে পেল, "তুই কী বোকা রে অনিদা !"


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য