সমর্পিতা ঘটক
বহু যুগের ও পার হতে...
বাতিঘর অনলাইন পত্রিকার এবারের সংখ্যার নাম বারিষনামা। এই নাম দেখেই আমার বারিষওয়ালার কথা মনে পড়ে গেল। কাঁধে ঝোলা আর বারিষ নামাবার নানান তত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছিল, সেই যে বারিষকর! ‘রেইনমেকার’-এর মতোই কিন্তু সবটা মোটেই এক নয়। হাসি হাসি মুখ আর খই ফোটা বুলি। খুব ছোটোবেলায় দেখেছি দূরদর্শনে। সবটা সেদিন বুঝেছিলাম! না। কিন্তু এটুকু ঠাহর হয়েছিল যে এই ছবি কবিতার মতো, দুর্বোধ্য কবিতা নয়, শুখা মনোভূমিতে বৃষ্টির মতো। বেশ কিছু সংলাপ ছন্দে ছন্দে। ছবির নাম ‘থোড়া সা রুমানি হো যায়ে’। অভিনয়ে নানা পাটেকর, অনিতা কানোয়ার, বিক্রম গোখলে, রিজু বাজাজ, দিলীপ কুলকার্নি, হেমন্ত দেশাই প্রমুখ। পরিচালক অমল পালেকর। আমার মতে দুর্দান্ত পরিচালক। তাঁর পরিচালিত ছবির বিষয়বস্তু ও নির্মাণ দেখলেই তা মালুম পড়ে। কম ছবি কিন্তু তাদের বিষয় ও নির্মাণ এত সুন্দর! পাঠকদের বেশি করে মনে পড়বে ‘পহেলি’র কথা কারণ সে ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন শাহরুখ খান এবং রানি মুখার্জি। অনেকেই মনে রাখেননি পরিচালকের নাম। আর অমল পালেকরের মতো আড়ালে থাকা সেলিব্রিটিদের তো কবেই আমরা ভুলতে বসেছি। আজ অভিনেতা অমল পালেকরের কথা থাক। অন্য আর একদিন সেসব কথা হবে। এই ছবির নির্মাণে সমান কৃতিত্বের দাবি রাখেন চিত্রা পালেকর।
কলকাতায় তেমন বৃষ্টি নেই এইবার। তাই হয়ত মনে পড়ে গেল ওই শহরটার কথা! ছোট্ট শহর। সুন্দর সুন্দর বাড়িঘর। ধাঁচ দেখলে মনে হয় ব্রিটিশদের তৈরি। ম্যাকলাস্কিগঞ্জের মতো। সেখানে বৃষ্টি হয়নি বহুদিন। উত্তপ্ত আবহাওয়া। শস্য শুকিয়ে যাচ্ছে, কৃষক, মজুর হাহাকার করছে বৃষ্টির জন্য তবু সরকার ঘোষণা করতে দেয় না যে পরিস্থিতি খরার থেকেও খারাপ। এসব ঘটনা সরাসরি দেখানো হয় না, চরিত্রদের সংলাপে উঠে আসে। আর উঠে আসে হতাশার কথা। বৃষ্টি আসলে সুখ-স্বপ্নের মতো। নয়তো সবই ফুটিফাটা। নিজেদের হতাশা অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। এই ছবির গল্পের কেন্দ্রে আছে বিন্নি, বিন্নির বাবা, বিন্নির এক দাদা, এক ভাই। বিন্নি বিন্দাস, তার বাবাও। আর আছেন জেডি (জয়দেব দাশগুপ্ত), জেলা প্রশাসক যিনি সরকারকে বোঝাতে ব্যর্থ হন যে এই খরার সময় ‘লগান’ কমানো উচিত এবং রিলিফ ফান্ড দেওয়ার নোটিশ তাকে ফিরিয়ে নিতে হয়।
শুখা আবহাওয়া আর শুখা মানুষ একই রকম। স্বস্তিতে থাকতে দেয় না মোটে। নিজের মর্জিতে খুশি থাকা মানুষকে ফুর্তিতে বাঁচতে দেয় না খুঁতখুঁতে ভ্রু-কুঞ্চিত সমাজ। কেন বিয়ে হচ্ছে না বিন্নির? বিন্নি কেন মেয়েদের মতো নয়! সে তো অসুন্দর! সে মেয়েই নয়। তার গঠন, কাজকর্ম, পোশাক, আদব কায়দা কোনোটাই তো মেয়েদের মতো নয়। ছেলেদের সামনে সে বিজলি ঝলকিয়ে চোখ ঝলসে দিতে