প্রিয়াঞ্জলি দেবনাথ


 

টিনটিন ও বিড়ালছানা


বাড়িতে বড্ড বেশি বিড়ালের উৎপাত। উঠতে বসতে সবসময় পায়ে পায়ে ঘুরছে মিনির সদ্যজাত ছানা দুটো। এক্কেবারে সহ্য হয় না টিনটিনের মায়ের। "কী কুক্ষণে যে মিনিটাকে রেখে দিয়েছিলাম বাড়িতে...!" দিনরাত্তির এই একই কথা বলে যাচ্ছে মা। তারপর গলাটা একটু জোরে করে মা টিনটিনের বাবাকে বলল, "শুনছ, কাল বাজার যাওয়ার সময় মিনির বাচ্চা দুটোকে নিয়ে যেও তো ব্যাগে ভরে। মাছের বাজারে ছেড়ে দিয়ে এস। তাহলে অন্তত না খেতে পেয়ে মরার ভয় থাকবে না।" বলতে বলতে টিনটিনের হাত ধরে মা চলে যায় শোবার ঘরে। টিনটিনও গাল ভার করে এগিয়ে যায় মায়ের সঙ্গে। আজকাল তার কোনো কথাই মা আর শুনতে চায় না। কত্তবার মাকে সে বলেছে, মিনির ছানা দুটোকে তার এত্ত এত্ত পছন্দ... অথচ মা কিছুতেই বোঝে না। উল্টে টিনটিনকেই বকে দেয়।

হঠাৎ কীসের একটা শব্দে ঘুম ভেঙে যায় টিনটিনের। চারিদিকে অন্ধকার। মনে তো হয় মাঝরাত। কিন্তু ঘর লাগোয়া ছোট্ট ব্যালকনি থেকে কীসের একটা আলো যেন ভেসে আসছে। সেদিকে চোখ পড়তেই টিনটিনের খুদে মুখের বড় বড় চোখদুটো আরো বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। আলোটা টিমটিম করতে করতে এগিয়ে আসছে তাদের ঘরের দিকেই। তারপর টিমটিমে আলোটা ক্রমশ উজ্জ্বল হতে হতে আরো বড় হয়ে যায়। হঠাৎ সেই আলোটা একটা সুদর্শন চক্রের মতো পাক খেতে খেতে টুংটাং করে থামল তাদের বারান্দা লাগোয়া একচিতে উঠোনটায়। টিনটিন সবই দেখতে পাচ্ছে চোখের সামনে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না। আচমকা টিনটিনদের শোবার ঘরের দরজাটা খুলে গেল। দেখল একটা সাত-আট ফুটের লম্বা লোক ভেতরে ঢুকে আসছে। লোকটাকে দেখতে ঠিক যেন রোবটের মতো। অথচ টিনটিন কোনো কথাই বলতে পারল না। মা-বাবাকে কি একবার ডাকবে সে? উুঁহু, তার গলায় তো তেমন কোনো জোরই নেই, শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া। রোবটটা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে টিনটিনের দিকে। তারপর একসময় তাকে দু'হাতে করে কোলে তুলে নিল। এইবার রোবট আকৃতির সেই লোকটি টিনটিনকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে তাদের বারান্দার দিকে। বারান্দা পেরিয়ে একচিলতে উঠোনটার দিকে। তারপর সেই সুদর্শন চক্রটার দিকে। ক্রমশ এগোতে থাকে তারা। নিমেষের মধ্যে টিনটিনকে নিয়ে সুদর্শন চক্র ও রোবট ম্যান ভ্যানিস হয়ে গেল।

