অমিতাভ দাস
রাসকিন বন্ড: এক বিরল প্রতিভাধর লেখক
রাসকিন বন্ড একজন বিরল প্রতিভাধর লেখক। ভারতীয় ইংরেজি ভাষার এই লেখক বহুকাল আগে থেকেই আমার প্রিয় লেখকদের একজন। কবে থেকে তাঁর লেখা আমি পড়ছি,আজ ঠিক মনে করতে পড়ছি না। তবে আমার লেখার শুরুর দিক থেকেই তাঁর লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। মনে পড়ছে ২০০৪ কি ২০০৫ সাল হবে, আমি শিয়ালদা সাবওয়ে বইমেলা থেকে রাসকিন বন্ডের একটি বই কিনেছিলাম-- " আমাদের গাছপালা দেহরাতে এখনো জন্মায়"। দেখলাম এই বইটি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত আত্মজীবনীমূলক গল্পের সংকলন। বাংলায় অনুবাদ করেছেন অসীম চৌধুরী। বলতে দ্বিধা নেই এই বইটি পড়েই তাঁর প্রতি আমি উৎসাহি হয়ে উঠি। তারপর একে একে তাঁর বেশ কিছু বই কিনে পড়ে ফেলি। যেমন, রাস্টির এডভেঞ্চার, The night train at deholi, কিছু গাছের কথা ইত্যাদি। মনে পড়ছে ওই সময়েই আমি রাসকিন বন্ডের কিছু কবিতার অনুবাদ করেছিলাম। বড়ো যত্ন করে অর্ধেন্দু চক্রবর্তী লেখাটি তাঁর পত্রিকায় ছেপে ছিলেন। অকৃতদার বন্ডের থেকে শিখেছি অকৃত্রিম প্রকৃতিপাঠ আর বৃক্ষপ্রেম। বন্ডের মতো প্রকৃতিচেতনা বিভূতভূষণ ছাড়া আর কারো লেখায় তেমন করে পাইনি। আমার অনুবাদ করা বন্ডের এই কবিতাটি আমার বড়ো প্রিয়।
গাছের আশীর্বাদ
ঠাকুমা প্রায়-ই বলতেন:
' আশীর্বাদ ধন্য সেই বাড়ির দেওয়াল
যা পুরোনো গাছের নরম ছায়ায় আবৃত।'
তাই, গত বসন্তে আমি একটি চারাগাছ পুঁতেছি।
সে এখন ছয়মাসের,
এবং দ্রুত বাড়ছে
ছয়বছর পর সে আমাদের
আশীর্বাদ করবে।
বেশ কয়েকটি ছোটোগল্প অনুবাদ করে ফেললাম। The coral tree গল্পটা পাঠালাম উৎপল ভট্টাচার্য সম্পাদিত ' কবিতীর্থ' পত্রিকায় ছাপা হল। বহু মানুষের প্রশংসাও পেলাম। এভাবেই চলছিল। রাসকিন বন্ডের লেখা সে সময় আমার বেশ কিছু আগ্রহী ছাত্রছাত্রীকে পড়ালাম। তাঁরাও বন্ডের গুণমুগ্ধ পাঠক হয়ে উঠল। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। তখন সাহেব বলে একজনকে পড়াতাম। একদিন ওকে পড়াতে গিয়েছি। ও বললে, 'স্যার আপনার জন্য একটা সাপ্রাইজ আছে।'
--'তাই নাকি! কী?'