পারে না। একটু ন্যাকামি, একটু ঢলে পড়া নেকুপুষু কায়দা (হিন্দিতে যাকে বলে আদায়ে) তার চরিত্রে নেই। তাই সে ছেলেদের মতোই। বরং বলা ভালো বিন্নির বাবার তিন ছেলে। এসব মন্তব্য কানে আসে বিন্নির, তার বাবার। যতই বিন্নি নিজেকে ভাবুক সে যথেষ্ট সুন্দর, অনন্যা এবং হাসিখুশি। এবং বিন্নির বাবাও আপাদমস্তক এক ইতিবাচক মানুষ। আদর্শ অভিভাবক। কিন্তু বাকিদের চোখে ছক না মিললেই তারা জাজমেন্টাল। তুমি অসুন্দর, কুরূপা, বিয়ের বাজারে অকেজো। পুরুষ তোমায় পাত্তা দেবে না। সমাজের ঠিক করা কাঠামোতে না পড়লেই আঘাত করো, মুর্ছিয়ে দাও মন, নিজের শর্তে বাঁচা মেয়েকে শেষ করে দাও। কবি ও নাট্যকার মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের ‘সুন্দর’ নাটকের কথা মনে পড়ে যায়।
বিন্নির অবিবাহিত তাত্ত্বিক বড়ো ভাই সব কিছুতেই নিজেকে ঠিক ভাবে। প্রখর বাস্তববাদী। কর্কশ। অন্যের খুঁত খুঁজে বেড়ানো লোক। সবাই তাকে মানে তবু সেই পেরফেক্তো দাদাটি গরমে ঘামতে ঘামতে বাবা, ভাই, বোন সবার দোষ খুঁজে বেড়ায়। রুমানি অর্থাৎ রোমান্স নেই, স্বপ্ন নেই তার জীবনে। বেনিতো পেরেস গালদোসের ‘দন্যা পেরফেক্তা’ উপন্যাসের কথা মনে পড়ে যায়। সেই রুখাশুখা গ্রাম ভিইয়াওররেন্দা আর শ্রীমতী পারফেক্ট। নিজেকে পারফেক্ট ভাবা কী ভীষণ এক ব্যারাম! ভাইয়ের দ্বারা কিস্যু হবে না বলে বলে ভাইয়ের আত্মবিশ্বাস তলানিতে পাঠিয়ে দিয়েছে বড়দা। অন্ধকারে ও উচ্চতায় ভয় পাওয়া ভাই ওড়ার স্বপ্ন দেখে। পাইলট হবে। দাদা ডানা মুচড়ে ভেঙে দিয়েছে সব স্বপ্ন। দ্বিধায় ভয়ে বিম কুন্ঠিত সবসময়। সে স্বপ্ন দেখে, বিশ্বাস করে স্বপ্ন সত্যি হয়। সে জানে প্রেমের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অনন্ত আকাশ, বিশ্বাস করে বৃষ্টি আসবেই। তবু দাদার কথা অগ্রাহ্য করতে পারে না কারণ দাদা তো ভুল হতে পারে না।
বৃষ্টি আনার প্রতিশ্রুতি নিয়ে বারিষকর আসে। এক সন্ধেবেলা। আলো নিভে যায়। আর অচেনা বারিষকর তখন দরজায়। মুশকিল হাল করনেকা ম্যাজিক হ্যায় উসকে পাস। একবিংশ শাতাব্দীর স্মার্ট, চৌখস এবং সর্বদাই প্ল্যান, স্কিম, ফ্যাক্ট নিয়ে ফার্ম চালানো বড়দা উত্তর দিতে পারে না কেন ফুল শুকিয়ে যাচ্ছে? ওহে আজনবি শুখার নাম শুনেছ তুমি? বারিষকর বলে, শুখার নাম সবচেয়ে বেশি তার কানেই ধ্বনিত হয়, তার পৌঁছানোর আগেই শুখা সর্বত্র পৌঁছে যায়, “কভি কভি লাগতা হ্যায় কে শুখা মেরে আনে কা খবর হ্যায়। শুখি নদীয়া, শুনি তলাইয়া, শুনা পোখরঘাট, শুনে নয়না শুনা কাজল, শুনি মন কে বাট।” কিন্তু যখন ফিরে যাই তখন সবুজ দিগন্তের গল্প চতুর্দিকে। ছমছম, ছলাৎ ছলাৎ শব্দে নেচে উঠছে সকলে, ধানের ওড়না মাথায় দিয়ে লাজুক মুখে নেচে উঠছে গাঁও। খোদ বারিষকর বৃষ্টির নামান্তর। মাঠ, প্রান্তর ছাড়াও ভিজিয়ে দেয় কোন মন্ত্রে মানুষের মন!
