সৌমী আচার্য্য
অতিক্রম
( ১ )
-ইরম নামদিছিস ক্যেনে? বাপ অন্য কাম করেনা ক্যানে?
-জানি নাই।
-তু সব জানিস, খালি কথা ঘুরাইছিস।
-তুর বাপরে কথাটো বল না কেনে।
বাপরে বাপকে এই কথা বলার ক্ষমতা আছে নাকি? এই এত্ত লম্বা, কালো ধুমসো, কোঁকড়া কোঁকড়া চুলের বাবা। সারাদিন মর্গে মরা ঘাঁটে। ছোটোখাটো মায়ের পাশে সে যেন দানো। যদিও বাপ ভালো মানুস। তবে কম কথা বলে। তাই বাবার কাছে ঘেঁষে না ছেলে। ভয় খায়। ইসকুলে সবাই ওকে খ্যাপায়। রাবণের ছেলে মহীরাবণ/ দশেরায় পুড়বে রাবণ/ ফটাফট জ্বলবে রাবণ/ ডোমের ব্যাটা মহীরাবণ। ওর মা সেমতি কিছুতেই বুঝতে চায়না নামটার সমস্যা। কতবার বলেছে, নাম তো ইকটা খোলস ভেতরের তুইটাই খাঁটি। খুব চটেছে মহী, ইল্লি আরকি! তু খালি শাসত্তর আউরাস। খোলসের জ্বালাটো বুঝিস লাই। ইসকুল যদি যেতিস, বুঝতিস। এসব কথায় ভারী অন্যমনস্ক হয়ে ওঠে সেমতি।
নদীর ধারে যেখানে সব মন খারাপের অন্ধকার একজোট হয়ে ঘোঁট পাকাতো, সেইখানে ওদের চালাঘর। মরা পোড়াতে পোড়াতে চুল্লুতে চুবে থাকা বাপ একদিন লগি ভেঙে সোজা ঢুকে গিয়েছিল চিতায়। সেই আধপোড়া শরীরটায় পুড়ে কালি হয়ে যাওয়া ছোট্ট একটা হাঁড়ি ছিল মাথার জায়গায়। সেমতি বিশ্বাস করতে চায়নি ওটা বাপের মাথা।
-ই তুরা সব মিছা বুলছিস! বাপ লয়, বাপ লয়! বাপ আমায় বুলেছিলো চরবাটি ইসকুলে পইড়তে পাঠাবেক, আমি পড়াটো শিকবো, লিখাটো শিকবো। এ বাপ! বাপো রে।
এগারো বছরের সেমতির মা হিজলি, দশবাবুকে সন্তুষ্ট করে মরা পোড়ানোর অধিকার পেয়েছিল। এমনিতে এই ছোট্ট শ্মশানে মরা আসে গোনাগুনতি। প্রথম যেদিন হিজলি চুল্লুতে চুমুক দেয়, হড়হড় করে বমি করেছিল। মাটি ফুঁড়ে সেই রস সোজা গিয়েছিল দেবতার পায়ে। নইলে মায়ের অমন বুদ্ধি আসে। রোজগার কম বলে খরচ কমিয়ে আয় বাড়ানোর আজীব সব ভেলকিবাজি। যেদিন যেদিন মরা পুড়ত, গোবর আর কাদামাটি পোঁদফল আর আলুতে আচ্ছাসে লেপে দিত সেমতি। মা চালান করে দিত চিতার নীচে। কাজ সেরে চিতা ঠাণ্ডা হলে, নাইকুণ্ডের সাথে ওগুলোও খুঁজে বার করে নিত। নদীর জলে ঘষে ধুয়ে ফ্যানা চটকে খেত ওরা, ভাত রান্না হতনা সেদিন সেদিন। জ্বালানি বাঁচতো।
