সুজিত কুমার বিশ্বাস
মাটিয়ারি দরগা এক সংহতির কেন্দ্র
প্রতি বছর বানপুর মাটিয়ারিতে পীরের দরগাতলায় এক ঐতিহ্যশালী মেলা বসে। খবরটি আমার আগে থেকেই জানা ছিল। কিছু বইপত্রেও এ বিষয়ে কিছু পড়েছি। গল্পকথা শুনেছিও অনেকের কাছে বিভিন্ন সময়। কিন্তু কোনোদিন যাওয়া হয়ে ওঠেনি বিভিন্ন কারণে। এ বছর অম্বুবাচীর সময় গত ২৪ জুন ২০২২ তারিখে ঘুরে এলাম সেই পবিত্র স্থান ও সাক্ষী হয়ে থাকলাম অনেক ঘটনার। অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল। আগামী দিনে আবার যাবার ইচ্ছা রয়ে গেল অনেক গুণ।
মাটিয়ারি দরগা এক ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান। নদিয়া জেলার কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকের অন্তর্গত সীমান্তবর্তী এক ঐতিহ্যমন্ডিত প্রাচীন গ্রাম হল এই মাটিয়ারি। মাটিয়ারি গ্রামটির উত্তর ও পূর্ব দুই দিকেই বাংলাদেশ। কাঁটাতারের বেড়ার ওপিঠে কুষ্টিয়া জেলা। পশ্চিম দিক বরাবর সুবিস্তীর্ণ জলাশয়।নদিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা থেকে এই মাটিয়ারি গ্রামে তার রাজধানী স্থানান্তরিত করেছিলেন। ভবানন্দ নদিয়ার এই মাটিতে এসে প্রাসাদ নির্মাণ করেন। অনুমান করা হয় মাটির স্তুপের উপর প্রাসাদ নির্মাণ হওয়ার দরুন গ্রামটি কালক্রমে মাটিয়ারি নামে পরিচিতি লাভ করে।আজও সেদিনের অনেক স্মৃতি এই গ্রামে বিভিন্ন ভাবে ধরা দেয়। এখানে এখনও আছে পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসাবে রুদ্রেশ্বর শিব মন্দির। এই স্থানের বিভিন্ন স্থানে উঁকি দেয় সেদিনের ইতিহাস। সেই ঐতিহাসিক গ্রাম মাটিয়ারি ও অম্বুবাচীর মেলা আজও সমানভাবে প্রসিদ্ধ। নদিয়া জেলার সর্বাধিক প্রসিদ্ধ এই দরগা একেবারে জেলার শেষ প্রান্তে অবস্থিত।
রানাঘাট- গেদেগামী লোকাল ট্রেনে চেপে বানপুর স্টেশনে নেমে উত্তর দিকের পাকা রাস্তা ধরে তিন কিলোমিটার গেলেই দরগা। কৃষ্ণনগর থেকে গেদে বানপুর বাসে চেপেও যাওয়া যায়। বানপুর রেল স্টেশন বা বাসস্ট্যান্ড থেকে দরগা যেতে সব সময় ভ্যান রিক্সা পাওয়া যায়।ভবানন্দ মজুমদারের রাজত্বকালে আবদুল্লা নামে এক পীর ও দু'জন শিষ্যসহ এখানে আসেন। তাঁর মৃত্যুর পর কবরের উপর এই সমাধিক্ষেত্রটি তৈরি করা হয়।পীর মল্লিক গস অর্থাৎ ‘ফকিরের বাদশা’ পীরের সমাধি।অল্প বয়স থেকেই এই পীরের মধ্যে ঈশ্বর অনুরাগ প্রত্যক্ষ হয়।এই পীরের অনেক অলৌকিক ভূমিকা ছিল।এই মাটিয়ারি গ্রামে তিনি অনেক অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে ছিলেন সে সময়। যা রাজা সহ সাধারণ মানুষ সহজেই মুগ্ধ হয়েছিল। মতান্তরে তিনি ছিলেন প্রথমে নদিয়া রাজকর্মচারী। পরে তিনি সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে ঐরূপ লৌকিক নাম গ্রহণ করেন। ভবানন্দ মজুমদারের আনুকূল্যে তিনি এই গ্রামে থাকার অনুমতি পেয়েছিলেন। এবং জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি এই গ্রামে কাটিয়ে দিয়েছেন ভক্তবৃন্দের ভালোবাসায়। সেই থেকে এই স্থানের জনপ্রিয়তা ছিল অনেক স্থানের তুলনায় বেশি। ভারত বাংলাদেশের এক অন্যতম ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল মাটিয়ারি।
