রঞ্জনা ভট্টাচার্য্য


 

মাসের প্রথম রোববার


মালতী  রিকেটি ছেলেটার পায়ে তেল ঘষতে ঘষতে ভাবছে কাল মাসের প্রথম রোববার। দীপেন এখনও ঘরে ফেরেনি। আগের মতো আর মোট বইতে পারে না। কাছেই  বাবার নামে ' গুরুচরণ মুদি দোকান' দিয়েছে। ওদের এই রেল গেটের ধারে গজিয়ে ওঠা বস্তির ঐ একটা মুদি দোকান ভরসা। বেশিরভাগ বাকিতে খায়, খুব ভালো মাল ও তুলতে পারে না। মালতী সকালে দুটো রান্নার কাজ করে আর বিকেলে একটা। আয়ার কাজ নিতে পারে নি অসুস্থ ছেলেটার জন্য। আগে শাশুড়ি সামাল দিত। এখন সেও প্রায় বিছানায়। অনেকসময় ঘরেই হেগেমুতে ফেলে। বকবক করতে করতে মালতী পরিষ্কার করে। আবার শাশুড়ির জন্য মায়াও হয়। এই ছেলের চিকিৎসার জন্য কোথায় না কোথায় ছুটেছে। একটাই ছেলে। দুটো মেয়ে নিজেরাই দেখেশুনে বিয়ে করে চলে গেছে। মালতীর তেমন খরচা করতে লাগেনি। বড়টার বর হোটেলে কাজ করে। ছোটটার বর মলে। মেয়ে দুটো নাইটি, জামা সেলাই করে। কখনও কখনও নরম নরম পুতুল তৈরির অর্ডার নেয়। মোটামুটি চলে যায়। এখন এই আটচল্লিশ বছর বয়সে মালতীর একটাই চিন্তা ছেলেটার কী হবে। দশটা বেজে গেছে । এখনও দীপেন ঘরে ঢুকলো না । তাড়াতাড়ি খেয়ে শুতে না পারলে ফার্স্ট ট্রেন ধরতে পারবে না। মাসের প্রথম রোববার মালতীর গোধূলিবেলার ছায়ানট। টুং করে একটা মেসেজ ঢুকলো। 'ফার্স্ট ট্রেন'। এই মেসেজটা ওর খুব গভীরে একটা চিনচিন ব্যথা ধরিয়ে দিল। সারা শরীর জুড়ে খেলে গেল শিহরণ। দীপেন ঢুকে দেখলো বউ ছেলেটার পায়ে তেল ঘষছে।একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। ছেলেটার দিকে তাকালে ছোটো ঘরটাকে আরও অন্ধকার মনে হয়। মালতীর দিকে তাকিয়ে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো, 'কাল তো আবার ফাস টেন ধরবে? এই নতুন বাড়ির কাজটা ছেড়ে দিলে হয় না? '
একটু অন্যমনস্ক ভাবে মালতী বলে উঠলো, 'ছেড়ে দিলে বাড়তি দুহাজার টাকা কোথায় পাবে? 'দীপেন চুপ করে বাথরুমে ঢোকে। মালতী রান্না ঘরে ঢুকলো ভাত গোছাতে।
ভাত খাওয়ার পর কাগজে মোড়ানো তিনটে পানের খিলি দীপেন বার করে। মালতী পান খেতে খুব ভালোবাসে। তাই, মাসের প্রথম শনিবার মালতীর পয়সা হাতে নেবার আগে মা, বউ আর ছেলের জন্য পান নিয়ে আসে দীপেন। কাগজটা খুলে খুব ধীরে সুস্থে পানটা মুখে দেয় মালতী। গালের একপাশ ফুলে ওঠে, পানের রস লেগে টইটম্বুর হয়ে ওঠে ঠোঁট। ছেলেকে একটা পান খুলে মুখে দিয়ে দেয়। আরেকটা পান নিয়ে শাশুড়ির ঘরে ঢোকে।
পান খেতে খেতে  বুড়ি বলে, 'কাল তো তুই টাকী যাবি  'তারপর একটু ইতস্ততঃ করে বলে, 'আমার জন্য টেনের থেকে এট্টা প্যাকিট আমলকি আনবি বউ? '
মালতী থুতনিটা নেড়ে দিয়ে বলে, 'আইনবো গো আইনবো।