মরার আত্মীয় পরিজনদের হাতে কলস তুলে দেবার আগে হিজলি স্নান সেরে মহিষথানের চকচকে শাড়ি পরে, কপালে সিঁদুর লেপে নিত। মাকে দেখতে তখন কালী ঠাকুর বলে মনে হত ওর। লোকে বেশি টাকা দিতে এলে হিজলি কোমল স্বরে বলত, বেশি টাকা লিএ পাপ করতে পারবোক লাই। ঐ থানে রেখে আসেন। মায়ের মন্দির গড়তে কাজে আসবে। আপনাদের ভাঁটি পোড়া মন ঠাণ্ডা হবেক।
জাদু ছিল হিজলির কথায়। মন্দিরের নামে আরো একটু বেশি টাকা দিত লোকে। কিন্তু ঐ টাকায় হাত দেওয়া বারণ। কতদিন সেমতি কেবল কচুপোড়া নুন দিয়ে খেয়েছে। আশেপাশে কেউ নেই। কোনো আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব কিচ্ছু না। বাপ বেঁচে থাকতেই বাজারে গেলে লোকে সরে দাঁড়াত। ওরা যেন জ্যান্ত যম। ছোঁয়া বাঁচিয়ে আনাজ দিত, সব্জি দিত দোকানদার। সেমতির বাপ একদিন বলেছিল, তুই দুঃখটো করিসনা সেমতি, ব্যাটারা মরলে বাঁশ দিয়্যে মাথাটো ভাইঙবো। খিলখিল করে হাসত দুজনে।
ওর মা মাথায় টাকা গুনতে গুনতে বলে, ভাববি এই সময়টোও চলে যাবেক। একটু সইতে পারলেই সব বদলে যাবে দেখিস। সেমতি বিশ্বাস করতো, তাই হবে তাই হবে। হলোও তাই। বছর চারেক হিজলির নিষ্ঠায় চেষ্টায় চরবাটির শ্মশানকালী জাগ্রত হয়ে উঠল। একে একে জোটে চ্যালা চামুণ্ডা। হরে, ফটকা, বিসলা, যোধি, শোকু। ওরা বশ হয়েছিল মায়ের আর মায়ের টাকার। সেমতি বহুবার বলেছে, মা ইখন তো তোর ট্যাকা হইছে, গায়ে কাপড় হইছে, ঘরে খাবার হইছে, আমাক ইবার ইসকুলে পাঠানা ক্যেনে! জিভ বার করে হিজলি বলে, মায়ের পূজা ছ্যেড়ে পড়তে হবেক লাই। মাকে বশ করতে শেখনা ক্যানে? জগৎটা সেই তো চালাচ্ছে নাকি! তুই তো আমার ভর না পড়ল্যে মন্দিরে আসিস না ঠিক কর্যে।
শ্মশানের মন্দির জাগ্রত হতে হতে মরা পোড়ানো এক বিশেষ ঘটনা হয়ে দাঁড়ালো। বছরের বিশেষ দিনে কেবল এই পূণ্যভূমিতে দাহ হবার রীতিও চালু হল। গ্রাম প্রধান, নেতামন্ত্রী ঢাকঢোল না পিটিয়ে চুপিচুপি এসেছিল। রাত তখন গভীর।
-দেখুন হিজলি, গ্রামের বড়ো শ্মশানে ইলেকট্রিক চুল্লি বসেছে। তাছাড়া ওখানে যারা দাহকাজ করে তারা সবাই সরকারী লোক। আপনি মন্দিরের আয় বাড়ান আমাদের আপত্তি নেই কিন্তু দাহ এখানে আর হবেনা। নদীর ধারটাও সংস্কার হবে।
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে হিজলি স্হির চোখে বলে, সে হোক ক্ষতি লাই। আমার মায়ের মন্দিরের চাতালটাও ঐ সংস্কারের সাথেই বাঁধিয়ে দিবেন, আর দাহ পুরো বন্ধ করা যাবেক লাই। আর স্বামী শ্বশুরের কাজ বুল্যে কথা।