একসময় দরগাটি ধ্বংসপ্রায় পরিণত হয়েছিল। এই গ্রামের ঐতিহ্য সচেতন ব্যক্তিগণের মিলিত উদ্যোগে মাটিয়ারি দরগা সংরক্ষণ ও সংস্কার কমিটি জনসাধারণের আর্থিক সহযোগিতায় এই সংস্কারে এক ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছেন। প্রতিবছর অম্বুবাচী উপলক্ষে দরগার সন্নিকটেই ১৫ দিন ব্যাপী বিরাট মেলা বসে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, এমনকি বাংলাদেশ থেকেও হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অসংখ্য নরনারী মেলায় আসেন এবং তাদের মতো করে সামনের পুকুরে অবগাহন করে পুণ্যার্জন করেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন এক দৃশ্য চোখে না দেখলে উপলব্ধি করা যাবে না। ধর্মনিরপেক্ষতার এই প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে নদিয়া জেলার এই মাটিয়ারি গ্রামের এই ক্ষেত্রকে উল্লেখ করা যেতে পারে।
মেলায় ঢুকতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। সামনে পূজার জন্য নানা উপাচার। নীল রং করা মাটির ঘোড়া। সেই সাথে বাতসা, নকুলদানা, ধূপকাঠি সহ পূজার বিবিধ দ্রব্য।মাইকে বাজছে পীর ফকিরের গান। যারা দূর থেকে আসছেন তারা এই সমস্ত সম্ভার নিয়ে দরগায় চলেছেন। খালি পায়ে ভক্তিময় চিত্তে পীর সাহেবের সমাধির কাছে যেয়ে মোমবাতি ও ধূপকাঠি জ্বেলে দিচ্ছেন সবাই। একজন স্বেচ্ছ্বাসেবক সেখানে দায়িত্ব নিয়ে এই কাজটি সম্পন্ন ক্রছেন।পীরের দরগাটি ছাদ্র চাদর দিয়ে ঘেরা। নানা দাতা ফলকে এই স্থানের কিছু ইতিহাস লিখিত।এখানে একটি কমিটি আছে। তারা পুরো ব্যাপারটি দেখভাল করছেন। সমাধি ঘরের সামনে এই কদিন প্রচুর সাধুসন্ন্যাসী এসে জড়ো হয়। নারীপুরুষ সকলে সাহায্যের পাত্র বিছিয়ে রেখেছেন এবং ভক্তগণ তাদের সাধ্যমত সেখানে দান করে যাচ্ছেন। কেউবা শিঙে ফু দিচ্ছেন। কেউবা তন্ত্রমন্ত্র সাথে যজ্ঞ করছেন। এ বছর প্রচুর মানুষের ভিড় হয়েছিল। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক সাধুসন্ন্যাসী এসেছিলেন।এদিন এখানে দেখলাম পীর মল্লিক গস এর সমাধি।শ্বেত পাথরে সুন্দর ভাবে মোড়া। সামনেই আছে প্রদীপ ধুপকাঠি জ্বালাবার স্থান। এদিন রজনীগন্ধা সহ একাধিক ফুল দিয়ে সাজানো হয়। সমাধির গায়ে লেখা – পীর সাহেবের পবিত্র সমাধি।স্থানটিতে পা দিলে অন্য ভাবনার উদয় হয়।