বৃষ্টি আবার আনা যায় নাকি? যতসব বুজরুকি। জোচ্চুরি। পাগল কিংবা প্রতারক! বিন্নির বাবা আর ভাই বিশ্বাস করতে শুরু করে বারিষকরের কথা। শুনতে ভালো লাগে। সস্তা, সুন্দর টিকাও বারিষ, পাঁচ হাজার টাকা অ্যাডভান্স। ৪৮ ঘন্টার মধ্যে আসবে বারিষ। বাবা রাজি হয়ে যান। বিন্নি এবং বিন্নির দাদার ওজর-আপত্তি উড়িয়ে। বিন্নির ভাই আনন্দে আত্মহারা। বিন্নির চোখে কেন অবিশ্বাস? সমাজের বেঁধে দেওয়া ঠুলি সেও পরে নিল চোখে? জেডি আসেনি ডিনারে এবং প্রত্যাখানের নামে সে অপমান করেছিল বিন্নির বাবাকে, হাত তুলেছিল বিম-এর গায়ে। তাই হয়তো বিন্নি বিশ্বাস করতে শুরু করে দিল মানুষকে সহজে বিশ্বাস করে ফেলতে নেই। বারিষকরের কথা শুনতে ভালো লাগলেও আসলে সে একটি ধোঁকাবাজ! বৃষ্টি আনার আজব ফর্মুলার নামে সে বোকা বানাচ্ছে বিন্নিদের সবাইকে। সিনেমামোদী পাঠকদের নিশ্চয় মনে পড়ে যাচ্ছে ‘গল্প হল সত্যি’-র কথা। ধনঞ্জয়ের কথা। সংসারের কাজ সামলে দিতে এসে মাসমাইনে-করা রান্নার লোকটি আসলে সামলে ও শুধরে দিয়েছিল পরিবারের সদস্যদের মধ্যেকার সম্পর্ক। বারিষকর কি তাই করবে? বিমের সঙ্গে তার কথাবার্তা, তাকে দেওয়া টাস্ক এবং তারপর বিমের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার যাত্রা শুরু হয় । ‘সমুন্দর কো বাঁধে অ্যায়সা কই ঘাট নেহি, কদমোকো বাঁধে অ্যায়সা কই বাট নেহি।’ এই মন্ত্রে বিম নিজেকে খুঁজে পেতে শুরু করে।
বিমের বড়ো দাদা আসলে আমাদের সমাজের প্রতিবিম্ব, নতুন কিছু দেখতে পায় না। সচ্চাইয়ের নামে শুধু নীরস ফ্যাক্ট, মামুলি চামড়ার চোখে যা দেখা যায় তাই বলে, স্বপ্ন নেই, রুমানি নেই, ভালোবাসা নেই। ইট কাঠের মতো খটখটে তার আধার। বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় সেখানে আসবে কোন আনন্দে?