-বেশ তো আপনি এটাকে পূণ্য দাহ ক্ষেত্র করুন। বিশেষ অর্থের বিনিময়ে দাহ করবেন। তবে আপনার আয়ের পঁচিশ শতাংশ পার্টি ফাণ্ডে দেবেন। বোঝেন তো সবদিক সামলানোর একটা ব্যাপার থাকে।
হিজলির কালো শরীর চকচক করে ওঠে, চোখ চুল্লুর আভায় লাল। সে আমিও জানি বাবু। তবে আমার কাজটো কঠিন। বশীকরণ, পথের কাঁটা দূর করা সহজ কাজ তো লয়। সে সব হ্যাপা এই এরাই সামলায়। আপনার পারটি কেবল মহোচ্ছবেই টিকিটো দ্যাখায়। দশ পাবেন সাহেব লয়তো কিছুই লয়।
গ্রাম প্রধানের মুখ থমথমে হয়ে ওঠে। সেমতি বোঝে মা বড়ো সাহস দেখিয়ে ফেলছে কিন্তু অবাক হয়ে দেখল তাতেই বাবুরা রাজি হয়ে চলে গেল। সময় ভারী আজীব চিজ। আর টাকা তারচেয়েও ধুরন্ধর। সেমতি মার বুকে মুখ গুঁজে বলে, ক্যানে তুই মন্দ কামটো করিস মা! মরা ছ্যেড়ে এই জ্যান্ত মানুষ লিএ কারবারটো ক্যানে ফ্যাঁদাইলি?
-ভালো মন্দ বুলে কিছু হয় নারে মেইয়ে। বাঁইচবার জইন্যে সব ঠিক, সব।
-জ্যান্ত মানুষ ডরাই, সব যেন গিল্যে খেতে চায়। এর থিক্যা মরা ভালো।
-হ্যাঁ মরা ভালো! ঐ মরার আঁচে গলা জীবনটো ভালো। থুঃথুঃ। ক্যানে ভালো লাগছেক লাই এই চারবেলা পেট ভর্তি খাবার।
-আর তুর গায়ে যে পাপের গন্ধ সেটাও কি ভালো লাইগতে হবেক নাকি? কার কার সাথে শুয়ে আসিস।
-ট্যাঙস্ দিএ মাথাটো ভ্যাইঙে দিব। রিষ মনের মইধ্যে সেঁধাইছ্যে লাকি?
-থুথু শরীরটো নোংরা করাইছিস আর মেয়ের মনে পাপ খুঁইজছিস।
কিন্তু সেমতির হাবভাব বদলে গেল। গা দেখানো জামায় ওর টানটান সদ্য যৌবনে পতঙ্গ উড়তে লাগল। মন্দিরের ছেলে ছোকড়া গুলোর মন ছোঁকছোঁক। পঁয়ত্রিশ বছরের শরীর পনেরোর কাছে হেরে যাবার আশঙ্কায় তেড়ে উঠেছে যেন। চোখ জ্বলতে লাগে হিজলির। মন্দিরের কাঁচাটাকা মাথায় ভেলকি দেখাচ্ছে তার। রাস্তা যাই হোক এগিয়ে যাওয়া অনিবার্য।
(২)
-মা এ মা! তুর কী হইছ্যে বলতো! তখন থ্যেকে শুধু ভাবছিস আর ভাবছিস?
ছেলের ডাকে জ্ঞান ফেরে সেমতির। চোখের ভেজা কোণটা মুছে বলে, ও কিছু লয় বাপ তু যা হাত পা ধুয়ে আয়। আজ পোঁদফলের ঝোল কইরেছি কষে ঝালটো লাগায়ছি।
-ছিঃছিঃ কী সব ভাষায় কথাটো বলিস মা! ডিম বলনা ক্যেনে। এখন আর ইসব কেউ বলে?
-ক্যানে বললে কী হইছে?