এর পাশেই গড়ে উঠেছিল অস্থায়ী নোঙরখানা। এখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে খিচুরি ও পায়েস বিতরণ। হাজার হাজার মানুষ সকাল থেকে বিনা পয়সায় পেট ভরে খেয়ে চলেছেন এই মহাপ্রসাদ। গ্রামের সাধারণ মানুষ দায়িত্ব নিয়েছেন এই নোঙরখানার। সাধন বিশ্বাস নামে এক জনৈক ভক্ত এই আয়োজনের কথা জানালেন। বালতি হাতা নিয়ে আমার কথার উত্তর দিতে এগিয়ে এলেন এই নোঙরখানার অপর যুবক উদয় দত্ত। আমার কথার উত্তরে জানালেন কয়েকদিন ধরে চলবে এই নোঙরখানার আয়োজন।
কথায় কথায় দেখি দরগার সামনে ভিড় জমে গিয়েছে। অনেক যুবকের ভিড়। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে- এখন মুরগি নিলাম হবে। খুব উৎসাহ হল। দেখি কমিটির একজন উচু চেয়ারে উঠে এক হাতে মাইক্রোফোন আর অন্য হাতে এক গুচ্ছ মুরগি বা মোরগ। গুচ্ছে কখনো তিনটি বা চারটি করে মুরগি আছে। কমিটি প্রতি ক্ষেত্রে একটি দাম ধার্য করছে। কিন্তু নিলামে সেই মুরগি কয়েক গুণ বেশি অর্থে সংগ্রহ করে নিচ্ছে অনেকে। বিভিন্ন জন বিভিন্ন দাম বলছে। সব থেকে বেশি দাম যিনি দিচ্ছেন তিনিই সেই মুরগি বা মোরগ পাবার অধিকারী। জানা গেল অনেক ভক্ত পীর সাহেবের দরগায় ছাগল বা মুরগি দান করে যান। দিনের শেষে সেই মুরগির সংখ্যা নেহাত কম হয় না। তাই কমিটির এই সিদ্ধান্ত। আর বিষয়টিও অন্য ভক্তগণ বেশ উপভোগ করে থাকেন। প্রসঙ্গত বাংলাদেশের জনৈক মন্ত্রী ও বর্তমান সাংসদ মাননীয় আবদুল হাই মহাশয় এই স্থানে আসেন এবং এই দরগায় হাজত দেন।
বিভিন্ন স্থান থেকে ভক্তবৃন্দ সারাদিন এখানে এসে থাকেন। সামনের পুকুরের থেকে স্নান বা হাত পা ধুয়ে এই দরগায় তারা প্রার্থনা জানান। এই উপলক্ষে এখানে চলে এক প্রাচীন মেলা।রাস্তার দুপাশ দিয়ে বিবিধ দোকান সারি সারি তাদের পশরা নিয়ে থাকে মেলার কয়েকদিন। লোহার সরঞ্জাম, কাঠের সরঞ্জাম, মিষ্টির দোকান বেশি আসে এই মেলায়। তাছাড়া ফুচকা সহ বিবিধ খাবারের দোকানের দেখা পাওয়া যায় এই মেলায়।
রাজা রঘুরাম এই দরগার সামনে এই পুকুরটি খনন করেন এবং বেশ কিছু সম্পত্তি প্রত্যর্পণ করেন। এই সমাধির পাশে আরও দুটি সমাধি আছে। কথিত আছে এই দুই সমাধি আসলে পীর সাহেবের দুই শিষ্যের। যারা পীরের সঙ্গে সেই পারস্য থেকেই এসেছিলেন। সমাধির সন্নিকটে একটি পাথরের খুটি দেখা যায়। সাধারণ মানুষের কাছে যার নাম আশাবরী। এটা কেউ স্পর্শ করে না। এই ক্ষেত্রে হিন্দু- মুসলমানের সম্প্রীতির ইতিহাস শত শত বছর ধরে টিকে রয়েছে।হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এখানে মানত করে ধুপদীপ জ্বালিয়ে শিন্নি চড়ায়। অম্বুবাচী তিথিতে পীরের মৃত্যু দিবস উপলক্ষে এখানে এই মেলা বসে। ভারত বাংলাদেশের মানুষের সকলেই এই মেলায় ভিড় করত আগে। এই ক্ষেত্র থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত মিনিট চারেকের পায়ে হাঁটা পথ। এখানেই মিলে মিশে যায় মধু মাখা হরি নাম আর মোহাম্মদের দিল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। বাড়ি ফিরতে মন চায় না। তবুও চলে আসতে হয়। পিছন থেকে ডাক দিয়ে যায় – বাড়ির পাশে আরশিনগর।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন