মৌসুমী মুখোপাধ্যায়


 

হার্টফেল

 

  ঘরের ঠিক মধ‍্যিখানের মস্ত বড় খাটটায় মণিদাদু শুয়ে রয়েছে। গায়ে একটা সাদা চাদর ঢাকা দেওয়া। দুই চোখের উপরে বড় বড় দুটো তুলসী পাতা। হাত দুটো জড়ো করে রাখা আছে বুকের ঠিক উপরে। চাদরে‌র উপর দিয়ে‌ও তাই একটু উঁচু মতো হয়ে আছে ওই জায়গা‌টা; আর সেইখানটাতেই ছোট্ট একটা রঙচঙে ব‌ই রাখা। ব‌ইটার উপরে আবার একটা রথ আর দুটো রাজপুত্তুরের ছবি আঁকা। 

পুপলু একটু ভালো করে দেখবে বলে ব‌ইটা টানতে গিয়েছিল, মিনুমাসি এক ঝটকায় পুপলুর হাতটা সরিয়ে এনেছে। পুপলুর একটু ব‍্যথা ব‍্যথা লেগেছিল, তাও পুপলু কাঁদেনি। কাঁদবে কী, বড়রাই সবাই কাঁদছে যে। মা, মিনুমাসি, পমপম, মণিদিদা, তাতাই, কাকিমণি সব্বাই কাঁদছে। ঘরের মধ্যে কেমন একটা গুনগুনে একটানা স্বর। তাতাই আবার হুঁ হুঁ করে কেমন একটা শব্দ করে কাঁদছে। ডাক্তার জেঠু এসেছিল একটু আগে। মণিদাদুকে ভালো করে দেখে মাথা নাড়িয়ে বলে গেছে "হার্টফেল!"

           খুব ভালো হয়েছে মণিদাদু মরে গেছে। মণিদাদু খুব পচা। কোলে নিয়ে কেমন করে যেন একটা আদর করত পুপলু‌কে। পুপলুর খুব ব‍্যথা লাগত।

কিন্তু সবাই এত কাঁদছে কেন সেটাই পুপলু বুঝতে পারছে না! তাহলে কি মণিদাদু এদের কখনও ব‍্যথা দেয়নি!

মা আবার মাঝে মাঝেই শাড়ির আঁচলে শব্দ করে করে নাক মুছছে। এমনিতে তো পুপলু নাকে হাত দিলেই চোখ পাকিয়ে বলবে, "পুপলু, ডোন্ট ডিগ ইওর নোজ!" আর এই বেলা! 

মাথার উপর পুরোনো পাখাটা‌ আস্তে আস্তে ঘুরছে ঘটাং ঘটাং শব্দ করে। গুনগুন, হুঁ হুঁ, ঘটাং ঘটাং সব মিলে অদ্ভুত একটা শব্দ হচ্ছে। 

পুপলুর খুব হাসি পেয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এই সময় যে হাসা যাবে না সেটাও পুপলু বুঝতে পারছে। তাই প্রাণপণে হাসি চেপে মুখটাকে দুঃখ দুঃখ করে রেখেছে। 

শুধু মা আর মণিদিদা কাঁদছে বলেই পুপলুর যা একটু কষ্ট হচ্ছে। খুব ইচ্ছে করছে একবার মণিদিদা‌র কোলে গিয়ে বসে; কিন্তু সাহস হচ্ছে না। মণিদিদা খুব কাঁদছে যে!

আসলে পুপলু মণিদিদা‌কে খুব ভালোবাসে। মণিদিদা কত সুন্দর সুন্দর গল্প বলে ওকে। ভাত মেখে খাইয়ে দেয়, পায়ের উপর বালিশ রেখে দোল দিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়ায়। পুপলু এখন বড় হয়ে গেছে কিনা, তাই ওভাবে শুলে মণিদিদা‌র পেটুর মধ্যে পা লাগে, মা রাগ করে। তবুও মা যখন কোনো কাজে বাইরে যায় আর পুপলু‌কে মণিদিদা‌র কাছে রেখে দিয়ে যায়, পুপলু তক্ষুনি একটা বালিশ নিয়ে এসে মণিদিদা‌র পায়ের উপর শুয়ে পড়ে আর বলে, "গল্প বলো!" মণিদিদা অমনি সেই দুষ্টু রাক্ষস আর রাজপুত্তুরের গল্পটা বলতে শুরু করে।

মা একদম ভালোবাসে না মণিদিদা‌কে। বিশেষ করে রাত্তিরে রাক্ষসের স্বপ্ন দেখে পুপলু যখন ঘুমের মধ্যেই কেঁদে ওঠে, মা পুপলু‌কে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, আর বলে, "দুর বোকা, এ তো স্বপ্ন! স্বপ্ন দেখে কেউ ভয় পায় নাকি? ভয় পেও না সোনা, একদিন একটা সুন্দর রাজপুত্র এসে সব দুষ্টু রাক্ষসদের মেরে দেবে, কোনো ভয় নেই মা।"

তখন পরম নিশ্চিন্ততায় আবার ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতে পুপলু শুনতে পায় মা রাগ রাগ গলায় বাবিকে বলছে "বারবার বলেছি তোমাকে, মণিকাকিমার বাড়িতে মেয়েকে পাঠিও না, রোজ রোজ কী সব ভূত-প্রেত আর রাক্ষসের গল্প বলেন মেয়েটা‌কে, আর ঘুমের মধ্যে মেয়ে আমার কেঁদে কেঁদে ওঠে.. বারণ করলেও শোনেন না….কোন আক্কেলে মেয়েটা‌কে তুমি কাল আবার ওনার ওখানে নিয়ে গিয়েছিলে?"

বাবি আস্তে আস্তে বলে, "মণিকাকিমার জন্য তো যাই না, মণিকাকার জন্য যাই! পুপলু‌কে কত ভালোবাসেন উনি, দেখো না!"

ইস্! বাবিটা কী বোকা! জানেই না পুপলুর স্বপ্নের রাক্ষস‌টাকে আসলে কার মত দেখতে!

সব কাজ মিটিয়ে শ্মশান থেকে সবাই ফিরে এলে, অনেক রাত্রে মা বিছানায় শুতে এল যখন, তখন ঘুমের মধ্যেই আধো আধো ঘোরে মাকে জড়িয়ে ধরল পুপলু। হাসিমুখে বলল, "রাজপুত্তুর সত্যিই এসেছিল মা, দুষ্টু রাক্ষস‌টাকে মেরে দিয়ে গেছে।"

সারা দিনের পরিশ্রমের পর ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে তখন মায়ের। জড়ানো গলায় মা জিজ্ঞেস করল "তাই নাকি মা? কী নাম সেই রাজপুত্তুরের?"

-"হার্ট ফেল"॥




মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য