-তুই তো বলিস মা সামনে এগোতে লাগে।
সেমতি ছেলেকে খেতে দিয়ে ঘর গোছায়। মানুষটা একেক দিন সন্ধ্যায় ফেরে। মরার গন্ধ ঢাকতে উগ্র আতর লাগায় গায়ে। একেকদিন রাতে চিৎকার করে ওঠে। ঘুমন্ত ছেলের মুখে চুমো খেয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। ডুকরে বলে, আমি তো মরা চিরতে, সেলাই করতে চাই নাইরে সেমতি, ডোমের জীবনটো কোনো জীবন লয়রে, ঠাণ্ডা শরীরগুলো আমার চোখের সামনে ভেইস্যে থাকে সব্বক্ষণ। সেমতি বুকের সাথে জড়িয়ে রাখে পাহাড়ের মতো মানুষটাকে। আবার কখনো নেশায় চুর।
তবে আজ অবধি লোকটা তার গায়ে হাত দেয়নি। যেদিন প্রথম তাদের মন্দিরে এসেছিল সেদিন থেকে সেমতিকে উজাড় করে ভালোবেসেছে। মায়ের পেয়ারের নাঙ বিসলা ওকে এনে হিজলিকে বলেছিল, এই নাও জ্যান্ত রাক্ষস এনে দিলাম। তোমার মেয়ের পাহাড়াদার আর কোনো ভয় থাকবে না। হিজলি গভীর চোখে মেপেছিল তাকে। ওদের পাকা একতলা বাড়ির লাগোয়া একটা টিনের ছাদ দেওয়া ঘর তুলে দিল মা। প্রয়োজন ছাড়া মন্দিরের ধারেকাছে যাওয়া, চত্ত্বরের বাইরের বেরোনো, লোকজনের কাছে ঘেঁষাঘেঁষি বন্ধ হল সেমতির। তবে পাহাড়ের মতো লোকটাকে কতটা বিশ্বাস করা যায় কে জানে? হিজলি বিশ্বাস করতে পারেনি বিসলার সবকথা। সময় বলবে যা বলেছে সব সত্যি কিনা।
সন্ধ্যে হলে ধূপধুনোর গন্ধে চতুর্দিক ভারী হয়ে উঠত। যোধি ঢাকে বোল তুলতো। মায়ের ভর পড়া শুরু হলে, সেমতি গুটিগুটি সরে আসত নদীর কাছে। ভেপারের আলোয় নদীকে দেখতে মায়া লাগে ওর। মেয়েকে মোবাইল কিনে দিয়েছে হিজলি। তাতে গান শোনা যায় ফোন করা যায়। ও শোনে না। ফোন করার কেউ নেই, বন্ধু নেই, ভাইবোন নেই। সেমতি একা মরুভূমির মতো। মাঝেমধ্যে ওর মা ফোন করে, দূরে কোথাও গেলে। তখন পাহাড়া আরো শক্ত হয়। নদীতে স্নান করাও বন্ধ। জল তুলে দেয় লোকটা, তাতেই কাক স্নান করতে হয়। নিঝুম হয়ে বসে ছিল। হঠাৎ!
-আমার নাম ভৈরব। পড়াশোনাটো জানি কিন্তুক দেখতে এরকম বল্যেএ কেউ কাজে রাখে না। আপনার মার দয়ায় কাজটো জুটলো। কিন্তুক আপনি ইখ্যানে একা! ওদিকে পুজোটো হচ্ছেক। পুজোতে তো আপনাকে থাইকতে বুলছ্যে।
সেমতি কিছু বলতে চায়না। কী লাভ বলে? ভৈরব বুঝতে পেরে খানিক দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।
-আমায় পড়াটো শিখাইবেন? বাপোর ইচ্ছা ছিল কিন্তুক মরে গেলো।
নদীর জলে গুণগুণ গান ধরে। দুটি সুকুমার মন দূরত্ব রেখে বুনে চলে কত শব্দ। ভৈরবের কাছেই সেমতি প্রথম জানলো ডোমরা আসলে বিষ্ণু দেবতার পুজো করে আর ধর্মরাজের। শ্মশানে শ্মশানকালীর বাস, এই মত থেকেই নাকি এই মন্দির হয় শ্মশানে শ্মশানে। ভারী মজা পায় সেমতি। সত্যি নাকি এসব? কে জানে?
