নন্দিতা মিত্র
মেঘবালিকা ঝান্ডি আর তার জলশরীরের সফরকথা
“আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি
মন বান্ধিবি কেমনে?
আমার চোখ বান্ধিবি, মুখ বান্ধিবি
পরাণ বান্ধিবি কেমনে?’’
সত্যিই তো! ভ্রমণপিয়াসী মানুষের ‘পরাণডারে’ বেঁধে রাখা কী সহজ কথা! সময় পেলেই সংসারের মায়াজাল আর ‘তাসের দেশে’-র নিয়মের বেড়াজাল ছিন্ন করে সে বেরিয়ে পড়তে চায়। গন্তব্য দেশ থেকে দেশান্তরে কিংবা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। আসমুদ্রহিমাচলের যেকোনও জায়গাই হোক না কেন, ভ্রামণিকের মন প্রকৃতির হাতছানিতে ঘরছাড়া হয়ে ভেসে যেতে থাকে। সুযোগ পেলেই পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট ছোট্ট অজানা গ্রামে যাঁরা ছুটে যান সারাবছরের অক্সিজেন আর বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করতে এ লেখা তাঁদের জন্য, যাঁরা শহরে থেকেও পাহাড়ে থাকার স্বপ্ন বুকে নিয়ে বাঁচেন এ লেখা তাঁদের জন্য, এক মহা সন্ধিক্ষণে যাবতীয় হতাশা, বিদ্বেষ দূর করে পাহাড়ের বুকে যাঁরা পেতে ফেলেন দিনকয়েকের অস্থায়ী সংসার…এ লেখা শুধুমাত্র তাঁদেরই জন্য।
একটা সাদা ক্যানভাস- সবুজ পাহাড়ের গা ঘেঁষে ছোট্ট একটা পাহাড়িয়া ঘর, আর সেই ঘরে নরম কম্বলের ভিতর উষ্ণতা গ্রহণ করে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে উপভোগ করতে থাকব বাইরের প্রকৃতিকে। সারা শরীরে শিহরণ জাগিয়ে তুলবে দূরের পাইন-ওক-ধুপির সাম্রাজ্য আর তার সাথে ভাললাগায় ভরিয়ে দেবে বুনোফুলের মন মাতাল করা সুবাস। আকাশ নীলের চেয়েও হালকা কিংবা প্রশস্ত নীল আকাশটাকে প্রকৃতি যেন একটু আগে দুগ্ধপাত্রে স্নান করিয়ে দিয়ে গেছে কিংবা পাহাড়ি রাস্তার পথের একধারে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকব কীভাবে দিনের শেষে সূর্য তার স্বর্গ-ছেঁড়া মায়াবী রক্তিম আভা ছড়িয়ে বিদায় নিচ্ছে কিংবা কাচের শার্সি দেওয়া দেওয়ালজোড়া জানালার পর্দা সরিয়ে দেখতে থাকব এই বুঝি ভোর হয় হয়… এই বুঝি সে ফাঁকি দিয়ে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে... সাদা কাগজে একের পর এক কখনও জলরঙ চড়িয়ে, কখনও বা তেলরঙ ছুঁইয়ে এই ছবিগুলোই এঁকে ফেলেছি বহুবার। ‘আজীবন পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’ প্রাণের মানুষটির হাতে হাত রেখে এমনই একটা জায়গায় স্বপ্নের সওয়ার হওয়ার চেষ্টা করেছি। আমার দেখা সেই স্বপ্নের ক্যানভাসে আঁকা ছবিগুলো একটু একটু করে রঙ পেয়েছিল ঝান্ডি সফরে।