বি কম পাশ করার পর রাকেশ যখন কোনো কাজ পেলো না তখন ফুচকার দোকান দিল। তারপর এই ফুচকার দোকান দিয়ে কুড়ি বছর ধরে নিজের সংসার প্রতিপালন করছে। অ্যাকাউন্টেন্সি, ডেবিট, ক্রেডিট ফুচকা আর চুরমুরের  টেস্টে সেট হয়ে গেছে। দমদম ক্যান্টনমেন্টে ফুচকা বেচে দু কামরার ফ্ল্যাট কিনেছে, বিয়ে করেছে। মেয়ে দর্শনে অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। বাড়িতে  টুকটাক টিউশন করে। মেয়ে চাকরি করবে সে আশা রাকেশ করে না। তাই ফুচকার দোকান টাকে একটু সুন্দর করে গড়ে তুলতে চাইছে, যাতে মেয়ে এটাতে বসতে পারে। পাপড়ি  চাট, দই বড়া, ফুচকা, লস্যি, ফুচকার কাটলেট(রাজেশের নিজস্ব রেসিপি), চুরমুর, দম ফুচকা (রাজেশের মেয়ের আবিষ্কার), আলুকাবলি, ঘুগনি সব মিলিয়ে একটা বেশ বড় আউটলেট। সেইখানে মালতী তার ক্যান্টনমেন্টের কাজের বাড়ি থেকে  ফেরার পথে ফুচকা খেতে ঢুকেছিল। গ্রহ, নক্ষত্র, চাঁদ, আকাশ, তরঙ্গ, শক্তি মাঝে মাঝে এরকম ষড়যন্ত্র করে, আর সেই ষড়যন্ত্রের কাছে মানুষ হার মেনে যায়। একটা উন্মাদ মুহূর্ত এসে দুজনের মধ্যেকার অতীতকে টেনে নিয়ে এল। মালতী ক্লাস এইটে রাকেশের কাছে অঙ্ক করতো, সেই রাকেশের সাথে এতোদিন বাদে দেখা। তখন ওরা দুজনেই দত্তপুকুরে থাকতো। রাকেশের বাবা অল্প বয়সে মারা যান। টিউশন করে রাকেশ নিজের পড়াশোনা আর সংসার চালাতো। তারপর শোনা যায় রাকেশ নাকি কলকাতায় কাজ পেয়ে মাকে নিয়ে চলে গেছে। মালতীকে  মামারা তাড়াতাড়ি ঘাড় থেকে নামানোর জন্য বারো ক্লাস পাশ করার আগেই দীপেনের মত হাড়-হাভাতের সাথে বিয়ে দিয়ে দিল। দীপেনের  রেলবস্তিতে পলিথিন দেওয়া দু-কামরার ঘর ছাড়া কিছু ছিল না। উল্টোডাঙা আর ক্যান্টনমেন্টের  মাঝের দূরত্ব প্রায় চৌত্রিশ বছর বাদে স্পেস-টাইম কার্ভেচারকে দুমড়ে দিল।  রাকেশ দেখলো মালতীর সরল মায়াময় চোখদুটো অভাব অনটনেও একইরকম আছে।

প্রচণ্ড গরম পড়েছে আজ।  মালতী সায়াটাকে বুকের কাছে আটকে শুয়ে পড়লো। গা ধুয়ে আর নাইটি গায়ে দিতে ইচ্ছে করলো না। মালতীর  শ্যামল চিকন উন্মুক্ত পিঠটা  দীপেনের দিকে  ফিরে আছে। দীপেন দেখছে দাড়িপাল্লা আঁকা পিঠে দুদিকেই দোল খাচ্ছে শূন্যতা। এই আটান্নতেও শরীর চনমন করে ওঠে। কালকে সারাদিন দোকান বন্ধ রেখে ওকে ঘর সামলাতে হবে। এই একটা রোববার টাকার কাছে বিকিয়ে গেছে ভেবে মনটা তেতো হয়ে ওঠে। একঝটকায় মালতীকে  নিজের দিকে নিয়ে এসে ওর উপর চেপে বসে।  অধিকারের কোপ দিয়ে আনন্দ নেবার চেষ্টা করে হরমোনময় শরীর।
বাথরুমে গিয়ে জল ঢালতে ঢালতে মালতী ভাবে একটা রোববার ঈশ্বর ওকে নিজের জন্য দিয়েছেন।