-ল্যেখাপড়া করলে কত কী জানা যায়! আমার বাবা শোওরের হাসপাতালে মর্গে কাজটো করে। আমি দেখ্যে এসেছি শরীলের ভিতর কত যনত্তর। বাপরে সেসব দ্যেখলে পাগলা হতে হয়।
সেমতি এসব গল্প শুনতে শুনতে কখন যেন বিশালাকৃতির দৈত্যের ভিতর মানুষ দেখতে পায়। মরা দেখে দেখে মানুষ হওয়া সেমতির দেবতায় ভয় নেই। তাই ভর ওঠা হিজলির ধুনোর গন্ধ এড়িয়ে নদী পাড়ে আঁকিবুঁকি কাটে। ওপাড়ে জোনাকিরা খেলায় মেতে ওঠে। আকাশজুড়ে তারারাও সঙ্গী হতে নেমে আসে নদীর গায়ে। ফিসফিস করে কারা? ছায়ার মতো মাথায় ঘোরে শব্দ।
-তোমার মায়ের বুজরুকি ধরিয়ে দাও। পালিয়ে যাও, পালিয়ে যাও। মরা পোড়ানো ছেড়ে তোমার মা মরা জোগাড়ে ব্যস্ত। পথের কাঁটা দূর করা যায় কী ভাবে? কী ভাবে?
সেমতি কুঁকড়ে ওঠে। ভৈরব তার ফ্যাকাশে মুখ দেখে ব্যথা পায়। কুন্ঠিত হয়ে বলে, আমায় বলো না ক্যেনে সেমতি? কারা ছিল ওরা?
সেমতির মাথায় নাচে শব্দ, চোখে আগুন। তোমার মার রাজত্বে তুমি প্রজা, সেবাদাসী। তোমার অধিকার নেই কিছুতেই। শরীর চেনা নিষিদ্ধ তোমার, ইচ্ছেমতো বাঁচা নিষিদ্ধ। সব সুখ তোমার মায়ের। তুমি বাবার স্মৃতি আঁকড়ে শ্যাওলার মতো পচছো সে সব পুড়িয়ে ক্ষমতার, শক্তির নেশায় চুর হয়ে আছে।
-এ্যাই হেই মোর মা বটে। জুতায় মুখটো ছিঁড়ে লিবো।
-সে তোমায় চাকর বানিয়ে রেখেছে। তার জন্য রান্না করা, মাথায় গায়ে তেল দেওয়া। এসবের লোক তুমি। সেমতি তুমি সব পাল্টে দিতে পারো। তুমি তো জানো ভর টর কিচ্ছু না সব বুজরুকি। হাজার মৃত্যুর কারিগর তোমার মা। খতিয়ান চাও!