ও আমার হাতে একটা ইংরেজি কাগজ তুলে দিল। সেখানে রাসকিন বন্ডের ছবি আলোচনা ও সাক্ষাৎকার মনে হয় ছিল। আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। অভিভূত এবং বিস্মিত। সাহেব মিটিমিটি হাসছে। সেই প্রথম আমি রাসকিন বন্ডের ছবি দেখি। কী যে আনন্দ হচ্ছিল তখন। সাহেব বললে, 'জানি স্যার, আপনি খুশি হবেন এইটে দেখে। কাগজটা আপনাকে দিলাম। থাক আপনার কাছে।' তারপর থেকে সে কাগজ আজো আমার নিজস্ব সংগ্রহে ছিল বহু বছর, এখনো হয়ত আছে। খুঁজলে ঠিক পেয়ে যাবো। সেই ২০০৪ সালে বাংলায় তাঁকে নিয়ে এত মাতামাতি শুরু হয়নি। অনেকেই তাঁর লেখাও পড়েনি। এখন অবিশ্যি রাসকিন বন্ডের নাম অনেকেই শুনেছে। অনুবাদের দৌলতে অনেক পাঠকের কাছে তিনি পৌঁছছেন।
বর্তমানে 87 বছরের ইয়াং রাসকিন বন্ড। তাঁকে দেখলে বুঝি বয়স তাঁর কাছে একটা সংখ্যা মাত্র। সব সময় খুশিতে থাকেন। লিখে চলেন। মানুষকে ভালোবাসেন। প্রকৃতির সঙ্গে লগ্ন হয়ে থাকেন। তাঁর লেখায় প্রকৃতি মিশে থাকে, ছোটোরা মিশে থাকে। শিশুর মতো মন না হলে তো ছোটোদের জন্য লেখা যায় না। ছোটোদের জন্য লেখা তো বেশ কঠিন। তাঁর অধিকাংশ লেখাই তো তাঁর আত্মজীবনীর অংশ। তিনি তো নিজেকেই রচনা করেছেন। তাঁর কট্টর সমালোচকরা বলেন যে বন্ডের লেখায় কল্পনার তেমন জায়গা নেই, কাল্পনিক চরিত্রের বিস্তার নেই।
রাসকিন বন্ডের কথা পড়ছিলাম। জন্ম ১৯৩৪ সালে হিমাচল প্রদেশে কসৌলি ক্যানটনমেন্ট শহরে এক ব্রিটিশ পরিবারে। বাবা ছিলেন ব্রিটিশ এয়ারফোর্সের উচ্চ পদস্থ এক অফিসার। বন্ড নির্জনতা-প্রিয় একজন মানুষ। জীবনের একটা সময় সাংঘাতিক নিঃসঙ্গতায় কাটিয়েছেন। শৈশব ও কৈশোর কাটিয়েছেন গুজরাতের জামনগরে, দিল্লি ও সিমলার বিশপ কটন স্কুলের ছাত্রাবাসে। মাত্র দশ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন। মা বিয়ে করেছিলেন অন্য একজনকে। মা চাননি বন্ড লেখক হোক। চেয়েছিলেন সেনাবাহিনিতে চাকরি করুক ছেলে। কিন্তু রাসকিন বন্ড কেবল লেখক হতেই চেয়েছিলেন। নিজের লোকজনেরা মা, দিদিমাসহ অন্যরাও ইংল্যান্ডে চলে গেল। বন্ড ভারতকে ভালোবেসে থেকে গেলেন এদেশেই।
যদিও ষোলো-সতেরো বছর বয়সে ইংল্যান্ডে চলে যান মাসির কাছে চাকরির সন্ধানে। যদিও থাকেননি বেশি দিন। লিখে ফেলেছেন প্রথম উপন্যাস মাত্র সতেরো বছর বয়সেই। নাম ' দ্য রুম অফ দ্য রুফ'। প্রকাশককে এই ব ইটির পান্ডুলিপি দিয়ে যে অগ্রিম পেয়েছিলেন সে অর্থেই পুনরায় ভারতে ফিরে আসেন। শুরু করে দেন নিয়মিত তাঁর সাহিত্যচর্চা। শুরু হয় এক সাহিত্য-সাধকের দীর্ঘ জীবনপথে চলা। আমার লেখা স্মৃতিকথা মূলক গদ্যের বই " আমার পাঠ গ্রহণ" এ রাসকিন বন্ড প্রীতির কথা লিখেছিলাম। ২০১৪ সালে।
