অসিত মণ্ডল

 



জে. আলফ্রেড প্রুফরকের প্রণয়গীতি-- টি. এস. এলিয়ট

অনুবাদ -- অসিত মণ্ডল


চলো যাই, তুমি আর আমি

যখন সারা আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে সন্ধ্যা 

টেবিলে শায়িত অসাড় রোগীর মতো

চলো যাই, প্রায় পরিত্যক্ত রাস্তায় 

যেখানে শোনা যায় অস্ফুট স্বগোতক্তি 

অশান্ত রাত কাটে সস্তা হোটেলে

কাঠের গুঁড়ো ছড়ানো রেস্তোরাঁয়, 

যেখানে জমে থাকে ঝিনুকের খোলা 

রাস্তাগুলো অন্তহীন বিতর্কের মতো জট পাকানো

তাদের উদ্দেশ্য গোপন 

এই সব জটিল রাস্তারা তোমার কাছে রাখতে দেয় না 

আমার অমোঘ প্রশ্নটি 

আহা,বলো না আবার, ' সেটা কি?'

চলো যাই, আমরা দেখা করি। 


ঘরের ভেতরে মেয়েরা আসে আর যায়

আর মাইকেল এঞ্জেলো নিয়ে কথা বলে অনায়াসে। 


   হলুদ কুয়াশা পিঠ ঘষে শার্শির গায়,

হলুদ ধোঁয়া মুখ ঘষে শার্শির গায়

আর সন্ধের কোণে কোণে চেটে নেয় কুয়াশা

কুয়াশা ঝুলে থাকে ড্রেনের ওপর

চিমনি চোঁয়ানো ঝুল জমা হয় তাতে

কুয়াশা লাফিয়ে নামে বারান্দা থেকে 

আর যখন দেখে অক্টোবরের রাত খুব নরম 

বাড়ির চারপাশে ঘুরপাক খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। 


        অবশ্যই সময় হবে

কারণ গড়িয়ে যায় রাস্তায় হলুদ কুয়াশা 

শার্শিতে পিঠ ঘষার পর 

অবশ্যই সময় হবে, হবেই

সেজেগুজে সেই সব মুখের মুখোমুখি হওয়ার ;

সময় হবে হত্যা ও সৃষ্টির, 

সময় হবে সব কাজের ও দিনের

আর তোমার প্লেটে একটা প্রশ্ন রাখার

হবে সময়,তোমার আর আমার,

এবং সময় হবে শত শত সিদ্ধান্তহীনতার,

এবং শত শত বার দেখা ও ফিরে দেখার,

সকালে বিস্কুট সহযোগে চা পানের আগে। 


    ঘরের ভেতরে মেয়েরা আসে আর যায় 

আর মাইকেল এঞ্জেলো নিয়ে কথা বলে অনায়াসে। 


এবং অবশ্যই সময় হবে 

ভাবতে বসার ' আমি কি পারব?' 'আমি কি পারব? '

সময় হবে ঘুরে দাঁড়ানো আর সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার, 

মাথায় আমার মস্ত টাক নিয়ে -

(তারা বলবেঃ লোকটার মাথার চুল কি তাড়াতাড়ি পাতলা হয়ে গেল!)

আমার সকালের কোট,চিবুক অবধি তোলা সুঠাম কলার

আমার নেকটাই দামী আর ভদ্রস্থ, অথচ তাতে আলপিনের দাগ-

(তারা বলবে ঃ লোকটার হাত পা দিন দিন লিকলিকে হয়ে যাচ্ছে!) 

আমি কি পারব 

পৃথিবীকে অশান্ত করতে?

মুহূর্তেই হবে সময় 

কারণ সিদ্ধান্তগুলি উল্টেপাল্টে বদলে গিয়ে জট পাকিয়ে যায়। 


        ওদের সবাইকেই আমার জানা হয়ে গেছে, সবাইকেই-

জেনেছি সমস্ত সন্ধ্যা, সকাল ও বিকেল

মেপেছি কফির চামচে নিজের জীবন 

আমি জানি ক্রমশ মিলিয়ে যাওয়া সমস্ত কন্ঠস্বর 

আমি জানি পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা অপসৃয়মান সুরমূর্ছনা

      তবে কিভাবে ধারণা করি? 