-হেই আমি পারবোক লাই, পারবোক লাই।
ভৈরব দেখে সেমতি টলতে টলতে ঘরে চলে যায়। বদলটা থেকে যায় বেশ কয়েকদিন। তারপর শান্ত সব। ভৈরব একটু দিশেহারা। কারা ছিল? সেদিন সন্ধ্যার পুজো শুরু হতেই দুটো কর্তা ব্যক্তি গোছের লোক তাকে জোরাজুরি শুরু করে গঞ্জের হাসপাতালের মর্গে কাজ করার জন্য। সেখানে নাকি ডোমের অভাবে লাশ পচছে। দ্রুত পরিস্কার না করলে গঞ্জের বাতাসে দূষণ ছড়াবে। সেমতি একা নদীর পাড়ে, যত হাত ছাড়িয়ে যেতে চায় ভৈরব, তত কাকুতি মিনতি আসে। কোনোক্রমে কথা দিয়ে এগোতেই দেখে বেশ কয়েকজন। যেন প্রেত। ভৈরব হাঁকে, কে কে উখানে? আলোর বেগে হারিয়েছে ছায়া। তারপর থেকে আদর চাউনি, সুযোগ বুঝে ছুঁয়ে যাওয়া সবই উবে গেল সেমতির। অস্থির হয়েছে ভৈরব, তার অচল জীবনে সেমতি যেন দুর্দান্ত আগুন। যেন বুকের ভেতর জোর করে বেঁধে রাখা ঝড়। কদিন পর আকাশে ঝকঝকে রোদ্দুর।
-ভৈরব তোমার হাসপাতলের কাজটো হয়ছ্যে লাকি?
-হইছ্যে, তবে উরা পারমেন্ট করবেক বুলছ্যে। কিন্তু আমি লাশকাটা ঘরে কাজটো চাই লাই কখুনো।
-পারমেন্ট তো ভালো।
-কিন্তু তোমায় ছ্যেড়ে মানে এই কাজটো ছাড়তে হবেক।
-সে ছ্যাইড়তে হয় ছ্যাইড়বে। ই আবার কোনো কাজ লাকি?
-আমি কাইজট্যা ছাড়লে তুমার ভালো লাইগবে?
-লাইগবে।
ভৈরব তল পায় না। দুটো দিন নিজের ভিতর গুমড়ে মরে। লাশকাটা কাজ পারমেন্ট। সেমতির ভালো লাগবে? অমাবস্যার বড়ো পুজোর আয়োজনে সকলের সাথে লেগে পড়ে কাজে। মন্দির লাগোয়া বড় চাতালে ভক্তদের বসার জায়গা আর পিছনে চলছে রান্না। সেমতিকে খুঁজতে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায় ভৈরব। গজরাচ্ছে দুই নদী। ফুঁসছে। যেন বাণের তোড়ে ভেসে যাবে সব।
-ফটকা আর শোকুকে দিয়ে তুই গ্রাম পোধানের পথের কাঁটা উজ্জ্বলমাস্টাররে মেরে লাইনে শুইয়ে দিস নাই? বিসলা, হরে, শোকু ঐ উকিলের সুন্দর মেইয়েটার সব্বোনাশ করে নাই? মধু সরকারের বউয়ের পথের কাঁটা হইছিলো বল্যে? গাদাগাদা টাকা তুর হইছ্যে আর কত কার জীবনটো লষ্ট হইছ্যে ভেইবেছিস। ভর পড়ার নামে লাটক করিস? ভগবান তুর পাপের শাস্তি তুরে দেবেক নাই?
-কিসের পাপ? সব শালারা লুটে পুটে নিচ্ছে আর আমার বেলায় পাপ? তুর এত কথা কুত্ থ্যেকে আইসছে? তুর ছ্যেনালি বন্ধ কইর্যেছি বলে তড়পাচ্ছিস লাকি? এত কথা কে শিখাইছে? ঐ রাইখসটা?
-খবরদার মা! ঐ ভালো মানুসটার নামে একটো কথাও তুই বুলবিক নাই। রাইখস ও না, তুই! তুর লজ্জা করে নাই? মানুষ মারিস তুই? এর চায়ে আমার মরা পোড়ানো মাটো ভালো ছিল। ইটা মা লয় পিচাশ বটে।
হিজলি হঠাৎ মেয়েকে ঘরের দরজার ঢাঁশা দিয়ে পিটতে থাকে। ভৈরব খানিক দোনোমোনো করেও দরজার সামনে গিয়ে বাজখাঁই গলায় চিৎকার দেয়।
-ওকে আর একটাও বাড়ি দিবেন নাই। আমার চায়া খারাপ কেউ হবেক নাই তবে।
ওর ভীমমূর্তি দেখে হিজলি থেমে যায় ঠিকই তবে তীব্র চোখে বলে, তুই যে না মরদ সেটা বুইলেছিস ওরে? পিরিতি থাইকবে তো? সাবধান কর্যে দিস। আগুন লিএ খ্যেলতে এলে পুড়ে ছাইটো হবে। কিন্তু সেমতি নিজেই হয়ে উঠেছিল জ্বলন্ত আগুন। হিজলি যেতেই উঠে বসে, বড়ো বড়ো চোখে তাকায় ভৈরবের দিকে। ভৈরব ম্লান চোখ নামাতেই বলে, তুমি চোখ ক্যেনে নামাইছো? না মরদ হওয়াটো কোনো পাপ লয়। আমার সাথ্যে থাকো। কাজটো আছে। শ্যেষ কইর্যে তুমার সঙ্গে চল্যে যাবোক।
-কুথায় যাবেক? কাজটো কী?
সেমতি উত্তর দেয় না। ঘরের ডানদিকের জামাকাপড় থেকে মোবাইলটা বার করে। কানে নিয়ে কথা বলা শুরু করে।
-সব শুইনছেন তো? ইবার পূজার ঘরে যাচ্ছি। আপনারা আসেন না ক্যেনে? আইসছেন! ঠিক আছে আর একটু পরেই লাটক শুরু হবেক।
ফোন রেখে ভৈরবকে বলে, আমাকে বিয়া করতে পারবিক! আজই! ভৈরবের মাথা শূন্য হাওয়ায় হাপর টানে। কী বলছে এই একরত্তি মেয়ে! আমতা আমতা করে বলে, বিয়া করবো কী করে? আমি তো, আমি তো?
-ক্যেনে? আদর কইরতে, ভালোবাইসতেও কি পারবিক লাই? বাচ্চা তো পথেঘাটেও পইড়্যে থাকে।
ভৈরবের চোখ আলো হয়ে ওঠে। কোমড়ের নীচে চিরঘুমে থাকা মাংসপিণ্ডের ব্যর্থ খোলস অভিযোজিত হয়ে শিরদাঁড়ায় জুড়ে যায়। এরপরের ঘটনাগুলো খুব সাধারণ। পুলিশের বুটের ভারী আওয়াজ, খানিকটা তীব্র চিৎকার চ্যাঁচামেচি, ধপাধপ মার, শাপশাপান্ত। বুক দিয়ে আড়াল করে রাখে ভৈরব সেমতিকে। সাঙ্গপাঙ্গদের আক্রোশের তীর তার গায়েও লাগতে দেয়না। পুলিশের ভ্যানে তুলে নেওয়া হয় সব অপরাধীদের। থানার বড়োবাবু নিজে এগিয়ে আসে সেমতির দিকে।
-তুমি জানোনা কত বড় কাজ তুমি করলে। বহুদিন ধরে একেরপর এক রিপোর্ট থাকা সত্ত্বেও আমরা এ্যাকশান নিতে পারছিলাম না। সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্টে সরাসরি আঘাত করা কঠিন। তুমি সাহায্য না করলে, সকলের সামনে সব কুকীর্তির সাক্ষী না দিলে এত সহজে সব হত না। চেষ্টা করবো এর সম্মান যাতে তুমি পাও সেই ব্যবস্থা করতে।
সেমতি ঝরঝর কাঁদে, বাবু আমি অনাথ হইছি তুই একটু দাঁড়া না ক্যানে। একটো কাজ তুই সামনে দাঁড়ায় থ্যেকে করে দে। আমার সেই সম্মান হবে।
দৌড়ে যায় পুজোর ঘরে মাকালীর সামনে রাখা সিঁদুরের থালাটা এনে বাড়িয়ে দেয় ভৈরবের দিকে। বড়োবাবু ইশারা করে হিজলিকে নামানোর কিন্তু নারাজ সেমতি, হেই মোর মাটো লয় রে বাবু, ডাইকতে হবেক লাই। তুই থাকনা ক্যেনে। কাঁপা হাতে সিঁদুর পরায় ভৈরব। বড়োবাবুকে ওরা প্রণাম করলে উনি হাজার টাকা দিয়ে আশীর্বাদ করেন। চরবাটির শ্মশানে হঠাৎ জেগে ওঠা সব কোলাহল বন্ধ হয় যায়।
(৩)
-তারপর রাবণ ঐ বাচ্চাকে কী করলো?