বিয়ে করেননি রাসকিন বন্ড। কিন্তু তাঁর মস্ত এক পরিবার আছে। দত্তক নেওয়া পরিবার। তাদের সঙ্গেই বন্ড দিব্য ভালো আছেন। আনন্দে আছেন। তাঁর জীবনে বারবার প্রেম এসেছে, ভেঙেও গেছে। নানা কারণে বিয়ে করা হয়নি তাঁর। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল এই তো সাধকের জীবন। প্রকৃতির মতো স্বাধীন। নদীর স্রোতের মতো স্বচ্ছ তাঁর মন। চট করে মিশে যেতে পারেন ছোটোদের মধ্যে। তিনি বলেন, ছোটোদের মন স্বচ্ছ, উদার, আবেগময়। ' দুটো শিশুর মধ্যে বন্ধুত্বের জন্য লাগে শুধু একটা মার্বেল বা একটু পুতুল বা একটা আধুলি কিংবা একটা হাতের চুড়ি। কেননা, শিশুরা প্রবঞ্চনা জানে না। শিশুরা চায় বাধা-বন্ধনহীন প্রশ্রয়, জলের মধ্যে উদ্দাম লাফঝাঁপ, বৃক্ষ আরোহন। শিশুদের অদম্য উৎসাহ নিজের চারপাশের সবকিছু জেনে নেওয়ার।'
ঋণস্বীকার
১. আমাদের গাছপালা দেহরাতে এখনো জন্মায়: রাসকিন বন্ড: সাহিত্য আকাদেমি
২. কৃত্তিবাস- রাসকিন বন্ড সংখ্যা
৩. রাসকিন বন্ডের বিভিন্ন রচনা।।
কী যে ভালো লাগল জেনে, আমার প্রিয় রাজ্যে রাসকিন বণ্ড জন্মেছেন। অইতাভদা অনুবাদ গুলিও পড়তে চাই , পড়াবেন। শুভেচ্ছা রইল।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ সৌমী। সুযোগ পেলে পড়াবো অনুবাদ। মতামত পেয়ে ভালো লাগল।
মুছুনঅমিতাভদা বানানটা অটো কারেক্টে যাতা হয়ে গেল,🙏
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগলো পড়ে। একজন সাহিত্য প্রেমী সাধকের জীবনকথা গুছিয়ে সাজিয়েছেন। আপনার অনুবাদ করা কবিতা ও খুব সুন্দর। তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। শুভেচ্ছা রইল।
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ । খুশি হলাম।
মুছুনআমার খুব প্রিয় লেখক। দেরাদুনে গিয়ে ওঁর বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করেছিলাম খানিকক্ষণ। লেখাটি আগ্রহ উদ্দীপক।
উত্তরমুছুন- রাজদীপ ভট্টাচার্য
বাহ্.....দারুণ।ভালো লাগলো
উত্তরমুছুনবাহ্.....ভালো লাগলো। সত্য ই রাসকিন বন্ড বড্ড ভালো লাগার।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনরাস্কিন বন্ড খুব আত্মমগ্ন ও নিরহংকার একজন মানুষ। প্রকৃতি ভালোবাসেন। সেই সঙ্গে তাঁর নিজের উত্তরাধিকার থেকেই জেনেছিলেন বৃটিশ ভারতের নানা দ্বন্দের কথা। বড়দের জন্য লেখায় সেসব আছে। অতি প্রিয় মানুষকে নিয়ে অমিতাভর লেখাটা প্রাণে শীতল পরশ দিল। খুব আন্তরিক লেখা।
উত্তরমুছুনঅনিন্দিতাদি
আপনি পড়লেন, আনন্দ পেলাম দিদি🌷🌷
মুছুন