কোলাখাম থেকে ঝমঝমিয়ে নেমে আসা বৃষ্টি মাথায় নিয়েই এগিয়ে চলেছি ঝান্ডির পথে, এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়ে। প্রবল বৃষ্টি দুশ্চিন্তার পারদ চড়িয়ে মন খারাপের উৎসেচক হিসেবে কাজ করে। শৈলশিরার বাঁকে বাঁকে বৃষ্টি তাড়া করে নিয়ে যায় আমাদের। গাড়ীর জানালা থেকে দেখা যায় গোটা পাহাড় জুড়ে রয়েছে ঘন মেঘ। ধূসর কালো রঙের মেঘের পর্দা গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনের সামনে এক মায়ার জগৎ তৈরি করে রেখেছে। প্রকৃতির নির্দেশ মেনেই ড্রাইভার নিম্বা ভাইয়ার হেডলাইট –ফগলাইট জ্বেলে সাবধানী অগ্রসর। আশেপাশের গাছগুলো যেন মেঘের চাদরে ঢেকে আছে। পাহাড়িয়া বৃষ্টি নাছোড়বান্দা বালকের মতোই আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরে। একবার শুরু হলে কখন যে সে থামবে সেটা কেউ জানে না। এই বৃষ্টিতে পর্যটকের মনখারাপ হলেও পাহাড়িয়া উপত্যকার অরণ্যে অরণ্যে তখন নতুন করে প্রেমের জোয়ার বয়ে যায়। নদীতে, ঝর্ণায়, শৈলচূড়ায়, পাহাড়ের খাদে, গাছের ডালে, পাতায়-পাতায় উদ্দাম স্ফূর্তি জাগে, নতুন করে তারা সজীব হয়ে ওঠে। তবে এ পথে ভয়ও অমূলক নয়। কখন যে ধস নামে সেই আতঙ্কও থাকে সবসময়। বুকের ভিতর চরম বিপন্নতার আশঙ্কা ধুকপুক করতে থাকে। এইভাবে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আর ভয়-আশঙ্কার দোলাচলে ভুগেই একসময় পৌঁছে যাই ঝান্ডিতে।
জনমানসে হয়তো খুব পরিচিত নাম নয়, কিন্তু এই পাহাড়িয়া গ্রামটি আজও আমায় খুব টানে। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে মাত্র ৬২০০ ফুট উঁচুতে ঝান্ডি। মন ভালো করার এক আশ্চর্য ওষুধ রয়েছে এই গ্রামটায়। পথ-চলা সহজ-সরল স্থানীয় মানুষদের সাথে মিশে গিয়ে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে ঝান্ডির কোনও এক আজানা বাঁকে। সবুজ পাহাড়ের কোণে চুপটি করে লুকিয়ে থাকা নিরালা এই গ্রামটির শরীরে লেপটে থাকা হিম হিম ভেজা ভাব স্পর্শ করেই এখানে প্রথম প্রবেশ করি। সুরেলা এই গ্রামের ওপর দিয়ে ঢেউ খেলে যাওয়া হিমেল বাতাস স্বাগত জানায় তার অতিথিদের। প্রকৃতির সাথে নিবিড় হয়ে যাওয়া একরত্তি গ্রামটি ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতোই। এখানে চলতি পথে হাতছানি দিয়ে ডাকে পাহাড়ী নদী-ঝোরা-প্রপাতগুলি আর তার সাথে পর্যটকদের দেয় এক স্নিগ্ধতার আশ্বাস।
শৈত্য আবরণ ও গ্রামীণ ছন্দে বয়ে চলা সাবেকি রঙের যাবতীয় সবুজ নিয়েই ঝান্ডি। পাহাড়ি বুনোফুলের খুশবুতে আচ্ছন্ন থাকি। নির্জনতা এই গ্রামের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। শান্ত, নিপাট পাহাড়ি গ্রামগুলো যেমন হয় আর কি! নির্বাক ছবির মতো। এখানে এসে উঠেছিলাম আমাদের পূর্ব নির্ধারিত হোমস্টেতে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট ঘরগুলি নিয়ে জায়গাটা বন্য প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে একটু অগোছালো বলে আরও বেশি করে ভালো লেগে যায়। আশেপাশে শুধুই জঙ্গল আর উঁচু-নীঁচু অরণ্যপথ। ঝান্ডিতে পৌঁছতে না পৌঁছতে আবার শুরু হল বৃষ্টি। মুহূর্তের মধ্যেই চারপাশ অন্ধকার করে ঘিরে ধরল মেঘের দল। দেখতে বেশ ভালোই লাগছিল। পাহাড় আর বৃষ্টির মেলবন্ধন একটু বেশিই অন্যরকম। দুপুরের পর অবশ্য বৃষ্টি তার মেঘের দলকে নিয়ে নিরুদ্দেশ হল। চোখের সামনে থেকে একটা বিরাট বড় সাদা মেঘের চাদর একটু একটু করে সরে যেতেই খোলা আকাশটা হঠাৎ করে উন্মুক্ত হয়ে গেল। সেখানে ঝলমল করছে লাল, নীল, কমলা, হলুদ, সবুজের এক অবিমিশ্র পথ। যেন কোনও এক অজানা শিল্পীর অপরূপ তুলির টান – রামধনু। এমন আনন্দ অনেকদিন পাইনি। রোদ আর না উঠলেও পাহাড়ী বন, গুল্মলতার সোঁদা গন্ধ, ঠান্ডা ভেজা বাতাস শরীর ও মনকে আচ্ছন্ন করে দেয়।
বৃষ্টিটা একটু ধরে আসতেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সামবিয়ং চা-বাগানের দিকে। সুন্দর ঢেউখেলানো চা-বাগান। আকাশে একঝাঁক রঙিন পাখি প্রায়ই দেখা যায়। সে’রকমই নানারঙা পোশাক পরিহিত ঝাঁকে- ঝাঁকে শ্রমিকদের চা-বাগানে কাজ করতে দেখে এক নান্দনিক দৃশ্য বলেই মনে হচ্ছিল। নিপুণ হাতে তোলা ‘একটি কুঁড়ি দুটি পাতা’-য় ভরে উঠতে থাকে নেপালি মেয়েদের চায়ের ঝুড়ি। সদ্য নেমে আসা মেঘ থমকে থাকে চা-বাগিচার খাঁজে খাঁজে। বৃষ্টির জলে ধুয়ে সবুজের জেল্লা আরও বেশী করে বৃদ্ধি পেয়েছে। মনে হয় টুকরো টুকরো সফরকথারা এখানে জমা হয়ে আছে সবজে ইস্তাহারে। ফেরার পথে জঙ্গলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে একটি ছোট্ট প্রপাত দেখে চোখ আটকে গেল। নাম গীতখোলা ঝর্ণা। ছোট্ট হলেও বর্ষার জল তার রূপের ডালি খুলে দিয়েছে। মনে মনে নাম দিলাম ‘রূপসী গীতখোলা’। এই রূপসীর রূপের ছটায় যদি কেউ পাগল না হয় তাহলে সে সৌন্দর্য উপভোগ করা থেকে উপসী হয়েই থেকে যাবে। তিনটে নদীর ধারা পাহাড় থেকে নেমে এসে লুটিয়ে পড়ছে গীতখোলার শরীরে। একে ঘিরে কিছু গল্পও প্রচলিত আছে। স্থানীয়দের মতে কিছু পাথরের গায়ে আঘাত করলে নাকি শঙ্খধ্বনি শোনা যায়। মনে হল এই ঝর্ণার পাশে পড়ে থাকা প্রতিটি পাথরের খাঁজে খাঁজে একেকটা গল্প চাপা পড়ে আছে। কোনও অনুভবী লেখকের আবেগি কলমের ভরসায় তারা বসে আছে কবে সেগুলো সাদা কাগজের পাতায় কালো অক্ষরের আঁচড় হয়ে ফুটে উঠবে। নিম্বা ভাইয়া জানালেন চারপাশে নানা ধরণের জড়িবুটি বা মেডিসিনাল গাছ- গাছড়া রয়েছে। বেশ কিছুটা সময় এখানে কাটিয়ে ফিরে আসি হোমস্টেতে।
হোমস্টেটির ব্যবস্থা সাধারণ হলেও এর অবস্থান অনবদ্য জায়গায়। যেদিকে তাকাই সেদিকেই প্রকৃতির উজাড় করা রূপ। শেষ বিকেলে সূর্য তার জাদুদন্ডের স্পর্শে খোলা আকাশে শুরু করল রঙের খেলা। ৩৬০ ডিগ্রীর বিস্তৃত, উন্মুক্ত আকাশে তার কিছু দৃশ্যের সংহত উপস্থাপন দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। পুরো আকাশ জুড়ে লাল, নীল, কমলার আভা। অপূর্ব মায়াময় পরিবেশে মনকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় স্বপ্নের জগতে। সৃষ্টি করে রূপকথার এক ব্রাহ্ম মুহূর্ত। কানে বাজতে থাকে নশ্বর এই জীবনের প্রতি ভালোবাসার এক ভৈরবী সুর যার অনুরণন অনেকক্ষণ থেকে যায় আমার সমস্ত অনুভূতিতে। এমন দৃশ্য দেখে মন আপনা থেকেই গুনগুনিয়ে ওঠে-
“ঠিক সন্ধে নামার মুখে
তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে
মুখ লুকিয়ে কার বুকে
তোমার গল্প বলো কাকে?”