                      সদ্য জেগে ওঠা ভোরের কামরায়  মালতী জানালার ধারে বসে। মনে মনে প্রার্থনা করে ক্যান্টনমেন্ট অবধি যেন কেউ পাশের সিটে না বসে। মোবাইলে ছোটো ম্যাসেজ দেয়   'পিছনের দিকের ভেন্ডারের দুটো কামরা আগে। ' প্রতিদিন সময়ের আন্ডারে থাকে মন। আজ সময় মনটাকে ছুটি দিয়েছে। তাই চোখ বুজে আসছে।  জংশন পেরিয়ে গাড়িটা একটু দাঁড়িয়ে পড়লো। এইসময়  দেখে ফোনে ওর সদ্য লেখা ম্যাসেজের নীচে একটা লাল রঙের হৃদয়ের ছবি। মালতী কী সত্যি সত্যি রাকেশকে হৃদয় দিয়েছে! তবে কী ও  দীপেনকে ভালোবাসে না? একসাথে দুজন মানুষকে কী ভালোবাসা যায়? ভাবনাটাকে এলোমেলো করে দিয়ে ট্রেন আবার চলতে শুরু করে। ক্যান্টনমেন্টে ট্রেনে উঠেই রাকেশ বসে পড়লো  মালতীর পাশে। রাকেশের গায়ের থেকে খুব সুন্দর একটা সেন্টের গন্ধ আসছে।মালতী মনে মনে ভাবছে, 'মালতীরও সেন্ট আছে। মেখে আসতে পারে নি। তালেই সন্দ হবে। চোখে এট্টু কাজল, এট্টু লিবিস্টিক কিছুই দিয়ে বের হতে পারে না। পুরুষমানুষ কত স্বাধীন! কোথায় যাচ্ছে বলা লাগে না। মেয়ে মানুষ কাজ করলেও হাজার কৈফিৎ দিতে দিতে প্রাণ যায়।' মালতীর সমস্ত গায়ের গন্ধ দীপেন ওর জিম্মায় রেখে দিয়েছে। তাই রাকেশ নতুন করে গায়ের গন্ধ, চোখের কাজল, ওষ্ঠের রঙ ওর ব্যাগের চোরাকুঠুরিতে ভরে নিয়ে আসে।
বারাসাত ছাড়লেই বাইরের দৃশ্য বদলে যেতে থাকে।  চারিদিকে সবুজ আর সবুজ তার মধ্যে দিয়ে ট্রেন বিলি কেটে কেটে এগোতে থাকে।ট্রেনের কামরায় মাখা সন্দেশ উঠলেই মালতীর শরীরে এলাটিং বেলাটিং হয়। ব্যাগের থেকে মুড়ির প্যাকেট বার করে। তারপর রাকেশ আর ও মাখা সন্দেশ আর মুড়ি খায়।

দীপেন ওদের ঘরের সামনে  কল তলায় দাঁড়িয়ে মুখ হাত ধুতে এসেছে। সকাল ন'টা বেজে গেছে উঠতে উঠতে। মালতী যত সকালেই বেরুক খিচুড়ি আর ডিম ভাজা করে গেছে। ওর একটু খেতে দেওয়া ছাড়া কোনো কাজ নেই। কল তলায় বেমক্কা লাইন দেখে দীপেনের মটকাটা গরম হয়ে গেল। সামনের বাড়ি মহারাণী দিপেনকে দেখে বললো, 'আজ তো মালতী বাড়ি নেই, তাই না? '
'হুঁ। টাকী গেছে। '
মহারাণী  হাতকাটা নাইটির  বুকের উপর আলগোছে আধভেজা গামছা দিয়ে রেখেছে। ভিতরে জামা কিছু পরেনি, ঝুলন্ত স্তনের বোঁটা থেকে দীপেন  তামাক পাতার গন্ধ পায় । দীপেনের সাথে  শত্রুতা করে হঠাৎই হিসহিসিয়ে ওঠে হরমোন স্রোত। কেমন একটা অপরাধ বোধ জেগে ওঠে। টালসামলাতে না পেরে বাথরুমে চলে যায়।  দীপেন বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে ওর মা কাপড়ে -চোপড়ে  হয়ে গেছে। 'সামলাতি পারো না? ' বলে চিল্লিয়ে ওঠে। ওর মা করুণ মুখে বলে, 'আজকাল পারি না রে। বৌমা বলছিল এট্টা হাবিব না কি এনি দিবে। ওটা পরি থাকলি কাপড়ে-চোপড়ে হবে নি। ইবার টাকী থিকে  পয়সা নে ফিরলি ওটা দিবে। '