-সে তো যে সে বাচ্চা লয়, ঋষি গৌতমের স্তিরি অহল্যার নামটো জড়ায় আছে যে তার সাথে, তাই রাবণ তাকে মন্দোদরীকে দিয়ে দিলো। মন্দোদরী তাকে বুকে করে মানুষটো করলো।
-তাই বল্যে তুই আমার নামটো মহীরাবণ রাখলি ক্যেনে? আমায় কী তুই কুড়ায় পাইছিস লাকি? সবাই যে বলে তুর মুখটো বসানো আমার মুখে।
ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে সেমতি। কী যে মিষ্টি ঘ্রাণ চোখ বুজে আসতে চায়।
-তুমার মুখ তো মোর মতোই হবেক। তুমি যে মোর বাপ। তবে আমি তুমার নামটো রাখিলাই বাপ। ঠাকুরের আশ্রমে এই নামটো তোমায় গুরুদেব দিচ্ছেন। তুমি মহীরাবণের মতো ভালো, বাধ্য সন্তানটো হবেক তাই! আর নামে কী যায় আসে বাপ? কামটো করো। বাবা ইসকুলে পড়াইছে, ভালোবাসছে আর কী চাই?
ভৈরব সন্ধ্যার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে শোনে ছেলে মায়ের গায়ে গা ঘষে বলছে, মোর মাকেও চাই, ঠাকুরের আশ্রমে শাসত্তর শোনা ভালো মা মোর। স্পষ্ট বোঝে ভৈরব, যে মরার গন্ধ উগ্র আতরে যায় না সেই সব শ্বাসরোধকারী গন্ধগুলো উবে গিয়ে তার প্লাস্টার বিহীন ইঁটের বাড়িটা থেকে ভীষণ মিষ্টি জীবনের গন্ধ ভেসে আসছে। ছেলেটাকে সে কিছুতেই মরা ঘাঁটতে দেবে না।
সুন্দর গল্প। মানভূমের ভাষায় সবকিছু ভীষণ বাস্তব হয়ে উঠেছে।
উত্তরমুছুনআপনার নামটি দেখা যাচ্ছে না, তবে পড়ার জন্য আমার কৃতজ্ঞতা রইল
উত্তরমুছুনবাহ্ বেশ ভালো লাগল। বিদ্যার আলোয় মনের অন্ধকার দূর হোক সেমতি, ভৈরবদের।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ নন্দিতা
উত্তরমুছুনএমন সুন্দর গল্প পড়তে পারলে ভালোলাগা অনেক গুণ বেড়ে যায়। শুভেচ্ছা অফুরান।
উত্তরমুছুনআন্তরিক ধন্যবাদ জানাই
মুছুনভালো লাগল আচার্য্য
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগল পড়লে💙
উত্তরমুছুনValo legeche amar.
উত্তরমুছুননাম না থাকায় বুঝতে পারলাম না কে লিখেছেন, তবে পড়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ
মুছুনতোকে অনেক ভালোবাসা জানাই।চুমু।
উত্তরমুছুননিবু দিদি।
তোমার একটি লেখা এই গল্পের জন্ম দিয়েছে দিদি। তোমার লেখাটি পড়ে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। আমার ভালোবাসা নিও কৃতজ্ঞতাও
মুছুনভালো হইছে বটে গল্পটো ❤
উত্তরমুছুন--- তারকদা 😊
আমোদ হইছে শুনে
মুছুন