পলাশ দাস



 মোম 


লেবুর মতো এই পৃথিবীটা ঘুরতে ঘুরতে দিন রাতের খেলায় মেতে ওঠে আর সেই খেলার হাত ধরে এখানে এখন অন্ধকার। সেই অন্ধকারের ধারাপাত বেয়ে এগিয়ে চলেছে মোহনা ফোনে কথা বলতে বলতে। “কতবার বলেছি তোমাকে, যখন তখন ফোন করবে না। তোমাকে তো বলেছিলাম, বলো? তাহলে কেন, তখন ফোন করেছিলে?”  রাত দশটায় গলির রাস্তা বেশ ফাঁকা। দু’পাশে বিন্যস্ত ঘর-বাড়ি শীতের মেঘের মতো সাড়াশব্দ হীন স্থির। কোনো কোনো বাড়ির জানলা থেকে উঁকি দিচ্ছে ধাপসা আলো। মোহনা এগিয়ে চলেছে কথা বলতে বলতে। 


বাস রাস্তা পার করে মোহনা নেমে এসেছে এই গলি পথে। এই পথে খুব কম মানুষজনের চলাচল। বিকেলে শেষ হতেই আরও শুনশান। সেই সময় গলিপথ দখল নেয় উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা। হাতে হাত রেখে তারা সেইসময় হেঁটে যায় জীবনের প্রথম বসন্তের দিনগুলো। নিশ্চিন্তে কিছু কথা চলাচালি করে আর সেই কথা এই ঘর বাড়িগুলো শোনার চেষ্টায় কান পাতে, আর ব্যর্থ হয়। মোহনার মতো যারা, তাদের কথা খুব সহজেই শুনতে পায় এই ঘরবাড়িগুলো। 

  

খুব শান্ত স্বর হলেও চাপা উদ্বিগ্নের ছায়া ভাসিয়ে অমর বলল, “খুব দরকার ছিল যে! টাকার খুব দরকার হয়ে পড়েছে, এ-মাসে তো টাকা পাঠালি না। বাজরে এখন আর ভালো বেচাকেনা হচ্ছে না। আমার মত এখন অনেকেই লোক। আমার মতো পুরোনোরা অনেকেই মার খাচ্ছে। তোর পাঠানো টাকাই যে ভরসা...” অমরকে থামিয়ে দিয়ে মোহনা বলতে শুরু করল, “সেইজন্যই তো এই অচেনা শহরে একা পড়ে আছি বাবা। গুলতির পড়ার খরচ, সংসারের খরচ, মা-র ওষুধ সব মনে আছে। শহরের এসে কিছু ভুলে যাইনি। বরং তোমাদের আরও বেশি করে মনে করি। কিন্তু টাকা যে গাছে ফলে না, রোজগার করতে হয়। এমাসে টাকা পেতে একটু দেরি হচ্ছে। তাই পাঠাতে পারি নি। আমার দিকটা একটু  বোঝ!” 


এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল মোহন। ফোন জুড়ে নীরবতা। এবার নীরবতা কাটিয়ে মোহনা বলল, “তুমি এখন ফোন রাখো। কালকে দেখি, পাঠিয়ে দেবো যে করে হোক।” ফোন রেখে দেবে এমন সময় অমর বলল, “সুধীরের দেখে দেওয়া বাড়িতেই থাকছিস?”

“হ্যাঁ।” খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর মোহনার। রাস্তার নিস্তব্ধ অন্ধকারের মতো ফোনের ভিতর শব্দের হুড়োহুড়ি থেমে গেল।    

 

সরু গলির প্রায় শেষের দিকে এসে পড়েছে মোহনা। পিছনে যতটা চোখ যায় একবার ফিরে দেখে নিলো। কালো অন্ধকার চেপে বসেছে পিচের কোল ঘেঁষে। মোহনাকে এবার বড় রাস্তায় উঠতে হবে। বড় রাস্তায় অনেক আলো, মানুষ, গাড়ি। নিস্তব্ধতা থেকে একটুকরো প্রাণের সমাবেশ। শহরের চেহারা নিতে চলা বারাসাত আসতে আসতে মেতে উঠছে যানজটে, উঁচু বাড়ির হাঁকডাকে, আর মানুষের বাহারি প্রাচুর্যে। যে মানুষরা একে অপরকে চেনে না তবুও কী অবলীলায় গা ঘষাঘষি করে রাস্তা ভাগ করে নিচ্ছে। মোহনা এদেরই একজন। এই রাস্তা দিয়ে এগিয়ে তিন রাস্তার মোড় থেকে ডানদিকে কয়েকটা বাড়ি পরেই অচেনা শহরে মোহনার একমাত্র মাথা গোঁজার জায়গা।   