এখন টিনটিনের চারিদিকে অনেক রোবট আকৃতির লোক। তবে তারা একেকজন একেক রকম দেখতে। কেউ কালো, কেউ সবুজ, কেউ নীল, কেউবা গোলাপি। তাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ তাল গাছের মতো লম্বা। টিনটিন অবাক চোখে দেখছে তাদের। এত্ত রোবট একসঙ্গে সে কখনো দেখেনি । বাবার বন্ধু অম্বুকাকুর বাড়ি একটা রোবট দেখেছিল বটে টিনটিন। তবে সে রোবট তো এমন সুন্দর কথাও বলে না, হাসেও না, গল্পও করে না। বাবা বলেছিল অম্বুকাকু একজন সায়েনটিস্ট। মানে বিজ্ঞানী। অথচ...
--"হ্যালো, ওয়েলকাম টু রোবটিয়ং।"
একজন রোবট ম্যান এতক্ষণে টিনটিনকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলল। একদম স্বচ্ছ ইংরেজিতে। তবে কি এরা ইংরেজিও জানে? এতক্ষণ যে কী সব ভাষায় কথা বলছিল...! কিছুই বুঝতে পারছিল না টিনটিন। এইসময় হঠাৎ পাশ থেকে আরেকজন রোবট ম্যান বলে উঠল,
--"তোমার নাম টিনটিন, তাই তো ?"
তারপর খটখট করে হেসে আবার বলল,
--"স্বাগত তোমায়, আমাদের এই রোবটিয়ং গ্রহে।"
টিনটিন শুধু অবাক বিস্ময়ে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। তার মানে এটা পৃথিবী নয়। এটা একটা অন্য গ্রহ। যার নাম রোবটিয়ং। ঠিকই ভেবেছে টিনটিন, এরা আসলে সবাই রোবট। বাংলা-ইংরেজি সব ভাষাই এদের আয়ত্বে। ঠিক যেন গল্পের বইয়ের মতো। কিন্তু টিনটিনকে তারা কেন এখানে নিয়ে এসেছে ! সে তো তাদের কোনো ক্ষতি করেনি। এইবার কাঁদো কাঁদো মুখে টিনটিন প্রায় কেঁদেই ফেলে।
--"আরে আরে কাঁদছো কেন? আমরা তোমার কোনো ক্ষতি করব না। কোনো ভয় নেই তোমার।"
একটা রোবট, বলা ভালো একজন লেডি রোবট কথাগুলো বলেই টিনটিনকে কাছে টেনে নেয়। তার হাতের স্পর্শ যেন ঠিক তার মায়ের মতোই। টিনটিন এতক্ষণে কথা বলার শক্তি ও সাহস পেল।
--"তোমরা কে? আমাকে তোমরা কেন এখানে নিয়ে এসেছ?"
পাশ থেকে আবার কে একজন বলে উঠল,
--"কোনো ভয় নেই তোমার। তোমার ওপর আমরা একটু এক্সপেরিমেন্ট করব। তারপর আবার তোমায় রেখে আসব পৃথিবীতে।"
--"আমি মায়ের কাছে যাব।"
রোবট ম্যানদের কথা শেষ হতে না হতেই ফুপিয়ে কেঁদে বলে উঠল টিনটিন।
--"যাবে তো। কয়েকদিন থাকো। এখানে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না।"
বলেই আলতো করে স্নেহের সাথে টিনটিনের মাথা স্পর্শ করে দিল মায়ের মতো সেই লেডি রোবটটি।

টিনটিনের সামনে এখন তার ফেভারিট হট চকলেট, পিজা, মোমো আরো কত কী...! তার প্রিয় সব খাবার। কত নতুন নতুন খেলনা। কত গেমস্। যেগুলো কখনোই বাবা তাকে কিনে দেয়নি। ওই তো মিনির ছানাগুলোর মতো এখানেও রয়েছে চারটে রোবট বিড়াল। দুটো ডগি। কই, টিনটিনের মায়ের মতো এরা তো কেউ তাড়িয়ে দিচ্ছে না এদের!! টিনটিন যত দেখে তত অবাক হয়ে যায়। তার পাশে এখন দাঁড়িয়ে আছে প্রতিদিনের টিভিতে দেখা তার প্রিয় কার্টুন চরিত্ররা। টম, জেরি, মিকি মাউস, ডোরেমন, নবিতা। যাদের না দেখলে মায়ের হাজার আদর সত্ত্বেও এক বেলাও খাবার মুখে তোলে না টিনটিন। অথচ কী অদ্ভুত, এরাই এখন খেলতে এসেছে টিনটিনের সাথে। বিস্ময়ে চোখ গোল গোল হয়ে উঠছে তার। একটা চাপা উত্তেজনা। একবার কী এদের ছুঁয়ে দেখবে টিনটিন! নাহ্, থাক, যদি কিছু বলে...! এখানে তো মাও নেই। টিনটিনের মুখে হঠাৎ আবার নেমে এসেছে মেঘলা ছায়া। এখন সে বড্ড মিস করতে লাগল তার বন্ধু গুল্লু, ডোডো, পিকুদেরকে।