জোচ্চোর নটবরলালের খোঁজ পড়ে, এই শহরেই লুকিয়ে আছে সে। আমরা সবাই বুঝতে পারি বারিষওয়ালাকেই খুঁজছে প্রশাসন। বিন্নি ততক্ষণে বারিষওয়ালার চমৎকারি বুঝতে পেরে গেছে। প্রেমে ডুবতে ডুবতে সে বুঝতে পেরেছে কিছু স্বপ্ন অলীক হলেও দেখতে হয়। এবং সে শরিক হয়ে যায় বারিষওয়ালার উদ্ভট সব স্বপ্নের। আগ্নেয়গিরি নিভিয়ে দেওয়া, বৃষ্টি নিয়ে আসা, লোশন মাখিয়ে গায়েব করে দেওয়া, ম্যাজিক চশমা পরে অন্যের মনের তল খুঁজে পাওয়া ... এই সমস্ত কাজগুলোকেই সত্যি মনে হতে থাকে। তবু সে বারিষওয়ালার হাত ধরে পাড়ি দিতে চায় না চন্দনের বনে, কারণ স্বপ্ন যতদিন মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে ততদিন তারা সুন্দর, শ্রেয়। হাতের মুঠোয় চলে এলেই নষ্ট। বারিষকরের সঙ্গে একটি কাটানো রাত বিন্নিকে ফিরিয়ে দিয়েছে হারানো বিশ্বাস। সমাজের তৈরি করা পট্টি খুলে ফেলতে পেরেছে সে। মনের মধ্যে টলটল করছে সুখ। আর আশা-উম্মিদ যখন জেগে ওঠে মরু প্রান্তরে... তখনই তো বৃষ্টি নামে।
বুকের মধ্যে বৃষ্টি নামে, নৌকা টলোমলো
কূল ছেড়ে আজ অকূলে যাই এমনও সম্বল
নেই নিকটে — হয়তো ছিলো বৃষ্টি আসার আগে
চলচ্ছক্তিহীন হয়েছি, তাই কি মনে জাগে
পোড়োবাড়ির স্মৃতি? আমার স্বপ্নে-মেশা দিনও?
চলচ্ছক্তিহীন হয়েছি, চলচ্ছক্তিহীন।
বৃষ্টি নামলো যখন আমি উঠোন-পানে একা
দৌড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম তোমার পাব দেখা
হয়তো মেঘ-বৃষ্টিতে বা শিউলিগাছের তলে
আজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছো আকাশ-ছেঁচা জলে
কিন্তু তুমি নেই বাহিরে- অন্তরে মেঘ করে
ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে!
(যখন বৃষ্টি নামলো- শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই কবিতা বিন্নির কিংবা জেডির অথবা বিম... যারা ভালোবেসেছে... যারা বৃষ্টিতে ভিজেছে... অথবা বারিষকরের... যে একমাত্র জানে, কেবল বাহিরে নয় সবার আগে বৃষ্টি নামুক অন্তরে অন্তরে...
চলচ্চিত্র নিয়ে লেখার সময় প্লট অনেকটাই বলে দিলাম, কেন? কারণ এই লেখা রুমানির স্মৃতি রোমন্থন, কলহপ্রিয়তা আর নীতি পুলিশের চোখের ওপর মুষলধারে বর্ষণ। আর ৩২ বছর আগে নির্মিত একটি বিস্মৃত ছবির উদযাপন।
কোথায় যেন ভেসে গেলাম, বারিষকর আছে, সে আসে, কিন্তু কখন সেটাই কেবল অজ্ঞাত। খুব সুন্দর লিখলে । বিশ্বাস ফিরে পাওয়াটা জরুরি
উত্তরমুছুনকী সুন্দর বললে সৌমী! ❤️
মুছুনমন ভরে গেল আমার। হ্যাঁ, ব্যারিষকর আসে। সে এলে ঠিক টের পাবে। 😊
ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন- রাজদীপ ভট্টাচার্য
অসম্ভব সুন্দর একটা লেখা!!
উত্তরমুছুনমনে পড়ে গেল সেই মুগ্ধ কিশোরী বেলা, প্রথম অনেক কিছু।
খুব ভালো লাগল।
উত্তরমুছুনপৃথা চট্টোপাধ্যায়