এবং তাদের চোখের চাহনি আমার চেনা, সবার

যে চোখগুলি তোমাকে পরিপাটি কথার ছাঁদে আটকে রাখে 

আর যখন আমিও বেশ পরিপাটি, আলপিনের ওপর ছড়ানো, 

যখন আমি পিনবদ্ধ এবং দেওয়ালে কাতরাচ্ছি 

তখন কিভাবে আমি শুরু করব? 

কিভাবে ফুৎকারে উড়িয়ে দেব জ্বলন্ত সিগারেট টুকরোর মতো আমার দিন ও পথের প্রান্ত? 


এবং কিভাবে আমি ধারণা করি?

এবং আমি ইতোমধ্যেই বাহুগুলো চিনেছি, চিনেছি সব-

ব্রেসলেট পরা বাহু, ফর্সা আর নিরাবরণ 

(কিন্তু বাতিস্তম্ভের আলোয়,হালকা বাদামি চুলে আনত!)

এ কি কোন পোশাকের প্রসাধনী সুবাস, 

যা আমার সমস্ত কথা এলোমেলো করে দেয়? 

টেবিলে প্রসারিত বাহু অথবা চাদরে ঢাকা 

       এবং আমি কি ধারণা করি?

      এবং কিভাবে আমি শুরু করি? 


       *         *        * 


আমি কি বলবো,  আমি গোধূলিবেলায় গলিপথ ধরে হেঁটে গেছি

এবং দেখেছি কি চুরুটের ধোঁয়া 

শার্ট পরিহিত কোন নিঃসঙ্গ মানুষের, যার জানালায় বাড়ানো মুখ ?... 


      যদি আমি কোন পাখির পায়ের এক জোড়া ফাটা নখ হতাম

তবে শান্ত সমুদ্রের বুকে আঁচড় কাটতাম। 


     *     *     * 


এবং বিকেল,সন্ধ্যা শান্তিতে নিদ্রিত!

যেন লম্বা আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় প্রশান্ত,

নিদ্রিত............. ক্লান্ত.............  অথবা অসুখের ভান করে

মেঝেয় শায়িত, এখানে তোমার ও আমার পাশে। 


চা কিংবা কেক আর আইসক্রিম শেষ হয়ে গেলে

আমি কি পারব মুহূর্তকে নিয়ে যেতে সংকটে?

কিন্তু যদিও আমি কেঁদেছি আর উপোস করেছি, কেঁদেছি আর প্রার্থনা করেছি,

যদিও আমি দেখেছি আমার মাথা (আংশিক টাক পড়া)

        আনা হয়েছে একটি প্লেটে ; 


আমি কোন মহাপুরুষ নই - আর আমার কেন মহৎ কাজও নেই, 

আমি দেখেছি নিঃশেষিত হয়ে যেতে আমার জীবনের মহত্ত্বতম মুহূর্তকে

দেখেছি যমদূত এসে খামচে ধরেছে আমার কোট আর তখন হেসেছে, 

এবং মোদ্দা কথা, আমি ভয় পেয়েছিলাম। 


        এবং এতে কি কোন কাজ হতো? 

কাপ, মোরব্বা কিংবা চা পর্বের পর 

চিনামাটির পাত্র আর তোমার আমার কিছু কথার ভেতর, 

এর কি কোন মূল্য থাকত?

মৃদু হেসে বিষয়টি দাঁতে কাটার 

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ছোট্ট বলে পরিণত করার

এবং চরম অমোঘ প্রশ্নগুলোর দিকে গড়িয়ে দেওয়ার 

বলা : ' আমি ল্যাজারাস, সদ্য ফিরেছি মৃতের দেশ থেকে 

সবকিছু তোমাদের বলতে এসেছি, তোমাদের বলে যাব 

যদি কেউ মাথার বালিশটা ঠিক করে দেয়

       আর বলে : ' আমি কখনোই বলি নি তা,

কখনোই না। 


     আর এতে কি কেন কাজ হতো? 