'হ। টাকীর পয়সা দি সব কইরবে!হাগিস কিইনবে, চাইল সারাবে, ছেলেরে ডাগদার দেখাবে, লাখ লাখ টাকা পাবে কিনা! '
বুড়ি কোনো উত্তর না দিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়। দীপেনের মায়ের জন্য হঠাৎ খুব কষ্ট হয়। বাথরুমের দরজা ধাক্কিয়ে বলে, 'বেশি জল ঘেঁটো নি। আমি পোষ্কার করে দিবখন। 'বুড়ি আরও জোরে জোরে জল ঢালতে থাকে।

টাকীতে  নেমে রাজবাড়ীর ঘাটে  পৌঁছে ওরা ওখানে বসে চা আর ডিম টোস্ট খায়। মালতী বলে 'ডিম টোস'। রাকেশ অনেকবার ওকে বলেছে, 'ডিম টোস না ডিম টোস্ট' মালতীর লজ্জা মালতীর জিভের আড় ভাঙতে পারেনি।  নৌকা চড়ে। ফুরফুরে মিঠে হাওয়া মালতীর চুল কেটে কেটে চলে, গুনগুন করে গেয়ে ওঠে মাঝ বয়সী কিশোরী, 'আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে... 'রাকেশ ওর হাত ধরে চুপটি করে বসে শোনে । তারপর একটা ভ্যান রিকশা ধরে রাজবাড়ীতে যায়। ওখানে বাগানে ঘোরাঘুরি করে।  আবার লঞ্চে চড়ে বসে। প্রতিবার টাকী ঘুরতে এসে অচল ছেলেটার জন্য কষ্ট হয়। প্রথমবার ছলছলে চোখে রাকেশকে বলেছিল কষ্টের কথা। রাকেশ  তখনই বলেছে ও ভেলোরে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দেবে, তবে দালাল ধরতে হবে। তারজন্য কিছু টাকা পয়সারও দরকার।  তিন বাড়ি রান্নার কাজ করে ও এখন বারো হাজার টাকা পায়। ন হাজার দীপেনকে দিয়ে দেয়। দীপেনকে বলেছে নতুন কাজের বাড়ির কর্তা-গিন্নীর আদি বাড়ি টাকী। সেখানে মাসের প্রথম রোববার ঘর-দোর পরিষ্কার  করতে ওকে নিয়ে যায়। ওখানে সবাই মিলে রান্না বান্না করে, খায়, ঘোরে। তারপর শেষ ট্রেনে বাড়ি আসে। এরজন্য দু হাজার টাকা ওরা এক্সট্রা দেয়। সারাদিন পরিশ্রমের দাম আছে না! বাকি একহাজার ছেলের জন্য জমাচ্ছে। ভেলোরে যাওয়া মানে প্রায় লাক খানেক টাকার ধাক্কা। দীপেনের নিজের পুঁজি কিছুই নেই। রাকেশ বলেছে পঞ্চাশ হাজার জোগাড় করে দেবে। বাকি পঞ্চাশ হাজারের ব্যবস্থা তো মালতীকেই করতে হবে। একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ওর পাখির মতো বুক থেকে। রাকেশের খুব ইচ্ছে করে মুঠো করে ধরে ঐ পাখি দুটোকে, তারপর আবার উদাস দৃষ্টিতে লঞ্চে বসে আকাশের দিকে তাকায়। আরও একটু ঘন হয়ে বসে মালতীর  হাতটা নিজের হাতে তুলে নেয়। কাঁধ দিয়ে স্পর্শ করে বুক। মালতীর মুখ বিষাদ ও লজ্জায় মেটে রঙা হয়ে ওঠে।

মধ্য দুপুরে ডাল, আলু পোস্তোর তরকারি আর আমোদি মাছের ঝাল দিয়ে খুব তৃপ্তি সহকারে  হোটেলে ভাত খেলো দুজনে। নিজের হাতের রান্না খেয়ে খেয়ে মালতীর অরুচি ধরে গেছে। কেউ এমন সাজিয়ে গুছিয়ে বেড়ে দিলে সেই ধোঁয়া ওঠা ভাতের তৃপ্তিই আলাদা। ভাত খেয়ে মালতী আর রাকেশ  জর্দা দেওয়া পান খায়। তারপর সস্তার একটা নোনা ধরা দেওয়ালের হোটেলে ওঠে। দেওয়াল জুড়ে চল্টা উঠে উঠে কত বিচিত্র মুখ আর মেঘের সাজ। নোনা ধরা হলেও তো দেওয়াল। প্লাস্টিক গোঁজা ঠাঁই তো নয়। মাথার উপর আস্তে আস্তে ফ্যান ঘোরে। আশ্চর্য সুখে মালতী রাকেশের বুকে মাথা রাখে। দুটো ওষ্ঠের আদরে জর্দা-সুগন্ধের রশি ছিঁড়ে যায়। দুটো শরীর ওম নেয়, শীতল হয় আবার ওম নেয়। মালতী ভাবে তার ভিতরেও এতো ইচ্ছা কোথায় ছিল! রুটিনে অভ্যস্ত শুকনো শরীরে এমন উত্তাল ঢেউ ওঠে ,মাসের প্রথম রোববার ছাড়া সে জানতেই পারতো না। তারপর সারা মাসের সবচেয়ে নিশ্চিন্তের, সবচেয়ে শান্তির ঘুম ঘুমায়। মালতীর উদোম পিঠে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দেয় রাকেশ। রাকেশের বুকে মুখ গুঁজে দুপুর ও যেন মালতীর সাথে ঝিম লেগে থাকে।
আজকাল মহারাণী যেন কেমন কেমন চোখে তাকায়। মালতী না থাকলে ঘরে এসে জিজ্ঞাসা করে, 'কিছু খাবার করে দেবে কিনা। 'আজকেও মাঝ দুপুরে ঘরে  এসে হাজির। ছেলেটাকে ঠাকুমার কাছে দিয়ে এসময় মাঝের পাল্লাটা ভেজিয়ে  মোবাইলে একটু নীল ছবি দেখে।মহারাণী  শুনশান বাড়িতে ওর ঘরে ঢুকে পরে ঝাপ আটকে দেয়। দীপেন হকচকিয়ে যায়। হঠাৎই  ওকে জাপ্টে ধরে দীপেনের জিভের নোনতা স্বাদ টেনে নিতে থাকে, দীপেন ও নিজেকে সামলাতে পারে না। দুটো শরীর হরমোনের উত্তাল খেলায় মেতে ওঠে। কিন্তু, মহারাণীকে  কিছুতেই বিছানায় উঠতে দেয় না। বিছানাটা ভুরু কুঁচকে মাটিতে ওদের লণ্ডভণ্ড হতে দেখে।
ঠোঁটের কষ বেয়ে পানের রস থমকে আছে। মালতী আলগোছে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখটা মুছিয়ে  দেয়। মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে ভাবে রাকেশ ওর কাছে পরম আশ্রয়। ওর বাবাকে ও কত ছোটো বেলায় হারিয়েছে, তবু মনে আছে বাবার হাত ধরে থাকলে মনে হতো ওর কোনো ভয় নেই। রাকেশের হাত ধরে থাকলেও সেরকম নির্ভার , নির্ভয় লাগে। হোটেল ছেড়ে পড়ন্ত  বিকেলের আলোয় ওরা হেঁটে হেঁটে ঘোরে শ্বাসমূল, ঠেসমূলের জঙ্গলের উপর মাটি কাটা ইট রাস্তায়। মাটি ঠেলে উপরে ওঠা অসংখ্য লিঙ্গের মতো শ্বাসমূলকে  দেখে রাকেশের মনে হয় সমস্ত লিঙ্গ বোধহয় তার যোনিআধার আকাশের দিকে মুখ করে এমনভাবেই খোঁজে, কিন্তু, প্রগলভ হতে পারে না। লিঙ্গ আসলে তার শ্বাস খোঁজে তার নিজস্ব ব-দ্বীপে। কেউ পায় কেউ পায় না। মালতীর তিরতির নদীর মতো শরীর আর মন তাকে  কোনো এক অলৌকিক আশ্বাস দিয়েছে।