একটা বড় কাচের ঘর। চারিদিক কাচের দেওয়ালে ঘেরা। কোথাও কোনো দরজা নেই, জানালা নেই। বড় বড় কিছু মেসিনপত্রের সাথে একটা লম্বা নল কাচের বাইরে প্রসস্থ হয়ে আছে। এটা সম্ভবত অক্সিজেন নল। কাচের ভেতরে বসে আছে টিনটিন। আর বাইলে অসংখ্য রোবট ম্যান এদিক থেকে ওদিক ঘোরাঘুরি করছে। কাচের দেওয়ালের ওপার থেকে দেখছে এপারের টিনটিনকে। তারপর কী সব যেন বলাবলি করছে নিজেদের মধ্যে। টিনটিনের বড্ড ভয় করছে এবার। বাবার সঙ্গে  একবার মিউজিয়ামে গিয়ে বড় বড় কাচের খাঁচা দেখেছিল টিনটিন। ঠিক যেন টিনটিনের কাচের ঘরটার মতো। সেখানেও রাখা ছিল অনেক প্রাণী। ভয়ে কঁকিয়ে উঠল টিনটিন। তার সামনে রাখা তার অজস্র প্রিয় জিনিসগুলো এখন ফিকে হয়ে উঠছে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার। তার প্রিয় কার্টুন চরিত্রেরাও আর আনন্দ দিতে পারছে না টিনটিনকে। এখন তার শুধু চিৎকার করে ডাকতে ইচ্ছে করছে মাকে। আস্তে আস্তে টিনটিনের চোখের সামনে সব কেমন ধোঁয়াশা হয়ে যেতে লাগল। কোথায় যেন তলিয়ে যাচ্ছে সে। এইবার গুঙড়ে কেঁদে ফেলল টিনটিন। "মা, মা গো, ও মা,  মা..."।

ঘুমন্ত ছেলের কান্নার শব্দে ধড়ফড়িয়ে উঠল টিনটিনের মা ও বাবা। ছেলেকে নিজের কোলের কাছে টেনে নিয়ে মা জড়িয়ে ধরল।
--"কী হয়েছে সোনা, কী হয়েছে, তুমি স্বপ্ন দেখেছ? স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছো?"
মায়ের স্পর্শে ও আদরে চোখ খোলে টিনটিন। সে তখন তাদের শোবার ঘরের বিছানায় ওপর তার মায়ের কোলে শুয়ে আছে। মা তখন তাকে জাপটে ধরে বসে তার চোখমুখ মুছিয়ে দিচ্ছে। টিনটিন মাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে আবার ডুকরে কেঁদে উঠল।
--"তুমি আমার কাছে আছো মা?"
মা টিনটিনের কপালে চুমু খেয়ে তার গালদুটো নিজের আলতো হাতে ধরে বলল,
--"এই তো বাবাই, আমি এখানেই আছি।"
টিনটিন এবার অভিমানী সুরে বলে উঠল,
--"আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না বল।"
মাও এবার হেসে বলে ফেলল,
--"কোথায় যাব পাগল তোকে ছেড়ে...!"
--"ওরা যে আমায় নিয়ে গেল রোবটিয়ং গ্রহে। সেখানে তো তুমি বাবা কেউ ছিলে না। ওরা যে আমায় কাচের ঘরে রেখে দিল...!"
--"কারা? কোথায় নিয়ে যাবে তোকে? তুমি স্বপ্ন দেখেছো সোনা।"
মায়ের কথায় মোটেই আস্বস্ত হয় না টিনটিন। কিছুতেই সে মাকে বোঝাতে পারছে না, সে যে সত্যি সত্যি রোবটদের পৃথিবী থেকে ঘুরে এসেছে এই মাত্র। বড্ড অসহায় লাগছে তার। নিজেকে সামলাতে না পেরে আবার ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে টিনটিন। এইবার বাবাও টিনটিনকে টেনে নেয় নিজের কাছে। তাকে আদর করে মজার ছলে বলে,
--"বোকা ছেলে। তুমি কি জান না, বাবা-মার কাছ থেকে ভালো লোকেরা কখনো বাচ্চাদের নিয়ে যায় না। ওরা তো জানে, এটা খারাপ কাজ। এটা করলে ওদের তো শাস্তি পেতে হবে। দেখো, তুমি তোমার মায়ের কাছেই আছো।"
বাবার কথায় শান্ত হয় টিনটিন। তারপর আদুরে গলায় বলে,
--"কিন্তু ওরা যে আমায় নিয়ে গেছিল..."
এইবার মা টিনটিনের সারা মুখে অজস্র চুমু এঁকে দিয়ে বলে,
--"এই যে আবার দিয়ে গেছে..."

ওদের তিনজনের খুনসুটির শব্দে তখন ঘরের নীল আলো ফিকে হয়ে আসে। ঘর লাগোয়া ছোট্ট ব্যালকনির দরজাটার দিকে চোখ পড়তেই ওরা দেখে দরজা সরু হয়ে খোলা। আর খোলা অংশটা দিয়ে ভোরের প্রথম আলো এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। যার এককোণে পাপশের ওপর মিনি তার দুই সন্তানকে কোলে জড়িয়ে পরম নিশ্চিন্তে গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে। মা এবং টিনটিনের চোখ এখন সেদিকেই নিষ্পলক স্থির।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য