শিমুলতলা থেকে সুধীরের হাত ধরে এই শহরে এসেছিল মোহনা। সুধীরই ওকে একটা ঘর দেখে দিয়েছিল, থাকার জন্য। এখনকার ঘরটি অবশ্য সুধীরের ঠিক করে দেওয়া নয়। সুধীর শিমুলতলাতেই থাকে। মোহনাদের বাড়ির থেকে কয়েকটা বাড়ি পরে। গ্রামে সবাই সবাইকেই চেনে জানে, শহরের মতো নয়। এখানে কেউ কাউকে তেমন করে চিনতে চায় না, সাবই যে যার মতো। তবে মাঝের কয়েকটা মাসে সুধীরের সাথে মোহনার যোগাযোগ ছিল না। সেইসময় এই ঘরে উঠে এসেছিল মোহনা। 


বাড়ির বাইরের দিক দিয়ে উপরে উঠে যাওয়ার সিঁড়ি। নিজের ইচ্ছা মতো সময়ে যাওয়া আসা করার সুবিধা আছে। কাজ থেকে ফিরতে রাত হলেও তেমন অসুবিধা হয় না। শহরে কেউ কারো দিকে তাকায় না বলেই হয়তো মোহনার আরও বেশি করে মনে হয়, কোনো অসুবিধা নেই। সবাই দৌড়চ্ছে সকাল থেকে রাত, আবার রাত থেকে সকাল। দৌড় দৌড়  আর দৌড়... মোহনা যে কথাগুলো এতদিন শুনেছিল গত এক বছর ধরে দেখছে, জানছে, চিনছে...  


খট করে একটা আওয়াজ করে ঘরের দরজা খোলার পর আলো জ্বলে দিল মোহনা, আরেকটা মৃদু শব্দে। ঘরের জানলা, দরজা সারাদিন বন্ধ থাকায় কেমন ভ্যাঁপসা গুমোট হাওয়ায় ভরে উঠেছে ঘর। চৈত্র সবে পড়েছে, প্রথম থেকেই বেশ গরম পড়তে শুরু করেছে। জানলাগুলো খুলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল মোহনা। এই ঘরের সাথে বাথরুম নেই, পাশে একটা ঘর সেখানে মোহনা রান্না করে। ছাদের এক কোণে আলাদা বাথরুম। কাঁধের ব্যাগটা রেখে মোহনা ফ্যান চালিয়ে দিল। গরম হাওয়া নেমে আসছে ছাদ থেকে।   


বাইরের সমস্ত একঘেয়েমি কাটাতে মোহনা স্নান করে নিয়েছে। রোজই কাজ থেকে বাড়ি ফিরে স্নান করে নেয়। অভ্যাস হয়ে গেছে ঘরে ফিরে স্নান করা। যখন শিমুলতলায় ছিল, তখন এমন ছিল না এখন যেন ফিরে স্নান না করলে কেমন অস্বস্তি হয় মোহনার। যেদিন তাড়াতাড়ি ফেরে, সেদিন কিছু করে নেয় খাওয়ার জন্য। নাহলে বেশির ভাগ দিন কাগজে মুড়ে কিনে আনা রুটি খেয়েই রাত কাটায়। হাতের মুঠোয় কিছু ইচ্ছেগুলো বেঁধে মোহনা শহরে এসেছিল, ভেবেছিল ইচ্ছেগুলো এক এক করে শহরের জল হাওয়ায় পূর্ণতা পাবে। কিন্তু এসে থেকে সেই ইচ্ছেগুলোকে হাত খুলে দেখার চেষ্টাি ক্রতে পারেনি। প্রথম কাজ পেয়ে ভেবেছিল এবার সব হবে। কাজ পেলে মনে হয় সব সামলে নেওয়া যাবে, টাকা আসবে, ইচ্ছেগুলো পূর্ণ হবে। কিন্তু কাজে ঢুকে পড়লে নিজের সাথে নিজের ইচ্ছেদের দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করে।  নিত্য একটা মারামারি চলে নিজের ভিতরে ভিতরে আর সেই পথ ধরেই হতাশাগুলো শ্রাবণের মেঘের মতো ঘন হতে শুরু করে। মোহনার সাথেও তাই আলাদা কিছু হয়নি।  


রাতে একা ঘরে মোহনাকে চেপে ধরে এই মেঘগুলো। সারাদিনের দৌড়ঝাঁপে যেসব কথা মনে পড়ে না। একা হলেই মনে পড়ে কী করতে এখানে এসেছিল আর এখন কোথায়। ঘরের মধ্যে ঢুকলেই সমস্ত পৃথিবী থেকে আলাদা। আর এই পৃথিবীতে রাস্তার হালকা আলো এসে পড়ে জানলা দিয়ে। মশারির গায়ে অন্ধকার ছিন্ন করে নকশা কেটে দেয় চোখের সামনে। রাস্তার আলো অন্ধকার ঘরে মোহনাকে তীব্র অস্বস্তিতে ফেলে। 


ঠিক বছর খানেক আগে এরকমই একটা সময়ে মোহনাকে সুধীরের সাথে শহরে পাঠিয়েছিল অমর। শিমুলতলায় খুব চল ছিল শহরে সুধীরের জাঁকজমকের কথা। সবাই জানত খুব ভালো একটা কোম্পানিতে সুধীর কাজ করে। গ্রামে অনেককেই সুধীর বলত, “কাজ করলে বলবি কাজ আছে, অনেক টাকা।” অনেককে সুধীর কাজও দিয়েছিল। তারা আর কেউ গ্রামে ফেরেনি। সবাই শহরে পাকা আস্তানা গেড়েছে বলে গ্রামে সুধীর সকলকে বলেছিল। সেই সুরে সুর মিলিয়ে অমরও মোহনাকে পাঠিয়েছিল। শহরে পা দিয়ে মোহনা দেখেছিল রঙিন আদবকায়দা, আর আকর্ষিত হয়েছিল। আকর্ষিত করেছিল সুধীরের রকমারি কাজ কারার অভ্যাসও। সন্ধ্যায় সুধীর জ্যোতিষী, দিনে মঙ্গল সমিতির একজন হর্তাকর্তা, যার কাজ ভিখিরিদের নানা জায়গায় বসিয়ে দিয়ে আসা। মোহনা ভিড়ে গেল সুধীরের সাথে। ধীড়ে ধীরে মোহনার চোখে পরিষ্কার হয়েছিল সুধীরের কাজ করার দক্ষতা। কিন্তু ততদিনে মোহনা সুধীরের ডান হাত হয়ে উঠেছে। বেড়িয়ে আসতে চেয়েছে, কিন্তু দেখেছে দরজা বন্ধ। কড়া নাড়লে সুধীর এসে একমাত্র সামনে দাঁড়ায় দরজা খোলার জন্য। 


একলা ঘরে রাতে মশারির ছাদ অনির্দেশ্য আহ্বান রচনা করে। রাস্তার দু-এক টুকরো আলো, জানলা থেকে আসা ঝিরঝিরে হাওয়া আর ঘরের ভিতর বাস করা বিরাট একাকীত্ব। মশারির ছাদে পড়ে থাকা আলোয় মোহনা একটা সিঁড়ি খুঁজে পায়। যে সিঁড়ি তাকে নিয়ে যায় এক ঝলমলে আলোর ঠিকানায়। তখনই মোহনার চোখে ভেসে ওঠে কয়েকটা মুখ। খুব চেনা সেইসব মুখ, কিন্তু মোহনা কোথায় গুলিয়ে ফেলছে। গুলিয়ে ফেলতে ফেলতেই আবছা মুখগুলো পরিষ্কার হয়ে ওঠে মোহনার চোখের সামনে। মোহনা দেখতে পায় মুখগুলো বাবা, মা ,গুলতি-র। যারা অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। আর সে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে দূরে বাবা, মা, গুলতি-র থেকে অনেক অনেক দূরে।  দেখতে দেখতে  ধড়ফড় করে উঠে বসে মোহনা, জানলা বন্ধ করে দেয়, আবারও চোখ বোজার চেষ্টা করে। 


চোখ বুজলে কখনও কখনও কোলাহলের পৃথিবী হাতছানি দিয়ে ডাকে। সেখানে মানুষের গায়ে মানুষ গা ঘষাঘষি করে চলেছে ভিড় বাসে, বাসের চাল থেকে অদ্ভুত গরম নেমে আসছে। বাসের জানলা দিয়ে দেখছে বেদানার ভিতরের লাল অংশের মতো যানবাহনে ঠাসা রাস্তা। রোদের নীচে দাঁড়িয়ে রোদে ভিজছে শহরের নাগরিকেরা। আর সেই ভেজা গন্ধ থেকে ভেসে আসছে আঁশটে গন্ধ। ভিড় ঠেলে দরজার কাছে আসতে চায় মোহনা, সারা শরীর দিয়ে নেমে আসছে তিরতিরে স্রোতে। আঁশটে গন্ধে স্নান করে যাচ্ছে মোহনার সারা শরীর।      

                                                        



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য