রাজবাড়ীর  সামনে চালে ছাওয়া দোকানগুলোতে চাউমিন, এগরোল বিক্রি হচ্ছিলো। রাকেশ মালতীকে জিজ্ঞাসা করে, 'খাবি? ' মালতী মাথা নেড়ে বলে, 'আইসক্রিম খাব। ' আইসক্রিমের কোণ হাতে নিয়ে মালতী বলে, 'ছেলের বাবাও আইসক্রিম খেতে খুব ভালোবাসে। '
রাকেশ আচমকা মালতীকে জিজ্ঞেস করে, ' দীপেনকে বিয়ে করে তুই সুখী? '
এই প্রশ্নে মালতী চুপ করে যায়। একটা, দুটো তারা ওঠা আকাশে ও প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করে। ঝগড়া, মন কষাকষি সবকিছু সত্ত্বেও দীপেন বস্তির পুরুষদের মতো কোনোদিন তার গায়ে হাত তোলেনি। ছেলের লিকলিকে পায়ের জন্য তাকে দোষ দেয়নি কখনও। এটুকুই কী তার সুখী থাকার জন্য যথেষ্ট নয়? রাকেশের মতো যত্ন করতে পারে না তবুও ওর অযত্নের মধ্যেও মায়া আছে। তাই অস্ফুট বলে, 'বোধহয় সুখী। 'রাকেশ এবার একটু বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞাসা করে , 'তাহলে আমার কাছে আসিস কেন? '
মালতী এবার হেসে বলে, 'সুখী নই বলে আসি নাকি? তুমিতো আমার পরথম প্রেম গো। তাই তো না এসে পারিনি। '
রাকেশ এবার হেসে ফেলে। মালতী হাসি হাসি মুখে বলে, 'তুমি বৌদিকে নিয়ে সুখী নও? '
রাকেশ না ভেবেই বলে, 'সুখী। '
_'সব ছেড়ে তুমি আমায় নিয়া যেতে পারবা? পারবা না। আমিও সব ছেইড়ে তোমার সাথে চইলেও যাইতে পারবো না। এ আমাদের কর্মের বন্ধন। '
-'কর্ম না রে মায়া, সংসার'
-'কর্মই তো মায়া তৈয়ার করছে রাকেশদা। তোমার সাথে এই যে একটা দিন নিজের মতো করে বাঁচি, এই একটা দিন ছুটির দিন, মুক্তির দিন। পরেরদিন মনখারাপ হয়, কাজ আলুথালু হয়, তবুও শরীলে রোদে শুকানো কাচা জামার গন্ধ লেগে থাকে। আবার গুনতি শুরু করি উনত্তিরিশ, আটাশ... '

'সন্ধ্যা দিবিনি দীপেন? 'বুড়ির গলার আওয়াজে দীপেন  ধড়ফড়  করে ওঠে। মহারাণী কখন চলে গেছে। দীপেনের মধ্যে কেমন একটা শূন্য অনুভূতি কাজ করে। একটু আধটু কনুইগিরি ছাড়া দীপেন কোনো নারী শরীরের সাথে এভাবে লিপ্ত হয়নি। গ্যান্দা, গোপাল অনেকবার আগে ডেকেছে তাকে যখন  সে মোট বইতো, চরায় নিয়ে যাবার কথা কম বার বলেনি, বলেছে চরার পাশে আজব ঘূর্ণির কথা। দীপেনের শরীর চাইলেও মন সায় দেয়নি। মালতীর ডাগর দুটো চোখ বাঁধা দিয়েছে। আজ তার সমস্ত বাঁধ ভেঙে গেল। মাটি থেকে নিজেকে কোনোরকমে তুলে নিয়ে বাথরুমে যায়, শরীরে জল ঢালে। অবেলায় স্নান করছে বলে বুড়ি বকতে থাকে। দীপেন জল ঢেলেই চলে, ওর মনে হয় ওর খুব জ্বর হোক। মালতী এসে দেখুক ও জ্বরে কাতরাচ্ছে। ওকে মাথায় যত্ন করে জলপটি দিক। দীপেন ঝপঝপ ঝপঝপ জল ঢেলেই চলে। রিকেটি ছেলেটা হামা টেনে টেনে ঘরে এসে বিছানা টানটান করার চেষ্টা করে, করতেই থাকে।




মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য