আমার সেই স্বপ্নের ক্যানভাসের রঙগুলো একটু একটু করে ঝরে পড়ছিল হোমস্টের এই বারান্দায়। ঠিক একইরকম... অপূর্ব, অপরিবর্তনীয়। বারান্দায় বসেই কফির সাথে পকোড়ার সুখানুভূতি গ্রহণ করতে করতে মায়াবী এই রূপের মোহজালে আবদ্ধ হতে থাকি।
বাজপাখির মতো ঝুপ করে সন্ধে নেমে আসার সাক্ষী থাকার অনুভূতি পাহাড়ে এলেই একমাত্র সম্ভব। দূরে পাহাড়ের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা মানুষের বসতির চিহ্নগুলো। ঠিক যেন জোনাকির মতো আলোকবিন্দুর মাধ্যমে শিলিগুড়ি, নামচি শহরগুলো তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। এক অনাবিল অনুভূতি হয় এই নিস্তব্ধ, শান্ত পরিবেশে। কথা না বলে ভীষণভাবে নিজেকে একান্তে আবিষ্কার করতে ইচ্ছে করে। চারপাশের অপরূপ নীরবতায় চুঁইয়ে-পড়া সৌন্দর্য একটু একটু করে উপভোগ করতে থাকি আর ভালোলাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে শিরায় শিরায়। ভাবনার সব গ্রন্থির বন্ধন উন্মুক্ত করে দেই। মনের মধ্যে ভেসে আসে অন্তহীন সব না-বলা কথাগুলো। সন্ধের পর থেকে আবার প্রবল পরাক্রমে বৃষ্টি তার দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করল। বৃষ্টির জলে ঝাপসা আবছায়া জানালার কাচে দেখতে থাকি ঝান্ডির নিথর রাতকে। সময় যত গভীর হয় পাল্লা দিয়ে বৃষ্টির শব্দও ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। মন্দাক্রান্তা ছন্দে অবিরাম ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর বৃষ্টির ক্যাকোফনে অন্ধকার পেরিয়ে একটু একটু করে তলিয়ে যেতে থাকি ঘুমের রাজ্যে। ঘরে তখনও হালকা আলো জ্বলছে। তার আবছা নীলিমায় স্বপ্নিল হয়ে আছে নরম বিছানা, বালিশ। কম্বলের মখমলি উষ্ণতার আদরের ভিতর ডুবে যেতে যেতে কানে বাজতে থাকে হোমস্টের মালিকের কথাগুলো- “আগর নসীব আচ্ছা হ্যায় তো সুবহে আপকো কাঞ্চন দিখাই দেগা”। অপেক্ষা করে রইলাম ভোরের সূর্যোদয়ের সময় দিগন্তজোড়া আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষারভেজা শরীরে যখন প্রথম রবিকিরণের রঙের ছিনিমিনি খেলা শুরু হবে সেই মহার্ঘ দৃশ্য দেখার সাক্ষী হয়ে থাকবার।
কিন্তু হায়! পরদিন ভোরে উঠে সেই দুর্লভ দৃশ্য দেখার একটা ব্যর্থ প্রয়াস করলাম। ভিউপয়েন্ট থেকে ঘন কুয়াশার মধ্যে খুব হালকাভাবে তার অবয়বটা শুধুমাত্র বোঝা গেল। বহু নীচে দেখা যায় নীল-ফিতে-তন্বী তিস্তা আর চেল নদীর প্রবাহরেখা। আজ কুয়াশা যেন বেশ ঘন আর ভারী। গাছ, রাস্তা, পাহাড়, বন – সবকিছুই তার ছায়ার আড়ালে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। দিনের ঝলসানো আলোয় যা মায়াময় লাগে, আজ যেন তা অলৌকিকতায় মুড়ে ফেলেছে। মেঘ-কুয়াশায় মোড়া সেই সকালে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই ঝান্ডি ইকো হাটে। অপূর্ব সুন্দর রিসোর্টটি প্রথম নজরেই মন কেড়ে নেয়। এখান থেকে স্বর্গ-ছেঁড়া আলোর মতো এক অন্যরকম সূর্যোদয় দেখার সাক্ষী থাকি। রিসোর্টের আশপাশ ঘুরে ফিরতি পথ ধরি। পথের মধ্যে হঠাৎই শুনতে পাই পাখিদের সশব্দ ওড়াওড়ি। তাকিয়ে দেখি গাছের ডালের আড়ালে একজোড়া পাহাড়ি ঠোঁট সোহাগী আলাপচারিতায় ব্যস্ত। রকমারি পাখির কিচিরমিচিরে সাতসকাল মুখরিত। সবুজ ডালপালার ভিতরে সদ্য ঘুমভাঙা পাখিরা ডানার ঝটপটানিতে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। নাম জানিনা, কিন্তু বিবশ করে দেয় তাদের মধুর ডাক। মন খারাপের যাবতীয় স্বপ্নগুলো দূরে সরিয়ে দেয়। একরাশ ইচ্ছেরা ওদেরই মতো ডানা মেলে উড়ে যেতে চায় সৌন্দর্যের অন্বেষণে দূর থেকে দূরে আরও বহুদূরে।
পাহাড়ের ধাপে ধাপে রয়েছে এলাচ বন। রাইশাক, গাজর, কপিরও চাষ হচ্ছে। জঙ্গল কোথাও কোথাও বেশ ঘন। আকাশ ছুঁতে চাওয়া পাইনের গায়ে পুরু হয়ে জমে আছে শ্যাওলা, মস। ঘন জঙ্গলের মধ্যেই মাঝে-মাঝে আসা সামান্য আলোর নকশায় উন্মুক্ত হয়ে যায় স্যাঁতসেতে পরিবেশের বুনোগাছের ঝোপ, ফার্ন আর পাহাড়ি বুনোফুল। বনের খাঁজে খাঁজে আটকে থাকা ভোরের কুয়াশা ঝান্ডিকে এক নৈসর্গিক পরশের প্রলেপ দেয়। পাইনের বনে শনশনানি বাতাস বয়ে যাওয়ার শব্দে মনে হয় “লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া”। মাথার ওপর উন্মুক্ত নীলাকাশ আর আশেপাশে প্রকৃতির গাঢ় সবুজ আঁচলের আলিঙ্গন এক অপার্থিব প্রেমের উপাখ্যান রচনা করার আদর্শ প্রেক্ষাপট। এখানকার চারপাশের জঙ্গুলে গন্ধমাখা মায়াপথ পাখির ডানার মতো বিছিয়ে আছে। পাইনপাতায় মোড়া সরীসৃপ পথে এলোমেলো রোদ্দুর হাতছানি দেয় আর বাতাস আদিম সৃষ্টির গান শোনায়- যা সনাতন, যার গায়ে এখনও কোনও শহুরে অভিসম্পাত লাগেনি, মানুষের কুশলী হস্তক্ষেপে যা এখনও কলুষিত হয়নি। এখানকার বর্ণমালা হল ভালোবাসার যা শেখার জন্য মনুষ্যসৃষ্ট কোনও চিহ্নের প্রয়োজন পড়ে না। প্রকৃতির প্রতি ১০০ শতাংশ ভালোবাসা থাকলেই এই ভাষার মাধ্যমে যোগাযোগ সেতু তৈরি হয়ে যায়। তখন কান পাতলেই শোনা যায় পাহাড়ের গান, পাখিদের গান, জঙ্গলের গান, ঝর্ণাদের গান, দল বেঁধে কাঠ কেটে বয়ে আনা পাহাড়ি রমণীদের গান ... সেই গান যে একবার শুনেছে তাকে বারবার ফিরে আসতেই হবে ঝান্ডির কাছে। তবে লিস্ট মিলিয়ে সাইটসিন করা যাদের অভ্যাস কিংবা প্রতি মুহূর্তে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা যারা প্রত্যাশা করে ঝান্ডি তাদের জন্য আদর্শ জায়গা নয়।
হোমস্টেতে ফিরে এসে দেখি প্রাতঃরাশের আয়োজন করেছেন মালিক ও তার স্ত্রী। মেঘলা কুয়াশাচ্ছন্ন এক অদ্ভুত পরিবেশ, সঙ্গে হোমস্টের আতিথেয়তা আর তার সাথে ধোঁয়া ওঠা অপূর্ব সব রান্না এককথায় দুর্দান্ত। হোমস্টের মালকিন নিজের হাতে পুরো ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করেন। তাই আন্তরিকতার ছোঁয়া প্রতিটি কোণায় কোণায়। শুধু একবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবার অপেক্ষামাত্র। একগাল হাসি নিয়ে সব আবদার এমনভাবে পূরণ করার চেষ্টা করবে মনেই হবে না আমরা ক্ষণিকের অতিথি। অনেকটা নিজের বাড়িতে অনেকদিন বাদে ফিরে আসার মতো, সবই যেন না চাইতেই চলে আসছে ভাবামাত্রই – সকালের চা থেকে রাতের খাবার পর্যন্ত সব।
সময় হয়ে এসেছে আমাদের অস্থায়ী আবাস গোটাবার। স্বপ্নের সেই রঙিলা ভোর এবার হয়তো দেখা হল না। আড়ম্বরের বাহুল্যতা বা আয়োজনের আধিক্যতায় ঝান্ডি হয়তো পুরোপুরি পর্যটন কেন্দ্র হয়ে ওঠেনি, কিন্তু নিষ্পাপ সারল্য আর মধুরতায় সে আমার মন জয় করে নেয়। আমার ভ্রমণ মৌতাতে ভিড় করে থাকে ঝান্ডির অলীক পাহাড়িয়া দুপুর, বিকেল, সন্ধে আর রাতগুলো। তাইতো ঝান্ডির স্বপ্নের আঙিনায় হতবাক আমি সফরনামা খুলে বসতে বাধ্য হই। এখানকার পাহাড়িয়া ঝর্ণা, নদী, জঙ্গলের মাদক সুর আমার মনকে বন্ধক রেখে দেয়। বেশ বুঝতে পারি আজীবন এক কঠিন ঋণজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছি ঝান্ডির কাছে যা কখনোই শোধ করতে পারব না। গাড়ীতে ওঠার সময় তার দিকে তাই একবার মুখ ফিরিয়ে বলতেই হল – “যাবার বেলায় পিছু থেকে ডাক দিয়ে কেন বলো কাঁদালে আমায়”। যদিও ফিরে যেতে মন চায় না, মনে হয় এখানেই কাটিয়ে দেই বাকি জীবন। কিন্তু নির্মম বাস্তবতায় পাহাড়ি গ্রামের প্রতি ভালোবাসার আবেগে ভেসে গিয়ে চিরস্থায়ীভাবে এখানে ডেরা বাঁধা আমার কাছে সারাজীবন স্বপ্ন হিসেবেই থেকে যাবে। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখার মতো বছরে এক-আধবারই হয়তো তা সম্ভব। যদিও এই স্বপ্নের টানেই সুপ্তমনের ভালোবাসার আগল খুলে দিতে বারবার ছুটে যাব অন্য কোনও এক পাহাড়িয়া গ্রামে আর হারিয়ে যাব তার অজানা বাঁকে ঠিক এভাবেই কিংবা অন্য কোনওভাবে।
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগল আহা হাইডেনজিয়ার রূপ অপূর্ব। আগের মন্তব্যে পুরোটা লিখতে পারিনি তাই মুছলাম।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ সৌমি। পড়লে জেনে খুব খুশি হলাম।
উত্তরমুছুন