কোন কাজ হোত কি?

সূর্যাস্তের পরে,উঠোন আর ভেজা রাস্তা শেষ হলে। 

উপন্যাস, চায়ের কাপ, মেঝেয় লুটানো স্কার্ট -

এবং এটাও, আরও অনেক কিছুই? 

     এসব কিছুর পর-

আসলে আমি যা বলতে চাই তা বলা অসম্ভব! 

কিন্তু যেন জাদু লন্ঠন পর্দার ওপরে নকশার মতো বিন্যস্ত করেছে স্নায়ুগুলি

এতে কি কোন কাজ হতো? 

যদি বা কেউ মাথার বালিশ ঠিক করে দিয়ে, গায়ের চাদর ছুঁড়ে দিয়ে 

জানালা দিয়ে তাকিয়ে বলতো :

       ' না,আদৌ তা নয়।

সে অর্থে আমি বলিনি ও কথা। '


     *        *      * 


না! আমি রাজকুমার হ্যামলেট নই, হওয়ার কথাও ছিল না;

আমি নিছক সভাসদ এক

যার কাজ শুধু দল ভারি করা, দু' একটা দৃশ্যের শুরুতে থাকা, 


রাজকুমারকে উপদেশ দেওয়া, নিঃসন্দেহে নিরেট বোকা একজন,

এক সহজলভ্য আহ্লাদে আটখানা মানুষ, 

ধান্দাবাজ, সাবধানী আর খুঁতখুঁতে।

বাক্যবাগীশ,কিছুটা মাথামোটা, কখনে বা হাস্যকর কেউ 

কখনো বা প্রায় ভাঁড় একজন। 


আমার বয়স বাড়ছে......... বাড়ছে বয়স আমার.......

আমি প্যান্টের ঝুল গুটিয়ে পড়ব। 


       এখন কি পেছনে সিঁথি কাটবো?  পারব কি সাহস করে পীচফল খেতে?

আমি এখন ফ্লানেলের তৈরি সাদা প্যান্ট পরব আর হেঁটে বেড়াব সমুদ্র তটে। 

আমি জলপরীদের গান শুনেছি, তারা গায় সমস্বরে। 


       মনে হয় না ওরা আমাকে গান শোনাবে। 


     আমি দেখেছি ওদের ঢেউয়ের মাথায় চেপে সমুদ্রে ভেসে যেতে,

ঢেউগুলোর সাদা চুল ব্যাকব্রাশ করতে করতে ভেসে চলেছে তারা 

বাতাসে ভর করে, সাদা আর কালো জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে। 


      দীর্ঘক্ষণ আমরা আছি সমুদ্র -গুহায় দুজনে

সমুদ্র -বালিকারা লাল আর বাদামী রংয়ের জলজ উদ্ভিদের মালা পরিয়েছে আমাদের 


জেগে উঠি তুমি আর আমি কোন মানুষের ডাকে,

তারপর অতলে তলিয়ে যাই দুজনে।




মন্তব্যসমূহ

  1. ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে T.S.Eliot- এর কবিতা খুব পছন্দের। তোমার এই দুর্দান্ত অনুবাদ বাংলা সাহিত্যে একটা অনন্য সৃষ্টি হয়ে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। খুব খুব ভালো হয়েছে। আগামীতে আরও অনেক এমন সৃষ্টির অপেক্ষায় থাকব।❤️❤️❤️❤️🌹🌹🌹🌹

    উত্তরমুছুন
  2. ঝকঝকে অনুবাদ। দাঁতে কোনো কাঁকর নেই। ভালো লাগলো অসিত দা।
    - রাজদীপ ভট্টাচার্য

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য